কখনো গভীর প্রেম, কখনো আত্মত্যাগ, কখনো সামাজিক পরিকাঠামোর অপ্রতুলতার কথার দোহাই দিয়ে, মেয়েদের আন্দোলনের ক্ষেত্রে থাকা সত্ত্বেও, মূলত অরাজনৈতিক হয়ে থাকার বিষয়টিকে মেনে নেওয়া হল, হয়েছে। এক পুরুষ নকশালের সাথে প্রেম করা ও তারপর তাঁর ঘরণী হওয়াকেই বহুলাংশে মহিমান্বিত করা হল সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মেয়েলি বিদ্রোহ বলে। প্রথা ভাঙা বলে। এই গোটা বিষয়টিকে বলা যেতে পারে মাধবীলতা কমপ্লেক্স। লিখলেন নন্দিনী ধর।
নকশালবাড়ি নিয়ে লেখার মধ্যে একটা বেশ ফ্যাশনেবল ব্যাপার আছে। বিশেষত, বাঙালি একাডেমিক হলে। বিশেষত, বাঙালি একাডেমিক হয়ে ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানচর্চা করলে। নকশালবাড়ি বা নকশাল রাজনীতি হল অনেকটা মাছের পিঠের কাঁটার মতো না যায় গেলা, না যায় ওয়াক থু করে ফেলা। কাজেই, নকশালবাড়ি নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চার তাঁবেদারদের উৎসাহের অন্ত নেই। মানে, নকশালবাড়ি আজ একটি ছোটোখাটো একাডেমিক ইন্ডাস্ট্রি। সাংস্কৃতিক ইন্ডাস্ট্রিও বটে। জীবনে আন্দোলনটির ধারপাশ যাঁরা কোনোভাবে মাড়াননি, তাঁদেরও মনে হয় একটু নকশাল-নকশাল খেলি। এক্ষেত্রে, “নকশালবাড়ি” বা “নকশাল আন্দোলন” একটি ক্ষেত্র, যার পরিসীমা বহুদিন ছাড়িয়ে গেছে ওই উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়ি নামের জনপদটি। যার একধরনের স্বীকৃতি আছে আন্দোলনের মধ্যেও। যেখান থেকে তৈরী হয়েছিল একটি বাক্য — Naxalbari is not the name of a village only — নকশালবাড়ি কেবলমাত্র একটি গ্রামের নামই নয়। বার হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে এই নামের সংকলনসমূহও। তো, “নকশাল” বা “নকশালবাড়ি” শব্দটি আজ একটি সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক একক। ক্ষেত্র। যার নাগাল বহুদূর।
যে নাগালের আকর্ষণেই বহু বহু প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চার মানুষ এই ক্ষেত্রটির প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশেরই অবশ্য নকশালবাড়ির ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা লড়াই বা আন্দোলন, বা কোনো প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগও নেই। কাজেই, তাঁদের একাডেমিক দৃষ্টিকোণের সামনে “নকশালবাড়ি” হয়ে ওঠে এমন একটি ক্ষেত্র যা কিনা একাধারে গবেষকের সমালোচনামূলক দৃষ্টিনিগড়ের বস্তু, অন্যদিকে এক রকমের অদ্ভুতুড়ে এক ধরনের ব্যাপার। অনেকটা যাকে বলে “এক্সোটিক”। যে অদ্ভুতুড়ে-এক্সোটিকের কাছে এসে অবশ্যম্ভাবীভাবে আন্দোলনের বহিরাগত, বারবার নিজের সীমাহীন উচ্চ মধ্যবিত্ততার একঘেয়েমির থেকে একটু-আধটু হলেও মুক্তিপ্রাপ্ত হন। নকশালবাড়ির গরম আগুনের ভিতর নিজের হাত সেঁকে, নিরাপদ দূরত্ব থেকে, তাঁর সমস্ত মধ্যবিত্ততার, প্রাতিষ্ঠানিকতার সুখস্বাচ্ছন্দ্য বজায় রেখে, নিজেকেও বেশ একটু র্যাডিকাল বলে অনুভব করা যায়। তো, এই জাতীয় কাজগুলির অনেকগুলিই হল নকশালবাড়ির লড়াইয়ের অংশগ্রহনকারী মেয়েদের নিয়ে, নকশালবাড়ির লিঙ্গচেতনা নিয়ে। কারণ, নকশালবাড়ি ও লিঙ্গ, দুই-ই একাডেমিক বাজারে বেশ হট কেক।
