করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে সামনে এনেছে। রেলে ভারত সরকার এত টাকা বাজেট বরাদ্দ হিসাবে ঘোষণা করা হলেও সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে এত গাফিলতি কেন! এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আবশ্যক। রেল হল এই পৃথিবীতে সবচেয়ে পরিবেশ বান্ধব ও কম খরচের পরিবহন ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষের পক্ষে আকাশপথে বা নিজস্ব গাড়িতে ঝাঁ চকচকে সড়কপথে সফর করা খরচের কারণে বাস্তবত অসম্ভব। তাই রেলের প্রতি মানুষের নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি। ভারতীয় রেলের সমস্যা অনেক থাকলেও দু’দশক আগে পর্যন্ত রেলের চিন্তাভাবনার ভরকেন্দ্রে ছিল সাধারণ মানুষ। উদারীকরণের অর্থনীতি চালু হবার পর থেকে রেলকে বাণিজ্যিক ভাবে লাভজনক করার নামে বেসরকারিকরণ ও আউটসোর্সিং এর যে রাস্তা নেওয়া হয়েছে তা রেল সফরকে আরো বেশি সমস্যা আক্রান্ত করে তুলেছে। লিখলেন সুমন কল্যাণ মৌলিক।
বালাসোরে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার দশদিনের বেশি অতিক্রান্ত কিন্তু কি কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটল, রেলওয়ে সুরক্ষা ব্যবস্থায় কি ধরণের গাফিলতি ছিল — সে সংক্রান্ত সঠিক তথ্য এখনো অমিল। পরিবর্তে যত সময় যাচ্ছে এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনাকে এক অন্তর্ঘাত বলে প্রমাণের মরিয়া চেষ্টা করছে রেলমন্ত্রক। এই মরিয়া চেষ্টার মধ্যেও এক সুপরিকল্পিত ছক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রথমে বিজেপির আইটি সেলের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনা স্থলের নিকটবর্তী ইসকনের এক মন্দিরকে মসজিদ ও স্টেশন মাস্টারের নাম বিকৃত করে এটাকে এক মৌলবাদী অন্তর্ঘাত বলে চালানোর চেষ্টা হল। তারপরে রেলওয়ের স্বয়ংক্রিয় সিগনালিং ব্যবস্থা এবং রেললাইন সুরক্ষা সম্পর্কে হাজারো ত্রুটির কথা সামনে আসায় তড়িঘড়ি প্রধানমন্ত্রী ঘটনাস্থলে গিয়ে দোষীদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির নিদান দিলেন। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব (এই ঘটনা না ঘটলে একথা হয়ত জানাই হত না যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় এই নামের কোন রেলমন্ত্রী আছেন!) আরো এগিয়ে গিয়ে বললেন দুর্ঘটনার মূল কারণ ও দোষীদের চিহ্নিত করা গেছে। তারপর ভারতীয় রেলের ইতিহাসে সম্ভবত প্রথমবার রেলওয়ে সেফটি কমিশনারের তদন্ত শেষ হবার আগেই দুর্ঘটনার অতিরিক্ত তদন্ত করার জন্য সিবিআইকে ডেকে আনা হল। কিন্তু সরকার যতই চেষ্টা করুক না কেন, বিভিন্ন সরকারি রিপোর্ট ভারতীয় রেলের পরিকাঠামো ও নিরাপত্তার কঙ্কালসার অবস্থাকে সামনে নিয়ে আসছে। প্রায় তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু, প্রচুর মানুষের আহত হওয়ার দায় রেলমন্ত্রক কখনোই অস্বীকার করতে পারে না। ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে বিগত সময়ের মত নিচুতলার কিছু কর্মীকে বলির পাঁঠা করে দায়ভার সেরে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। তাই একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে এই দুর্ঘটনার কারণ, তার বৃহত্তর প্রেক্ষাপট ও ভারতীয় রেলের বর্তমান অবস্থাকে প্রশ্ন করা সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
