বিদ্রোহের শেষ নেই


  • June 30, 2023
  • (0 Comments)
  • 1367 Views

আজ একই ভাবে, আরও ভয়ঙ্কর পাটোয়ারি বুদ্ধির জোরে বনের অধিকার কেড়ে নিতে, বন-পাহাড় বড় বড় ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আদিবাসী সহায়ক পরিবেশ, বন সংক্রান্ত আইনগুলি কীভাবে দুর্বল, নিষ্ক্রিয় করে তোলা যায় তার সমস্ত রকম প্রস্তুতি চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। সরকার, কর্পোরেটই আজ জমিদার, মহাজনের ভূমিকা নিয়েছে। আর দিকে দিকে বাংলা, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়ের আদিবাসী প্রধান অঞ্চল জুড়ে ধিকিধিকি জ্বলছে হুলের আগুন। লিখলেন দেবাশিস আইচ

 

স্বাধীনভাবে নিজেদের শর্তেই বাঁচতে চেয়েছিলেন সিধু-কানুরা। দামিন-ই -কোহ্ ঘিরে ফের স্বপ্নের দেশ গড়ে তুলেতে চেয়েছিলেন। কতটুকুই বা তার আয়তন! ১৭৯৩-র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বলে বলিয়ান জমিদার, মহাজনদের খাজনা আর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে সাঁওতালরা পাহাড়-জঙ্গলের দিকে সরে যেতে শুরু করে। এভাবেই তারা একদিন পৌঁছল দামিন-ই-কোহ্-তে। রাজমহল পাহাড়ের দক্ষিণে বিস্তীর্ণ গভীর জঙ্গল সাফ করে একটি একটি করে গ্রাম পত্তন শুরু হল। সাঁওতালরা প্রথম গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করেছিল দামিন-ই-কোহ্’র পূর্বদিকে সগড়ডাঙায় এবং তার পর পিপড়া ও আমগাছিয়ায়। ১৭৯০ সালেই তারা রাজমহল পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে গিয়েছিল। পাহাড়ে থাকত দুর্ধষ প্রকৃতির পাহাড়িয়া জনজাতি। তারা চাষবাসের ধার ধারত না। শিকার, জঙ্গলের ফলমূল সংগ্রহ করেই তাদের চলত। ভবিষ্যতের রাজস্ব আদায়ের তাগিদে সাঁওতালদের এই আগমনকে এক রকম মদতই দিয়েছিল ইংরেজরা। এমনকি, হিন্দু জমিদার, মহাজনরা পাহাড়ি এলাকাগুলো দখল করতে থাকায় দামিন-ই-কোহ’র সীমানা নির্ধারণ করে তার চারপাশে ‘পিপলা’ (বেড়া) দেওয়ার ব্যবস্থা হল। ভাগলপুর, বীরভূম, মুর্শিদাবাদের ১৩৬৬.০১ বর্গমাইল এলাকা নির্ধারিত হল। এর মধ্যে ৫০০ বর্গমাইল এলাকা ছাড়া পুরোটাই ছিল পাহাড়ি এলাকা। সেই ৫০০ মাইলের মধ্যে আবার ২৪৬ বর্গমাইল এলাকা ছিল শুধুই জঙ্গল এবং ২৫৪ বর্গমাইল আবাদ ও বসবাসযোগ্য এলাকা। ১৮৩২-৩৩ সালে সীমানা নির্ধারিত হওয়ার পর পরই বড়লাট লর্ড বেন্টিঙ্ক রাজমহলের পশ্চিমদিকের জঙ্গল পরিষ্কার করে বসবাস করার জন্য সাঁওতালদের আহ্বান করলেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে দলে দলে সাঁওতাল কটক, ধলভূম, বরাভূম, মানভূম, ছোটনাগপুর, পালামৌ, হাজারিবাগ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম থেকে সেখানে এসে উপস্থিত হতে থাকল।

 

জঙ্গল সাফ করে গ্রাম পত্তন হল। শুরু হল চাষবাস। বড়লাট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যত জমি পার চাষ করো, তিন বছর কোনও খাজনা লাগবে না। তার পরে নামমাত্র খাজনা দিলেই চলবে। ক্রমে বোঝা গেল সে সব প্রতিশ্রুতি আসলে ছিল ভাঁওতা। এই অঞ্চল থেকে ইংরেজ সরকার ১৮৩৭-৩৮ সালে বার্ষিক খাজনা আদায় হয়েছিল ৬,৬৮২ টাকা। আর ১৮৫৪-৫৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়াল ৫৮,০৩৩ টাকা। এতো ছিল সরকারি খাজনা। কিন্তু, সরকারের নায়েব-সুজায়োল, দারোগারা খাজনা আদায় করতে গিয়ে অনেক বেশি অর্থ নানা ফন্দিফিকির করে, অত্যাচার চালিয়ে আদায় করে নিত। সাঁওতালরা দামিন-ই-কোহ্তে জমিয়ে বসতে না বসতেই হাজির হয়ে গিয়েছিল বাঙালি ব্যবসায়ী, মহাজন, মুদি, ব্যাপারি, সুদখোররা। মহাজনী ও অন্যান্য ব্যবসার নতুন সুযোগ আসায় পশ্চিমী ভোজপুরী, ভাটিয়া ব্যবসায়ীরা এসে জাঁকিয়ে বসল। বর্ধিষ্ণু বারহাইত গ্রামে ভাগ্য পরিবর্তনে আসা বহু অধিবাসীদের মধ্যে ৫০ জন বাঙালি ব্যবসায়ী পরিবার বাস করত। এখানেই ছিল বাজার। হাট বসত সপ্তাহে দু’বার।

