‘কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো’র ১৭৫ বছর : এক ভারতীয় কমিউনিষ্টের চোখে


  • July 1, 2023
  • (0 Comments)
  • 1570 Views

১৭৫ বছর পুর্তি উপলক্ষে ‘কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো’ নিয়ে আলোচনা করলেন শংকর

 

এই বছর সারা বিশ্বে ‘কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো’র ১৭৫ বছর পুর্তি উদযাপিত হচ্ছে। সর্বত্র কমিউনিষ্টরা নতুনভাবে ‘কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো’ পড়ছেন, আলাপ আলোচনা করছেন। আমাদের দেশে এই আলোচনা, চর্চার স্রোত অবশ্য খুবই ক্ষীণধারায় বইছে। যাও বা হচ্ছে তা-ও খুব একটা ধরাবাঁধা ছকের বাইরে যাচ্ছে না। প্রথাগত দু’একটা কথাবার্তার বেশি কাউকেই বলতে খুব শোনা যাচ্ছে না। ভাবতেও দেখা যাচ্ছে না। কমিউনিষ্ট পার্টি এবং গোষ্ঠীগুলির ভাবনাচিন্তার স্থবিরতা এবং অনুশীলনে এক প্রকার গড্ডালিকা প্রবাহ সকলেই নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন। অথচ ‘কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো’ একদিকে যেমন কিছু সাধারণ সত্যকে তুলে ধরেছিল যা আজও কমিউনিষ্ট রাজনীতির ভিত্তি তেমনি অন্যদিকে তাতে রয়েছে কিছু অসম্পূর্ণ এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভুল দৃষ্টিভঙ্গীও। মার্কস নিজেই এই ব্যাপারে সচেতন ছিলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছিলেন নাও বটে। ‘ম্যানিফেস্টো’ লেখার ১৭৫ বছর পর আজকে ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে আমরা তাকে কীভাবে বুঝব তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দলিলটিকে যে বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিতে দেখার দরকার, সাধারণভাবে সেই বিশ্লেষণী সাহস আজ অনুপস্থিত। এই পরিস্থিতিতে তবুও আমাদের চেষ্টা করতে হবে ‘কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো’কে নতুনভাবে পড়ার। বোঝার।

 

‘ম্যানিফেস্টো’-র সাধারণ সত্য

 

‘ম্যানিফেস্টো’-ই সর্বপ্রথম  কমিউনিষ্টদের একটি দৃপ্ত আত্মঘোষণা যা কতগুলি সাধারণ সত্যকে সোজাসাপটাভাবে তুলে ধরেছিল। ‘ম্যানিফেস্টো’ স্পষ্ট করে এটা ঘোষণা করেছিল যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে ধ্বংস করাই তার  প্রধান লক্ষ্য। এই ঘোষণা অতীতে কোনো শ্রেণির সচেতন রাজনৈতিক মুখপাত্ররা করেনি। ফলত, ‘ম্যানিফেস্টো’ জন্ম দিয়েছিল একটা নতুন যুগের, যেখানে মুখ্য লড়াইটি শোষণের এক রূপের বদলে অন্য রূপের জন্য ছিল না, এক শোষকের বদলে অন্য শোষককে ক্ষমতায় আনার জন্যে ছিল না। শ্রেণিবিভক্ত সমাজ এবং ফলত শ্রেণিশাসনের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেছিল এই দলিল। এবং সেই সঙ্গে কমিউনিষ্টদের কেন্দ্রীয় কর্তব্যকেও তা এককথায় প্রকাশ করে দিয়েছিল এই বলে, “এই অর্থে কমিউনিষ্টদের তত্ত্বকে এই এককথায় চুম্বক করা যায় : ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ।”

 

‘কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো’ই হল প্রথম দলিল যা পুঁজিবাদী অর্থনীতির সংকট এবং তার অনিবার্য ধ্বংসের কারণ হিসাবে তার অভ্যন্তরীণ গতিকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিল। এর আগে কমিউনিষ্টরা যে বক্তব্য রাখতেন বা যে দলিলগুলি রচনা করেছিলেন তাতে মূলত জায়গা পেয়েছিল এক ধরণের মানবতা বা ঔচিত্যবোধের প্রশ্ন। পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও সমাজ কতটা অমানবিক বা অনুচিত সেই প্রশ্নই সেখানে মূলত জায়গা পেয়েছিল। কিন্তু ‘ম্যানিফেস্টো’ই প্রথম পুঁজিবাদী অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ সংকট এবং ফলত তার পক্ষে দীর্ঘ সময়ে টিঁকে থাকার অক্ষমতার দিকটির প্রতি অঙ্গুলীনির্দেশ করে। সেখানে লেখা হয়েছিল নিম্নলিখিত কথাগুলি :

 

