খাদ্যশস্যের চাষ হোক, তামাক নয়


  • May 31, 2023
  • (0 Comments)
  • 688 Views

গ্রাউন্ডজিরোর প্রতিবেদন | তিথি রায়

 

৩১ মে ‘ওয়ার্ল্ড নো টোব্যাকো ডে’। ‘খাদ্যশষ্যের চাষ হোক, তামাক নয়’ — এই ভাবনা নিয়েই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এই বছরের ‘ওয়ার্ল্ড নো টোব্যাকো ডে’ পালনের আর্জি জানিয়েছে। তাঁদের এ হেন ভাবনার লক্ষ্য হল তামাক চাষীদের বিকল্প ফসল উৎপাদন ও তার বিপণন ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন করা। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য, তামাকের পরিবর্তে খাদ্যশস্যের চাষের ওপরেই তাঁরা জোর দিচ্ছেন।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত তথ্য বলছে, ভারতে মৃত্যু ও অসুস্থতার অন্যতম কারণ তামাক সেবন। শুধুমাত্র তামাক সেবনের জন্য এদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৩.৫ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। তামাক উৎপাদনের দিক থেকে সারা বিশ্বে প্রথমে রয়েছে চীন। আর তারপরেই ভারত। তামাক উৎপাদনই নয় তামাক সেবনেও ভারত দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে।

 

তামাক সেবন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক ২০০৩ সাল থেকে চালু করে সিগারেটস অ্যান্ড আদার টব্যাকো প্রোডাক্টস অ্যাক্ট (সিওটিপিএ) নামের আইন। আমাদের দেশে আইন থাকলেও, বাস্তবে বহু ক্ষেত্রেই তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত বিধি-নিষেধ মেনে চলা হয় না। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার নারী ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের সচিব, রহিমা খাতুন জানাচ্ছেন, “তামাক সেবনের কারণে ক্যান্সার হয়। হৃদযন্ত্রের সমস্যা তৈরি হয়, এবং শ্বাসকষ্ট ও শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা দেখা দেয়। এই অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অসুখ ও মৃত্যুর কারণে পরিবারগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” তাই এই ব্যাপারে দিল্লির উইমেন এন্ড চাইল্ড রাইটস অর্গানাইজেশন-এর সঙ্গে তারা একযোগে হাওড়া, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলায়,  তামাক বর্জন ও তামাক জাতীয় দ্রব্যের বিক্রি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। তঁদের প্রচারাভিযানের প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতে তামাক ব্যবহারের কারণে প্রতিবছর প্রায় ১৩ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যান। এর মধ্যে সরাসরি ধূমপানের কারণে মারা যান দশ লাখ আর বাকিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন পরোক্ষভাবে। সেই কারণেই, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন আরও কার্যকরী করার জন্য তাঁরা প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে বারবার আবেদন জানাচ্ছেন। রহিমা খাতুনের কথায়, “আমরা সিওটিপিএ আইনের বেশ কিছু সংশোধন চাইছি। মূলত পাঁচটি সংশোধনের দাবি আমরা তুলেছি — (১) পাবলিক প্লেস যেমন বিমানবন্দর, হোটেল, রেঁস্তোরা ইত্যাদিকে তামাকমুক্ত করা ও তারজন্য সেখানে ‘স্মোকিং জোন’ নিষিদ্ধ করা (২) তামাক-দ্রব্য গ্রহণের বৈধ বয়স ১৮ থেকে ২১ বছর করা, (৩) খুচরো দোকানে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা, (৪) সিগারেটের খুচরো বিক্রি নিষিদ্ধ করা, এবং (৫) আইন লঙ্ঘনের জন্য জরিমানা বৃদ্ধি করা।”

 

নারী ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের যুব নেত্রী, নেহা পারভীনের কথায়, “প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা গত বছর আবেদন জানিয়েছিলাম। আবেদন গৃহীত হয়েছিল এবং সেই কারণেই এবছর বাজেটে তামাক জাতীয় দ্রব্যের উপর কর বাড়ানো হয়। এবারের ওয়ার্ল্ড নো টোব্যাকো ডে-র কথা মাথায় রেখে আমরা জনগণের স্বাক্ষর সংগ্রহ করছি। আমাদের  দাবি-দাওয়াগুলি নিয়ে ৫ হাজার স্বাক্ষর সংগ্রহ করাই আমাদের লক্ষ্য। এছাড়া, আমরা একটি কিশোর-কিশোরীদের দল তৈরি করেছি যারা তামাক ব্যবহারের খারাপ দিকগুলি নিয়ে সমাজ মাধ্যমেও অনবরত প্রচার চালায়।”

“তামাক-দ্রব্য তৈরি অর্থাৎ বিড়ি তৈরির কাজ যাঁরা করেন তাঁদের মধ্যে তামাকের কারণে ক্ষতির বিষয়ে যখন প্রচার চালাই তখন তাদের কাছ থেকে একটি প্রশ্ন উঠে আসে — বিড়ি তৈরির কাজ ছাড়া তাঁরা কীভাবে রোজগার করবেন?” – এ কথা জানাচ্ছেন নারী ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের বীরভূম শাখার কর্মী সুমনা মজুমদার। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে তামাক নিয়ন্ত্রণ বা বর্জনের সঙ্গে এই ব্যবস্থায় জড়িয়ে থাকা শ্রমিকদের রুজি-রোজগারের প্রশ্ন উঠে আসছে। সুমনা আরও জানাচ্ছেন, “শ্রমিকদের বিকল্প জীবিকার চেষ্টাও আমরা করছি। সবটা যে পেরেছি এমন নয়। তবুও, তাদের এমব্রয়ডারি, ট্রেলারিং-এর কাজ, এছাড়াও হাঁস-মুরগি প্রতিপালন, ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র মেরামতির কাজে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে সরকারি প্রকল্পগুলির সহায়তা যাতে তাঁরা পান সেই সন্ধান চালাচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র ও অন্যান্য কৃষি-সংক্রান্ত প্রকল্পগুলির সহায়তায় যাতে তাঁদের সবজি চাষের দিকে ঝোঁক তৈরি করা যায়।”

 

অন্যদিকে, তামাক সেবনের ফলে ক্ষতির পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে উঠে আসছে তামাক চাষের ফলে চাষযোগ্য জমি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। তথ্য জানাচ্ছে, প্রতি বছর পৃথিবী জুড়ে নতুন করে  প্রায় ৩৫ লক্ষ হেক্টর জমি তামাক উৎপাদনের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তামাক চাষের মূল সমস্যা হল — যে জমিতে একবার তামাক চাষ করা হয় সেখানে মাটি এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার জন্য অন্য কোন ফসল চাষ করা সম্ভব হয়না। কার্যত, তামাক অর্থকরী ফসল হলেও, তামাক চাষের ফলে  স্থায়ীভাবে জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। তামাক চাষ কমাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সরকারি পদক্ষেপ এবং নীতি নির্ধারকদের ভূমিকাকেই বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারত সহ বিভিন্ন দেশে তামাক চাষী, তামাক জাতীয় দ্রব্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক এবং তামাক বিক্রেতাদের বিকল্প জীবিকার পরিকাঠামো তৈরি জোরদার করতে চাইছেন তারা।

 

Share this
Leave a Comment