তো, সেই বহিরাগত এক্সোটিসিজমের জায়গা থেকে এই লেখাটি নয়। লেখাটি এমন একজনের জায়গা থেকে যার জীবনে রয়েছে দুই প্রজন্মব্যাপী নকশালবাড়ির রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক। যদিও, সেই সম্পর্ক একরৈখিক নয়, সহজও নয়। যেমন নয় নক্সালবাড়ির ইতিহাস। বা, তার বাস্তবতা। এই লেখাটি এমন একজনের জায়গা থেকে যে নিজেকে মনে করে জিনগতভাবে নকশাল, কিন্তু নকশালবাড়ির রাজনীতি নিয়ে তার প্রশ্নও কোটি কোটি। এই লেখাটির আবেগগত জায়গা মূলত দু’টি, যন্ত্রণা ও ক্রোধ। কোনো কোনো জায়গায় এই দুই তথাকথিত বিপরীতধর্মী আবেগের মধ্যে আলাদা জায়গা নেই, থাকবে না। তো, একটু গল্পচ্ছলে শুরু করি।
আমি নকশালবাড়ি দেখিনি। আমি বলা যেতে পারে জরুরি অবস্থার সন্তান। কাজেই, আমার সঙ্গে নকশালবাড়ির সম্পর্ক ঐতিহাসিকতার সম্পর্ক। যে ঐতিহাসিকতা আবার একধরনের জ্যান্ত ঐতিহাসিকতা। প্রতি পদে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ছাপ ফেলতে ফেলতে যায়। তো, আমার গল্পে বড়ো হয়ে জুড়ে থাকবে নয় দশকের দেখা বাস্তবতা। যে বাস্তবতার মধ্যে আবার গভীরভাবে ছাপ ফেলেছিল পূর্ববর্তী দশকগুলোর বাস্তবতাও। সেই নয়ের দশকের মাঝামাঝি, যখন বিশ্বায়ন আগত, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে থাবা গেঁড়ে বসতে পারেনি এদেশের মাটিতে, তখনও আমার প্রজন্মের বহু মধ্যবিত্ত তরুণ -তরুণীর মধ্যে নকশালবাড়ি নিয়ে আগ্রহ গোটাগুটিভাবে মুছে যায়নি, তখন আমার বান্ধবীরা অনেকেই নকশাল আন্দোলনকে চিনেছে সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস “কালবেলা” পড়ে। বন্ধুরাও। বিশেষত, যাদের সঙ্গে পারিবারিকভাবে নকশাল আন্দোলনের বড়ো একটা সম্পর্ক ছিল না। এবং, কেমন অদ্ভুতভাবে, বন্ধুরা হতে চেয়েছে অনিমেষ। আর, বান্ধবীরা মাধবীলতা। কিন্তু, সমস্যা হল এই যে, মাধবীলতা হতে গেলে অনিমেষ ব্যতীত হওয়া যায় না। মাধবীলতারা সবসময়েই অনিমেষের মাধবীলতা। যদিও, অনিমেষদের অনিমেষ হয়ে উঠতে গেলে বড়ো একটা মাধবীলতাদের প্রয়োজন হয় না। বড়ো জোর, মাধবীলতারা অনিমেষদের জীবনে অনেকটা ওই পাঁঠার মাংসের ঝোলের ওপর নামিয়ে নেওয়ার আগে দেওয়া ঘি ও গরম মশলা-সম।
