জলবায়ু-সংকট, প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলন একটি সার্বিক-রাজনৈতিক আন্দোলন। পুরোনো রাজনীতির চশমা চোখে লাগিয়ে এই আন্দোলনকে গড়ে তোলা যাবে না। সবার আগে ওই পুরোনো চিন্তাগুলি, যেগুলো রাজনৈতিক পিতৃপুরুষের সম্পত্তির মত আগলে বসে আছি, সেগুলোকে ‘সাবোটাজ’ করা জরুরি। ‘উন্নয়ন’-দর্শনের সর্বগ্রাসী মায়া-চিন্তায় নাশকতা ঘটানো দ্বিতীয় ধাপ। লিখলেন নন্দন মিত্র।
একটা কথা স্পষ্ট করে আজ ৫ জুন আমাদের বুঝে নেওয়া উচিত। প্রাণ-প্রকৃতির আজকের সংকট নির্দেশ করছে, আমাদের আগামী দিনের রাজনৈতিক-সামাজিক দর্শনের প্রধান অক্ষ কী হওয়া উচিত। এবং, প্রাণ-প্রকৃতিকে রক্ষার অর্থ শুধুমাত্র কর্পোরেট প্রকল্প বা রাষ্ট্রের পরিকল্পনার বিরোধিতা/প্রতিরোধ করা টুকুই না। ওটা জরুরি। কিন্তু ওটুকুই কাজ নয়। আসল কাজ সমাজ গঠনের। আসল কাজ সমাজের মধ্যে এই সক্রিয় রাজনীতিকে স্পষ্ট করে তোলা। ঠিক যেভাবে গ্রামসভার মধ্যে দিয়ে আদিবাসী মানুষেরা তাদের সংলগ্ন অরণ্যকে আপন করে পাচ্ছেন, সম্পর্কিত নীতি-নির্ধারণের জায়গায় ক্ষমতাবান হচ্ছেন এবং প্রাণ-প্রকৃতির রাজনীতিকে স্পষ্ট করে তোলার একটা পরিসর তৈরি হচ্ছে, সেভাবেই, বা আরও নানাবিধ ভাবে সমাজের প্রত্যেক স্তরে, প্রতিটি আন্দোলনের মধ্যে, পাড়ায়-পাড়ায় এ ধরনের গণসক্রিয়তার পরিসর আমাদের গড়ে তোলার চেষ্টা করে যেতে হবে।
৫ জুন উপলক্ষে লেখার একটা পরিচিত ছক তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রাণ-প্রকৃতির হাল আরও কতটা বিগড়ালো তা নিয়ে হাড় হিম করা সব তথ্যে ভারাক্রান্ত সে লেখা আদতে কোথাও গিয়ে পৌঁছচ্ছে না বহুদিনই হল। সমস্যা এই, যা তথ্য দিনের পর দিন উঠে আসছে এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত নানাবিধ বিজ্ঞানসম্মত অনুমান থেকে যে ভয়াবহ ইঙ্গিত উঠে আসছে, সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াও কাজের কথা নয়। বিস্তারিত জানা-বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু শুধু সেটুকুতেই সমস্যার গভীরে যাওয়া যায় না। উপরন্তু, আমাদের মত দেশের মানুষের গড় সচেতনতার নিরিখে, তথ্যের যথার্থ বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন জটিলতর এবং বিবিধ মাত্রার সমস্যায়ন। জনগ্রাহ্য পরিসরে সে-সব তথ্যকে তার স্ব-স্ব-গুরুত্বে হাজির করাটা নেহাত অ্যাকাডেমিক ব্যাপার নয়। রাজনৈতিক দর্শন ব্যতিরেকে তা করা যায় না। তবে কি না আমজনতা গবেষণা থেকে যত-না শেখে তার থেকে ঢের বেশি শেখে নিত্যদিনের জীবন-সংগ্রাম থেকে। এবং, গত কয়েক বছরের মধ্যেই জলবায়ু বিপর্যয় তথা প্রাণ-প্রকৃতির সংকট হুড়মুড় করে অ্যাকাডেমিক সেমিনার-ওয়ার্কশপ এবং পরিবেশ কর্মীদের একচেটিয়া ক্ষেত্র ছেড়ে আমজনতার ঘরে ঢুকে পড়েছে। ফলে, চাইলেও ‘প্রাণ-প্রকৃতির সংকট একটি সর্বৈব মিথ্যা’ জাতীয় গল্প বাজারে চলছে না। এই মুহুর্তে তাপপ্রবাহ-দীর্ণ পূর্ব-ভারতের প্রতিটি কোনায়, প্রত্যেক চায়ের ঠেকে শুধু এই অসহ্য গরম নিয়ে আলোচনা। স্মরণাতীত কালের মধ্যে এমন দিন যে লোকে চাক্ষুস করেনি তা নিয়ে কথাবার্তা চলছে। এমনকি ঠিক আগের বছরের গরমটাও এতটা বেশি ছিল কি না সে নিয়েও বাসে-ট্রামে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। ফলে, পরিবেশ কর্মীরা যেটা চাইছিলেন, প্রাণ-প্রকৃতির সংকট সাধারণ মানুষের চিন্তার বিষয় হয়ে উঠুক, বাস্তবে বেশ খানিক তা হয়ে উঠেছে। এক দিকে এসি-র দোকানে লম্বা-লাইন, ইএমআই-র ভরসায় নিতান্ত মধ্যবিত্তও যেখানে ভিড় জমিয়েছে রাতের ঘুমটা নিশ্চিত করতে। ঠিক অন্যদিকেই এই আলোচনাও চলছে যে এসি-র দাপটে কীভাবে ঘিঞ্জি-মহল্লায় তাপ আটকা পড়ে বা হিট ট্র্যাপড হয়ে গরম বাড়িয়ে তুলছে। পরিবেশ কর্মীরা ব্যর্থ হয়েছিলেন। প্রকৃতি নিজের নিয়মেই আমজনতাকে বেশ খানিক ওয়াকিবহাল ক’রে তুলতে পেরেছে। প্রশ্ন, এর পরের ধাপে কী পরিবেশ কর্মী তথা প্রকৃতি-সংবেদী সমাজ-রাজনৈতিক কর্মীরা সফল হবেন! সোজা কথায়, জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সচেতনতার পরের ধাপ কী হতে হবে? ফলে, ৫ জুন যদি কোনও প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতেই হয় তবে সেই প্রশ্ন হচ্ছে অতঃপর কী? ‘হোয়াট নেক্সট’?