বালাসোর দুর্ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এতে তিনটে ট্রেন জড়িত। শালিমার-চেন্নাই করমণ্ডল এক্সপ্রেস, যশোবন্তপুরম- হাওড়া এক্সপ্রেস এবং একটি মালগাড়ি যা লুপ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। সংবাদপত্রগুলিতে প্রথম কয়েকদিন যা যা খবর প্রকাশিত হয়েছে তার থেকে প্রাথমিক ধারণা হল, দুর্ঘটনার কারণ ট্রাফিক সিগনালের ত্রুটি বা ব্যর্থতা। তবে সেই ত্রুটি নিয়েও রেলের তরফে একাধিক পরস্পর বিরোধী যুক্তি হাজির করা হয়েছে। প্রথম মতটি হল মেইন লাইনে ট্রাফিক সিগনাল সবুজ থাকা সত্ত্বেও করমণ্ডল ভুল করে লুপ লাইনে ঢুকে পড়ে প্রচণ্ড গতিতে মালগাড়িটিকে ধাক্কা মারে। দ্বিতীয় মতটি হল প্রথমে সবুজ থাকলেও শেষ মুহূর্তে সিগনালের গতিপথ পরিবর্তিত হয় পয়েন্ট সেটিং-এর ভুলের কারণে। এখন এই ভুল যান্ত্রিক বা মানুষের ভুলের কারণেও হতে পারে। কিন্তু আরেকটা সম্ভাবনার কথা রেলকর্তাদের বিভিন্ন মন্তব্যে উঠে আসে যে, করমণ্ডল আগেই লাইনচ্যূত হয়, মালগাড়ির সঙ্গে ধাক্কা তার পরের ঘটনা। বিশেষ করে প্রাথমিক রিপোর্টে সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার এ কে মহন্তর বিরোধী বক্তব্য (ডিসেন্ট নোট) দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ সংক্রান্ত জল্পনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এখন প্রশ্ন হল কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে তার তদন্ত করার ক্ষেত্রে ভারতীয় রেলে কীভাবে তদন্ত করা হয়! এক্ষেত্রে একশো বছর ধরে যে নিয়ম ভারতীয় রেলে প্রচলিত রয়েছে তা হল, সেফটি কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি এই অনুসন্ধান কার্য চালাবে। কিন্তু করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই তদন্ত প্রক্রিয়ায় নানান ধরণের হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটছে যা অভূতপূর্ব। প্রথাগত নিয়ম মেনে ৪ জুন সাউথ ইস্টার্ন সার্কেলের সেফটি কমিশনার এ এম চৌধুরীর নেতৃত্বে সেফটি কমিশন গঠিত হয়। ৫ জুন কাজ শুরু হয় এবং ৬ জুন কমিশন দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। নিয়ম মাফিক রেলওয়ে কর্মী, ঠিকা কর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শী মিলে মোট ৪০ জনকে সমন পাঠানো হয়। কিন্তু তাদের প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি হওয়ার আগেই ৪ জুন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব সংবাদ মাধ্যমে বলেন ইন্টারলকিং সিস্টেমে ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং এই ত্রুটি বাইরে থেকে ঘটানো হয়েছে এবং দায়ীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। পরের দিন সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয় যে তদন্তের জন্য সিবিআইকে ডাকা হচ্ছে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক যুক্তি বলে যদি কারণ ও দোষীদের চিহ্নিত করাই হয়েছে তাহলে আবার নতুন করে সিবিআই তদন্তের প্রয়োজন কোথায়? না কি একটা অন্তর্ঘাত তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই সিবিআইকে ডাকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে! এক্ষেত্রে এই ধরণের অন্তর্ঘাত তত্ত্বের আরেকটা উদাহরণ সামনে আনা প্রয়োজন। রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত চিফ ইঞ্জিনিয়ার অলোক কুমার ভার্মা আমাদের সঠিক সময়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে ঘটা কানপুর রেলওয়ে দুর্ঘটনার কথা, যেখানে ১৫০ জন যাত্রী প্রাণ হারান। সেবারও তৎকালীন রেলমন্ত্রী নাশকতার অভিযোগ তুলে তদন্তভার ন্যাশানাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সির হাতে তুলে দেন। দেড় বছর পরে সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাহার করে সেই তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। করমণ্ডল দুর্ঘটনার পর যেভাবে রেলওয়ে ট্র্যাক ও সিগনালিং ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যথাসময়ে না করার অভিযোগ উঠছে তাকে ধামাচামা দিতেই এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে সামনে আনা হচ্ছে।
