যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭ সালে তৈরি হয় ফোরাম ফর স্টুডেন্টস উইথ ডিসএবিলিটিস (এফএসডি) – প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের অধিকার, নিরাপত্তা, বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সুনিশ্চিত করতে। সম্প্রতি শ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে বাইকবাহিনীর হাতে প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের হেনস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হন প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি গেট-এ চলে অবস্থান প্রতিরোধ। অবশেষে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবেন এই মর্মে লিখিত আশ্বাস পাওয়ার পরেই তাঁরা বিক্ষোভ তোলেন। এফএসডি-র আন্দোলনের সাম্প্রতিক সময়ে এক বড় জয় এসেছে গত ১৬ জানুয়ারিতে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সেন্টার ফর পার্সনস উইথ ডিসএবিলিটিস (সিপিডি)-এর ভবনটি দখলমুক্ত করা গেছে এবং সেখানে প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে নতুন করে গবেষণা ও পরিষেবা দেওয়ার কাজ শুরু করতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেছে এফএসডি। এই ভবনটি রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে জবরদখলমুক্ত করা মোটেই সহজ ছিল না।
কীভাবে ছাত্র আন্দোলন, প্রতিবন্ধী আন্দোলন, বৃহত্তর রাজনীতির যোগসূত্র তৈরি হয় সেই বিষয়ে কিছুদিন আগে গ্রাউন্ডজিরো-র সুদর্শনা চক্রবর্তী-র সঙ্গে এক আলোচনায় তুলে ধরলেন এফএসডি-র সদস্য ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া মনজিৎ কুমার রাম (বাংলা বিভাগে পিএইচডি), যীশু দেবনাথ (বাংলা বিভাগে পিএইচডি) ও সূরজ ঝা (তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষ)।
প্র: বিশ্ববিদ্যালয়ে সিপিডি থাকা কেন প্রয়োজন? প্রথম যখন তৈরি হয়েছিল কী পরিস্থিতি ছিল?
উঃ (যীশু) সিপিডি তৈরি হয় ২০১৮ সালে। সূরজ ছাড়া আমরা সকলেই সেই সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলাম। আমাদের বাকি তিন জনেরই গ্র্যাজুয়েশন ও মাস্টার্স এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। আমরা যখন মাস্টার্স করছি তখনও এখানে ডিসএবিলিটি স্টাডিস বলে সেন্টারটি ছিল। এই সেন্টার যে ফান্ড পেত সেটি ছিল রিসার্চ-এর ফান্ড। ২০১৭ সালের শেষের দিকে এই সেন্টার থেকে বলা হল তাঁরা শুধু রিসার্চ করবেন, প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের কোনও সার্ভিস তাঁরা দেবেন না। রিসার্চ-এর ফান্ড থেকে কখনও কিছু বাড়তি অর্থ থাকলে তা দিয়ে তাঁরা কিছু অডিও বুক তৈরি করছিলেন। কিন্তু সার্ভিস বেসড কোনও ফান্ড তাঁদের কাছে নেই। সেই ২০১৭-এর ডিসেম্বর মাসে আমাদের মনে হয়েছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের যে ন্যূনতম চাহিদা তা পূরণ হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে রিসার্চ বা গবেষণা তো সেকেন্ডারি হওয়া উচিত। রিসার্চ-এর কথা তো তখনই ভাবা উচিত যখন ন্যূনতম সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব হবে। সার্ভিস দেওয়া হলে তারপর রিসার্চ করব – ব্যাপারটা এরকম নয়। দুটোই সমান্তরালভাবে চলতে হবে। তারজন্য তো দু’টোই থাকতে হবে। সার্ভিসও থাকবে, রিসার্চও পাশাপাশি চলবে। ২০০৭ থেকে ২০১২ একটি নির্দিষ্ট প্রজেক্ট-এর অন্তর্ভূক্ত হিসাবে সার্ভিস বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল। ডিসএবিলিটি স্টাডি-র পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয় ২০১২-র পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসি-র যে স্কিম এসেছে সেটা রিসার্চ স্কিম – ইউনিভার্সিটি ফর পোটেনশিয়াল এক্সিলেন্স-এর আন্ডার-এ (ইউপিই)। এই স্কিম-এ রিসার্চ ও সার্ভিস দু’টি প্রজেক্ট-ই আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ-এর প্রজেক্ট ক্লেইম করে সেটি পেয়েছে। আমরা জানতে চেয়েছিলাম – সার্ভিস যখন দিতে পারছেন না তখন রিসার্চ-এর প্রজেক্ট কেন ক্লেইম করলেন? সেই থেকেই গন্ডগোলের সূত্রপাত।
