স্বাধীনতার সাত দশক পরেও কেন লোধাদের মানব উন্নয়নের প্রায় প্রতিটি সূচকের মান প্রাক্-স্বাধীন ভারতবর্ষের মতোই রয়ে গেল? খাদ্য হোক বা স্বাস্থ্য সুরক্ষা, লোধাদের সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীগুলির দিগন্তবিস্তৃত বৈষম্য সৃষ্টি হল কীভাবে? উত্তর খুঁজলেন অমিত সর্দার।
‘বাংলা’য় একটা ‘বুরুন্ডি’ আছে। যাঁরা সস্তায় বিদেশ ভ্রমণ করতে চান তাঁরা মেদিনীপুরের নারায়ণগড়, ঝাড়গ্রাম, নয়াগ্রাম আর গোপীবল্লভপুরের জঙ্গল ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলটি ঘুরে আসতে পারেন অতি সহজেই। তবে দুঃখের বিষয় যে সেখানে বুরুন্ডিআনদের খুঁজে পাবেন না। ওটা নেই–মানুষদের দেশ। একটা ভীত–সন্ত্রস্ত বুভুক্ষু জাতির দেশ। ওটা লোধাদের দেশ। এই বছরেই সেখানে গত ৫ মাসে শিশু, যুবক আর বয়স্ক মহিলা ও পুরুষ মিলিয়ে মোট ১২ জন লোধা মারা গেলেন অনাহার ও অপুষ্টিতে। এত অল্প সময়ে একটি বিপন্ন আদিম আদিবাসী গোষ্ঠী বা পার্টিকুলারলি ভালনারেবল ট্রাইবাল গ্রুপ (পিভিটিজি), যাঁদের টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর) রিপ্লেসমেন্ট লেভেল-এর নীচে, তাঁদের ১২ সদস্যের মৃত্যুর ক্ষতি অপূরণীয়। এর দায় নেবে কে? ভারত এখন পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির স্বপ্নে বিভোর। আর বাংলা পঞ্চায়েত নির্বাচনের খেলায় বদ্ধ উন্মাদ।
এখন প্রশ্ন হল, ভারতের মতো একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র কেন এখনও ‘অপরাধপ্রবণ জনজাতি’র গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকা বিপন্ন লোধাদের জন্য ন্যূনতম খাদ্য ও সুস্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করতে পারল না? স্বাধীনতার সাত দশক পরেও কেন লোধাদের মানব উন্নয়নের প্রায় প্রতিটি সূচকের মান প্রাক্-স্বাধীন ভারতবর্ষের মতোই রয়ে গেল? খাদ্য হোক বা স্বাস্থ্য সুরক্ষা, লোধাদের সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীগুলির দিগন্তবিস্তৃত বৈষম্য সৃষ্টি হল কীভাবে?
সময়টা ২০১৯ সাল। পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার বিস্তৃত বনাঞ্চলে বসবাসকারী লোধা জনজাতির প্রায় ৭০টি গ্রামে সমীক্ষা করার সময় একটা আশ্চর্য বিষয় লক্ষ্য করি— দুপুরে কারও বাড়িতে ধোঁয়া উড়ছে না! শুধু দু’-একটি বাড়ি বা গ্রাম নয়, গ্রামের পর গ্রামের একই অবস্থা। দক্ষিণবঙ্গের বর্ধিষ্ণু গ্রামগুলির বাসিন্দারা বুঝতে পারবেন যে ব্যাপারটা ব্যতিক্রমী, কারণ গৃহস্থ বাড়িতে রান্নার সময় সেটা। কৌতূহলবশত পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড় ব্লকের এমনই একটি গ্রাম মারকুন্ডা’র এক বয়স্ক মহিলাকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেন, “ঘরে চাউল নাই, ভাত রাঁধব্ কী করি?”
