গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন : অনিমেষ দত্ত
কলকাতার রামলীলা ময়দান থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত কয়েকশো পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে মিছিলে হাঁটলেন বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন, চিকিৎসক সংগঠনের কর্মী এবং ছাত্রছাত্রীরা। মিছিল শেষে দিনভর প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হল ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে। তাঁদের অভিযোগ, সরকারি ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত শ্রমিকেরা এবং মৃত শ্রমিকদের পরিবার। ২৪ মে, বুধবার এই প্রতিবাদ মিছিল আয়োজিত হয়।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার গোয়ালদহ অঞ্চল থেকে ২০০৭-২০১২ সালের মধ্যে বহু তরুণ পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজে যুক্ত হন বীরভূম, আসানসোলের বিভিন্ন পাথর খাদানে ও পাথর ভাঙা কারখানায়। উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁ ব্লক থেকেও পরিযায়ী শ্রমিকদের যাওয়া শুরু হয় পাথর শিল্পে কাজ করতে। আর এই শ্রমিকদের বেশিরভাগই আজ সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত। অনেকে এই কয়েক বছরে মারাও গিয়েছেন। গোয়ালদহ থেকে আসানসোলে কাজ করতে যাওয়া এক পরিযায়ী শ্রমিক বলেন, “আমরা পাথর গুঁড়ো করার কাজ করতাম। আমার বড় ভাই বাড়ি ফিরে আসার পর জানতে পারি সে টিবি রোগে আক্রান্ত (টিউবারকিউলোসিস)। তখনও আমরা জানতাম না এই সিলিকোসিস বলে কোনও রোগ হয়। টিবির জন্য যা যা চিকিৎসা করার দরকার সব করানো হলেও আমার বড়ভাই আর বাঁচেনি। এরপর আমরা আন্দোলন করি ২০১৩ সাল নাগাদ। তারপর আমরা জানতে পারি আমরা সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত। আমরা জানার পর সেখান থেকে পালিয়ে আসি।” তিনি আরও বলেন, “আমরা গোয়ালদহতে একটি সেবাকেন্দ্র বানিয়েছি চাঁদা তুলে। আমাদের গ্রামের প্রায় ৩০০ সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকদের যখনই অক্সিজেন এবং অন্যান্য পরিষেবার প্রয়োজন হয় আমরা সেই সেবাকেন্দ্রর মাধ্যমে তা পৌঁছে দিই। এই কাজটা করার কথা ছিল সরকারের, কিন্তু সরকার উদাসীন।”
আসানসোলে কাজ করা আরেক পরিযায়ী শ্রমিক ভাঙড় ১ নং ব্লকের বাসিন্দা রেজ্জাক গাজি বলেন, “কাজটা এতটাই খারাপ, আমরা জানতাম না। অভাবের তাড়নায় আমরা ছয় ভাই গিয়েছিলাম। কারখানা থেকে আমাদের ছাড়েনি, আমরা পালিয়ে এসেছি। আমাদের অনেক বকেয়া টাকাও ছিল, যা আমরা পাইনি। শ্বাসকষ্টে আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। এখন আমার কোনও কাজ নেই।”
মিছিলে এসেছিলেন গোয়ালদহের দেবীতলার বাসিন্দা আজমিরা বিবি। আসানসোলে কাজ করতে গিয়ে ওঁর স্বামী সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হন। অসুস্থতার কারণে মিছিলে আসতে পারেননি। আজমিরা বিবি বলেন, “শাড়িতে পুঁতি বসানোর কাজ করে কোনও রকমে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে। স্বামীর সিলিকোসিসের জন্য শ্বাসকষ্টের সমস্যা, সংসারটা তো চালাতে হবে, তাই মাঝে মাঝে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে যায়। দমের কষ্ট হয় বলে আর ওই কাজে যেতে দিইনি। সরকার থেকে