তো, উপন্যাসের মাধবীলতা রাজনীতি করেন না। সংগঠন করেননি কখনো। চাকরি করেন, সংসারের বোঝা ঠেলেন। আর, ভাঙাচোরা শরীরে মুক্তির দশকের জেল-পুলিশ কাস্টডির অত্যাচারের সমস্ত স্মৃতি নিয়ে স্বামী অনিমেষ ফিরে এলে, মাধবীলতা প্রায় মুখ বুজে এক কঠিন প্রাত্যহিকতার দায়িত্ব মেনে নেন। যেমন করে থাকেন আমাদের চেনা বহু মধ্যবিত্ত মহিলারাই। উপন্যাসের শেষে আমরা অবশ্য দেখতে পাই, মাধবীলতা ও অনিমেষের প্রথাগতভাবে কোনোদিন কোনো বিয়ে হয়নি। এবং, তা নিয়ে মাধবীলতার মধ্যে কোনও অনুতাপবোধও নেই। নকশালবাড়ির রাজনীতি তাঁকে ছুঁয়ে গেছে এক প্রগাঢ়, ব্যক্তিগত জায়গায়। বিবাহব্যবস্থাকে তিনি তাই নাকচ করতে পেরেছেন। যে অবস্থানটি আবার ভয়ঙ্করভাবে লিঙ্গায়িতও বটে। মানে, একজন “সাধারণ” মধ্যবিত্ত মেয়ে, বিয়ে সংক্রান্ত সমস্ত সংস্কার, মূল্যবোধ কাটিয়ে উঠতে যে পারল, তার মধ্যে এক ধরনের সাহসিকতা আছে বৈকি। কিন্তু, এস্থলেও আছে জটিলতা। মাধবীলতা বিবাহব্যবস্থাকে নাকচ করেছেন বটে, কিন্তু সেই নাকচ করাটাকে তিনি সামাজিকভাবে তাঁর পরিচিতি করে তুলতে পারেননি। আইনি অর্থে তিনি বিবাহিতা নন। কিন্তু, পরিবারের কাছে, বাকি সমাজের কাছে তিনি অনিমেষের “স্ত্রী” পরিচয় নিয়েই বাস করেন। কাজেই, সেই অর্থে তাঁর এই লড়াইটাও আংশিক।
আমার নিজের জীবনে “কালবেলা” (বা অন্য কোনো বাজারি উপন্যাস) পরে নকশালবাড়ির রাজনীতি বা নকশালদের চিনতে হয়নি। মানে, বাজারি সাহিত্যের কোনো নকশাল চরিত্রই আমার চেনা কোনো নকশাল চরিত্র নয়। তারা কেউ আমার আজন্ম চেনা কাকু বা দাদাদের মতো নয়। আমার বন্ধুদের মতো নয়। আমার কমরেডদের মতো নয়। তবে, একথাও তো একভাবে ঠিক যে আমার চেনা যে নকশালবৃত্ত — দুই প্রজন্মের — সেখানে মেয়েদের সংখ্যা তুলনায় বড়োই কম।
আসলে, ঠিক বললাম না। মেয়েরা ছিলেন সেখানে। প্রায় সমপরিমাণেই ছিলেন। কিন্তু, তাঁরা ছিলেন নকশালদের প্রেমিকা হিসেবে, বৌ হিসেবে। সেই প্রেমিকা বা স্ত্রীর ভূমিকায় তাঁরা আন্দোলনে অংশও নিয়েছেন, মিছিলে হেঁটেছেন, বাকি কমরেডদের জন্য ভাত রেঁধেছেন। পরম মমতায় লড়াইয়ের ময়দানে স্বামীর কমরেডদের পদচারণাকে সহজতর করে তোলার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে কি তাঁদের নিজেদের মতো করে বোঝা রাজনৈতিক বোধ ছিল না? অবশ্যই ছিল। যে অর্থে এঁরা নিজেদের গার্হস্থ্য ভূমিকাকে দেখেছিলেন, তা ঠিক আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের গার্হস্থ্যতা নয়। রক্তের সম্পর্ক বা বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরেও সেখানে আছে এক বৃহত্তর যুথবদ্ধতা। আবার এও তো সত্যি যে এই নকশাল-পরিবারের সর্বজনীন গার্হস্থ্যতা, তার দৈনন্দিন পরিচালনা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের থেকে গুণগত ভাবে আমূল আলাদা কিছুও নয়। আলাদা নয় তার লিঙ্গ -রাজনীতিও। বা, মেয়েদের কাছ থেকে তাঁদের দাবি।