“গত বহু দশক ধরে শিল্প আর বাণিজ্যের ইতিহাস হল শুধু উৎপাদনের আধুনিক পরিবেশের বিরুদ্ধে, বুর্জোয়া শ্রেণির এবং সেটার আধিপত্যের অস্তিত্বের যা মূলশর্ত সেই মালিকানা-সম্পর্কের বিরুদ্ধে আধুনিক উৎপাদন-শক্তির বিদ্রোহের ইতিহাস। যে বাণিজ্য-সংকট পালা করে ফিরে ফিরে এসে প্রতিবার গোটা বুর্জোয়া সমাজের অস্তিত্বটাকেই আরও বেশি করে বিপন্ন করে ফেলে তার উল্লেখই যথেষ্ট। এইসব সংকটে বিদ্যমান উৎপন্নের অনেকখানিই শুধু নয়, আগেকার সৃষ্ট উৎপাদন-শক্তিরও অনেকটা পর্যায়ক্রমে ধ্বংস হয়। এইসব সংকটের ফলে এক মহামারীর প্রাদুর্ভাব হয়, সেটা অতীতের সকল যুগে অসম্ভব গণ্য হত – অতি উৎপাদনের মহামারী। হঠাৎ সমাজ যেন এক সাময়িক বর্বরতার পর্যায়ে ফিরে যায়; মনে হয় যেন বা এক দুর্ভিক্ষে, এক সর্বব্যাপী ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে বন্ধ হয়ে গেল সমস্ত জীবনোপায়ের যোগান, শিল্প আর বাণিজ্য যেন ধ্বংস হয়ে গেল; কিন্তু কী কারণে? কারণ সভ্যতা হয়েছে বড্ড বেশি, জীবনোপায়ের পরিমাণ অত্যাধিক, অনেক বেশি হয়েছে শিল্প, অনেক বেশি বাণিজ্য। সমাজের হাতে যত উৎপাদন-শক্তি আছে, তা বুর্জোয়া মালিকানার পরিবেশ বিকাশে আর সাহায্য করছে না; বরং হচ্ছে উল্টোটা: যে পরিবেশ দিয়ে সে-শক্তি শৃঙখলিত তার পক্ষে এই শক্তি বড্ড বেশি প্রবল; সেই শক্তি শৃঙখল অতিক্রম করা মাত্র তা সমগ্র বুর্জোয়া সমাজে এনে ফেলে বিশৃঙখলতা, বিপন্ন করে বুর্জোয়া মালিকানার অস্তিত্ব। বুর্জোয়া সমাজের পরিবেশ যে-সম্পদ সৃষ্টি করে তা ধারণ করার পক্ষে ঐ পরিবেশ সংকীর্ণ। বুর্জোয়া শ্রেণি এইসব সংকট কাটিয়ে ওঠে কোন উপায়ে? একদিকে, উৎপাদন-শক্তির বিপুল অংশ বাধ্য হয়ে নষ্ট করে ফেলে; অপরদিকে, নতুন বাজার দখল করে এবং পুরন বাজারের পূর্ণতর শোষণে। অর্থাৎ কিনা, আরও ব্যাপক, আরও ধ্বংসাত্মক সংকটের পথ প্রস্তুত করে, এবং সংকট রোধের উপায় কমিয়ে ফেলে।”

 

‘ম্যানিফেস্টো’ থেকে এই অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ একটি উদ্ধৃতি আমাদের দিতে হল এটা বলার জন্যে যে, আমাদের আজও আশ্চর্য হতে হয় যে, কী পরিমাণ স্পষ্টভাবে সে সময়তেই মার্কস-এঙ্গেলস পুঁজিবাদী সমাজের অভ্যন্তরীণ সংকটের গভীরতা এবং তার অনিবার্য ধ্বংসের বিজ্ঞানসম্মত সূত্রায়ন করে ফেলেছিলেন। এই দলিল লেখার পরবর্তী এই ১৭৫ বছর ধরে অর্থনীতিবিদরা এই অতি-উৎপাদনের সংকট নিয়ে আলোচনা করেছেন। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা হাজার চেষ্টা করেছেন এই তত্ত্বকে নাকচ করতে কিন্তু এই অকাট্য সত্যকে খারিজ করতে পারেন নি যে আজও পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রধান সমস্যাই হল অতি-উৎপাদনের সংকট। মার্কস পরবর্তীতে যখন ‘পুঁজি’ গ্রন্থটি রচনা করেন তখন এই ‘অতি-উৎপাদনের সংকট’-এর সূত্রায়নকে আরও বিস্তৃত করেন এবং গভীর করেন। সেখানে তিনি ‘পুঁজি-পণ্য-বর্ধিত পুঁজি’ (M-C-M`) থেকে কীভাবে ‘ঋণ পুঁজি -উৎপাদনশীল পুঁজি-পণ্য-বর্ধিত পুঁজি’ (M-M-C-M`) এই গতিতে পুঁজিবাদ বেড়ে উঠছে তা ব্যাখ্যা করেন। লেনিন আরও পরবর্তীকালে যখন সাম্রাজ্যবাদের অর্থনীতি আলোচনা করেছেন তখন ঋণ-পুঁজির পুরোদস্তুর লগ্নি-পুঁজির চেহারায় আত্মপ্রকাশ নিয়ে আলোচনা করেছেন, লগ্নিপুঁজির সঙ্গে উৎপাদনশীল-পুঁজির বিচ্ছেদ এবং পুঁজির রপ্তানির অর্থনীতির চেহারাকে উন্মোচিত করেছিলেন। কিন্তু এই গোটা গতিটির কেন্দ্রীয় সমস্যাই যে হল অতি-উৎপাদনের সংকট তা ‘ম্যানিফেস্টো’ ঘোষণা করে দিয়েছিল সেই ১৮৪৮ সালেই। আজ আমরা যে অতি-পুঁজির  সংকট চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, বিশেষ করে ২০০৮-এর বিশ্ব মহামন্দার অভিঘাতে তা যখন আরও স্পষ্ট এবং জাজ্বল্যমান তখন আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই অতি-পুঁজির সংকটের মর্মবস্তুও হল ঐ অতি-উৎপাদনের সমস্যা। অতি-উৎপাদনকে মোকাবিলা করতে গিয়ে বর্তমান পুঁজিবাদ পুঁজির অপেক্ষাকৃত কম অংশ পণ্যরূপে এবং অনেক বেশি অংশ লগ্নি পুঁজি, ঋণ পুঁজি এবং ফাটকা পুঁজিতে রূপান্তরিত করার ফলেই ২০০৮ সালের আমেরিকার সাব-প্রাইম সংকটের উৎপত্তি হয় যা অতি দ্রুত লগ্নিপুঁজির নেটওয়ার্ক বেয়ে দুনিয়াব্যাপী আর্থিক বিপর্যয়ের চেহারা নেয়। এই সংকটের মর্মবস্তু হল অতি-উৎপাদনের মৌলিক সংকট। ‘ম্যানিফেস্টো’ এমনই এক সাধারণ সত্যকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছিল যে যতদিন পুঁজিবাদ থাকবে ততদিনই তাই আমাদের বারে বারেই ‘ম্যানিফেস্টো’তে ফিরতে হবে।