দু’লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা, সেসব কিছুই পাইনি। বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্যও কোনো সাহায্য পাই না।” দেবীতলার বাসিন্দা মানোয়ারা বিবির স্বামী মারা যান ২০১৩ সালে সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে। তিনি জানান, “আমার ছেলে তখন তিনমাস কোলে, স্বামী মারা যান। তখনও জানতাম না এই রোগের কথা। এখন এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার, শাড়িতে পুঁতি বসানোর কাজ করে কোনও রকমে চালাচ্ছি। সরকার থেকে কোনও ক্ষতিপূরণ পাইনি। এমনকি সার্টিফিকেটে সিলিকোসিস রোগে মারা গেছেন সেটাও লিখে দেয়নি ডাক্তাররা।”
রোগটি কীভাবে হয়? শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের ডাক্তার সুজয় বালা বলেন, “ধুলোবালির কণা ইট ভাটা, পাথর খাদান থেকে আসতে পারে। সেই কণাগুলি খুব ছোট আকারের হয়। আর এগুলি যদি আমাদের ফুসফুসে নিঃশ্বাসের সঙ্গে সরাসরি প্রবেশ করে, তা ধীরে ধীরে আমাদের শরীরের সঙ্গে মিশে গিয়ে বিক্রিয়া সৃষ্টি করে যা আমাদের ডাক্তারি ভাষায় ‘ফাইব্রোসিস’। আমাদের ফুসফুস খুব নরম একটা জিনিস, সেটা তখন শক্ত হয়ে যায়। আর শক্ত হয়ে গেলে আমরা যখন নিশ্বাস নেব তখন ফুসফুস ছড়াতে পারবে না৷ ফলে ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকবে। সিলিকোসিস একটা ‘প্রোগ্রেসিভ ডিজিজ’।” সিলিকোসিস রোগের কোনও চিকিৎসা সম্ভব? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “একদম শুরুতে যদি আটকানো না যায় তারপরে আর তেমন কিছু করার থাকে না। প্রথমে শ্রমিকেরা এটা বুঝতে পারেন না। আর যদি বুঝতে পেরে কাজটি ছেড়েও দেন, তারপরও রোগটি থেকে যায় এবং বাড়তে থাকে। এটার কোনও চিকিৎসা নেই। হয়তো যে রোগী ছয় মাসে মারা যাবেন, তাকে অক্সিজেন ইত্যাদি দিয়ে হয়তো আরও এক বছর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।”
এখনও অবধি পশ্চিমবঙ্গে সরকারি তথ্য অনুযায়ী সিলিকোসিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মাত্র ৫৩ জন। যেখানে রাজস্থান ও হরিয়ানায় সংখ্যাটা হাজারেরও বেশি। এই কয়েক বছরের মধ্যে শুধুমাত্র গোয়ালদহতেই প্রায় ৩০ জন সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি থাকলে তবেই বিনামূল্যে অক্সিজেন এবং অন্যান্য পরিষেবা পাওয়া যাবে। বাড়িতে হলে অক্সিজেন সিলিন্ডারের খরচ নিজেদের বহন করতে হবে। এক একটা সিলিন্ডার কাজ করতে সক্ষম ১২ ঘণ্টার মতো, যার বর্তমান বাজার মূল্য ৭০০ টাকা। সরকারি হাসপাতালে সিলিকোসিস রোগী চিহ্নিতকরণেই রয়েছে ঘাটতি, দাবি সংগঠনের। শ্রমিক সংগঠক বর্ণব বলেন, “২০১৬-১৭ সাল নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে একটি সার্ভে করা হয়েছিল, যেখানে ৩২টি ব্লকে প্রায় ৬ লক্ষ সিলিকোসিস আক্রান্তদের চিহ্নিত করা হয়েছিল, মৃত্যুহার ৪০%। কিন্তু অদ্ভুতভাবেই আদালতে সেই তথ্য অস্বীকার করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তারপর তারা আবার সার্ভে করার কথা জানালেও এখনও অবধি কোনও সার্ভে হয়নি।