এই দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় রেলমন্ত্রী যেভাবে বার বার ঘোষণা করছেন অন্তর্ঘাত না হলে ইন্টারলকিং ও সিগনাল ব্যবস্থা ভুল করে না, বাস্তবের ছবিটা কিন্তু তার উল্টো সাক্ষ্য দিচ্ছে। ২০২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি প্রিন্সিপাল চিফ অপারেটিং ম্যানেজার (সাউথ-ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে জোন) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান, শুধুমাত্র লোকো পাইলটের উপস্থিত বুদ্ধির জন্য যশোবন্তপুরম- হজরত নিজামউদ্দিন সম্পর্ক ক্রান্তি এক্সপ্রেস এক মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ায়। এক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় ইন্টারলকিং ব্যবস্থা ভুল সিগনাল দেওয়ার কারণে দুটো ট্রেন এক লাইনে চলে এসেছিল। ৫ জুন ২০২৩, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান অনিল লাহৌটির সভাপতিত্বে হওয়া নিরাপত্তা সংক্রান্ত রিভিউ মিটিং-এর মিনিটস প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে চেয়ারম্যান বলেছেন, বিগত সময়ে বিভিন্ন সিগনাল, ট্র্যাক সংক্রান্ত ভুল ত্রুটির কারণে হওয়া দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালগাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছে তাই জীবনহানি সেভাবে হয়নি। কিন্তু রেলের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রচুর। এবং পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। এখানে আরও বলা হয় সাউথ ইস্টার্ন সেন্ট্রাল রেলওয়ে এবং ইস্ট কোস্ট রেলওয়ের ট্রেন চালক ও গার্ডরা টানা ১২ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন কারণ লোক নেই। ৪ জুন ২০২৩ বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় রেলের নিরাপত্তা সংক্রান্ত আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যাতে দেখা যাচ্ছে গত ৫ বছরে একই লাইনে দুটো ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১১টি। এগুলো সবিস্তারে উল্লেখ করার কারণ এটা বোঝানো যে পরিকাঠামোর দুর্বলতা এবং কর্মীবাহিনী কম থাকার কারণে দুর্ঘটনা ভারতীয় রেলওয়েতে নিয়মিত ভাবে ঘটছে।
করমণ্ডল এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনার ভয়াবহতা দেখে অনেকেই মোদী সরকারের বহু বিজ্ঞাপিত সংঘর্ষরোধী প্রযুক্তি ‘কবচ’ এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কারণ দাবি করা হয়েছিল এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দুর্ঘটনার সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনবে। এক্ষেত্রে মনে করিয়ে দেওয়া ভালো যে ২০১২ সাল থেকে রিসার্চ ডিজাইন অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন এই বিষয়ে গবেষণা করছিল এবং ২০২০ সালে এই কবচ ভারতীয় রেলওয়ের সুরক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রথমে এই প্রযুক্তির নাম কবচ ছিল না কিন্তু হিন্দুত্বের রাজনীতিকে সুড়সুড়ি দিতে কবচ (হিন্দু ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী বিপদ থেকে রক্ষাকারী মাদুলি) নামকরণ হয়। এই দুর্ঘটনার পর জানা যাচ্ছে এত বিজ্ঞাপন সত্বেও ভারতীয় রেলের ৯৮ শতাংশ রুটে এই প্রযুক্তির কাজ শুরুই হয়নি। বালাসোর রুটে বা করমণ্ডল এক্সপ্রেসের মত প্রিমিয়াম ট্রেনের রুটে এই প্রযুক্তি ছিলই না। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হল এই দুর্বলতাকে ঢাকতে রেলমন্ত্রকের বিভিন্ন সূত্র থেকে বলা হচ্ছে কবচ থাকলেও এই দুর্ঘটনা আটকানো যেত না। তাহলে তো কবচের কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে!