‘এরপর কী?’ প্রশ্নটার উত্তর পেতে গেলে আসলে আগে কতগুলো বিষয়ের সমাধান করতে হয়। এমন বলছি না, সব প্রশ্নের সমাধান করে তবেই পরের ধাপ নির্ণয় করা যাবে। অমন জ্যামিতিক যুক্তিতে সমাজ-রূপান্তর হয় না, হয়নি কোনো কালেই। ফলে, বিভিন্ন প্রশ্নের খোঁজ একসাথেই হতে হতে যাবে। একটা একটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা। একটা জট খুললে অন্য আরও পাঁচটা জটও ছেড়ে যেতে পারে। আবার অন্য কোথাও নতুন জট পাকিয়ে যেতে পারে। কারণ, বাস্তবে পরিবর্তিত হতে হবে আমাদের এই সমাজকে, যা কি না একটিই সাধারণ সূত্রের অধীন নয় কোনও কালেই। ফলে, এর মধ্যে দিয়েই প্রথম প্রশ্নের দিকে এসে পড়া গেল। প্রাণ-প্রকৃতির সংকট রুখতে সমাজকে পরিবর্তিত/ রূপান্তরিত হতে হবে কেন? প্রাণ-প্রকৃতির সংকট সমাজের চিন্তার বিষয় না হয়ে উঠলে আপামর জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন তেমন অনুভূত হয় না। আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতি এবং তার পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রব্যবস্থা সে কারণেই এসব নিয়ে হল্লা মাচায় না। নিয়ম করে কিছু ক্লাইমেট কনফারেন্স হয়। কিছু লক্ষ্য ঠিক হয়। তারপর, সে লক্ষ্যগুলো নিয়ম করেই মানা হয় না। কারণ, বিশ্ববাজার এবং ব্যবসার ক্ষতি করে কিছু করতে রাষ্ট্র রাজি নয়। কর্পোরেট মুনাফা বৃদ্ধি এবং প্রকৃতি রক্ষা, এই দুই কাজ একসঙ্গে করা বর্তমান রাজনৈতিক অর্থনীতিতে সম্ভব নয়, এটা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় চিন্তানায়কেরা জানেন। ফলে, তারা বিশেষ এক ধরণের তথাকথিত সমাধানের দিকে সমাজকে ঠেলতেই থাকে, যেখানে দর্শক হয়ে বসে থাকা ছাড়া সমাজের বড় একটা দায় নেই। সে সমাধান কী? প্রযুক্তি-বিজ্ঞান-আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদির সাহায্যে প্রকৃতিকেই পুনরায় বদলে নেওয়া। বা বদলে যাওয়া প্রকৃতির নিরিখে বাসযোগ্যতার শর্তকে প্রযুক্তির সাহায্যে বদলে নিয়ে কোনওক্রমে টিকিয়ে রাখা। বায়ুমণ্ডলে কার্বন জমে জমে বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটছে, জলবায়ু বদলাচ্ছে, সুতরাং বাতাস থেকে কার্বন টেনে নেবার প্রযুক্তি বার কর। ইতিমধ্যেই জমে যাওয়া কার্বন বা অন্য গ্রিনহাউস গ্যাস নতুন কোথাও জমানোর জন্য কার্বন ভান্ডার বা সিঙ্ক তৈরি কর, যেমন গাছ, মাটি, জল। কিম্বা সবুজ শক্তি উৎপাদনের জন্য বিশাল ড্যাম বানাও, সোলার পার্ক তৈরি কর, উইন্ডমিল বা হাওয়াকল বসাও। যাকে বলে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং। এই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্ষতি তো হবেই না, উলটে তা পুষ্ট হবে। কারণ আগামী দিনে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং-ই মুনাফা কামানোর বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠবে।
অঙ্কের হিসেবে বিষয়টা কী দাঁড়াবে? একদিকে বাসযোগ্য পরিবেশ ক্রমশ সংকুচিত হবে, ফলে জলবায়ু আরও চরম ভাবাপন্ন হবে, এবং এরপর রাজনৈতিক অর্থনীতি (অর্থাৎ পুঁজি ও পুঁজিবাদ) ও রাষ্ট্রের মিলিজুলিতে তৈরি হওয়া জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং সেই চরম পরিবেশে বাস করার এবং বেঁচে থাকার পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করবে। ঠিক যেভাবে দুবাইতে চরম তাপপ্রবাহ ঠেকাতে ‘ক্লাউড-সিডিং’ হচ্ছে। প্রযুক্তি সৃষ্ট মেঘ দিয়ে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে সাময়িক সমস্যা নিরসনের চেষ্টা। কিম্বা কোথাও জিওডেসিক ডোমের ঘেরাটোপে পুরোপুরি কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি। এরকম অজস্র হতে পারে। অতএব, এখানে সমাজের বিশেষ কোনও ভূমিকা নেই। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৩/৪ ডিগ্রি বেড়ে গেলে, বহুজাতিক পুঁজিরাষ্ট্রের ‘কল্যাণকামী’ জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং যদি শান্তির বৃষ্টি ঝরাতে পারে তবে লোক বাঁচবে, নয়তো বাঁচবে না। পকেটে পয়সা থাকলে, এখন যেভাবে এসির দোকানে ছুটছে ভবিষ্যতে আরও আধুনিক কোনও প্রযুক্তির দোকানে ছুটবে, নয়তো স্রেফ জ্বলে-পুড়ে-স্রোতে-ভেসে-মরবে। ফলে, সমাজ ক্রেতা হয়ে উদ্ধার পেতে চাইছে না নির্মাতা হয়ে সেটা প্রথম নির্ণয়ের বস্তু। আমাদের যাবতীয় পরিবেশ কর্ম এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে দিয়ে ঠিক হবে।
সমাজ যদি নিষ্ক্রিয় না-থেকে ক্রমশ সক্রিয় হতে থাকে, অর্থাৎ তার গণ-সচেতনতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে নিজের নিয়মেই, ঠিক যেভাবে এখন তার একটা পূর্বশর্ত তৈরি হতে দেখছি চারপাশে, তখন সমাজের সক্রিয়তা বাজারের ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে ফেলার মত শক্তি জুটিয়ে নিতে পারে। ঠিক এখানেই বাজারের তথা পুঁজি-রাষ্ট্র যুগলবন্দির আপত্তি। ফলে ভবিষ্যতের জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং-কে লাভজনক করে তুলতে হলে, আজ তাকে আরেক ধরণের ইঞ্জিনিয়ারিং, যাকে বলা যেতে পারে সোস্যাল-ইঞ্জিনিয়ারিং, করে চলতে হয়। অর্থাৎ, সমাজ জুড়ে প্রকৃতি-পরিবেশ নিয়ে যে সক্রিয়তার পূর্বশর্ত পেকে উঠেছে তাকে নেহাতই পরিবেশকর্ম নামক একটি পরিচিত খোপের মধ্যে আত্মসাৎ করে নিতে হয়। কিছুতেই যাতে এই সক্রিয়তা ‘রাজনৈতিক’ না-হয়ে উঠতে পারে তার ব্যবস্থা সে প্রতিনিয়ত তার বিভিন্ন সংস্থা/এজেন্সি এবং যন্ত্রপাতি/ অ্যাপারেটাস মারফত সুনিশ্চিত করতে থাকে। ফলে প্রাণ-প্রকৃতির রাজনীতি আত্মীকৃত হয় তথাকথিত পরিবেশ রক্ষার রাজনীতিতে।
শেষ কথাটা নিয়ে গোল পাকবে নিশ্চিত। এক ঝলকে মনে হবে পরিবেশ রক্ষার রাজনীতির সমালোচনা হচ্ছে বা পুঁজি-রাষ্ট্রের স্বার্থবাহী রাজনীতির সঙ্গে তুলনা। একটু ভেঙে বলা যাক। কর্পোরেট পুঁজি এবং তাদের কালো টাকায় পোষা বড় বড় সবুজ/ গ্রিন এনজিও মারফত পরিবেশ রক্ষার এক ধরণের রাজনীতি বাজারে চালু আছে। এরা বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ‘উন্নয়নশীল’ দেশগুলোয় কর্পোরেটের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করবে না এমন সব ক্ষেত্র বা সেক্টরে বন্যপ্রাণ, অরণ্য ইত্যাদি বাঁচানো নিয়ে নানান প্রোজেক্ট চালায়। যেখানে রাষ্ট্র বা কর্পোরেট স্বার্থ মুখোমুখি এসে পড়বে সেখান থেকে নিজেদের সযত্নে বাঁচিয়ে রাখে। কিছু ক্ষেত্রে কর্পোরেট রাষ্ট্রের এজেন্ট হয়ে পরিবেশ-আন্দোলনে সমস্যা সৃষ্টি করে। এসব বিগ গ্রিন এনজিও বা তাদের পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন পুঁজি-রাষ্ট্র পক্ষের আন্দোলন। তাকে ন্যায্য কারণেই সন্দেহের চোখে দেখা উচিত। যে কোনও প্রকৃতি রক্ষার কার্যক্রম থেকে এদেরকে দূরে সরিয়ে রাখা উচিত। এবং এদের কর্পোরেট-বান্ধব চরিত্র নিয়ে বিশেষ সন্দেহ রাখারও ইদানীং কালে কোনও কারণ নেই। এই সব বড় এনজিও এবং এদের পৃষ্ঠপোষক বিশ্বব্যাঙ্ক, রাষ্ট্রপুঞ্জ, ইউনিসেফ ইত্যাদি সংস্থা কর্তৃক ‘কর্পোরেট স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে পরিবেশ রক্ষা’র নানাবিধ মডেল সারা পৃথিবীতে চালানো হয়। স্কুল থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-কাছারি থেকে ছাদ-বাগানে এসব মডেল শেখানো-পড়ানো হয়। এবং এর মধ্যে দিয়ে এক-ধরণের যান্ত্রিক প্রকৃতি-পরিবেশ বোধ শিশুকাল থেকে তৈরি করা হতে থাকে। ৫ জুন আসলে বিশ্ব জুড়ে এই যান্ত্রিক প্রকৃতি-পরিবেশ উদযাপনের দিন। এই যান্ত্রিক বোধই আগামী প্রজন্মকে প্রকৃতি চিন্তায় পঙ্গু এবং জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং জাতীয় প্রযুক্তি নির্ভর সমাধানে অভ্যস্ত করে তুলছে। ফলে, পাড়ায়-পাড়ায় অঞ্চলে-অঞ্চলে যে হাজারো পরিবেশ মঞ্চ দেখতে পাওয়া যায়, তারা এই যান্ত্রিক অসম্পূর্ণ অস্পষ্ট অসাড় এবং চেতনা-পঙ্গু বোধের দ্বারাই চালিত হচ্ছে। এইসব মঞ্চ বহু জায়গায় গাছ কাটার বিরুদ্ধে, পুকুর বোজানোর বিরুদ্ধে, দূষণের বিরুদ্ধে নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছে। লোকাল ছোট-বড়-মেজো-সেজো নেতার হুমকি, সিন্ডিকেটের চমকানি এসব সহ্য করেই তারা টিকে রয়েছে। কখনো কখনো ওজনে-আয়তনেও বেড়ে উঠছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা যাবে, না গণস্তরে উদ্যোগগুলি বিকশিত হতে পারছে, না অজস্র উদ্যোগ নিজেরাও মিলে যেতে পারছে। অথচ, আমরা দেখছি বাস্তবে সমাজে এক ধরণের চেতনা বিকশিত হচ্ছে উষ্ণায়নের ধাক্কাতেই। ফলে, মঞ্চগুলির বিকাশের সুযোগ তো এহেন সময়ে অপরিসীম। কিন্তু তেমনটা হতে দেখা যাচ্ছে না।
কর্পোরেট গ্রিন প্রসূত পরিবেশ রক্ষার মডেল ঠিক এই কাজটাই করে। জনগণের মধ্যে থাকা আন্দোলনকে ধারণ করে একটা মাত্রায় তাকে বেঁধে রেখে দেয়। এটাকে শুধু সেফটি ভাল্ভের মতো ভাবলেও হবে না। যে গণসচেতনতা জমা হয়েছে, তার বিকাশকে আটকে দিয়ে বিকৃতির পরিসরও তৈরি করে দেয়। ফলে বিভিন্ন নতুন পুরোনো মঞ্চ প্রবল সম্ভাবনায় জমাট বেঁধেও একটা মাত্রার পর বিকশিত হতে পারে না, আন্দোলনের পথে যেতে পারে না। এবং, তার সামগ্রিক চৈতন্য বিকাশের রাস্তাও আটকে যায়। মঞ্চ ভেতরে ভেতরে দুর্বল হতে থাকে, শেষ অবধি ৪/৫ জন পতাকা বাহকের সাপ্তাহিক সন্ধের আড্ডায় পরিণত হয়। এই অভিজ্ঞতা যে কোনও সামাজিক আন্দোলনের মঞ্চ নিয়েই সত্য। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে অন্য একটি যুক্তি হতে পারে যে, ইস্যু-ভিত্তিক মঞ্চের বাস্তব আন্দোলন সমাজে না-থাকলে তা দুর্বল হওয়াতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। এই যুক্তিটা পরিবেশ-প্রকৃতির মঞ্চ নিয়ে খাটে না। কারণ, এখানে তো সমাজের মধ্যের আন্দোলন দিন দিন বৃদ্ধি পাবার কথা!
এসবের বাইরেও আরেক ধরনের প্রত্যক্ষ পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলন আছে, যা অরণ্যাঞ্চলে, গ্রামে, উপকূলে, পাহাড়ে, বিবিধ বাস্তুতান্ত্রিক ভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলে সরাসরি কর্পোরেটের বিরুদ্ধে চলছে। এই আন্দোলনগুলি কোথাও স্থানীয় সরকারের বিরুদ্ধে, কোথাও কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, নিচ্ছে। ফলত পুলিশ-প্রশাসন, ভুয়ো-কেস থেকে অজস্র রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ণের মুখোমুখি হয়েই প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষার জন্যে লড়তে হচ্ছে। ভারতবর্ষের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় এই সংগ্রাম, আন্দোলনগুলি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে চলেছে। কর্পোরেট গ্রিনের যাবতীয় মিটিগেশন পলিসি বা জলবায়ু সমস্যাকে মিটিয়ে নেবার (পড়ুন, মিটমাট করে নেওয়া) নীতি অগ্রাহ্য করে দীর্ঘ দীর্ঘ দিন ধরে অত্যাচার, হুমকি, গ্রেপ্তারি, মিথ্যে কেসে ফাঁসানো এবং সর্বোপরি বিভিন্ন সময়ে পর্যুদস্ত, পরাজিত হয়েও তারা দাঁড়িয়ে আছে। কর্পোরেট গ্রিনের পরিবেশ মডেলের উল্টোদিকে এটাও এক ধরনের পরিবশ রক্ষার মডেল। পাঠকের মনে হতে পারে, পরিবেশ রক্ষার যে রাজনীতিকে সমালোচনা করার কথা বলা হচ্ছিল, তার মধ্যে প্রতিরোধের এই মডেলও কি পড়ছে? সোজা কথায়, বহুজাতিক কর্পোরেট পুঁজি এবং রাষ্ট্রের যৌথের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যে প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলন বিকশিত হচ্ছে তাকেও কি সমালোচনা করার কথা বলা হচ্ছে?