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ কারোর সিলিকোসিস হলে সরকারি হাসপাতালে কোনও ডাক্তারই সিলিকোসিস লিখতে রাজি নয়। ডাক্তার বালা বলেন, “প্রথমত সিলিকোসিস ডায়াগনোসিস করতে হয় ছবি করে, সিটি স্ক্যান হলে ভালো। সরকার খরচ বাচানোর জন্য ডিজিটাল এক্স-রে করতে বলে। এই ডিজিটাল এক্স-রে বা সিটিস্ক্যান যাই করি সেক্ষেত্রে যে ছবি আমরা দেখতে পাই, সেই একই ধরনের ছবি আমরা দেখতে পাই অন্যান্য অনেকগুলি রোগের ক্ষেত্রেও। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে যেমন টিউবারকিউলোসিস ও সিলিকোসিসের মধ্যে পার্থক্য একমাত্র রোগীর ইতিহাস দিয়ে করা সম্ভব। রোগী যদি পাথরশিল্পে কাজ করে থাকেন তবে তার সিলিকোসিস হয়েছে। সিলিকোসিস পেশাগত রোগ। পেশাগত রোগ মানেই সরকারকে ফ্যাক্টরি আইনে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু, সরকার যতক্ষণ না বলছে, ততক্ষণ কোনও ডাক্তার সিলিকোসিস লিখতে পারবেন না। সরকারের নিয়োজিত কিছু ডাক্তার আছেন, শুধুমাত্র তাঁরাই সিলিকোসিস লিখতে পারেন। যেকোনো ডাক্তার লিখলে তার কোনও গুরুত্ব নেই। ফলে এখানে প্রয়োজন সরকারের আরও বেশি করে হস্তক্ষেপ করার, কিন্তু হচ্ছে উল্টোটা। দ্বিতীয়ত রোগটা সম্পর্কে জানতে পারলে মানুষ আর কাজ করতে যাবেন না। কেউ মরতে যেতে চান না। তৃতীয়ত কাজের সময় সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে যাতে মালিকরা প্রোটেকটিভ গিয়ার বা যথাযথ সুরক্ষা যন্ত্র দেয়। কিন্তু সরকার সেই দায়িত্ব নিতেই চায় না।”
২০১২ থেকে লাগাতার আন্দোলনের ফলে গতবছর সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিপূরণ নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হলে রোগী দু’লক্ষ টাকা স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য ক্ষতিপূরণ পাবেন। মারা গেলে চার লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ। এমনকি রোগীর পরিবারকে মাসিক পেনশন হিসেবে সাড়ে তিন-চার হাজার টাকা করে দেওয়ার এবং বাচ্চার পড়াশোনার দায়িত্বও নেওয়ার কথা ঘোষণা হয়। কিন্তু আন্দোলনকারীদের অভিযোগ সরকার নিজের নীতিই মানছে না।
এদিনের মূল দাবিও ছিল সরকার যাতে আক্রান্তদের সঠিক ভাবে ক্ষতিপূরণ দেয়। সিলিকোসিস আক্রান্তদের সংগঠন এসএএসএসসি এবং সিটু, ইফটু- সহ বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন, চিকিৎসক সংগঠন, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ যৌথভাবে পশ্চিমবঙ্গের শ্রম দপ্তরে অতিরিক্ত সচিবের কাছে একটি স্মারকলিপি দেয়। ফ্যাক্টরিস অ্যাক্ট ১৯৪৮, মাইনস অ্যাক্ট ১৯৫২-সহ একাধিক আইনে রানিগঞ্জ, আসানসোল, দুর্গাপুরে পাথরশিল্পে কাজ করা শ্রমিকদের বেশ কিছু অধিকার দেওয়া আছে। কিন্তু বাস্তবত সরকার এবং মালিক সেই আইনের ধার ধারে না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন-এর নির্দেশে ২০১৭ সালে হরিয়ানাতে, ২০১৯ সালে রাজস্থানে এবং ২০২২ সালে পশ্চিমবঙ্গে আইন তৈরি হয়েছে সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য। রাজস্থান ও হরিয়ানাতেও সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণ পান। কিন্তু সিলিকোসিস রোগের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি কিংবা রোগ হিসেবে চিহ্নিতকরণেই যদি সরকারের এমন অবহেলা থাকে তাহলে শ্রমিকদের মৃত্যু আটকানো আদৌ সম্ভব হবে? আর ইতিমধ্যেই যারা আক্রান্ত হয়েছেন কিংবা মারা গেছেন তাদের ক্ষতিপূরণ সরকার কবে দেবে? প্রতিবাদ মিছিল থেকে উঠে এসেছে এমন বহু প্রশ্ন।