গ্রাউন্ডজিরোর প্রতিবেদন | ০৯ জুন, ২০২৩
সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (এসআরএফটিআই)-এ বিগত চার দিন ধরে চলছে লাগাতার প্রতিবাদ বিক্ষোভ। একের পর এক যৌন হেনস্থার ঘটনায় ইন্টারনাল কমপ্লেন কমিটিকে (আইসিসি) অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও আইসিসি-র তরফে কোনও ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি বলে অভিযোগ জানিয়েছেন আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা। আর এই কারণেই শুরু হয়েছে লাগাতার আন্দোলন।
এক ছাত্রী গ্রাউন্ডজিরোকে জানিয়েছেন, “ফ্যাকাল্টির এক জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও আইসিসি দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখে বিষয়টি। তারপর দেখা যায় ওই শিক্ষক বহাল তবিয়তেই ক্লাস করাচ্ছেন।“ অবশেষে ছাত্রছাত্রীদের ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নেয় যে ক্লাস বয়কট করা হবে। এরপর ডিন, রেজিস্ট্রার-সহ বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি ও প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মীদের নানা ভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাদের তরফ থেকে কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। সোমবার দিনভর ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস বয়কট করে প্রতিষ্ঠানের মূল দ্বার অবরুদ্ধ করে রাখেন। সন্ধে পর্যন্ত চলে চাপানউতোর। ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর হিমাংশু শেখর খাটুয়া, ডিন বিপিন বিজয় ও রেজিস্ট্রার শুশ্রুত শর্মা এবং অন্যান্য ফ্যাকাল্টি সদস্যদের তরফে এখনও এ বিষয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
এসআরএফটিআই-এর ছাত্রছাত্রী ইউনিয়নের সহ সভাপতি সুব্বারমণ বলেন, “যৌন নির্যাতনের ঘটনা এখানে নতুন নয়। প্রতি বছরই বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটে, তারপর আইসিসিতে অভিযোগ জানানো হয়। কিন্তু আইসিসি প্রত্যেকবারই নানান অছিলায় ঘটনাগুলিকে চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। কখনও কখনও অভিযোগকারীকে তদন্তের জন্য ডাকা হয়, সেখানে বলা হয় চেপে যাওয়ার জন্য কিংবা অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য। সদ্য গঠিত নতুন আইসিসিতে কোনও ছাত্রছাত্রী প্রতিনিধিকে পর্যন্ত রাখা হয়নি। আমাদের দাবি আইসিসি এই প্রত্যেকটি অভিযোগ সঠিকভাবে খতিয়ে দেখে তদন্ত করে রিপোর্ট দিক। এর পাশাপাশি ছাত্রদের তরফ থেকে আইসিসিতে প্রতিনিধি নেওয়া হোক। তদন্ত প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হোক।”
কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কোনওভাবে আলোচনায় বসার প্রস্তাব এসেছে কি? এ প্রশ্নের জবাবে সুব্বারমণ বলেন, “এখনও পর্যন্ত না। ডিন নিজেই দেখা করছেন না।“ কোনও হুমকি এসেছে কি? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “ঠিক সেভাবে নয়, কারণ তাঁরা অ্যাকাডেমিক, তাঁরা প্রতিষ্ঠান চালান। অন্যভাবে টার্গেট করছেন। আমরা ফিল্ম মেকিং-এর ছাত্রছাত্রী। আমরা কোনও স্ক্রিপ্ট দিলে কিংবা শ্যুট করতে চাইলে সেগুলি ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কখনও ফান্ড কিংবা প্রয়োজনীয় শ্যুটিংয়ের যন্ত্রপাতি দেওয়া হচ্ছে না। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। আমরা চাই না বিনাবিচারে কিংবা অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই কাউকে শাস্তি দেওয়া হোক। আমরা চাই সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছভাবে তদন্তের মাধ্যমেই রিপোর্ট দিক আইসিসি। কিন্তু এই প্রক্রিয়াগুলি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তাই আমরা প্রতিবাদ করছি।”