 

উপরে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদে মার্কস-এঙ্গেলস কী অসামান্য অন্তর্দৃষ্টিতে পুঁজিবাদের সংকট নিরসনের বিষয়টি আলোচনা করেছিলেন তা দেখলে আজও আশ্চর্য হতে হয়। বুর্জোয়াদের সংকট নিরসনের তিনটি উপায় ‘ম্যানিফেস্টো’তে উল্লিখিত হয়েছে। এক, উৎপাদিকা শক্তিকে ধ্বংস করে; দুই, নতুন বাজারের সন্ধান করে; এবং তিন, পুরনো বাজারের পূর্ণতর শোষণ করে। এই তিনটি পথ আজও পুঁজিবাদের পালা করে আসা অর্থনৈতিক সংকট নিরসনের রাস্তা হিসাবে রয়ে গেছে। এবং, পুঁজিবাদের যে সাম্রাজ্যবাদের পরিণত হওয়া একেবারেই অনিবার্য ছিল তা এই রাস্তাগুলির মধ্যেই নিহিত আছে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, এক সর্বব্যাপী যুদ্ধই হল এই তিনটি রাস্তার একাধারে অনিবার্য ফলাফল এবং একইসঙ্গে তার কারণ। মার্কস-এঙ্গেলস এই বাক্যতে এই ইঙ্গিতও দিয়ে দেন যে, যদিনা বিপ্লব পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করতে পারে তবে বারেবারেই পুঁজিপতিরা এই রাস্তাগুলির মধ্যে দিয়ে সংকট থেকে আবারও পরিত্রাণের পর্যায়ে চলে যাবে, কিন্তু তা যাবে আরও বড় সংকটের রাস্তা তৈরি করে, এবং গোটা সমাজকে আরও সাংঘাতিক অমানিশায় ডুবিয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে এই পথেই আবির্ভূত হয়েছে ফ্যাসিবাদ। ১৯৩০-এর মহামন্দার ইতিহাস এবং ২০০৮ পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ভূত বর্তমানের নয়া ফ্যাসিবাদের অন্তর্গতিতত্ত্ব থেকে এই সূত্রায়নের সঠিকতা আবারও প্রমাণিত হয়েছে।

 

কিন্তু ‘ম্যানিফেস্টো’-র সাধারণ সত্য অত্যন্ত সঠিক ও আজও বৈধ থাকা সত্ত্বেও এই দলিলে এমন কিছু অতিশয়োক্তি ও ভুল দৃষ্টিভঙ্গী আছে যেগুলি সমস্যাকর। বর্তমানে এসে সেগুলির প্রতিও আমাদের সমানভাবে সচেতন থাকতে হবে।

 

‘ম্যানিফেস্টো’র বুর্জোয়া এবং আসল বুর্জোয়া

 

১৮৪৭ সালের শেষ দিকে যখন ‘ম্যানিফেস্টো’ রচিত হচ্ছে সেই সময়ে বুর্জোয়াদের সম্পর্কে কমিউনিষ্টদের কিছুটা উচ্চ ধারণা ছিল। সকলেই জানেন ‘ম্যানিফেস্টো’র সেই বিখ্যাত লাইনগুলো:

 

“বুর্জোয়া শ্রেণী যেখানেই প্রাধান্য পেয়েছে সেখানেই সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক, গোষ্ঠীতান্ত্রিক এবং রাখালিয়া সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে।”

 

আমরা সবাই জানি, ব্যাপারটা এমন মোটেও ছিল না। আসলে এমনটা ছিল খুব স্বল্প একটি সময়ের জন্যে, এবং খুব ছোট একটি ভৌগোলিক পরিসরে। যে দেশে বসে ‘ম্যানিফেস্টো’ লিখেছিলেন মার্কস এবং এঙ্গেলস সেই ইংলন্ড, যেখানকার বুর্জোয়াদের বিকাশকে মার্কস বুর্জোয়া বিকাশের আদর্শ জায়গা বলে মনে করতেন সেই ইংলন্ডের বুর্জোয়াশ্রেণির ভূমিকাও তেমনটা ছিল না। ভারতের ক্ষেত্রে তারা কী করেছিল তা আমরা জানি। ‘ম্যানিফেস্টো’ লেখার অর্ধশতকেরও অধিক আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নামে ইউরোপীয় ধাঁচের সামন্ততন্ত্র প্রবর্তনের কাজ শুরু করে। তৎপরবর্তী দেড় শতাধিক কালের ঔপনিবেশিক ইতিহাসে দেখা গেল সমগ্র এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকাতে পশ্চিমী বুর্জোয়ারা সামন্ততন্ত্রকে বজায় রাখতেই আগ্রহী। সুতরাং, ‘বুর্জোয়াশ্রেণি যেখানেই প্রধান্য পেয়েছে সেখানেই সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক, গোষ্ঠীতান্ত্রিক এবং রাখালিয়া সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে’ এই সিদ্ধান্ত বেঠিক। তা সেদিনও বেঠিক ছিল, পরেও বেঠিক প্রমাণিত হয়েছে।

 

আসলে ‘ম্যানিফেস্টো’ পড়ার সময়ে কয়েকটি বিষয় খেয়ালে রাখতে হবে। প্রথমত, ‘ম্যানিফেস্টো’ রচনার সময়ে মার্কস-এঙ্গেলসের দৃষ্টি পশ্চিম ইউরোপে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৮৮২ সালের দ্বিতীয় রুশ সংস্করণের ভূমিকায় তার ইঙ্গিত তাঁরা তা দিয়েওছিলেন। তাঁদের কথায় :

 

“তখনও পর্যন্ত (ডিসেম্বর, ১৮৪৭) প্রলেতারীয় আন্দোলন কত সীমাবদ্ধ স্থান জুড়ে ছিল সেটা খুবই পরিষ্কার করে দেয় ‘ইশতেহার’-এর শেষ অধ্যায়টা : বিভিন্ন দেশে ‘বিভিন্ন প্রতিপক্ষ পার্টি প্রসঙ্গে কমিউনিষ্টদের অবস্থান’। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখ নেই তাতে।”