অবশ্য, এক্ষেত্রে শুধু নকশাল পরিবার নয়, প্রাক-নকশাল পর্বের বাংলার বামপন্থী পরিবারও তো এর থেকে খুব আলাদা কিছু ছিল না। একভাবে বলতে গেলে, বাংলার বামপন্থী রাজনীতির ঘরোয়া ইতিহাস লিখতে গেলে দেখা যাবে, পরিবার প্রতিস্থাপিত হয়েছিল পার্টির মধ্যে, পরিবারের মধ্যে পার্টি। অদ্ভুতভাবে, যে নকশালবাড়ির রাজনীতি শোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তীব্র আহ্বান জানাল, আহ্বান জানাল সশস্ত্র কৃষি-বিপ্লবের, ডাক দিল আধা-সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে কঠিন লড়াই গড়ে তোলার, সেখানে এই যে শোধনবাদ, কৃষি-সম্পর্ক ও শ্রম, ও আধা-সামন্ততন্ত্র কীভাবে লিঙ্গ বিষয়টির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, তার কোনো কর্মসূচি তো দূরের কথা, আলোচনার বাতাবরণও তৈরি হল না আন্দোলনের মধ্যে। আলোচনা হল না, কীভাবে পরিবার প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে রাজনৈতিক শোধনবাদের ইতিহাস। কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেকার পরিবারতন্ত্রের ইতিহাস। আর, পরিবার যে হয় না লিঙ্গ রাজনীতি বাদ দিয়ে। কাজেই, এক অতীব জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নকশালবাড়ির রাজনীতির লিঙ্গ পরিচিতির ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়াল পৌরুষ। এক বিশেষ ধরণের নিয়মভাঙা, বিদ্রোহী পৌরুষ। যেমনটি হয়েছিল আগের কমিউনিস্ট পর্যায়ের কমিউনিস্ট আন্দোলনেও। যদিও, এই সমস্ত পর্বেই, মহিলারা, তা সে মধ্যবিত্ত মহিলারাই হন, আর শ্রমিক-কৃষক মহিলারাই হন, অংশগ্রহণ করেছেন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে।
কাজেই, খুব অদ্ভুতভাবেই, বাজারি সাহিত্য বা “কালবেলা”-র মূল নকশাল চরিত্রগুলির সঙ্গে আমার চেনা ওই আন্দোলনের পুরুষদের মিল না পেলেও, আমার চেনা-পরিচিত প্রায় সব নকশাল-গৃহিণী বা প্রেমিকার কিন্তু বেশ মিল খুঁজে পাই মাধুবীলতার সঙ্গে। পরিশ্রমী, দায়িত্বশীলা, বিপুল সহ্যক্ষমতার অধিকারিণী, কিন্তু প্রয়োজনে কঠোর— এই মহিলাদের আমরা যারা আন্দোলনের মধ্যে থেকেছি, তারা প্রায় সবাই চিনি। এবং, খেয়াল করে দেখলে দেখা যাবে, যে তাত্ত্বিক বিতর্কসমূহের ওপর বামপন্থী তথা নকশাল আন্দোলন ঐতিহাসিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে এঁদের প্রায় কারোরই কোনো আগ্রহ নেই। লেনিন বা মাও, চীন বা রাশিয়া নিয়ে কোনো বিতর্কে এঁরা অংশগ্রহণ করেন না। মার্ক্সবাদী তত্ত্ব নিয়েও এদের কোনো গূঢ় ভাবনাচিন্তা নেই। রাজনৈতিক সংগঠনের আশেপাশে যে সমাজসেবামূলক কাজ হয় বহু সময়েই, কমিউনিস্ট পার্টিগুলির আধারে, তাতে এঁরা অনেকেই জড়িয়ে থাকেন বটে, তবে সেটাও যেন অনেকটা ওই মধ্যবিত্ত বাড়ির গৃহবধূর সাংসারিক ভূমিকার পরিবর্ধন হিসেবেই। বড়োজোর তাঁদের দেখতে পাওয়া যায় ৮ মার্চের নারী দিবসের অনুষ্ঠানের এদিক-ওদিকে। অবশ্য, ঐসব অনুষ্ঠানে আবার কঠিন রাজনৈতিক ভ্যানগার্ড পুরুষ কর্মীদের দেখতে পাওয়া যায় না। অন্তত ঐতিহাসিকভাবে দেখতে পাওয়া যায়নি। পার্টির মহিলা ফ্রন্টের বার করা পত্রিকাও কি পুরুষ নেতৃত্ব পড়ে থাকে? পড়েছে কি ঐতিহাসিকভাবে? আমার প্রতক্ষ্য অভিজ্ঞতা বলে, না।