 

বারহাইত বাজার থেকে ব্যবসায়ী, মহাজনরা বিপুল পরিমাণ শস্য ধান, সর্ষে জঙ্গিপুর নিয়ে গিয়ে প্রথমে মুর্শিদাবাদ ও কলকাতা এবং পরে সর্ষের বেশি পরিমাণটাই ইংল্যান্ডে রফতানি করত। বিনিময়ে সাঁওতাল চাষিরা কী পেত? অতি সামান্য অর্থ, নুন, তামাক, কাপড়। অর্থ কম পাওয়ার একটা মস্ত কারণ সাঁওতালদের অজ্ঞতা ও অশিক্ষার কারণে ওজনে ভয়ানক কারচুপি করা হত। কেনবার সময় এই ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করত বড় বাটখাড়া বা পাথর যাকে বলা হত কেনারাম বা বড় বউ আর বেচার সময় ব্যবহার হত ছোট পাথর বেচারাম বা ছোট বউ। একে তো নিজেদের মর্জি অনুযায়ী ফসলের দাম ধার্য করা হত আবার নুন, তামাক, কাপড়, বাসনকোসন বিশেষ করে পিতল-কাঁসা বাসন বিক্রি করত বেশি দামে, কম ওজনের। দুমকার কিছু বাঙালি ব্যবসায়ী একই ভাবে সর্ষে, ধান নিয়ে এসে সিউড়িতে চালান করত।

 

হাজার পরিশ্রম করে সাঁওতালরা যতই ফসল ফলাক না কেন, যতই দুধ-ঘি উৎপাদন করুক না কেন তাঁদের দারিদ্র তো ঘুচলই না, উলটে মহাজনী ঋণ নিতে বাধ্য হওয়ায় জমি, গরু-ছাগল মায় ঘটিবাটি পর্যন্ত মহাজনের পেয়দারা কেড়ে নিতে শুরু করল। এর সঙ্গে ছিল শারীরিক অত্যাচার, ফসল ধ্বংস, মিথ্যা মামলায় জমিবাড়ি কেড়ে নেওয়া।

 

অবশেষে একদিন সব অন্যায়, অত্যাচারের জবাব দিতে ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন রাতে ভগনাডিহির গ্রামে ৪০০ গ্রামের ১০,০০০ সাঁওতাল কৃষক সিধু-কানুর নেতৃত্বে মিলিত হলেন। সভা থেকে ঘোষিত হল, আর কেউ জমির জন্য খাজনা দেবে না; কোনও ঋণও তারা শোধ করবে না। তারা সমস্ত জমিদার, মহাজনকে তাড়িয়ে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে। এই মর্মে ভাগলপুরের কমিশনার, ভাগলপুর ও বীরভূমের কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট, বিভিন্ন থানার দারোগা, কিছু জমিদারের কাছে চরমপ্ত্র পাঠানো হল। একই সঙ্গে তারা স্থির করল, যেহেতু কুমার, কামার, তেলি, চামার, মুসলমান তাঁতিরা সাঁওতাল সমাজের প্রতি সহানুভূতিশীল তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।

 