 

এখান থেকে একটা জিনিস আন্দাজ করা যায়। ১৮৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কমিউনিষ্ট আন্দোলন বিশ্বের যে অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল সেটাই ছিল ‘ম্যানিফেস্টো’-র পৃথিবী, ‘ম্যানিফেস্টো’-র ভূগোল। সুতরাং, ‘ম্যানিফেস্টো’-র সমস্ত কথাকেই উক্ত ভৌগোলিক পরিসরের মধ্যে রেখেই বিবেচনা করতে হবে। এর মানে এমন নয় যে, ‘ম্যানিফেস্টো’ তে সার্বজনীন সত্য কিছুই নেই। অবশ্যই তা আছে। তবে তা খুবই গভীর বিবেচনার মধ্যে দিয়েই গ্রহণ করতে হবে। নির্বিচারে নয়।

 

দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে তা হল, ‘ম্যানিফেস্টোর ভূগোল’-এও দীর্ঘকালীন বিচারে বুর্জোয়াদের এই ভূমিকা থাকে নি। বিষয়টিকে পরবর্তীকালে এঙ্গেলস সঠিকভাবেই সূত্রায়িত করেছিলেন ‘জার্মানিতে কৃষকযুদ্ধ’-এর ১৮৭০ সালের ভূমিকায়।

 

“বুর্জোয়াদের একটা বিশেষত্ব যা অন্য শ্রেণিগুলির থেকে আলাদা তা হল, এর বিকাশের একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে পৌঁছনোর পর, এর প্রতিটি বিকাশ, অর্থাৎ এর পুঁজির প্রতিটি বৃদ্ধি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিজের হাতে রাখার ব্যাপারে তাকে শুধু অযোগ্যই করে তোলে। ‘বৃহৎ বুর্জোয়াদের ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রলেতারিয়েত।’ যে মাত্রায় বুর্জোয়ারা বাড়িয়ে তোলে তার শিল্প, ব্যাবসা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, এ বাড়িয়ে তোলে শ্রমিকশ্রেণিকেও। এই বিন্দুতে এসে, যেটি অবশ্যই সর্বত্র একই সময়ে এবং বিকাশের একই স্তরে আসে না, এরা খেয়াল করতে শুরু করে যে, এর দ্বিতীয় স্বত্তা একে ছাপিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখন থেকেই সে একক রাজনৈতিক আধিপত্য হারাতে থাকে। পরিস্থিতি বুঝে আধিপত্য ভাগ করে নেওয়ার মত অথবা পুরোটাই ছেড়ে দেওয়ার মত সঙ্গী সে খুঁজতে থাকে।”

 

বুর্জোয়াদের এই সঙ্গী কারা? এঙ্গেলস বলছেন,

 

“এই সঙ্গীরা সকলেই প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের। এটা হল রাজক্ষমতা, সঙ্গে তার সৈন্যবাহিনী এবং আমলাতন্ত্র, আর হল বৃহৎ সামন্ত অভিজাততন্ত্র, অথবা ক্ষুদ্র ভূস্বামী, এমনকি যাজকতন্ত্র। বুর্জোয়ারা এদের সবার সাথে এত রকম ঘনিষ্ঠতা এবং জোটবন্ধন গড়ে তোলে নিজেদের প্রাণপ্রিয় চামড়া বাঁচানোর জন্যে যে আজ আর বিনিময় করার মত সে কিছুই রাখে নি।”

 

এঙ্গেলসের বক্তব্য ছিল মোটামুটি ১৮৪৮ সাল থেকেই জার্মানীতে এই বিন্দুটা এসে গেছিল। এবং এঙ্গেলসের অন্যান্য কিছু মন্তব্য থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে, ইউরোপে ১৮৫০ থেকেই বুর্জোয়ারা সামন্ততন্ত্রের সাথে এই আপোষের পথে পা বাড়িয়েছিল। সুতরাং, ১৮৭০ সালের পর থেকে মার্কস-এঙ্গেলস মোটের ওপর এটা বুঝতে শুরু করেন যে, ‘ম্যানিফেস্টো’তে বুর্জোয়াশ্রেণির বিপ্লবী ভূমিকার প্রতি যে উচ্চ ধারণা পোষণ করা হয়েছিল তা মোটেই বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় নি। আরও সঠিকভাবে বললে বলা যেতে পারে যে, ‘ম্যানিফেস্টো’ পশ্চিম ইউওরোপের ইতিহাসের একটি ছোট এবং নির্দিষ্ট সময়ের দলিল। সেই কারণেই মার্কস এই দলিলকে “ঐতিহাসিক দলিল” বলেছিলেন।

 

১৯০৮ সালে ‘কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো’-র ষাট বছর পুর্তিতে কাউটস্কি একটি প্রবন্ধ লেখেন। তাতে তিনিও অনুরূপ কথাই বলেন :

 

“The revolution of 1848 then brought disappointment and revealed the modern class antagonism. Economic development has, as we have just seen, progressed more and more, and thereby forced the industrial bourgeoisie and its adjuncts increasingly out of the camp of democracy and into the camp of reaction….. Today there is nowhere any more talk of a revolutionary bourgeois, except perhaps in Russia.” [The Communist Manifesto/ Norton Critical Edition/ 1988/ USA]

 

সুতরাং, বুর্জোয়াদের বিপ্লবী ভূমিকাটি অতি সংক্ষিপ্ত এবং সেটি একমাত্র পশ্চিম ইউরোপের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। রাশিয়ায় কাউটস্কি যে প্রগতিশীল বুর্জোয়াদের কথা একটা সম্ভাবনার আকারে বলেছিলেন লেনিন এবং বলশেভিকরা সেই প্রশ্নে একমত ছিলেন না, একথা আমরা জানি। ‘ম্যানিফেস্টো’ পড়ার সময়ে এই কথাগুলো আমাদের স্মরণে রাখতে হবে।

 