তো, আরেকটু সরাসরিভাবে বলতে গেলে, এক অন্যধরনের গার্হস্থ্যতার শরিক, এবং রাজনীতির অংশ হলেও, এই যে নকশাল-সহধর্মিণীরা (বা, ক্ষেত্রবিশেষে প্রেমিকারা), রয়ে গেলেন মূলত অরাজনৈতিকতার বৃত্তে। যেমন ছিলেন সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসের মাধবীলতা।
অবশ্যম্ভাবীভাবে, তাই প্রশ্ন জাগে, এই যে এঁদের এক ধরনের অন্য ধারার জীবন বেছে নিলেন, তা কি আসলে একটি আদর্শ বা রাজনীতির প্রতি ভালোবাসা, নাকি, একটি মানুষ (অর্থাৎ, তাঁর স্বামী, তথা প্রেমিক) তাঁর প্রতি ভালোবাসা? একটি সংগঠনের প্রতি আনুগত্য, নাকি একটি মানুষ (অর্থাৎ, তাঁর স্বামী তথা প্রেমিক)-এর প্রতি আনুগত্য এই শরিক হওয়া? অথবা, মেয়েটির ক্ষেত্রে একটি মানুষ ও একটি আদর্শ কি এক হয়ে যায়? যেমনটি হয়েছিল মাধবীলতার ক্ষেত্রে, কোনো রাখঢাক ছাড়াই ? কিন্তু, এই যে একটি মানুষ — বিশেষ করে যে আবার একটি মেয়ের স্বামী, বা প্রেমিকও বটে — তাঁর মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক আদর্শকে দেখা, তার মধ্যে দিয়ে নিজের গোটা জীবনটাকে সংগঠিত করা, এটাকেই তো সমাজ বলে পতিব্রত। সমাজের যে আধিপত্যকারী সামাজিক দর্শন, সে তো বলে, নারীকে পতিব্রতাই হতে। নকশালবাড়ির রাজনীতি কি তবে একধরনের পতিব্রতা নারীরই দর্শনকেই একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, আরেকটু রোমান্টিকতা মিশিয়ে প্রাধান্য দেওয়া হল?
অবশ্যম্ভাবীভাবে হ্যাঁ। এবং, শুধু তা-ই নয়, এই যে গোটা প্রক্রিয়াটির ভেতর রয়েছে অনগ্রসর রাজনীতির ছাপ, সেই বিষয়টিকে ঐতিহাসিকভাবেই নকশালবাড়ি-আন্দোলনজাত যে লড়াইয়ের ক্ষেত্রগুলি, সেখানে মান্যতা দেওয়া হয়নি। কখনো গভীর প্রেম, কখনো আত্মত্যাগ, কখনো সামাজিক পরিকাঠামোর অপ্রতুলতার কথার দোহাই দিয়ে, মেয়েদের আন্দোলনের ক্ষেত্রে থাকা সত্ত্বেও, মূলত অরাজনৈতিক হয়ে থাকার বিষয়টিকে মেনে নেওয়া হল, হয়েছে। এক পুরুষ নকশালের সাথে প্রেম করা ও তারপর তাঁর ঘরণী হওয়াকেই বহুলাংশে মহিমান্বিত করা হল সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মেয়েলি বিদ্রোহ বলে। প্রথা ভাঙা বলে।
তো, এই গোটা বিষয়টিকে বলা যেতে পারে মাধবীলতা কমপ্লেক্স।
আমি এমন কোনো দাবি করছি না যে এই গোটা বিষয়টি শুধুই কিছু পুরুষদের চক্রান্ত। মানে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের মেয়েরা, যাঁরা নকশাল আন্দোলনের ক্ষেত্রটির চারপাশে ঘুরঘুর করেছেন, এই টোপটি খেয়েছেন। এই মাধবীলতা কমপ্লেক্সের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন নিজেদের পরিচিতি, বৈষয়িকতা ও জীবনের অর্থ। নকশালের সঙ্গে প্রেম করার মধ্যে আছে একধরনের বিদ্রোহ। তার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহের গ্ল্যামার। একথা আর কে না জানে। আছে এর মধ্যে যৌন রাজনীতির জটিল গল্পও। স্কুল-কলেজ-পাড়া চত্বরে নকশাল-বিপ্লবী পুরুষদের এক ধরনের যৌন আপিল থাকে বটে। মানে, ওই “ব্যাড বয়” রূপকল্পের এক অতীব চরম রূপ আর কি!