এক কথায় উত্তর হল, হ্যাঁ। তবে সমালোচনার অক্ষটি ভিন্ন। এর আগে আলোচিত পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন/ উদ্যোগগুলির ক্ষেত্রে মূল সমস্যা ছিল তাদের রাজনীতি নিয়ে। অর্থাৎ, প্রকৃতি ধ্বংসের মূল দায় যাদের ওপর বর্তায় তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভাবে স্পষ্ট এবং জোরালো অবস্থান তারা নিতে পারছে কিনা! যদি নিতে পারে, তবে তাদেরই তৈরি করা পরিবেশ রক্ষার কর্মসূচি নাকচ করে তারা বেরিয়ে আসতে পারছে কি না! এবং, সেই অবস্থানে টিকে থাকতে পারছে কি না! কিন্তু, বর্তমান আলোচ্য আন্দোলনগুলির ক্ষেত্রে সে সমস্যা সরাসরি নেই। তারা সরাসরিই প্রকৃতি ধ্বংসকারী কর্পোরেট এবং তার পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রের বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। অর্থাৎ, প্রাথমিক রাজনীতি স্পষ্ট হয়েছে। কিছু আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক ধরণের সমস্যা হয় দ্বিতীয় ধাপে। অর্থাৎ, যেখানে আন্দোলনের মূল দাবি নির্ধারণ করতে হয়। কর্পোরেট বা রাষ্ট্রের দরাদরি করতে তখনই সুবিধে হয় যখন আন্দোলনের দাবির মধ্যে অর্থনীতি লুকিয়ে থাকে। অর্থাৎ, কোনও ভাবে যদি প্রাণ-প্রকৃতির ধ্বংসে জমির প্রশ্ন, বা হারিয়ে যাওয়া জীবিকার প্রশ্ন ইত্যাদি প্রধান হয়ে ওঠে তখন তাদের পক্ষে সুবিধে হয় দরকষাকষির মাধ্যমে মিটমাট করে ফেলতে। সহজে না-হলেও গায়ের জোরে, আন্দোলনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, আইন-আদালতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে বাস্তব আন্দোলনকে মিটিয়ে ফেলা যায়। আর প্রকৃতির ক্ষতি মেটানোর জন্যে ঢপের অফসেটিং তত্ত্ব তো আছেই। পুরুলিয়ায় পুরো জঙ্গল কেটে জলপাইগুড়িতে চাড্ডি গাছ লাগানোর মতো। কিম্বা ক্যাম্পা বা কম্পেন্সেটরি অ্যাফরেস্টশন প্রকল্প মারফত কাটা জঙ্গলের দাম বাবদ প্রচুর পরিমাণ পয়সা রাষ্ট্রের কাছে জমা করা। ফলে, কর্পোরেট প্রকল্পের বিরুদ্ধে শিনা টান করে দাঁড়িয়ে থাকা আন্দোলনকেও অর্থনৈতিক দাবির প্রাধান্যে পুঁজি-রাষ্ট্র যৌথের খোপেই ঢুকে যেতে দেখা যায়। পুঁজি-রাষ্ট্র যৌথের সমস্যা তখনই হয় যখন সে রাজনৈতিক অর্থনীতির মানদণ্ডে আন্দোলনকে বেঁধে ফেলতে পারে না। ধরুণ, গঙ্গা বাঁচানোর জন্য আন্দোলন হচ্ছে, বা যশোর রোডের গাছ বাঁচানোর আন্দোলঞ—এখানে আন্দোলনকারীদের সরাসরি কোনও অর্থনৈতিক যোগ নেই আন্দোলনের দাবির সঙ্গে। ফলে, আন্দোলনটি কোনও আশু দাবির মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলা যায় না। এই ধরনের আন্দোলন তাই চরিত্রগত ভাবে অনেক বেশি আদর্শনৈতিক এবং রাজনৈতিক। মুশকিল হল, সে কারণেই এখানে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তের ভিড় কম। ফলে, আন্দোলনের জোরও কম। খানিক বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত। যেখানে জমি-জীবন-জীবিকার প্রশ্ন সরাসরি জড়িত সেখানে আন্দোলনের শক্তি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু আন্দোলনের দাবি আশু অর্থনৈতিক চরিত্রকে অতিক্রম করে বিস্তৃত না হতে পারলে তার রাজনীতি রাষ্ট্রিক রাজনীতির পরিসরকে পেরিয়ে যেতে পারে না। ফলে আন্দোলনের ভেতরে ইকোনমিক হিটম্যানরা ঢুকতে শুরু করে এবং বাইরেটা প্রশাসনিক শক্তি ঘিরে ফেলতে থাকে। এভাবেই আন্দোলনগুলো আটকে পড়ে বা সে সম্ভাবনা জোরালো হয়।
ভারতবর্ষের অরণ্যাঞ্চলে প্রকৃতি রক্ষার যে সব আন্দোলন চলছে সেগুলোর অধিকাংশকে যে পুঁজি-রাষ্ট্র যৌথের রাজনৈতিক খোপে গিলে ফেলা যায়নি, তার কারণ সম্ভবত আদিবাসী মানুষের জীবন-সংস্কৃতি। যে জীবন-সংস্কৃতিতে অরণ্য শুধুমাত্র আশু অর্থনীতির মধ্যেই জড়িয়ে নেই। জড়িয়ে আছে কৌম-সংস্কৃতিতে, সমাজ, ইতিহাস এমনকি ব্যক্তি চেতনাতেও। ফলে জমির হিসেবে সব জায়গায় ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা যায় না। বা এক-দু’জনের জীবিকার সুযোগ করে দিয়ে কৌম-জীবনের যৌথ হিসেবনিকেশ উলটে দেওয়া যায় না। তাদের জীবনবোধ এবং