সভ্য পৃথিবী এবং বর্বর পৃথিবী

 

‘ম্যানিফেস্টো’ পড়ার সময়ে আমাদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে আরও একটি বিষয়ে। ‘ম্যানিফেস্টো’তে মার্কস-এঙ্গেলস খুব পরিষ্কার করে পৃথিবীকে দুইভাগে ভাগ করেছিলেন। “সভ্য” এবং “বর্বর”! তাঁদের করা এই ভাগাভাগি যে যথেষ্ট সমস্যাজনক ছিল তাতে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। ‘ম্যানিফেস্টো’-র এই সমস্যাজনক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণ ছিল যে সময়কালকে ধরে উক্ত দলিলটি কমিউনিষ্ট ঘোষণাপত্র তৈরি করেছিল তা ছিল অতি সংক্ষিপ্ত। যেমন নিচের প্যারাগ্রাফটি কী বলছে দেখুন :

 

” সকল উৎপাদন-সাধিত্রের দ্রুত উন্নতি ঘটিয়ে, যোগাযোগের অতি সুবিধাজনক উপায় মারফত বুর্জোয়ারা সভ্যতার মাথে টেনে আনছে সমস্ত জাতিকে, এমনকি অতি অসভ্য জাতিকেও। যে কামান দেগে তারা সমস্ত চীনা-প্রাচীর চূর্ণ করে, অসভ্য জাতিদের অতি একরোখা বিজাতি-বিদ্বেষকে বাধ্য করে আত্মসমর্পণে, তা হল তাদের পণ্যের সশ্তা দর। সকল জাতিকে তারা বাধ্য করে বুর্জোয়া উৎপাদন-পদ্ধতি গ্রহণে, অন্যথায় সংশ্লিষ্ট জাতির বিলুপ্ত হয়ে যাবার ভয় থাকে; জাতিগুলিকে বাধ্য করে সেই বস্তু গ্রহণে যাকে তারা বলে সভ্যতা – অর্থাৎ বাধ্য করে তাদেরও বুর্জোয়া বনতে। এককথায়, বুর্জোয়া শ্রেণি নিজের ছাঁচে জগতটাকে গড়ে তোলে।”

 

এই অনুচ্ছেদটিতে পৃথিবী জুড়ে বুর্জোয়া আগ্রাসনের একটি বর্ণনা আছে, যা পক্ষপাতশূণ্যভাবে রচিত। কিন্তু পশ্চিমী বুর্জোয়ারা যে সভ্য জগতের বাসিন্দা এই প্রশ্নে মার্কস-এঙ্গেলসের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। আর যেখানে তারা হাত বাড়াচ্ছে সেই উপনিবেশগুলি যে ছিল অসভ্য বর্বরদের অঞ্চল তাও একেবারে ডেটে বলে দেওয়া হয়েছে। এর ঠিক পরের অনুচ্ছেদে এই মনোভঙ্গী আরও পরিষ্কারভাবে বিধৃত হয়েছে।

 

“গ্রামাঞ্চলকে বুর্জোয়া শ্রেণী শহরের কর্তৃত্বাধীন করেছে। সৃষ্টি করেছে বিরাট বিরাট শহর, গ্রামের তুলনায় শহরের জনসংখ্যা বাড়িয়েছে প্রচুর, এবং এইভাবে জনসমষ্টির একটা বিশাল অংশকে বাঁচিয়েছে গ্রামজীবনের মূঢ়তা থেকে। গ্রামাঞ্চলকে এরা যেমন শহরের মুখাপেক্ষী করে তুলেছে, ঠিক তেমনই করেছে বর্বর আর অর্ধবর্বর দেশগুলিকে সভ্য দেশের, কৃষকবহুল জাতিকে বুর্জোয়া-বহুল জাতির, প্রাচ্যকে পাশ্চাত্যের মুখাপেক্ষী।”

 

‘কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো’-তে মার্কস-এঙ্গেলস যখন উক্ত কথাগুলি লিখছেন তখন পশ্চিমী জ্ঞানচর্চার সীমাবদ্ধতাহেতু তাঁদের ধারণাই ছিল না যে, পুঁজিবাদের বহু আগেই মানবসভ্যতা শহরের জন্ম দিয়েছিল। এবং তা দিয়েছিল প্রাচীন সময়ের উন্নত সভ্যতার জায়গাগুলিতে যার অধিকাংশই রয়েছে আজকের এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায়। একজন ভারতীয় কমিউনিষ্ট হিসাবে আমি এখানে ভারতের কথাই বলব। এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ভারতে প্রথম নগরায়নের যুগ ছিল সিন্ধুসভ্যতার সময়ে। সমগ্র সিন্ধুসভ্যতাটি দাঁড়িয়েই ছিল শহর বা নগর কেন্দ্রীক ব্যবস্থার উপরে। বর্তমান আফগানিস্তান থেকে হরিয়ানা এবং গুজরাট পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই নগর কেন্দ্রীক সভ্যতার বিকাশ হয়। উত্তর-বৈদিক যুগে গাঙ্গেয় অঞ্চলে শুরু হয় দ্বিতীয় নগরায়নের যুগ। যা অপ্রতিহত গতিতে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এবং এক দীর্ঘ সময়জুড়ে অধিষ্ঠিত থাকে। যে ইউরোপকে মার্কস “সভ্য” এবং “আলোকজ্জ্বল” বলে বর্ণনা করেছেন তার অধিকাংশ অঞ্চলই বরং সেই সময়ে গ্রামজীবনের মূঢ়তায় আচ্ছন্ন ছিল। ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসও যদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে রাস্তা, সেচ ব্যবস্থা, যোগাযোগের মাধ্যমের অগ্রগতি, কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্র সুপ্রোথিত হওয়া, বাণিজ্যের বিস্তার সব মিলিয়ে এক গতিময় এবং বিকশিত অঞ্চলের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই তাতে পাওয়া যায়। ইউরোপীয়রা যে অর্থে তাঁদের নিজেদের ভৈগোলিক পরিসরে “মধ্যযুগ” কথাটি ব্যবহার করেন ভারতে তা ছিল না। ভারতের মধ্যযুগ বরং অনেক বেশি বিকশিত, অনেক বেশি জ্ঞানালোকিত ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইউরোপের মধ্যযুগের মত বর্বর তা ছিল না। ভারতীয় সভ্যতার তুলনায় বরং ইউরোপকেই বলা চলত বর্বর বা আধা-বর্বর।

