গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন : সুদর্শনা চক্রবর্তী
“আমরা তো সেই তাঁদের বাড়িতেই যাচ্ছি। তাঁদের বাড়িঘরই পরিষ্কার করছি, তাহলে আমাদের ওদের লিফট ব্যবহার করতে দেবে না কেন?”
“কোনও কোনও বাড়িতে দেয়, আর বেশির ভাগ বাড়িতেই বাড়ির বাথরুম আমাদের ব্যবহার করতে দেয় না এখনও। কোথাও ড্রাইভার, কাজের লোকদের আলাদা বাথরুম থাকে। কেন তা হবে? আমাদের কেন দেবে না বাথরুম ব্যবহার করতে?”
“অনেক সময়েই যা বলে তার থেকে অনেক বেশি কাজ করিয়ে নেয়, অথচ টাকা দেওয়ার সময় বেশি টাকা দেয় না তো! মাইনে বাড়ানোর সময় আসলেই তার কিছুদিন আগে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়। পুরনো মাইনেতে নতুন মেয়ে কাজে রাখে।”
“ওনারা মনে করেন আমরা তো অশিক্ষিত তাই আমরা বাড়ির জিনিস চুরি করতে পারি। আমাদের নামেই বদনাম দেন। শিক্ষিতরা তো চুরি করতে পারেন না।”
১৬ জুন আন্তর্জাতিক গৃহশ্রমিক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনাসভায় যোগ দিয়েছিলেন কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় কাজ করা মহিলা গৃহশ্রমিকেরা, নিয়োগকারীরা, শ্রমজীবী মহিলা সংগঠন, গৃহশ্রমিক অধিকার আন্দোলনকর্মী, নারী অধিকার কর্মীরা। এই আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল সব পক্ষের উপস্থিতিতে একটি দাবি সনদ তৈরি করা, যাতে গৃহশ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবিদাওয়গুলি স্বীকৃতি পায়, নিয়োগকারীদের তাঁদের কা্ছ থেকে পেশাদারী যে পরিষেবা পাওয়ার প্রত্যাশা থাকে তা উঠে আসে এবং গৃহশ্রমিকদের বিবিধ অধিকারের বিষয়গুলিও দাবি সনদে চিহ্নিত হয়। এই দাবি সনদ তৈরি করার উদ্দেশ্য ছিল গৃহশ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিরা এইটি নিয়ে পরবর্তী সময়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে বসতে চায় যাতে ন্যূনতম মজুরি সহ গৃহশ্রমিকদের দাবি ও অধিকগুলি বিষয়ে নির্দিষ্ট নীতি প্রণয়নের জন্য আলোচনা ফলপ্রসূভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
তবে এদিনের আলোচনায় বেশ কিছু গৃহশ্রমিক ও অধিকার আন্দোলনকর্মীরা থাকলেও, নিয়োগকারীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো কম। ছিলেন না সরকারি কোনও প্রতিনিধি। আলোচনার আয়োজক সংস্থা ‘পরিচিতি’, যারা ২০০০ সাল থেকে গৃহশ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে, তার পক্ষ থেকে কাকুলি দেব কারণ হিসাবে বলেন, “প্রথমত নিয়োগকারীদের যোগাযোগ নম্বর পাওয়া বেশ কঠিন। অনেকেই আগ্রহী হন না। তারপর আমরা এরকম দেখেছি হয়তো আমাদের সংগঠনের কোনও গৃহশ্রমিক সেই নির্দিষ্ট বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়েছেন, ফলে সেই নিয়োগকারী আর এধরনের আলোচনায় আসতে আগ্রহী হন না। আজ যাঁরা কনফার্ম করেছিলেন তাঁরা বেশ কয়েক জন কাজ পড়ে যাওয়ায় আসতে পারেননি। আমরা বিশ্বাস করতে চাইব যে কারণগুলি সত্যি। তবে এ কথা অবশ্যই ঠিক যে বেশ কয়েক বছরের আন্দোলনের পরেও এখনও গৃহশ্রমিকদের বিষয়টি নিয়োগকারী, সামগ্রিকভাবে সমাজে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করাই হয় না। উপস্থিতি কম হওয়ার সেটাও কারণ।” শ্রম দপ্তরের কোনও প্রতিনিধি আসতে পারেননি, রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের দিন ঘোষণা হওয়ার কারণে – এমনটাই আয়োজকদের জানানো হয়।
