গ্রাউন্দজিরো । এপ্রিল ১৯, ২০২৩
“সেভ আইআইইএসটি” লেখা ব্যানার লাগানোর জন্য শোকজ নোটিশ ধরানো হল চার শিক্ষককে। গত সপ্তাহে হাওড়ার শিবপুরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (বা সংক্ষেপে আইআইইএসটি)-র শিক্ষক সংগঠন আইআইইএসটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন -এর পক্ষ থেকে ক্যাম্পাসের মধ্যেই একটি মিছিল অনুষ্ঠিত হয়, তারপর ক্যাম্পাসের এক ও দুই নম্বর গেটের বাইরে “সেভ আইআইইএসটি” লেখা ব্যানার লাগানো হয়। প্রথমে কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই সেই ব্যানার সরিয়ে দেন সিকিউরিটি গার্ডরা, তারপর আবার শিক্ষকরা সেই ব্যানার যথাস্থানে লাগিয়ে দেন। এরপরই কর্তৃপক্ষের তরফে একটি শোকজ নোটিশ পাঠানো হয় শিক্ষক সংগঠনের সম্পাদক তপেন্দু মণ্ডল-সহ আরও তিন জন শিক্ষককে।
কেন ব্যানার লাগিয়েছিলেন শিক্ষকরা?
“প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না, হস্টেলগুলির বেহাল দশা, চাঙড় ভেঙে পড়ছে, মেরামতির দায়িত্ব নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। একই অবস্থা ল্যাবরেটরি গুলোতেও। ক্লাসরুমের অভাব দেখা যাচ্ছে। আর এই সমস্ত পরিকাঠামোগত অব্যবস্থার মধ্যে শিক্ষকদের ক্লাস নিতে হচ্ছে। তাই আমরা গত কয়েক বছর ধরেই এই সমস্ত পরিকাঠামোগত দাবি নিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছি। ক্যাম্পাসের মধ্যে মিছিল করি। ব্যানার লাগাই। আমাদের স্লোগান ‘সেভ আইআইইএসটি’; আর এই ব্যানার লাগানোর জন্যই এই শোকজ নোটিশ” বলেন অধ্যাপক অমিত রায়চৌধুরী।
আইআইইএসটি শতাব্দী প্রাচীন একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালে রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের রূপ পায়। আগে নাম ছিল বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি, এলাকায় আজও ‘বেসু’ বা ‘বিই কলেজ’ নামে পরিচিত। ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ার পর নাম হয় আইআইইএসটি, বাংলায় ‘ভারতীয় প্রকৌশল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা প্রতিষ্ঠান’। এনআইটির অধীনে থাকা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এর আগেও এরকম নানার অভিযোগ উঠেছে। গতবছর কংক্রিটের চাঙড় ভেঙে পড়ে হস্টেলে। এক ছাত্র কোনও রকমে রক্ষা পান, মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপের ক্ষতি হয়। বারবার লিখিত ভাবে কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। উল্টে ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ ছিল চিঠি দেওয়া, প্রতিবাদ করার জন্য তাদেরকে শাসানো হয়।
২০১৪ সালের পরে রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ার ফলে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন সংক্রান্ত নানা বিষয়ে জটিলতা তৈরি হয়। শিক্ষক-কর্মচারীরা বছরের পর বছর ডেপুটেশন দিয়েছেন, অবস্থান বিক্ষোভ করেছেন বেতন কাঠামো সংক্রান্ত জটিলতা কাটাতে। বিশেষ করে হস্টেল কর্মীদের স্থায়ীকরণ ও পেনশন সমস্যার জটিলতা দূর করার দাবি ওঠে। কিছুক্ষেত্রে সুরাহা হলেও এখনও নানান সমস্যা রয়েই গেছে। ২০২২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে এক শিক্ষক সান্ধ্য ভ্রমণে বেরোলে তাকে গার্ড আটকে দেন। ক্যাম্পাসে অবাধ চলাচলের স্বাধীনতার জন্য সেই সময়েও বিক্ষোভ দেখান শিক্ষক ছাত্রছাত্রীরা। মিছিল অনুষ্ঠিত হয় ক্যাম্পাসের মধ্যে। অন্যদিকে হস্টেল পরিকাঠামোর বেহাল দশার জন্য অনেক ছাত্রছাত্রীই বেশি টাকা খরচ করে ক্যাম্পাসের বাইরে মেস বা পিজিতে কিংবা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন দ্য গ্লোবাল অ্যালুমনি অ্যাসোসিয়েশন অব আইআইইএসটি-র তরফে প্রায় এক হাজার স্বাক্ষর সম্বলিত একটি পত্র দেওয়া হয়েছে ডিরেক্টরকে, তারা সংহতি জানিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষকদের। বর্তমানে ওই চার জন শিক্ষকের শোকজ নোটিশ ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিতে আন্দোলন চালাচ্ছেন শিক্ষকরা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ২০১৯ সালের শেষ ও ২০২০ সালের শুরুর দিকে এনআরসি ও সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন)-র বিরুদ্ধে গোটা দেশে যখন আন্দোলন চলছে সেই আন্দোলনের সংহতিতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আইআইইএসটি থেকে একটি মিছিল বের হয়। প্রায় পাঁচশোর উপর ছাত্রছাত্রী শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ এই মিছিলে সামিল হন। এরপরেই কর্তৃপক্ষের তরফে একটি নোটিশ জারি করে জানানো হয় যে ক্যাম্পাসের মধ্যে কোনও রকম রাজনৈতিক মিছিল করা যাবে না, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ইত্যাদি লাগানো যাবে না। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এনআইটির অন্যান্য ক্যাম্পাসগুলিতে কিংবা এনআইটির তরফেও এমন কোনো নির্দেশিকা নেই। শুধুমাত্র আইআইইএসটিতেই এমন নির্দেশিকা জারি করা আছে আজও। আর সেই নির্দেশিকার ভিত্তিতেই ওই চার জন শিক্ষককে শোকজ নোটিশ পাঠিয়েছে কর্তৃপক্ষ। নির্দেশ অমান্য করার ব্যাখ্যা চেয়েছেন রেজিস্ট্রার দেবাশিস দত্ত। ডিরেক্টর পার্থসারথি চক্রবর্তীর তরফ থেকে এখনও পর্যন্ত কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি এব্যাপারে।
আইআইইএসটির মতো শতাব্দী প্রাচীন প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকবছর ধরেই বেড়েছে হিন্দুত্ববাদের প্রচার। হোস্টেল ওয়ার্ডেন এবং ডিন পদে আছেন সুদীপ্ত মুখোপাধায়, যিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (বা এবিভিপি) নেতা। আরএসএসের মিছিলে ক্যাম্পাসের অস্থায়ী কর্মীদের টাকা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও উঠেছে এর আগে। বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকবার অপবিজ্ঞানের প্রচার হয়েছে বলে অভিযোগ। এনআইআরএফ র্যাংকিংয়েও বছরের পর বছর ধরে পিছিয়ে পড়ছে এই প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালে ১৯ তম, ২০২১ সালে ২৭ তম অবস্থান থেকে ২০২২ সালে প্রায় ৪০ ধাপ পিছিয়ে নেমে আসে ৬৬ তম অবস্থানে।
পরিকাঠামোগত সমস্যা, অপবিজ্ঞাপনের প্রচারই কি এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান নীচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে? ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অবস্থাও শোচনীয়। এমতাবস্থায় দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান প্রযুক্তি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগামী দিনে কীভাবে ঘুরে দাঁড়ায় সেটাই দেখার।