 

‘কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো’-র ১৫০ বছর উপলক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে ডেভিড হার্ভে The Geography of Class Power শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি বলেন:

 

“The division of the world into ‘civilized’ and ‘barbarian’ nations is, to say the least, anachronistic if not downright objectionable even if it can be excused as typical of the times. Furthermore, the centre-periphery model of capital accumulation which accompanies it is at best a gross oversimplification and at worst misleading. It makes it appear as if capital originated in one place (England or Europe) and then diffused outwards to encompass the rest of the world.”

 

হার্ভে এখানে সঙ্গতভাবেই দুটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। প্রথমটি হল দুনিয়াকে “সভ্য” এবং “বর্বর” এই দুইভাগে ভাগ করার প্রশ্নটি এবং দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাদী বিকাশের প্রেক্ষিতে কেন্দ্র এবং পরিধির প্রশ্নটি। আসলে মনে রাখতে হবে যে, এভাবে দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করা সেই সময়ে পশ্চিমী ইউরোপের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা পরিচালিত ছিল। ভারতীয় কমিউনিষ্টদেরই উচিৎ ছিল এই ভুল দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করার প্রয়াস নেওয়া। কিন্তু, ভারতীয় কমিউনিষ্টদের মধ্যে গুরুবাদের সুগভীর প্রভাব তাঁদের মুখস্তবিদ্যার বেশি এগোতে দেয়নি। আজও, এই ১৭৫ বছরে যখন লোকে “কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো” নিয়ে আলোচনা করছে তখনও এই প্রশ্নগুলি কোথাওই উঠতে দেখা যাচ্ছে না। হার্ভে যে প্রশ্নগুলো তুলছেন তা ভারতীয়রা অনেক আগেই তুলতে পারত এবং আরও ভালোভাবে পারত। অন্তত, পারা উচিৎ ছিল। হার্ভে লিখেছেনঃ

 

“Leaving aside the whole problem of where, exactly, capitalism was born and whether it arose in one and only one place or was simultaneously emerging in geographically distinctive environments (an arena of scholarly dispute that shows no sign of coming to a consensus) the subsequent development in Europe in general and Britain in particular, cannot be encompassed by such a diffusionist way of thinking.”

হার্ভে এখানে খুবই সঠিকভাবে এটা চিহ্নিত করেছেন যে, সামন্ততন্ত্রের গর্ভ থেকে স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিবাদের বিকাশ হয়। সেটা শুধু পশ্চিম ইউরোপেই হয়েছে এমন তো নয়। পৃথিবীর সর্বত্রই হয়েছে। পুঁজিবাদ পৃথিবীর সর্বত্রই তার পূর্ব সমাজ থেকে অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেটা যে কারণে বাস্তবায়িত হতে পারে নি তা হল সেই পশ্চিম ইউরোপ, যেখানে জন্ম নিল ঔপনিবেশিকতাবাদ। হার্ভে এই আলোচনায় ঢোকেন নি। খুব সম্ভবত সেটা তাঁর প্রবন্ধের বিষয় ছিল না, এই কারণে। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে, পশ্চিম ইউরোপের মাটিতে তৈরি হওয়া নগ্ন ঔপনিবাশিকতাই এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বৃহৎ অঞ্চলগুলিকে দখল করে সেখানকার পুঁজির বিকাশকে প্রতিহত করে, আটকে দেয়। শুধু তাই নয়, এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুঠ করেই এই পশ্চিম ইউরোপীয়রা তাদের নিজেদের পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে, যন্ত্রসভ্যতা তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় পুঁজি সংগ্রহ করেছিল। আমি এখানে জওহরলাল নেহেরুর Discovery of India থেকে দুটি অংশ উদ্ধৃত করছি ব্রিটিশরা যখন ভারতে আসে তখন ভারত আর ইংলন্ডের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক কি ছিল এবং কীভাবে তা বদলাল তা দেখাবার জন্যে।

 

“Foreign adventurers originally came to India because of the excellence of her manufactures which had a big market in Europe. The chief business of the British East India Company in its early days was to trade with Indian goods in Europe, and very profitable trading it was, yielding enormous dividends. So efficient and highly organized were Indian methods of production, and such was the skill of India’s artisans and craftsmen, that they could compete successfully even with the higher techniques of production which were being established in England. When the big machine age began in England, Indian goods continued to pour in and had to be stopped by very high duties and, in some cases, by outright prohibition.” [ The Discovery of India, J. L. Nehru, p 334]

 

সুতরাং, ভারতের উন্নত ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পকে খুব সচেতনভাবে ধ্বংস করাই ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির উদ্দেশ্য এবং তারা তাই করেছিল। এর ফলেই ধীরে ধীরে ভারতের মত দেশগুলি সমাজ বিকাশের ধারায় পিছিতে পড়তে শুরু করে। এটি একটি সচেতন রাজনৈতিক নীতির ফল ছিল। নেহেরু দেখিয়েছেন,

 

“The chief business of the East India Company in its early period, the very object for which it was started, was to carry Indian manufactured goods, textiles, etc., as well as spices and the like from the East to Europe, where there was a great demand for these articles. With the developments in industrial techniques in England a new class of industrial capitalists rose there demanding a change in this policy. The British market was to be closed to Indian products and the Indian market opened to British manufacturers.” [Ibid, p 351]

 