দেশের জীবনরেখা ভারতীয় রেল ১৬০ বছর আগে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের আমলে তৈরি হয়। এখন প্রতিদিন ভারতীয় রেল গড়ে ১১,০০০ ট্রেন ৬৭,০০০ মাইল রেলপথে চালায়। প্রতিদিন রেলে সফর করেন ২ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ এবং ১.৫ বিলিয়ন টন পণ্য সামগ্রীর পরিবহন হয়। রেলের সুরক্ষা আন্তর্জাতিক মানের করার দাবি নিয়ে ২০১৭-১৮ বর্ষে ‘রাষ্ট্রীয় রেল সংরক্ষা কোষ’ তৈরি হয়। বলা হয়েছিল পরবর্তী ৫ বছরে ১ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে এবং প্রথম বছর খাতায় কলমে ২০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এখন সত্যি যদি রেলওয়ে ট্র্যাকের আধুনিকীকরণ, উন্নত সিগনালিং ব্যবস্থা, দুর্ঘটনার অভিঘাত সহ্য করতে সক্ষম এলএইচবি কোচ বাধ্যতামূলক করার মতো সুরক্ষার প্রাথমিক ব্যবস্থা করা যেত তাহলে অবশ্যই ভারতীয় রেলের সুরক্ষা সংক্রান্ত পরিকাঠামোর খোল নলচে পাল্টে যেত। বাস্তবের ছবিটা যে একেবারে উল্টো তা প্রকাশিত হয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে প্রকাশিত ক্যাগের অডিট রিপোর্টে। ২০২২ সালে প্রকাশিত “ডিরেইলমেন্ট ইন ইন্ডিয়ান রেলওয়েজ” শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২৪টি কারণে লাইনচ্যূত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এপ্রিল ২০১৭ থেকে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত ১১২৯ টি লাইনচ্যূত হওয়ার ঘটনার মধ্যে ২৮৯টি দুর্ঘটনা (২৬%) ঘটেছে ট্র্যাক ঠিকসময়ে মেরামতি না হওয়ার জন্য। ৪২২টি ঘটনার জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৮২টি ঘটনার জন্য মেকানিকাল ও ২৭৫টি ঘটনার জন্য অপারেটিং ডিপার্টমেন্টকে দায়ী করা হয়েছে। ক্যাগ রিপোর্ট দেখিয়েছে ট্র্যাকের নবীকরণের জন্য বরাদ্দ ২০১৮-১৯ সালে ছিল ৯৬০৭.৬৫ কোটি টাকা যা ২০১৯-২০ সালে কমে হয়েছে ৭,৪১৭ কোটি টাকা। এক দিকে টাকার বরাদ্দ কমে যাওয়া এবং যে টাকা এসেছে তাও খরচ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ২০১৭-১৮ সালে লাইনচ্যূত হওয়ার ঘটনার ২৬% ঘটেছে বলে ক্যাগ রিপোর্ট মনে করছে। নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য ট্র্যাক রেকর্ডিং কার-এর সংখ্যা এবং তা চালানোর লোকের সংখ্যা কমে গেছে। ক্যাগ বলছে, লোক না থাকার কারণে ভারতীয় রেলের ১১ টি জোনে ১৩১৮৮১টি কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে ট্র্যাক কার চালানোর ক্ষেত্রে। এমনকি নিরাপত্তার জন্য গঠিত এই কোষের টাকা অন্য খাতে ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে। এই খাতের টাকা থেকে ফুট ম্যাসেজার, বাসনপত্র, বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, শীতের জ্যাকেট, কমপিউটার, এস্কেলেটর কেনা হয়েছে। ২০১৭-১৮ সালে নন প্রায়োরিটি সেক্টরে খরচ ছিল ২.৭৬% যা ২০১৯-২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৬.৩৬%। তৃণমূল স্তরে নিরাপত্তা হাল নিয়ে মোদী সরকারের প্রতিশ্রুতির ফানুস চুপসে দিয়েছে ক্যাগ রিপোর্ট।
কর্মী সংখ্যার প্রশ্নটি আজ রেলের শোচনীয় অবস্থার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। আজ ভারত রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা জনগণের পয়সায় গড়ে ওঠা ভারতীয় রেলকে এক সাদা হাতি মনে করে তাকে নানান ভাবে কাটছাঁট করে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। ডেলয়টের মতো পরামর্শদাতাকে সাথে নিয়ে আজ রেলবোর্ড যে নীতি নিয়ে চলছে তার মূল কথাগুলি হল নতুন নিয়োগ বন্ধ, চুক্তিভিত্তিক শ্রমশক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি ও যথেচ্ছ আউটসোর্সিং। এর ফলে কর্মী সংখ্যা কমছে অস্বাভাবিক হারে। ১৯৯০-৯১ সালে রেলের কর্মীবাহিনী ছিল ১৬.