দুয়ারে সরকার শিবিরে বঞ্চিত কাজ, খাদ্য, সামাজিক সুরক্ষা : সমীক্ষা


  • May 9, 2023
  • (0 Comments)
  • 936 Views

গ্রাউন্ডজিরো রিপোর্ট: দেবাশিস আইচ

 

অশীতিপর বৃদ্ধ, হুগলির বৈঁচির আনন্দকুমার ঘোষ বার্ধক্য ভাতার জন্য আবেদন পত্র নিয়ে হাজির হয়েছিলেন পঞ্চম দুয়ারে সরকার শিবিরে। তাঁর আবেদন গৃহীতই হয়নি। এই প্রথম নয়, ২০২৩-এর আগে ২০২১ সালেও তিনি আবেদন জানিয়েছিলেন। মেলেনি ভাতা। কলকাতা প্রেস ক্লাবের ডায়াসে কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি তুলে ধরেছিলেন আবেদনের প্রমাণপত্র। আর জড়ানো গলায় বোঝাতে চাইছিলেন তাঁর অসহয়তা। সে দৃশ্যের ঝটপট ছবি হল।

 

আনন্দকুমারের সামান্য দু’আড়াই বিঘা জমি গিয়েছে ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রীর চিকিৎসায়। স্ত্রীকে হারিয়েছেন। বিবাহিত মেয়ে থাকে দূরে। একমাত্র ছেলে পাশেই থাকে। বৃদ্ধের আক্ষেপ সেই ছেলে বাবাকে দেখে না।

 

হাওড়ার সাঁকরাইলের রোজিনা মিদ্দ্যার স্বামী নিখোঁজ। তাঁর ছোট ছোট দুই সন্তান প্রতিবন্ধী। রোজিনার স্বাস্থ্যসাথী কার্ড রয়েছে। দুই সন্তানের প্রতিবন্ধকতার শংসাপত্র মিলেছে কিন্তু অভিযোগ প্রতিবন্ধকতা ‘৪০%’ হওয়ায় তেমন কোনও বিশেষ সুযোগ মেলে না। রোজিনা এবার গিয়েছিলেন তাঁর মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ভাইয়ের জন্য। যদি কোনও প্রকল্পের সুযোগ মেলে। খালি হাতে ফিরেছেন তিনি। তাঁর অভিযোগ কথাই শুনতে চাননি দুয়ারে সরকারের কর্মীরা। তাঁর আবেদন, কাগজপত্র গুছিয়ে দিতে সাহায্য করবে যে — ছিল না এমন কেউ। রোজিনা ঠিক কী চান তা বোঝাতে সাংবাদিকদের সামনে হাজির হতে হল আয়োজক সংগঠনের প্রতিনিধিকেই। বোঝাই যাচ্ছে রোজিনার কথা মন দিয়ে শোনা, প্রয়োজনীয় তথ্য জোগানো, কাগজ তৈরিতে সাহায্য করার কোনও কর্মী ছিলেন না শিবিরে। এ কেমন সরকার?

 

বৃদ্ধ আনন্দকুমার কিংবা তরুণী রোজিনার দেখা মিলল ‘খাদ্য ও কাজের অধিকার অভিযান’ সংগঠনের ডাকা এক সাংবাদিক সম্মেলনে। ২০২২ থেকে ২০২৩, এই এক বছর ধরে রাজ্যের ১৬টি জেলার অধিকার অভিযান ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্পের ২৫৩০ জন উপভোক্তার উপর একটি সমীক্ষা করে।

 

দুয়ারে সরকার প্রকল্পের ছ’দফা শিবির হয়ে গেল। তো, পঞ্চায়েত, পুরসভার মতো স্থানীয় সরকার থাকা সত্ত্বেও কেন দুয়ারে সরকার প্রকল্প আনতে হল? কী তার কার্যকারিতা আর উপভোক্তাকে পরিষেবা পৌঁছে দিতে তার ক্ষমতাই বা কতটুকু? অধিকার অভিযান জানাচ্ছে, “এ কথা অস্বীকার করার কোনও অবকাশ নেই যে এর সাহায্যে সরকারি প্রকল্পগুলি সত্যিই মানুষের “দুয়ারে” এসে উপস্থিত হয়েছে কিন্তু সেই প্রকল্পের সাহায্য থেকে মানুষেরা আগের মতোই দূরে আছে।”

 

সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, যেখানে দুয়ারে সরকার প্রকল্পকে গ্রামের এক একটি পঞ্চায়েত এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষের কাছে পৌঁছানোর কথা ছিল, সেখানে একটি শিবির গড়ে ১১৮ জনের নাম নথিভুক্ত করতে পেরেছে। প্রতি চার জনের মধ্যে তিন জন এই প্রকল্পে নিজেদের আবেদন রাখার সুযোগ পেয়েছেন। এবং সুযোগ পাওয়া মানুষদের মধ্যে মাত্র ৪২% কোনও সরকারি প্রকল্পের আওতার মধ্যে নিজেদের আনতে পেরেছেন। সমীক্ষা থেকে আরও জানা যাচ্ছে, তপসিলি জাতি ও জনজাতির মানুষরা দুয়ারে সরকার প্রকল্প থেকে একইরকম বঞ্চিত। প্রতি ৪ জন এসসি ও এসটি গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে মাত্র ১ জন শিবিরে অংশ নিতে পেরেছেন। পঞ্চম দফার দুয়ারে সরকার শিবির শেষ হওয়ার পর দেখা গেছে আবেদনকারীদের মধ্যে ৩০% মানুষের খাদ্যসাথী এবং ৪৬% মানুষের তপসিলি জাতি ও জনজাতি শংসাপত্র মেলেনি। এই সমীক্ষায় অবশ্য সর্বশেষ অর্থাৎ ষষ্ঠ দুয়ারে সরকার প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

 

সমীক্ষা থেকে স্পষ্ট, মানুষের সবচেয়ে বেশি চাহিদা ও আগ্রহ ছিল রেশন কার্ড, এসসি ও এসটি শংসাপত্র পাওয়া এবং ১০০ দিনের প্রকল্পে নাম নথিভুক্তিকরণের উপর। অথচ, ‘বাধ্যতামূলক ভাবে’ জোর দেওয়া হয়েছে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ ও ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পে। বার্ধক্য ভাতার মতো প্রকল্পে নথিভুক্তিকরণ বন্ধ ছিল। অর্থাৎ, খাদ্য সুরক্ষা, কাজের সুরক্ষা, সামাজিক সুরক্ষার মতো কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলি গুরুত্বই পায়নি। বঞ্চনার মাত্রা এক্ষেত্রে বঞ্চিতদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। দেখা গেছে, ৪২% জনজাতি/ আদিবাসী আবেদনকারী এবং ২৫% তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষ জানিয়েছেন তাঁরা এক বা একাধিক বার আবেদন জানালেও সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের সুবিধা পাননি। চা বাগানের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ৪৪% অন্তোদ্যয় অন্ন যোজনা (এএওয়াই) কার্ড পাননি। অথচ, রাজ্য সরকারের নীতি অনুযায়ী, চা বাগানের শ্রমিক পরিবারগুলির জন্য এএওয়াই কার্ড বাধ্যতামূলক।

 

তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই যে প্রশ্নগুলি ওঠে তা হল, এই যে কোটি কোটি টাকা খরচ করে শিবির করা, শিবির করার জন্য সরকারি কর্মচারীদের উপর আরও বেশি করে কাজের বোঝা চাপানো, বিদ্যালয়ে শিবির করে পঠন-পাঠন গোল্লায় দেওয়ার পর হাতে রইল কী! খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি তথ্য এ ক্ষেত্রে ধরা পড়েছে। এবং তা হল, সমীক্ষাকৃত ৫৮% মানুষ বলেছেন, দুয়ারে সরকারের আগে তাঁরা জানতেনই না এই সুযোগ সুবিধাগুলি আবেদনের মারফত তাঁরা পেতে পারেন। ২৩% বলেছেন, তাঁরা জানতেন এবং অন্যভাবে আবেদনও করেছিলেন, কিন্তু সুবিধা পাননি। ১৪% বলেছেন, তাঁরা বিভিন্ন প্রকল্পের কথা জানতেন কিন্তু কীভাবে আবেদন করতে হবে তা জানতেন না। ৪% বলেছেন, আগে আবেদন করেছেন কিন্তু কিছু রদবদল প্রয়োজন বলে শিবিরে ফের এসেছেন।

 

এরপর, চোখ কপালে তুলেই ভাবতে বসতে হয়, তাহলে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতি রাজ এতকাল কী করল? গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে ৪৮,৬৫০ জন, পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে ৯,২১৭ জন এবং জেলা পরিষদ স্তরে ৮২৫ জন জনপ্রতিনিধি এতদিন কী করলেন? স্থানীয় সরকার, জনপ্রতিনিধিরা কি তবে ব্যর্থ? আর সেই ব্যর্থতা ঢাকতেই কি পঞ্চায়েত-পুরসভাকে এড়িয়ে খোদ নবান্ন থেকে গ্রামে গ্রামে সমান্তরাল প্রশাসনিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে? বিকেন্দ্রীকরণ শিকেয় তুলে আমলা নির্ভর কেন্দ্রীকতাই কি ভবিষ্যৎ?

 

“খাদ্য ও কাজের অধিকার অভিযান, পশ্চিমবঙ্গ”-র সচিবালয়ের অন্যতম প্রধান সদস্য অনুরাধা তলোয়ার মানলেন যে, ‘দুয়ারে সরকার’ পঞ্চায়েতি রাজকে ‘দুর্বল’ করে তুলছে। তাঁর মতে, “পঞ্চায়েতি আইন মেনে, গ্রামসভার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্পগুলির সঠিক উপভোক্তা নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পরিবর্তে দুয়ারে সরকার শিবিরগুলির মাধ্যমে ক্ষমতাকে আরও কেন্দ্রীভূত করার কাজ চলছে।”

 

Share this
Leave a Comment