মহিলাটি বলেন কী, বাংলায় তো আর ১৯৪৩’র দুর্ভিক্ষ চলছে না! গত কয়েক দশকে সমগ্র দেশের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও জোগান অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ সমীক্ষায় দেখা গেল, প্রায় ৮৭ শতাংশ লোধা পরিবার তিন মাস ও তার বেশি সময় দুই বেলা পেটভরে খেতে পায় না। তাঁরা আদিম আদিবাসী প্রায় ৭২ শতাংশ পরিবারের মাথাপিছু মাসিক আয় বর্তমান দারিদ্র্যসীমারও ২৯০ টাকা নীচে। খাদ্য ক্রয়ক্ষমতার চূড়ান্ত অভাব। দুই কর্মক্ষম সদস্য সম্পন্ন পাঁচ জনের একটি পরিবারের এক দিনে আয় ৬৭ টাকা। পাশাপাশি ঐতিহ্যগতভাবে তাঁদের সংস্কৃতিতে চাষবাস না থাকায় নিজ কৃষি উৎপাদন থেকে খাদ্যসুরক্ষারও কোনও সম্ভবনাই নেই। সুতরাং রেশন ব্যাবস্থায় নির্ভরশীলতা অত্যন্ত বেশি। তবে রেশনে যে খাদ্যশস্য পায়, তার দৈনিক মাথাপিছু পরিমাণ এক জন ভারতবাসী দৈনিক যে পরিমাণ খাদ্যশস্য খায় তার চেয়ে ৫৪ শতাংশ কম। পর্যাপ্ত রেশন না পেয়ে, পাঁচ সদস্যের পরিবার ৬৭ টাকায় ওই ৫৪ শতাংশ খাদ্যশস্য-সহ শাকসবজি, তেল-মশলা ও জ্বালানির ব্যবস্থা করবে কী করে? ফলে প্রায় ২৮ শতাংশ পরিবারের খাদ্যাভাব থাকে ৭ মাসেরও বেশি।
অন্যদিকে, প্রচলিত খাদ্যাভ্যাস থেকে ভিন্ন অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন বিশেষ খাদ্যাভ্যাস যা বনভূমির বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে তাল রেখে দীর্ঘ সময় ধরে লোধাদের মধ্যে গড়ে ওঠেছিল, তা সম্প্রতি প্রায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে বনভূমির ক্ষয়ের ফলে। ফলে আপামর বাঙালি ও ওড়িয়াদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যে সংখ্যায় পুষ্টিকর খাদ্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তার অধিকাংশই লোধাদের খাদ্য তালিকায় অনুপস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৮৮ শতাংশ লোধা পরিবার ভাত আর শুধুমাত্র একটি পুষ্টিকর খাবার কোনওরকমে জোগাড় করতে পারে। খাদ্য বৈষম্য এতই বেশি যে যেখানে সপ্তাহে প্রায় ৬৭ শতাংশ বাঙালি এবং ৮০ শতাংশ ওড়িয়া প্রতিদিন শাকসবজি খায়, সেখানে বাংলায় ৭৫ শতাংশ ও ওড়িশায় ৫৬ শতাংশ লোধা সপ্তাহে দুইবার শাকসবজি খেতে পায়। ডাল, মাংস, মাছ, ডিম, দুধ ও ফলের ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও বেশি প্রকট। ফলে অত্যন্ত পরিশ্রমী এক লোধা যুবক দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় খাদ্যশক্তির (ক্যালোরি) চেয়ে ৩৪ শতাংশ কম খাদ্যশক্তি পেয়ে কোনওরকমে বেঁচে থাকে।
লোধাদের জনস্বাস্থ্যের ওপর এগুলির সম্মিলিত ফল হয়েছে সর্বব্যাপী মারাত্মক অপুষ্টি। প্রায় ৯৫ শতাংশ লোধা পরিবার অপুষ্টিতে আক্রান্ত। অনাহার ও অপুষ্টিতে মৃত্যু এখনও সমানে চলেছে। দুর্দশা তাদের এমনই যে ২০১৩ সালে খাদ্য নিরাপত্তা আইন চালু হবার পাঁচ বছর পরও ২০১৮ সালে একটামাত্র গ্রামেই দুই সপ্তাহে সাত জন মারা যান। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমাজের মূলধারার সঙ্গে লোধাদের সামাজিক দূরত্ব এত বেশি যে বাকি মৃত্যুগুলির খবরে আসে না। প্রথম আসে ২০০৪ সালে, যখন চার জন লোধার মৃত্যু হয় অনাহারে। এর কিছুপর ২০০৮ সালে এক গবেষণাপত্রে দেখা যায় ৪৫ শতাংশ লোধা (১৮-৪৯ বছর বয়স্ক) অপুষ্টিতে আক্রান্ত যা হু’র (WHO) মতানুযায়ী সঙ্কটময় অবস্থা এবং অবিলম্বে পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এরপরও অপুষ্টি প্রতি বছর ১.৪ শতাংশ হারে বেড়ে গত দশ বছরে হয়েছে ৬০ শতাংশ যা পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র আদিবাসী জনগোষ্ঠীর চেয়ে ১২৬ শতাংশ এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর চেয়ে ১৬৮ শতাংশ বেশি। শিশু অপুষ্টির ক্ষেত্রেও প্রবণতা একই। আবার পশ্চিমবঙ্গের বনাঞ্চলের তুলনায় ওড়িশার বনাঞ্চলে বসবাসকারী লোধাদের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ৪ শতাংশ বেশি হওয়ার ফলে অপুষ্টির হার সেখানে ১৭ শতাংশ বেশি।