যাই হোক, মেয়েরা তাই আন্দোলনের ক্ষেত্রে গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে দৌড়োদৌড়ি করেছে, শ্রম দিয়েছে। কিন্তু, যে মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক চর্চা এত গভীরভাবে দাঁড়িয়ে আছে বৌদ্ধিক ও তাত্ত্বিক চর্চার উপর, সেখানে স্বল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, তাত্ত্বিক হয়ে উঠতে পারেননি আন্দোলনের চারপাশে থাকা, এমনকি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা মেয়েরাও। এবং, এই যে তাঁরা পারেননি, এটাও বড়ো একটা কাউকে ভাবায়নি। কারণ, এই যে তাঁরা হয়ে ওঠেননি রাজনৈতিক-তাত্ত্বিক চর্চার বৈষয়িকতার অধিকারিণী, তার মধ্যে দিয়েই আন্দোলনের ক্ষেত্রগুলির মধ্যে প্রতিস্থাপিত করা গেছে এক বিশেষ ধরনের “নকশালি পিতৃতন্ত্র।” না, নকশালি পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রেই যে সামাজিক, আধিপত্যকারী পিতৃতন্ত্র, তার মিল নেই। কীভাবে নেই, কেন নেই, তা এই স্বল্প পরিসরের লেখায় যাওয়া সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, যেখানে নকশালবাড়ি আন্দোলনের রাজনীতির মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ তথা উপ-মহাদেশের রাজনীতির বুকে প্রায় সর্বত্র আমূল পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছিল, এবং এখনো বহুলাংশে বলা হয়, তা সে আন্দোলনটি যত বিভক্তই হোক না কেন, সেখানে কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে গাঁটছড়া বাধা হয়েছে সামাজিক পিতৃতান্ত্রিক স্থিতিস্থাপকতার সঙ্গে। এবং, সেখানে একভাবে সমর্পণ করেছেন, সহযোগী হয়েছেন একটি বড়ো অংশের আন্দোলনের ভেতরে থাকা মেয়েরা। কারণ, মাধবীলতা হওয়াতে এক ধরনের বৌদ্ধিক পরিশ্রম বিমুখীনতা আছে। এক ধরনের রাজনৈতিক পরিশ্রম-বিমুখীনতা আছে। সংগঠন ঘিরে যে তৈরি হয় একেকটি রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, সেখানে সামাজিক সম্মান পাওয়া যায় অনেক বেশি।
কিন্তু, এরপরেও আছে আরেকটি গল্প। আমি আমার যে বান্ধবীরা অনিমেষের মাধবীলতা হতে চেয়েছিল, তাদের মতো নই। মাধবীলতা হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার কোনোদিন ছিল না। অনিমেষেরও নয়। অন্য কারোরও নয়। আমি নকশাল হতে চেয়েছিলাম। পাতি নকশাল। নকশালের বৌ নয়। নকশালের প্রেমিকা নয়।
অর্থাৎ, আমি হলাম সেইসব বেয়াড়া মেয়েদের দলে, যারা সংখ্যায় কম হলেও আছে। ছয় এবং সাতের দশকেও ছিলেন। আমি তাঁদের কাউকে কাউকে চিনতামও বটে শৈশবকাল থেকেই। না, তাঁদের সঙ্গে মাধবীলতার কোনো মিল ছিল না। নেই। যেমন আমাদের প্রজন্মেও ছিল না। বরং, বহু ক্ষেত্রেই মাধবীলতা কমপ্লেক্সের সাথে লড়াই করেই তাঁদের নিজেদের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক জমি বানাতে হয়েছিল। যদিও, তাঁদের জীবনেও ছিল প্রেম, ছিল যৌনতা নিয়ে লড়াই। কিন্তু, তার সঙ্গে সঙ্গে আছে তাঁদের স্বাধীন রাজনৈতিক বিষয় হয়ে ওঠার লড়াইও। কিন্তু, সেই লড়াইয়ের প্রতিফলন, তার জটিলতার রূপায়ন আমরা প্রায় দেখলাম না কোথাওই। না বাজারি সাহিত্যে, না শিবিরজাত সাহিত্যে।