“গ্রিভান্স সেলে বারংবার চিঠি দেওয়া, একাধিকবার কমিটির কাছে অভিযোগগুলি নিয়ে কথা বলতে যাওয়া সত্ত্বেও তারা বার বার সময় নিচ্ছে, সঠিকভাবে উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না,” এমনটাই অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ছাত্রী। এসআরএফটিআই-তে এর আগেও যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। এই হেনস্থাগুলি কখনও শারীরিক ও মানসিক, কখনও মানসিক তো আবার কখনও ষণ্ডামোর (বুলি) পর্যায়ে চলে যায়। “ক্যাম্পাসে পড়তে আসা প্রত্যেকটি ব্যাচে ভারতের নানান প্রান্ত এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের দেখা মেলে। সেক্ষেত্রে কখনও কখনও তা পৌঁছে যায় কোনও ছাত্র বা ছাত্রীর জাতি, পোশাক কিংবা সে কোন এলাকা থেকে এসেছে তা নিয়ে বিদ্বেষমূলক মন্তব্যে,” অভিযোগ সেই ছাত্রীর। কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে যৌন হেনস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এই রকম গা-ছাড়া মনোভাবে, ছাত্রদের তুলনায় খুবই অল্প সংখ্যক ছাত্রীরা ক্যাম্পাসকে তাঁদের জন্য সুরক্ষিত মনে করবেন কোন ভরসায়? উঠছে প্রশ্ন।
এর আগে ২০১৭ সালে এক ছাত্রী নিজের ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, “যদি তুমি এসআরএফটিআই-এর ছাত্রী হও, তোমাকে যৌন হেনস্থার শিকার হতে হবে, তোমাকে ধর্ষণের শিকার হতে হবে, এর থেকে বাঁচার কোনও পথ তোমার কাছে থাকবে না।… সমস্ত চেষ্টার পর অবশেষে আমি আমার জীবন শেষ করে দিতে চলেছি।“ (মূল পোস্ট ইংরেজি থেকে অনূদিত) আত্মহত্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার পর সেই ছাত্রী জানিয়েছিলেন কীভাবে তিনি দিনের পর দিন ধরে একটি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক জন অধ্যাপকের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। ২০১৫ সালে যৌন হেনস্থার অভিযোগে তিন জন ফ্যাকাল্টি সদস্যকে প্রথমে সাসপেন্ড ও পরে বহিষ্কার করা হয়। অভিযুক্তদের তালিকায় বাদ যায়নি ছাত্ররাও। ২০১৮ সালেও একাধিক অভিযোগ ওঠে। সে সময়েও ফ্যাকাল্টি সদস্য ও কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে অভিযোগকারীদের এই জাতীয় ঘটনা চেপে যাওয়ার জন্য বলা হয়। ৫টা বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এটাই বোঝায় যে, অবস্থা বিন্দুমাত্র বদলায়নি বরং নির্যাতনের মাত্রা আরও তীব্র হয়েছে।
পাশাপাশি ইউজিসি নির্দেশিত আইসিসি নিয়েও শিক্ষা এবং রাজনৈতিক মহলে রয়েছে একাধিক বিতর্ক। অনেকেই মনে করেন আইসিসি শিক্ষা ক্ষেত্রে ঘটে চলা যৌন নির্যাতনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে সামাল দেওয়া এবং সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট নয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জিএসক্যাশ (জেন্ডার সেনসেটাইজেশন কমিটি এগেন্সট সেক্সচুয়াল হ্যারাসমেন্ট) গঠনের দাবি আজও উঠছে। দেশের তথাকথিত এলিট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম এসআরএফটিআই-তেই যদি নির্যাতনের মাত্রা এইরকম হয়, তাহলে তথাকথিত ‘পিছিয়ে থাকা’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হেনস্থা, বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের মাত্রা সহজেই অনুমেয়। প্রতিষ্ঠানের ‘মাথারা’ বিষয়টিকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন? আদৌ দিচ্ছেন কি? দীর্ঘদিন ধরে সরকার এ ব্যাপারে চুপ কেন? এ প্রশ্নগুলো রয়েই গেল।
ছবি : অনিমেষ দত্ত।