সভাতেই স্থির হয়েছিল, তাদের উপর যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচারের বিহিত করতে কলকাতা অভিযান করা হবে। শুরু হল অভিযান, প্রবল গণরোষের সামনে ইংরেজ সৈন্য, দারোগা, জমিদার বাহিনীকে খুঁজে পাওয়া গেল না। প্রথম ধাক্কাতেই বিদ্রোহী বাহিনীর হত্যা করল পাঁচখেতিয়ার কুখ্যাত জমিদার ও মহাজন মানিক চৌধুরি, গোরাচাঁদ সেন, সার্থক রক্ষিত, হিরু দত্ত, নিমাই দত্তকে। সিধু-কানুকে গ্রেফতার করতে এসে মারা পড়ল প্রবল অত্যাচারী দিঘি থানার দারোগা মহেশলাল দত্ত-সহ ৯ পুলিশ কর্মী। গোদ্দা মহকুমার কুরহুড়িয়া থানার দারোগা প্রতাপনারায়ণকে ‘ঠাকুরের নামে বলি’ দেওয়া হয়। বারহাইতের প্রকাণ্ড বাজার লুঠ করে একদিকে যেমন বিদ্রোহীরা বহু রসদ সংগ্রহ করে, অন্যদিকে বহু অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে বাজারের বেশ কিছু মহাজনকেও হত্যা করে। বিহারের ভাগলপুর জেলার গোদ্দা মহকুমা, পাকুড়, দুমকা, মুর্শিদাবাদ সীমানার মহেশপুর, বীরভূম জেলার প্রায় অর্ধেক বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়। অনেক গ্রাম, ধনী ব্যবসায়ী, মহাজনদের ঘরবাড়ি ছাড়খাড় করে দেয় বিদ্রোহী কৃষকরা। একটা সময়ে বীরভূম থেকে ভাগলপুর—পূর্ব ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইংরেজ, জমিদার, নীলকরদের শাসনের একরকম অবলুপ্তি ঘটে।

 

১৮৫৫ সালের ১০ নভেম্বর ইংরেজ সরকার মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, ভাগলপুরে সামরিক আইন  ঘোষণা করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। হাজার হাজার সেনা, জমিদারদের পাইক-বরকন্দাজ, কামান-বন্দুক, হাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। চারপাশ দিয়ে ঘিরে জ্বালিয়ে দেওয়া হল গ্রামের পর গ্রাম, সংগঠিত গণহত্যায় শ্মশানে পরিণত হল। সাঁওতাল বাহিনী তখনও আত্মসমর্পণ করেনি। ছোট ছোট দলে ছড়িয়ে গিয়ে গেরিলা কায়দায় লড়তে লাগল তারা। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ধরা পড়ে গেলেন সিধু। তাঁকে গ্রেফতার করার সঙ্গে সঙ্গেই গুলি করে মারা হয়। ভাগলপুরের কাছে ভয়ঙ্কর লড়াইয়ে প্রাণ হারান চাঁদ ও ভৈরব। ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বীরভূম জেলার ওপারঁবাধের কাছে গুলি করে হত্যা করা হয় কানুকে। ইংরেজ সেনাপতিরাই বলে গিয়েছেন, তারা যা করছেন তা যুদ্ধ নয়, গণহত্যা। আত্মসমর্পণ কাকে বলে সাঁওতালরা জানত না। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের যুদ্ধের মাদল বাজত, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা যুদ্ধ করত এবং গুলির আঘাতে প্রাণ দিত। তাদের তিরের আঘাতে বহু সৈন্য মারা যেত, তাই তারা যতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তির ছুড়ত ততক্ষণ পর্যন্ত গুলি চালাতে হত।

 

হাজারে হাজারে, কোনও কোনও হিসাব মতো ১০ থেকে ১৫ হাজার সাঁওতালকে হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করেছিল ইংরেজ ঔপনিবেশবাদ। মদত যুগিয়েছিল ইংরেজই সৃষ্টি করা জমিদার ও মহাজনরা। এই জমিদার, মহাজন, ঔপনিবেশিক শোষণ, অত্যাচারের হাত থেকে স্বাধীন ভাবে বাঁচতেই এক মহাবিদ্রোহ ঘটিয়েছিল সাঁওতালরা। সাত মাসব্যাপী এই বিদ্রোহের পর আজ প্রায় ১৬৮ বছর, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে দেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে আজও দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের উপর সেই একই শোষণ, একই অত্যাচার অব্যাহত। সারা পূর্ব ও মধ্যভারত জুড়েই আদিবাসী মানুষ তাঁদের জল, জঙ্গল, জমি থেকে বিতাড়িত হয়েই চলেছে। আমাদের রাজ্যে উন্নয়নের দোহাই পেড়ে বীরভূমের পাঁচামি, পুরুলিয়ার অযোধ্যায় পাহাড়, জঙ্গল, নদী-সহ আদিবাসী উচ্ছেদের পরিকল্পনা প্রস্তুত। আজ একই ভাবে, আরও ভয়ঙ্কর পাটোয়ারি বুদ্ধির জোরে বনের অধিকার কেড়ে নিতে, বন-পাহাড় বড় বড় ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আদিবাসী সহায়ক পরিবেশ, বন সংক্রান্ত আইনগুলি কীভাবে দুর্বল, নিষ্ক্রিয় করে তোলা যায় তার সমস্ত রকম প্রস্তুতি চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। সরকার, কর্পোরেটই আজ জমিদার, মহাজনের ভূমিকা নিয়েছে। আর দিকে দিকে বাংলা, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় জুড়ে ধিকিধিকি জ্বলছে হুলের আগুন। বিদ্রোহের শেষ নেই।

 

Share this
Leave a Comment