সমাজবোধ প্রাণ-প্রকৃতিকে তাদের রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান অক্ষ করে রেখেছে এখনও। অর্থাৎ বলা চলে, এক ধরনের অলিখিত প্রাণ-প্রকৃতির রাজনীতি আন্দোলনকারী সকলের মধ্যে, তাদের সমাজ-বোধের মধ্যে, জীবন-জীবিকা থেকে রাষ্ট্র-পুঁজিকে বোঝার মধ্যে বিদ্যমান। যেটা বাকি সমাজ থেকে হারিয়ে গিয়েছে কারণ বাকি সমাজের যাপনের মধ্যে প্রাণ-প্রকৃতি প্রত্যক্ষত জড়িয়ে নেই। সে নিয়মগিরিই হোক বা অযোধ্যার পাহাড় বাঁচানোর আন্দোলন, সব ক্ষেত্রেই দেখা যাবে আশু অর্থনীতি ছাপিয়ে আন্দোলন বিকশিত হয়েছে। কিন্তু শুধু বিকশিত হলেই তো হবে না। অলিখিত প্রাণ-প্রকৃতির রাজনীতিকে মূর্ত করে তুলতে হবে কর্পোরেট-রাষ্ট্র যৌথের সামনে, সর্বোপরি বাকি নগর-গ্রামবাসী সমাজের সামনেও।
২০০৬-এর বনাধিকার আইন রাষ্ট্রিক আধারেই সেই রাজনীতিকে স্পষ্ট করে তোলার এক ধরনের ক্ষমতা দিয়েছে ভারতবর্ষের অরণ্যগ্রামবাসী মানুষদের সামনে। যার মধ্যে দিয়ে অরণ্যগ্রামে এক ধরনের যৌথ নিয়ন্ত্রণ, নীতি-নির্ধারণ এবং যুথবদ্ধ রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সুযোগ অরণ্যগ্রামবাসী মানুষেরা খাতায়-কলমে পেয়েছেন। কিন্তু বাস্তবত আইন চালু হয়নি অধিকাংশ জায়গাতেই। বরং রাষ্ট্রের সরকারি শাসকেরা এই আইন অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করেছে। যেখানে যেখানে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বনাধিকার আইন মোতাবেক গ্রামসভা ইত্যাদি গঠনের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, সেখানে বাধা সৃষ্টি করেছে। এই আইন বাস্তবে যে প্রাণ-প্রকৃতির রাজনীতিকে অন্তত রাষ্ট্রিক স্তরে হলেও, রাষ্ট্র-পুঁজির এক্তিয়ারের বাইরে স্পষ্ট করে তুলতে পারে বা পারছে তা বুঝেই বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকেরা বিভিন্ন অরণ্য আইনের বদল এনে ‘বনাধিকার আইন ২০০৬’-কে একরকম অকার্যকরী করে তোলায় সচেষ্ট হয়েছে।
আসলে পরিবেশ রক্ষার চালু রাজনীতি দিয়ে আজ আর চলবে না। আমাদের রাজনীতির অক্ষকেই প্রাণ-প্রকৃতির রাজনীতি হয়ে উঠতে হবে এক রকম ভাবে। নচেৎ, পরিবেশ-রক্ষার রাজনীতি দিনের শেষে কর্পোরেট-রাষ্ট্রের যৌথের ‘উন্নয়ন’ রাজনীতির বিরোধী-ভাষ্য হয়েই টিকে থাকবে। ‘উন্নয়ন’ রাজনীতির সর্বগ্রাসী চৈতন্যকে অতিক্রম করতে পারবে না। পারছেও না। কারণ, এ-যাবৎ মানুষের ইতিহাসে এই দার্শনিক বিশেষত্বে সমাজের বিবর্তনকে বোঝা হয়নি। সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে পৌঁছনোর যে বাস্তব শর্ত উপস্থিত হয়েছিল তা অর্থনৈতিক ভাবে, সামাজিক ভাবে, দার্শনিক ও রাজনৈতিক ভাবে প্রকট হবার মধ্যে দিয়ে হয়েছে। পুঁজিবাদ-উত্তর সমাজে পৌঁছানোর শর্তটা আমরা মোদ্দায় বুঝেছিলাম, শুধু সামাজিক উৎপাদন হলেই হবে না, উৎপাদনের সামাজিক মালিকানা হতে হবে। এ বিশ্বের মেহনতি শিল্প-শ্রমিকশ্রেণির হাত ধরে সামাজিক উৎপাদন সমাজে মুক্ত হবে। উৎপাদনের ওপর চেপে বসে থাকা যাবতীয় মুনাফার শর্ত লোপ পাবে, ইত্যাদি। নতুন সমাজমুখী রাজনীতির সোভিয়েত, চীন অনুপ্রাণিত নানাবিধ মডেল শেষত ‘পুঁজি-রাষ্ট্র’ নির্মিত যে চৈতন্য তাকে অতিক্রম করতে পারেনি। বরং, দিনবদলের রাজনীতি ওই সর্বগ্রাসী চৈতন্যেই এক রকমের অধিকৃত হয়েছে। সেটা কেন হয়েছে, কী হয়েছে ভিন্ন প্রশ্ন। এ লেখায় সে আলোচনার সুযোগ নেই। জলবায়ুর সংকট ক্রমশ যে দিকে মোড় নিয়ে ফেলেছে তা থেকে এটুকু বোঝা যাচ্ছে, মোদ্দায় যে নতুন সমাজের কল্পনা এতকাল করে আসা হয়েছিল তা যথেষ্ট নয়। অর্থাৎ উৎপাদনের সামাজিক মালিকানা সৃষ্টি হলেই প্রাণ-প্রকৃতির সংকট থেমে যাবে না। তেমন হলে, সাময়িক গতি কমতে পারে বড়জোর, যেহেতু অপ্রয়োজনীয় উৎপাদনের বহর কমবে। বা প্রকৃতিকে আত্মসাৎ করে রাজস্ব আদায়ের প্রবণতা কমবে। ধরে নেওয়া যেতে পারে কমবে। কিন্তু বাস্তব সমস্যা আরও গভীরে। আজ যে মানুষেরা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে প্রাণ-প্রকৃতির বর্তমান অবস্থা প্রত্যক্ষ করছেন বা আগামী দিনে