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সরাসরি লুন্ঠন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে ভারত থেকে রাজস্ব আদায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল এবং ভয়ানক ব্রিটিশ শোষণ এবং লুন্ঠনের ফলে এক বিপুল পরিমাণ ভারতীয় সম্পদ ব্রিটিশের হস্তগত হয়। ফলে ভারতের মত অগ্রসর দেশগুলির সম্পদ তাদের নিজেদের পুঁজিবাদের বিকাশের কাজে লাগল না। কাজে লাগল ইউরোপের পুঁজিবাদের বিস্তারে। এবং এর পরেই পশ্চিমী বুদ্ধিজীবিরা ভারতের মত দেশগুলিকে চিহ্নিত করলেন “বর্বর” বা “আধা-বর্বর” বলে, আর পশ্চিম ইউরোপ চিহ্নিত হল “সভ্য জগত” বলে। “কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো”-ও মোটের ওপর এই চিন্তাধারাকেই অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। বহির্বিশ্ব সম্পর্কে ইউরোপীয় বুর্জোয়াশ্রেণির ধ্যানধারণার সঙ্গে তা বিচ্ছেদ ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছিল। সঙ্গত কারণেই তাই হার্ভে মন্তব্য করেছেন যে, ‘ম্যানিফেস্টো’ ছিল মূলত ইউরোপ-কেন্দ্রিক, আন্তর্জাতিক নয়।

 

ঐতিহাসিক দলিল

 

প্রকৃতপ্রস্তাবে ‘কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো’ রচনার অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ‘ম্যানিফেস্টো’ সেকেলে হয়ে পড়ে। দলিলটি ছাপাখানায় যাবার অব্যবহিত পরেই সারা ইউরোপ জুড়ে ১৮৪৮-এর বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। এই বিপ্লবের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে মার্কস ১৮৫০ সালে বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছিলেন। এই লেখাগুলিতেই মার্কস সর্বপ্রথম শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের ধারণায় উপনীত হন। ‘ম্যানিফেস্টো’-র কোথাও শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের কথা বলা নেই। অথচ, আন্তর্জাতিক শ্রমিক বিপ্লবের পরিণতির প্রথম ধাপই হল শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা, তা পরে মার্কস-এঙ্গেলস একাধিকবার অত্যন্ত জোরের সাথে হাজির করেছেন। অথচ ‘ম্যানিফেস্টো’তে এ ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। এর কারণ ছিল সেই সময়ে তাঁরা এই ধারণাতেই পৌঁছন নি। ১৮৪৮-এর বিপ্লবের অভিজ্ঞতা থেকেই এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এসেছিল। কিন্তু ‘ম্যানিফেস্টো’র একাধিক ভূমিকায় মার্কস বারবার বলেছিলেন যে, ‘ম্যানিফেস্টো’ হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি ঐতিহাসিক দলিল। সুতরাং, একে পরিবর্তন করার কোনো অধিকার তাঁদের আর নেই। মার্কস-এঙ্গেলসের পরিকল্পনা ছিল যে পরবর্তী সংস্করণের ভূমিকাগুলোতে তাঁরা এই পরিবর্তনগুলো করতে করতে যাবেন। এই কাজটি কিছু পরিমাণে তাঁরা করেও ছিলেন। কিন্তু সময়াভাবেই হোক, বা অন্য কোনো কারণে হোক, এই কাজটিও খুব সন্তোষজনকভাবে তাঁরা করতে পারেন নি। যেটুকু করেওছিলেন সেটাও ‘ম্যানিফেস্টো’র পাঠকের কাছে যথোচিত গুরুত্ব নিয়ে ধরাও পড়ে নি। যেমন রাশিয়া নিয়ে মার্কস যতই গভীর গবেষণায় লিপ্ত হয়েছিলেন ততই তিনি এটা বুঝতে পারেন যে, রাশিয়ায় সমাজবিকাশের ধারা পশ্চিমের মত নয়। রাশিয়ায় কৃষিজমির ওপর সাধারণ মালিকানা বা অবশ্চিনা থেকে পুঁজিবাদ পেরিয়ে সরাসরি সমাজতন্ত্রে পৌঁছনোর একটা সম্ভাবনা তখনও আছে। ১৮৮২ সালে দ্বিতীয় রুশ সংষ্করণের ভূমিকায় মার্কস-এঙ্গেলস এই অভিমতই রেখেছিলেন যে, যদি রাশিয়ার বিপ্লব পশ্চিমের শ্রমিক বিপ্লবের বার্তাবাহক হয়ে উঠতে পারে তাহলে পশ্চিমের সহায়তায় রাশিয়ায় এই ‘স্টেপ জাম্প’ অসম্ভব হবে না। অর্থাৎ, রাশিয়ার কৃষক বিপ্লব চরিত্রগতভাবে সমাজতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারে এই ইঙ্গিতও তাঁরা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মার্কসের এই মূল্যায়ন নিয়ে মার্কসবাদীদের কখনই খুব একটা আলোচনা করতে দেখা যায়নি। মার্কসবাদীরা অনেক বেশি করে ‘ম্যানিফেস্টো’-র মূল টেক্সট-এ মনোযোগ নিবদ্ধ রেখেছেন। ফলে ভূমিকায় যে পরিবর্তনগুলো মার্কস করেওছিলেন তা তাঁর পাঠককে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়নি।

 

পাশাপাশিভাবে এটাও দেখা যায় যে, মার্কস-এঙ্গেলসের জীবিতকালে এই দলিলটি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ দলিল ছিল না। বরং, তাঁরা পরবর্তীতে যে কাজগুলো করছিলেন সেগুলোই তাঁদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল পরিস্থিতির নিরিখে। মার্কস প্রায় পুরোপুরি ‘পুঁজি’ গ্রন্থটিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এঙ্গেলস দার্শনিক বিষয়গুলিকে পরিস্ফুট করার কাজ করছিলেন। ‘ম্যানিফেস্টো’ কিছুটা অবহেলিতই রয়ে যায়। কিন্তু মার্কস-এঙ্গেলস-পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে ‘ম্যানিফেস্টো’ একটি অন্যতম প্রধান কমিউনিষ্ট দলিল হিসাবে উঠে আসে। কিন্তু দলিলটির অসম্পূর্ণতা বা বেঠিক বিষয়গুলির প্রতি পরবর্তীকালের কমিউনিষ্ট আন্দোলনও যথোচিত নজর দেয়নি। ফলে তার অসম্পূর্ণতা ও ভুল দিকগুলোসহই ‘ম্যানিফেস্টো’ প্রায় এক ধর্মীয় গ্রন্থ হিসাবে উঠে আসে। এখানেই তৈরি হয় সমস্যা। আমাদের আজ, ‘ম্যানিফেস্টো’-র ১৭৫ বছরে এসে এই সমস্যার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ধূমধাম সহকারে মার্কস-পুজো বা ম্যানিফেস্টো-পুজো করার চেষ্টা হলে তাতে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু হবে না।