২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি মাসে সিপিডি তৈরি করার রেজোলিউশন এসেছিল ইসি (এগজিকিউটিভ কাউন্সিল)-তে । ২০১৮-র ১৫ জানুয়ারি থেকে আমরা ইসি-তে বসে ছিলাম অবস্থান বিক্ষোভ করে। ১৬ তারিখে ওঁরা জানালেন যে – হ্যাঁ, ছাত্রছাত্রীদের সার্ভিস পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ, কাজেই বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব মেইনটেনেন্স-এর ফান্ড থেকে বা প্রয়োজনে ইউজিসি থেকে টাকা পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্ভিস বেসড একটা সেন্টার তৈরি করবে – নাম দেওয়া হবে ‘সেন্টার ফর পার্সনস উইথ ডিসএবিলিটিস’। সমান্তরালভাবে দু’টি সেন্টার চলবে। ২০১৮-র ১৬ জানুয়ারি থেকে সিপিডি শুরু হল। আর এত বছরের অনেক ঝামেলা পেরিয়ে ২০২৩-এর ১৬ জানুয়ারি সিপিডি-র ঘরের উদ্বোধন হয়েছিল। প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের যে সার্ভিস পাওয়া প্রয়োজন সেটা আমরা দাবি তুলি, বিশ্ববিদ্যালয় সেই দাবিটা মেনে নিয়ে সেন্টারটি তৈরি করে।
প্র: সেন্টারটা তৈরি হয়ে পড়েছিল অনেক দিন। প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের জন্য তৈরি হলেও আপনারা তা ব্যবহার করতে পারছিলেন না। সেই জায়গা থেকেই শুরু হয় আপনাদের লাগাতার আন্দোলন, যা যথেষ্ট জোরদার ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এতদিন লেগে গেল ঘরটা পেতে, সেন্টারটা ফিরে পেতে। ঠিক কোন্ জায়গায় থেকেবাধা আসছিল?
উঃ (যীশু) দেখুন, ছাত্রছাত্রীরা কোনও একটা সেন্টার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও একটা পরিকাঠামো পরিচালনা করবেন, তাঁদের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকবে – আইডিয়া হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা অনেকটাই কমে গেছে। মানে ডিপার্টমেন্ট-এ কোনও একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে স্টুডেন্টরা সেটা আয়োজন করল তা ঠিক আছে। কিন্তু একটা স্বাধীন সেন্টার সেটাতে স্টুডেন্টদের স্টেক থাকবে, আমার ধারণা স্টুডেন্টদের প্রতিনিধিত্ব যবে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শাখায় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেমন ইসি-তে এক সময়ে স্টুডেন্টদের প্রতিনিধিত্ব ছিল, বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি কাউন্সিল-এও স্টুডেন্ট প্রতিনিধি থাকতেন – সেগুলো সবই তুলে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আর কোনও সেন্টার নেই যেখানে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব আছে।
সেই জায়গায় আমাদের একটা খুব জোরালো পয়েন্ট ছিল – প্রতিবন্ধীদের নিয়ে গবেষণা করুন আর যাই করুন তাতে তাঁদের শামিল করতে হবে। বিভিন্ন সার্কুলার, বিভিন্ন আইনের রেফারেন্স দিয়ে এটা বলেছিলাম। এবার ঘটনা হল, ২০১৭ পর্যন্ত আমরা এখন যেখানে বসে আছি সেই ঘরটার কোনও জায়গা আমরা অ্যাক্সেস করতে পারতাম না, মানে যেতেই পারতাম না। যা হত, আমরা দরজা দিয়ে ঢুকে চেয়ার পেতাম বসার জন্য। অফিস সামলানোর জন্য দু’জন বসে থাকতেন। আমাদের কাছে জানতে চাইতেন কী দরকার। আমরা হয়তো বলতাম কোনও বই দরকার। বলে দিতেন – “স্লিপ দিয়ে যাও, আমরা ফোন করে দেব, এসে নিয়ে যাবে।” এছাড়া আর কোনও কাজ হত না। আমরা আসতাম, তারা আমাদের কোনও একটা ফেসিলিটি দিতেন, আমরা চলে যেতাম।
প্র: মানে, আপনারা যে সার্ভিস দাবি করছিলেন, সেই সার্ভিস-এর নামে এটুকুই আপনাদের দেওয়া হত?