পানীয় জল না পেয়ে আরও গভীর ভাবে প্রত্যক্ষ করবেন, কর্পোরেট-স্বার্থকে আরও স্পষ্ট করে চিনতে পারবেন, হয়তো কর্পোরেটের বিরুদ্ধে বৃহত্তর গণআন্দোলনে ফেটে পড়ার মত শক্তিও জুটিয়ে ফেলবেন, তার পরেও প্রাণ-প্রকৃতির রাজনীতি স্পষ্ট হয়ে উঠবে না। কারণ, পুঁজিবাদ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নয়। তা প্রকৃতিতন্ত্রও বটে। অর্থাৎ, মানুষে-মানুষে, রাষ্ট্রে-মানুষে, কোম্পানি-মানুষে সামাজিক-অর্থনৈতিক যোগটুকু নির্ধারণ করতে চেয়েই সে থামে না, আর বাকি প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিটি মানুষের ব্যবহার মূল্য কেন্দ্রিক বিনিময় মূল্যের নীতিটিও নির্ধারণ করে। আদিবাসী সমাজের একাংশের দীর্ঘকালের জীবনবোধ তাকে এখনও প্রকৃতি-মানুষ ঐক্যের চোখ দিয়ে আন্দোলনের যৌথ-পরিসরে দেখতে বুঝতে সাহায্য করছে। অথচ ব্যক্তি পরিসরেই হয়তো দেখা যাবে সর্বগ্রাসী পুঁজি-চৈতন্য তার মোবাইল ফোনের ফ্রি-ডেটা দিয়ে আত্মসাৎ করে ফেলতে চাইছে যৌথচেতনার রান্নাঘরটিকে। নগর পরিসরে এর রূপ আরও মারাত্মক ও ভয়াবহ। যে ‘উন্নয়ন’-এর ধামাকায় গত ৭০ বছরে প্রকৃতির এই সাড়ে-সব্বোনাশ হয়ে গেল, আসলে নগরের ক্রমশ সক্রিয় হতে থাকা জনতা আরেক কোনও ‘উন্নয়ন’ দিয়েই তার সমাধান করে ফেলতে চায়। পুঁজি-রাষ্ট্র যুগ্মের ‘উন্নয়ন’-দর্শন সোভিয়েত-উত্তর পৃথিবীতে এমন এক মায়া-সত্যের জন্ম দিয়েছে যাকে অতিক্রম করে জালের ওপাশের রাজাকে দেখাও যায় না। এমনকি গলাও শোনা যায় না। যাবতীয় মানবিক গুণাবলী এবং সামাজিক যৌথের ঐতিহ্যকে ধ্বস্ত করে এই দর্শন অর্থনীতির মানদণ্ডকে সমাজের প্রতি ক্ষেত্রে সার্বিকএনরে তুলেছে। সর্বগ্রাসী ভোগকে মানবিক গুণে রূপান্তরিত করতে পেরেছে। সমাজের সংবেদকে আপাত উৎসাহ যুগিয়ে সমাজমাধ্যমের দেওয়ালে আত্মপ্রেমের দলিলে আত্মসাৎ করতে পেরেছে। সমাজকে এক স্ব-হীন, নিষ্ক্রিয়, বিচ্ছিন্ন, ব্যক্তিসর্বস্ব ভিড়ে পরিণত করতে পেরেছে। এমন সমাজ যখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই ৫ জুনের মিছিলে জড়ো হয়, তার ক্ষণস্থায়ী সংবেদ স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। মগজের ভিতরে থাকা ওই ‘উন্নয়ন’-দর্শন, ওই ‘মায়া-সত্য’টি তাকে স্বাধীন উদ্যোগ নেওয়া থেকে বিরত করতে চায়। ওই মায়া-সত্যে আটকে পড়া কোনও একটি রাজনৈতিক দর্শনের অনুবর্তী হয়েই তার যাবতীয় সক্রিয়তাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। বাস্তবে কিন্তু সে সত্যিই পরিবেশ-রক্ষার রাজনীতিতে সামিল, কিন্তু প্রাণ-প্রকৃতির সংকট মুক্ত এক নতুন সমাজের দিকে এক পা-ও এগোনো যাচ্ছে না।
অথচ, তার ভেতরের চাহিদা কিন্তু নতুন এক সমাজে মুক্ত হবার যেখানে প্রাণ-প্রকৃতির সংকট নেই। তেমন এক সমাজ তখনই হতে পারে যখন খোলনলচে বদলে, মায়া-সত্য ভেঙে মানুষ প্রজাতি হিসেবে প্রকৃতিলগ্ন এক জীবনবোধের মধ্যে দিয়ে নিজের সামাজিক, কৌম অস্তিত্বকে ফিরে পেয়েছে। প্রাণ-প্রকৃতির আঘাত গুলো সারাতে সেখানে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সব কিছুই ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু সবার আগে মানুষের এযাবৎ কালের সমাজ-রাজনৈতিক দর্শনের আমূল বদল ঘটিয়ে তার যৌথচেতনাকে প্রকৃতিলগ্ন হতে হবে। আজকের প্রতিটা আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই এই পথে যাবার চেষ্টা করতে আমাদের হবে। তবেই তো অস্পষ্ট চিন্তা দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে উঠবে। পরিবেশ রক্ষার রাজনীতি থেকে প্রাণ-প্রকৃতির রাজনীতিতে উত্তরণের চেষ্টা ছাড়া মায়া-সত্যের অন্ধ প্রাচীরে বারংবার ধাক্কা খাওয়াই আমাদের ভবিতব্য। এর মধ্যে এ শতাব্দ শেষ হতে হতে পৃথিবীর তাপমাত্রায় অন্তত ২ ডিগ্রি বৃদ্ধি তো অবশ্যম্ভাবী। ফলে, পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী ভেবে বসে থাকার মতো বিলাসিতার বিশেষ সুযোগ আমাদের নেই। একটা কথা স্পষ্ট করে আজ ৫ জুন আমাদের বুঝে নেওয়া উচিত। প্রাণ-প্রকৃতির আজকের সংকট