শিবিরের মেয়েরা অনেকেই কলম ধরলেন বটে, কিন্তু কোথায় যেন সেইসব লেখার মধ্যেও এক ধরনের দ্বিধা থেকে গেল। তাঁদের মধ্যে অনেকেই হয় নিজেদের রাজনৈতিক হয়ে ওঠার লড়াইটিকে পুরোপুরি নিজেদের লেখা গল্প-কবিতা-স্মৃতিকথা র মধ্যে আনলেন না। আনলেও আনলেন কেটে ছেঁটে, অনেকটা যেন ডেটল-স্যাভলন দিয়ে ধুয়ে, পরিষ্কার করে। কিন্তু, আদতে বিষয়টা এই যে, এই শিবিরের মেয়েরা তেমনভাবে লিখলেন না। নকশালী সংস্কৃতির মধ্যে তত্ত্বচর্চা ও সাহিত্যচর্চা দুই-ই হয়ে রইল পৌরুষের দাপাদাপির ক্ষেত্র। অবশ্য, এই কথাটি তো সার্বিকভাবে ভারত তথা সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সত্য। মানে, এত তত্ত্বায়নের ঘনঘটা, এত এত বিতর্কের ডামাডোল, যা প্রায় এক জীবনে পড়ে ওঠা অসাধ্য, সে ঘনঘটা স্তব্ধ হয়ে যায় মেয়েদের কলমের কাছে এসে। বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলন-জাত লড়াইয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য তিন থেকে ছয় মাসই যথেষ্ট।
তাহলে, একদিক থেকে আজ আমাদের সামনে দুটো প্রশ্ন—কমুনিস্ট ধারায় তত্ত্বায়নের যে ঐতিহ্য ও ইতিহাস, সেখানে মেয়েদের অবস্থান কোথায়? অন্যদিকে, আজ আমাদের দেশে ও সার্বিকভাবে এই উপমহাদেশে যখন ধর্মীয় মৌলবাদ-জাড়িত ফ্যাসিবাদ ও নয়া উদারতন্ত্র নিয়ে আসছে জটিল লিঙ্গ মতাদর্শের রূপরেখা, যেখানে কোথাও কোথাও নকশালবাড়ির ইতিহাস-সহ সমস্ত প্রগতিশীল লড়াইয়ের ইতিহাসই একদিকে পণ্য ও অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের লক্ষ্য, সেখানে কি যুগের স্বাভাবিক নিয়মেই বিলীন হয়ে যাবে মাধবীলতা কমপ্লেক্স? বিশেষ করে যখন প্রশ্নচিহ্নের মুখে প্রায় গোটা কমিউনিস্ট রাজনীতিই? আমার অভিজ্ঞতা, হয় না। হয়নি। আমাদের অভিজ্ঞতা, হয়নি। হয় না।
এই লেখাটি শুরু করেছিলাম একটি কথা বলে। যে এই লেখাটি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বচর্চার জায়গা থেকে লেখা নয়। যে তত্ত্বচর্চা বা যে ধারার তাত্ত্বিকদের, যাঁদের আমরা একাডেমিক বলে থাকি, তাঁদের কোনো দায় নেই তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বেশি। কিন্তু আমার আছে। আমাদের আছে। যেমন, খুব স্পষ্ট করে বললে, আমার মতো কোনো একটি মেয়ের, কোনো একটি মেয়ের প্রেমিক, স্বামী বা বিবাহরহিত রাজনৈতিক সন্ধান বা যাত্রাপথের গল্প আমরা পেলাম না। পেলাম না বাস্তবের আন্দোলনের জমিতে সঠিক রাজনৈতিক স্থানও। তাই, আমি অপেক্ষায় রইলাম। কবে মাধবীলতা রূপক ভেঙে গুঁড়িয়ে নকশালবাড়ি সাহিত্যে লেখা হবে বেয়াড়া মেয়েদের বিদ্রোহের গল্প। রাজনৈতিক সন্ধানের গল্প। প্রেমের গল্প। না বোঝা, মেনে নেওয়া বা মানিয়ে নেওয়ার গল্পও।
(লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দু’হাজার একুশ-এ বামা পত্রিকার ‘নকশালবাড়ি ও নারী’ সংখ্যায়। লেখক সমরেশ মজুমদারের সদ্য প্রয়ানকে মাথায় রেখে লেখাটি গ্রাউন্ডজিরোতে পুণর্প্রকাশিত করা হল।)
লেখাটি জরুরি, ধারালো ও ভাবনা-সঞ্চারী। এবং ঐতিহাসিক ভাবে প্রাসঙ্গিক।