 

‘ম্যানিফেস্টো’ একটি ঐতিহাসিক দলিল। সব ঐতিহাসিক দলিলের মতই তা যুগের সীমাবদ্ধতা, স্থানের সীমাবদ্ধতা ও দৃষ্টিভঙ্গীর সীমাবদ্ধতাকে নিজের ভেতরে ধরে রেখেছে। এই দলিল এমন এক সময়ে লেখা হয়েছে যখন কমিউনিষ্ট আন্দোলন নিজেই অপরিণত। এবং যার বিরুদ্ধে সে লড়াই করছিল, সেই শত্রুপক্ষ বুর্জোয়াশ্রেণিও ছিল অপরিণত। ১৯৪৭ সালে বুর্জোয়ারা এমনকি ইউরোপেরও সর্বত্র ক্ষমতাতেই আসেনি। ১৮৪৮-৫০ সালের বিপ্লবই প্রথম বুর্জোয়াদের সার্ব-ইউরোপ ক্ষমতা দেয়। তাও দেখা যাবে রাশিয়া বা পূর্ব ইউরোপের ক্ষেত্রে তা খাটে না। আন্তর্জাতিকস্তরে শ্রমিকশ্রেণি অপরিণত, কমিউনিষ্ট আন্দোলন অপরিণত এবং শত্রুপক্ষ বুর্জোয়াশ্রেণিও অপরিণত। এমতাবস্থায় যে কমিউনিষ্ট দলিল লেখা হবে তাও যে দলিল হিসাবে অপরিণত হবে তাতে আশ্চর্যের কিছু ছিল না। বরং, আশ্চর্যের যদি কিছু থাকে তাহলে তা এটাই যে, সেই অপরিণত অবস্থাতেই তরুন মার্কস এবং এঙ্গেলস কী অদ্ভুত অন্তর্দৃষ্টিতে পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ সংকটকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক অনেক বিষয়েই অত্যন্ত এগিয়ে থাকা বক্তব্য আমরা লক্ষ্য করি ‘ম্যানিফেস্টো’তে। এমনকি আজও বহু কমিউনিষ্ট যা ভেবে উঠতে পারেন নি বা তাকে গ্রহণ করার মত স্তরে এসে উঠতে পারেন নি, সেই পরিবার ব্যবস্থার উচ্ছেদের কথা ‘ম্যানিফেস্টো’তে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এবং এই কাজটিও যে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি কমিউনিষ্টদের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং লক্ষ্য তা ‘কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো’ পরিষ্কারভাবে এবং সোচ্চারে ঘোষণা করতে পেরেছিল সেই যুগেই। আমরা জানি যে, এঙ্গেলসের ‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ গ্রন্থটিই হল মার্কসীয় নারীবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি। এই গ্রন্থটি রচিত হচ্ছে ১৮৮৪ সালে, অর্থাৎ মার্কসের মৃত্যুর পর। এখানেই এঙ্গেলস দেখান যে, পরিবার ব্যবস্থা একদিকে যেমন হল পুঁজিবাদের (এবং পূর্বতন অন্যান্য সমাজব্যবস্থার) অর্থনৈতিক একক এবং অন্যদিকে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য ও দমনের প্রাথমিক ক্ষেত্র। সুতরাং, পরিবার ব্যবস্থার উচ্ছেদের প্রশ্নটির সাথেই একাধারে পুঁজিবাদ উচ্ছেদ এবং নারীমুক্তি অর্জনের প্রশ্নটি যুক্ত। সুতরাং, পুঁজিবাদের উচ্ছেদ এবং পরিবারের উচ্ছেদ সরাসরি নারীমুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। আবার পুঁজিবাদের উচ্ছেদ শ্রেণিসংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্যও বটে। সুতরাং, নারীমুক্তির প্রশ্ন প্রকৃতপ্রস্তাবে শ্রেণিসংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ধারণা ‘পরিবার’ গ্রন্থে বিস্তারিত রূপে হাজির করা হলেও তার প্রাথমিক সূত্রায়ণ আমরা ‘ম্যানিফেস্টো’তেই পাই। তাই নারীমুক্তির সংগ্রাম যে শ্রেণিসংগ্রামেরই অংশ সেই তত্ত্বায়নের ভিত্তিপ্রস্তরও ‘ম্যানিফেস্টো’তেই স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল।

 

আজ, ১৭৫ বছর পর ‘ম্যানিফেস্টো’র প্রকৃত সম্পদ হল অত্যাশ্চার্য অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টিতে রচনা করা ‘ম্যানিফেস্টো’-র এই বিন্দুগুলি। আমরা বর্তমানের কমিউনিষ্টরা ‘ম্যানিফেস্টো’-র এই রত্নগুলিকে রক্ষা করি, উর্ধ্বে তুলে ধরি, এবং অন্যদিকে এই দলিলের সীমাবদ্ধতাকে বর্জন করি, তাকে উন্নত করার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করি। আমাদের বিশ্বাস ভারতীয় কমিউনিষ্টদের এ ব্যাপারে আরও অনেক বেশি সাহসী হতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে।

 

(লেখক ভারতীয় কমিউনিষ্ট আন্দোলনের নেতা।)   

Share this
Leave a Comment