নির্দেশ করছে, আমাদের আগামী দিনের রাজনৈতিক-সামাজিক দর্শনের প্রধান অক্ষ কী হওয়া উচিত। এবং, প্রাণ-প্রকৃতিকে রক্ষার অর্থ শুধুমাত্র কর্পোরেট প্রকল্প বা রাষ্ট্রের পরিকল্পনার বিরোধিতা/ প্রতিরোধ করা টুকুই না। ওটা জরুরি। কিন্তু ওটুকুই কাজ নয়। আসল কাজ সমাজ গঠনের। আসল কাজ সমাজের মধ্যে এই সক্রিয় রাজনীতিকে স্পষ্ট করে তোলা। ঠিক যেভাবে গ্রামসভার মধ্যে দিয়ে আদিবাসী মানুষেরা তাদের সংলগ্ন অরণ্যকে আপন করে পাচ্ছেন, সম্পর্কিত নীতি-নির্ধারণের জায়গায় ক্ষমতাবান হচ্ছেন এবং প্রাণ-প্রকৃতির রাজনীতিকে স্পষ্ট করে তোলার একটা পরিসর তৈরি হচ্ছে, সেভাবেই, বা আরও নানাবিধ ভাবে সমাজের প্রত্যেক স্তরে, প্রতিটি আন্দোলনের মধ্যে, পাড়ায়-পাড়ায় এ ধরনের গণসক্রিয়তার পরিসর আমাদের গড়ে তোলার চেষ্টা করে যেতে হবে। দাবিদাওয়া ভিত্তিক পরনির্ভরশীল আন্দোলনের থেকেও সমাজের অভ্যন্তরে গঠনমূলক আত্মশক্তিকে প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার কাজে সক্রিয় করে তোলার কাজে জোর দিতে হবে। তবেই তো ‘উন্নয়ন’ দর্শনের সঙ্গে, রাষ্ট্র-পুঁজি যুগ্মের ওপর নির্ভরশীলতার প্রশ্নে, ভোগের প্রশ্নে, সামাজিক ভাবে প্রকৃতি ও উৎপাদনকে ব্যবহারের প্রেক্ষিতে বাস্তব আলোচনা/ তর্ক/ বিতর্ক সমাজ থেকে উঠে আসবে। তবেই তো প্রকৃতি নিয়ে সংবেদনশীল তরুণ এসইজেড না-হওয়ায় চাকরি হল না বলে দুঃখ করবে না, সামগ্রিকভাবে নিজেকে প্রাণ-প্রকৃতি বনাম রাজনৈতিক অর্থনীতির দ্বন্দ্বে দেখতে পারবে। এই গণসক্রিয়তার নির্মানের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠতে পারে প্রকৃতিলগ্ন আগামী সমাজের রূপরেখা—জলবায়ুর সংকটকে যেখানে হয়তো আমরা অনেকটাই ঠেকিয়ে দিতে পারব। আমরা না-পারলেও হয়তো আমাদের আগামী প্রজন্ম পারবে।
শেষ করি একটা অন্য প্রসঙ্গ টেনে। সুইডিশ লেখক, অধ্যাপক ও জলবায়ু-সংকট চিন্তক আন্দ্রে মাম একটি বই লিখেছেন, ‘হাউ টু ব্লো আপ এ পাইপ লাইন’। বইতে উনি জলবায়ু-সংকট বিরোধী আন্দোলনগুলির অহিংস-রূপ’কে সমালোচনা করেছেন। মাম-এর মতে ‘সাবোতাজ’ জলবায়ু-কর্মকাণ্ডের একটি যৌক্তিকপন্থা হওয়া উচিত। ইতিহাস ছেনে পুরোনো আন্দোলনের শিক্ষা বিশ্লেষণ করে তিনি বর্তমানে জলবায়ু-আন্দোলনে ‘সর্বোতভাবে অহিংস’ পন্থাকে নাকচ করছেন। তাঁর এই বই নিয়ে একই নামে একটি সিনেমাও তৈরি হয়ে গেছে। যদিও মামের পন্থা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে, আবার তাঁর জলবায়ু-আন্দোলন সম্পর্কিত বিশ্লেষণ প্রশংসাও কুড়িয়েছে। কেউ কেউ তাঁকে ‘ইকো-টেরোরিজম’ প্রোমোট করতে চাইছেন বলে গালও দিয়েছে। ইওরোপে জলবায়ু-আন্দোলন বেশ অনেক দূর এগিয়েছে। সেখানের আন্দোলনে এসব তত্ত্ব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করার হয়তো খানিক অবসরও তৈরি হয়েছে আন্দোলনের নিজের গতিতেই। আমরা অনেক প্রাথমিক জায়গা নিয়ে কথা বলছি। মামের বইয়ের ভিত্তিতে নির্মিত সিনেমাটির শুরুর একটি দৃশ্যে দেখা যায় এক জন পরিবেশ কর্মী ছুরি নিয়ে একটি বড় দামি গাড়ির টায়ারগুলো কেটে দেয় এবং একটি লিফলেট গাড়ির বনেটে লাগিয়ে দেয় যায় হেডিং ‘হোয়াই আই সাবোটাজড ইওর প্রোপার্টি’! এই দৃশ্যটা দেখে ক্রমশ মনে হতে থাকে যে, এই তাপপ্রবাহই সমাজকে দু-ভাগে ভাগ করে দিল। যাদের এসি আছে আর যাদের নেই। এ বিভাজন আরও বাড়বে। সমাজের মধ্যের অর্থনৈতিক বৈষম্য বাসযোগ্য পরিবেশের বৈষম্যকেও তীব্র করে তুলবে। অথচ, সারা বিশ্বের নীচের তলার ১% মানুষ যতটা কার্বন নির্গমন করে তার ১০০০ গুণ বেশি কার্বন নির্গমন করে ওপরের তলার ১% মানুষ! ফলে, দিনের শেষে জলবায়ু-সংকট, প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলন একটি সার্বিক-রাজনৈতিক আন্দোলন। পুরোনো রাজনীতির চশমা চোখে লাগিয়ে এই আন্দোলনকে গড়ে তোলা যাবে না। সবার আগে ওই পুরোনো চিন্তাগুলি, যেগুলো রাজনৈতিক পিতৃপুরুষের সম্পত্তির মত আগলে বসে আছি, সেগুলোকে ‘সাবোটাজ’ করা জরুরি। ‘উন্নয়ন’-দর্শনের সর্বগ্রাসী মায়া-চিন্তায় নাশকতা ঘটানো দ্বিতীয় ধাপ।