৫ লাখ যা ২০১৫ সালে হয় ১৩.৩৪ লাখ। ২০১৯-২০ সালে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ১২.৫৩ লক্ষ। টাইমস অব ইন্ডিয়ার করা একটি আরটিআই অনুসারে গ্রুপ সি-তে ১৪,৭৫,৬২৩ পোস্টের মধ্যে ৩.১১ লক্ষ ফাঁকা রয়েছে। এই পোস্টগুলোর মধ্যে রয়েছে ট্র্যাকম্যান, সিগনাল অপারেটর, সিগনাল অপারেটরের মত পদ। এই অবস্থায় যাত্রী সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে গাফিলতি থেকে যাচ্ছে।
ভারতীয় রেলের সুরক্ষার প্রশ্নে আরও দুটো বিষয় আছে যা তুলনায় কম আলোচিত। প্রথমটি হল রেললাইনের উপর অতিরিক্ত ট্রেনের চাপ (কনজেশন)। সাধারণ হিসাবটা হল, ট্র্যাকের ক্ষমতার ১২৫ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে ট্রেনের বোঝা সামলাতে। এই চাপের ফলে একদিকে যেমন ট্রেনের সময় সারণী উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে (দূরপাল্লার ট্রেনগুলোর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে না চলাটা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে), তেমনি ট্র্যাক মেরামতির জন্য যথেষ্ট সময় (রেলের ভাষায় ব্লক) পাওয়া যাচ্ছে না। অভিযোগ হল ট্রেনের সময় সারণী রক্ষা করতে ট্র্যাক ইঞ্জিনিয়ার যদি ২ঘন্টার ব্লক চান তবে তাকে ৪৫ মিনিটের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা বলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আলোচনায় উঠে আসছে ২০১৭ সালের মুজফফরনগর রেল দুর্ঘটনার কথা।সেখানকার ট্র্যাক ইন্সপেক্টর লাইনে ত্রুটি দেখেন এবং অবিলম্বে সিগনাল ব্লকের আবেদন করেন। কিন্তু তাকে ব্লক দেওয়া হয় নি। এই অবস্থায় লাইনে লাল পতাকা লাগিয়ে ঝুঁকি নিয়ে ইন্সপেক্টর কাজ শুরু করেন। ঐ লাইনে লাল পতাকা লক্ষ্য না করে কলিঙ্গ উৎকল এক্সপ্রেসের ড্রাইভার ট্রেন ছুটিয়ে দেন ফলে ২৩ জন মারা যান। এই ধরণের দুর্ঘটনার বড়ো কারণ কোনও মেরামতির পর লাইন পূর্বের অবস্থায় ফিরল কি না তা দেখার জন্য ফিজিকাল ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন হয়। ব্লকের যথেষ্ট সময় না পাওয়ার কারণে সেই প্রক্রিয়া তাড়াহুড়ো করে হয়। করমণ্ডলের ক্ষেত্রেও মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী পয়েন্টের কাজ দুর্ঘটনার আগে ঐ স্থানে হয়েছিল। দুর্ঘটনায় প্রাণহানির আরেকটা বড়ো কারণ জনপ্রিয় লাইনগুলোতে দূরপাল্লার ট্রেন হোক বা শহরতলির ট্রেন, যাত্রী সংখ্যা দ্বিগুন হয়। করমন্ডলে যাত্রার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তাদের জানা এই ট্রেনের জেনারেল বগি এবং স্লিপার কোচে দ্বিগুণ লোক যায়। সংরক্ষিত স্লিপার ক্লাসে জরিমানা দিয়ে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক সফর করতে বাধ্য হন। এই নারকীয় অবস্থায় কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে তার ক্ষয়ক্ষতি হয় অনেক বেশি। করমণ্ডলে সরকারি মতে ২৮৭ জন এবং বেসরকারি মতে তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু আসলে এই সামগ্রিক অব্যবস্থার পরিণতি।
করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে সামনে এনেছে। রেলে ভারত সরকার এত টাকা বাজেট বরাদ্দ হিসাবে ঘোষণা করা হলেও সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে এত গাফিলতি কেন! এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আবশ্যক। রেল হল এই পৃথিবীতে সবচেয়ে পরিবেশ বান্ধব ও কম খরচের পরিবহন ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষের পক্ষে আকাশপথে বা নিজস্ব গাড়িতে ঝাঁ চকচকে সড়কপথে সফর করা খরচের কারণে বাস্তবত অসম্ভব। তাই রেলের প্রতি মানুষের নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি। ভারতীয় রেলের সমস্যা অনেক থাকলেও দু’দশক আগে পর্যন্ত রেলের চিন্তাভাবনার ভরকেন্দ্রে ছিল সাধারণ মানুষ। উদারীকরণের অর্থনীতি চালু হবার পর থেকে রেলকে বাণিজ্যিক ভাবে লাভজনক করার নামে বেসরকারিকরণ ও আউটসোর্সিং এর যে রাস্তা নেওয়া হয়েছে তা রেল সফরকে আরো বেশি সমস্যা আক্রান্ত করে তুলেছে। আর নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গতির উড়ানের নামে অদরকারী ক্ষেত্রগুলিতে যথেচ্ছ বিনিয়োগ করা হচ্ছে।
বিলাসবহুল, তীব্র গতির ট্রেন চালানোর চেষ্টা হচ্ছে শতাব্দী প্রাচীন ও নবীকরণ বিহীন রেলপথে। ভারতীয় রেল আমেদাবাদ থেকে মুম্বাই পর্যন্ত বুলেট ট্রেনের জন্য ৫০০ কিমি একটা রেলপথ তৈরি করছে যাতে প্রযুক্তিগত কারণে অন্য কোনও ট্রেন চলতেই পারবে না। এই রেললাইন বানাতে খরচ হচ্ছে দুই লক্ষ কোটি টাকা অথচ ৭ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করলে দেশের ১৫০০০ কিমি রেলপথ নতুন ভাবে তৈরি করা যায়। ৬,০০০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে বন্দেভারত ট্রেনগুলোর জন্য। এই ট্রেনের ভাড়া সুপারফাস্ট শতাব্দীর দ্বিগুণ অথচ সময় লাগছে শতাব্দীর চেয়ে মাত্র আট ঘণ্টা কম। প্রথম দিন থেকেই জানা বন্দেভারত এই ট্র্যাকে পূর্ণ গতিতে চলবে না। কোটি কোটি টাকা খরচ করে সৌন্দর্যায়নের নামে স্টেশনগুলোকে শপিং মলে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। সাধারণ শৌচালয়, জলের কল, প্রতীক্ষালয় কমিয়ে দিয়ে ইউজার্স ফি দিয়ে বাতানুকূল, ওয়াইফাই পরিষেবা যুক্ত ক্যাফেটেরিয়া আজ ভারতীয় রেলের অভিজ্ঞান। সোজা কথায় ভারতীয় রেলে আজ গরিব হাটাও প্রকল্প চলছে। বলা হচ্ছে জেনারেল কামরা ও স্লিপারের সংখ্যা কমিয়ে বাতানুকূল কামরার সংখ্যা বাড়ানো হবে।
প্রবীণদের টিকিটে ছাড় তুলে দেওয়া হয়েছে। ডায়নামিক ফেয়ার টিকিটের নামে সাধারণ টিকিট দেড় গুণ বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। পৃথক রেলমন্ত্রক তুলে দিয়ে আজ ভারতীয় রেলকে এক কর্পোরেট সংস্থায় পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে। করোনার সময় প্ল্যাটফর্ম টিকিট-সহ সমস্ত টিকিটের দাম বাড়িয়ে (সে সময় সমস্ত জেনারেল কামরাকে সংরক্ষিত কামরা বানানো হয়েছিল এবং লোকাল ট্রেনকে এক্সপ্রেস বা মেল ট্রেন ঘোষণা করা হয়) সাধারণ মানুষকে লুঠ করা হয়েছিল তা অভূতপূর্ব। এই দর্শনে তাই যাত্রী সুরক্ষা, রেলওয়ে ট্র্যাক ও সিগনালিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, রেললাইনের বাড়তি চাপ কমানোর বিষয় গুরুত্ব পায় না। এত মানুষের মৃত্যু এই সত্যটাকে আবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
তথ্যসূত্র:
১) রেলওয়েজ, লাইফলাইন অব ইন্ডিয়া’জ ইকোনমি ইন আইসিইউ (নিউজ ক্লিক, ১১ জুন, ২০২৩)
২) কভার ইয়োর ট্র্যাকস: দ্য মোদী গভর্নমেন্ট অ্যাটিটুড আফটার দ্য বালাসোর ট্র্যাজেডি (দ্য ওয়ার, ৯ জুন ২০২৩)
৩) দ্য ওড়িশা ট্রেন ক্র্যাশ ওয়াজ দ্য টেরিবল কস্ট অব ইগনোরিং ক্যাগ অডিট (দ্য ওয়ার, ৮ জুন ২০২৩)
৪) ওড়িশা ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট: রেলওয়েজ গট টু ওয়ার্নিং ইন সিক্স মান্থস অন ফল্টি সিগনালিং (স্ক্রল নিউজ, ৪ জুন, ২০২৩)।
রেল ভাড়া যেভাবে উর্দ্ধমুখী, ঠিক সেভাবেই যাত্রী নিরাপত্তা নিম্নমুখী। এটা এখন আর ভারতীয় রেল নয়, এজেন্সি রেল যাদের লক্ষ্য যাত্রী পরিসেবা নয়, যাত্রী শোষণ। বৃহত্তম পরিসেবা ক্ষেত্রে সবচেয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন নিদর্শনের সাক্ষর রাখছে সরকার।