এতো গেল বনাঞ্চলের কথা। কয়েক দশক আগে পশ্চিমবঙ্গের অনাহারক্লিষ্ট বনাঞ্চল ছেড়ে ওই অঞ্চলগুলিরই কৃষিপ্রধান স্থানগুলিতে যারা বসবাস করতে শুরু করেছিল তাদের অবস্থা এখন আরও শোচনীয়। তাঁদের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ না বনাঞ্চল থেকে পালিয়ে যাওয়া, না কৃষিকাজের সুবিধা, না রাজ্যের সীমানা— কোনওটাই লোধাদের এই অনাহারক্লিষ্ট অবস্থার কোনও ইতিবাচক পরিবর্তন করতে পারেনি। বরঞ্চ অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তায় বৈষম্য বেড়েছে অল্প সময়ে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে।
অথচ সাম্প্রতিক অর্থবর্ষগুলিতে তাদের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ অর্থ নামমাত্র বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই সঙ্গে বড় অঙ্কের অর্থের কোনও খরচই হয়নি। এ ছাড়া গবেষণামূলক জ্ঞানের অভাব সত্ত্বেও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া থেকে লোধাদের দূরে সরিয়ে রাখার ফলে, তাঁদের আর্থ-সামাজিক সমস্যার মূলগুলোকে চিহ্নিত করাই যায়নি। আদিবাসী কল্যাণমূলক দপ্তরগুলি শুধু বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন করে গেছে। ফলে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন লোধারা মূল ধারার ব্যাপক উন্নয়নের পাশাপাশি তাঁদের লক্ষ্য করে গড়ে ওঠা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেরও সুফল পায়নি। অন্যদিকে ঐতিহ্যগতভাবে অরণ্যসম্পদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জীবন-জীবিকাকে রীতিবদ্ধভাবে ধ্বংস করে লোধা আদিবাসী সমাজে উন্নয়নের নামে পুঁজিবাদের অনুপ্রবেশকরণের ফল হয়েছে আরও মারাত্মক বৈষম্য।
তাহলে লোধাদের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দূর করা সম্ভব কীভাবে? পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায় একটি করে ‘লোধা উন্নয়ন পরিষদ’ আছে। সেখানে কেবলমাত্র লোধাদের উন্নয়ন ও নীতিনির্ধারণের জন্য নিয়োজিত আমলাকে এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করেছিলাম, “লোধারা তো শাকসবজি- সহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারই খেতে পাচ্ছেন না। আপনারা পুষ্টিকর খাদ্যের কোনও ব্যবস্থা করছেনা না কেন?” আমলার উত্তর ছিল, “কেন, শাকসবজি কেন খাবে? মাছ ছাড়া ওদের মুখে খাবার রুচে না?” আসলে ‘জাতিবিদ্বেষ’ এত সহজ জিনিস না যে শুধু প্রথাগত শিক্ষা দিয়ে তা নির্মূল করা যাবে। ওই আমলার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। মূল সমস্যা হল, অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির জীবনশৈলীতে কৃষিকাজ অঙ্গাঙ্গিকভাবে বহুকাল ধরে জড়িত থাকলেও, লোধাদের সংস্কৃতিতে সেটা প্রায় এখনও নেই। অতএব শাকসবজি পাবে কোথায়? ক্রয়ক্ষমতাও তো নেই। অজ্ঞ দিশাহীন আমলা’তে ভরসা হারিয়ে তাই সোজা ওড়িশার সুলিয়াপাদা ব্লকের টিঁয়াসি গ্রামের এক ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, “আপনাদের তো কোনওমতে দু’বেলা খাবার জোটে। যদি রেশনে ৩৫ কেজি চালের দ্বিগুণ ৭০ কেজি চাল দেওয়া হয় তাহলে কি সবাই তিন বেলা খাবার খাবে? উত্তরটা ছিল, “না, লোধা জাতির জন্মগত অভ্যাস হয়ে গেছে দু-বেলা খাওয়া”। এটা কোনও অভিমান না, দীর্ঘ সময়ের তীব্র খাদ্যাভাব ও রাষ্ট্রের অবহেলাকে হেলায় হারিয়ে বেঁচে থাকার একটা সফল কৌশল তা যতই পীড়াদায়ক হোক। তবে এটা কল্যাণমুলক রাষ্ট্রের পক্ষে লজ্জার। সে এখনও বসে বসে দেখতে থাকুক সমগ্র আদিম জনজাতিকে ব্রিটিশের দেওয়া ‘অপরাধপ্রবণ জনজাতি’র গ্লানি কীভাবে তাঁদের দেহ-মনে আজও সমানভাবে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে চলেছে।
(লেখক জনজাতি বিষয়ক গবেষক।)