নারী অধিকার কর্মী অঞ্চিতা ঘটক যেমন মনে করেন, “আগের তুলনায় মূল ধারার নারী অধিকার আন্দোলনে গৃহশ্রমিকদের ইস্যুর ভিসিবিলিটি অনেকটা বেড়েছে। তবে আরও এত রকম বিষয় নিয়ে নারী অধিকার আন্দোলনে সব সময়েই লড়তে হয় যে এই ইস্যুগুলি হয়তো কিছুটা পেছনে পড়ে যায়। সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলিকে গৃহশ্রমিকদের বিষয়ে সচেতন করার জন্য আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে। আরও একজোট হয়ে, সুনির্দিষ্ট ইস্যু নিয়ে লড়তে হবে।”
উপস্থিত গৃহশ্রমিকদের নিজেদের ও অধিকার আন্দোলনের দাবির মধ্যে উঠে আসে –
- সপ্তাহে এক দিন, মাসে চার দিন ছুটি
- ন্যূনতম মজুরি ঘন্টায় ৪৫ টাকা
- সংগঠিত ক্ষেত্রের মতো বেতন বৃদ্ধি করতে হবে ঘন্টায় শতকরা হিসাবে
- নিয়োগের সময়ে চুক্তিপত্র থাকবে, যাতে বেতনের হার ঠিক থাকে ও বিনা নোটিসে কাজ থেকে ছাড়ানো না যায়
- অতিরিক্ত কাজে অতিরিক্ত টাকা
- বাথরুম ব্যবহারের অধিকার
- চাকরি ছাড়ার আগে লিখিত নোটিস
- কাজের জায়গায় কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে নিয়োগকারী প্রাথমিক চিকিৎসা খরচ বহন করবেন
- বিনা প্রমাণে চুরির বদনাম দেওয়া যাবে না
- বোনাসের নির্দিষ্ট নিয়ম থাকতে হবে
- মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটি
নিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে এর মধ্যে অধিকাংশ দাবি আলোচনা সাপেক্ষে মেনে নেওয়ার কথা বলা হয়। তবে তাঁদের যে প্রত্যাশাগুলি উঠে আসে, তা হল –
- কাজের গুণগত মান ভালো হওয়া
- নির্দিষ্ট সময়ে কাজে আসে
- বিনা নোটিসে ছুটি না করে, নিয়োগকারীর সঙ্গে আলোচনা করে, দু’ তরফের সুবিধা-অসুবিধা বুঝে ছুটি নেওয়া
একটি বিষয় স্পষ্ট, আর্থ-সামাজিক জায়গা থেকে অতিরিক্ত উপার্জনের জন্য গৃহ শ্রমিকেরা বেশি বাড়িতে কাজ করতে বাধ্য হন, ফলে অতিরিক্ত পরিশ্রমে কাজের মান খারাপ হতে থাকে। ন্যূনতম মজুরি স্থির হলে এই সমস্যা অনেকটাই মিটবে ও তাঁরা ভালো পরিষেবা দিতে পারবেন।
গৃহশ্রমিক আন্দোলন কোভিড পরবর্তী সময়ে কিছুটা হলেও স্তিমিত হয়ে পড়েছে। কাজ বাঁচিয়ে রাখাটাই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এমত পরিস্থিতিতে এই আন্দোলনকে আবারও নতুন করে জোট বাঁধতে হবে ও সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষদের উপর দাবিদাওয়া ভিত্তিক পলিসি তৈরির জন্য চাপ তৈরি করতে হবে।
গৃহশ্রমিক আন্দোলনের বিষয়টি লিঙ্গ রাজনীতির সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই যুক্ত। এই পেশায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মহিলা। তাছাড়া ধরেই নেওয়া হয় গৃহশ্রমিকদের সঙ্গে বাড়িতে যোগাযোগ রক্ষার দায় বাড়ির মহিলাদেরই। তাই তাঁরা ছুটি নিলে বাড়ির মহিলাদের শুনতে হয়, “তুমি ছুটি দিলে কেন?” এবং সেই সময়ে বাড়ির যাবতীয় কাজের দায়িত্ব এসে পড়ে বাড়ির মহিলাদের উপর। ফলে লিঙ্গ রাজনীতির পরিসরেও এই বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশি কথা বলা প্রয়োজন।
আলোচনা থেকে বেরিয়ে গৃহশ্রমিক শান্তি মন্ডল বলছিলেন, “সরকারকে গৃহশ্রমিক ও নিয়োগকারী দু’পক্ষের সঙ্গে বসে এই চুক্তি বানাতে হবে। সরকারকে ঠিক করে দিতে হবে, তাহলেই সবাই সব নিয়ম মানবে।” গৃহশ্রমিকদের শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি ও সরকারের নির্দিষ্ট নীতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
গৃহশ্রমিক ও নিয়োগকারীর সম্পর্কটা একটা মানবিক মানদন্ডের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কারণ এখানে কোনো উৎপাদিত পণ্য নেই। গৃহশ্রমিকের প্রয়োজনে ১০/১৫ হাজার টাকা ধার দেওয়া হয় মাসে ৫০০টাকা করে ফেরত দেওয়ার মৌখিক চুক্তি তে। তাদের বাচ্চাদের স্কুলের বইখাতা ব্যাগ ইত্যাদি কিনে দেওয়াটাও ব্যক্তিগত মানবিক সম্পর্কের ওপরেই নির্ভরশীল। এখানের দাবিসনদগুলোর সাথে একমত।