উঃ (যীশু) প্রথমদিকে এটুকু ছিল, পরের দিকে সেটাও কমে গেল। একটা সেন্টার সেটা যে যৌথ অংশীদারিত্বে চলবে এরকম ব্যাপার ছিল না। আইডিয়া ছিল – ওনারা সার্ভিস দেবেন, আমরা নেব, ব্যাস। এতদিন এভাবেই চলেছে। শেষে যখন সেটাও বন্ধ হয়ে গেল তখন আমাদের বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু হল।
দেখুন, বাস্তব হল প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হল – ইন্টারেস্ট-এর খুব অভাব। যেমন ধরুন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অ্যাকাডেমিক স্কোর-এর ব্যাপার থাকে, প্রমোশন হতে পারে, ইনক্রিমেনট হতে পারে, অ্যাকাডেমিক কেরিয়ারে লাভ আছে কিছু – এইসব যাতে না হচ্ছে তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ ইন্টারেস্টেড হন না। সেইজন্য যতদিন রিসার্চ ছিল, যদিও বা কিছুটা উৎসাহ ছিল, কারণ যাঁর আন্ডার-এ রিসার্চ তাঁর অ্যাকাডেমিক স্কোর হবে, যখনই সার্ভিস-এর দিকে ব্যাপারটা ফোকাস করল তখন কোনও অধ্যাপক আর খুব একটা ইন্টারেস্টেড হলেন না। তাঁদের মনোভাবটা দাঁড়াল, “এদের জন্য লাইব্রেরি তৈরি হবে বা ব্যাটারি অপারেটেড গাড়ি চলবে ক্যাম্পাসে – এগুলোর সঙ্গে আর আমাদের কী আছে। এগুলো খুবই সামান্য সিভিল-এর কাজকর্ম। তাই আমাদের আর কোনও ইন্টারেস্ট নেই।” যার ফলে সিপিডি যখন তৈরি হল ২০১৮-র জানুয়ারি মাসে, তখন থেকে ২০১৮-র সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর তেমন কোনও অ্যাক্টিভিটি ছিলই না। একটা কমিটি ছিল যা কখনও কখনও মিটিং-এ বসত। সেখানে স্টুডেন্ট প্রতিনধি থাকতেন চারজন। কোনও কাজই হত না। একটা ছোট ঘর ছিল অফিস হিসাবে এখানে একটি বিল্ডিং-এর ভেতরে। সিপিডি তৈরির পর সেটা কোনও দিন খোলা হয়নি। মিটিংগুলো মূলত রেজিস্ট্রার-এর অফিসেই হত। তারপর যখন আমরা অ্যাক্সিসেবল লাইব্রেরি তৈরির জন্য আন্দোলন করলাম, যে দুটো টো-টো এখন প্রতিবন্ধী স্টুডেন্টদের জন্য ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে সেগুলোর জন্য আন্দোলন হল – তখন থেকে সিপিডি-কে কেন্দ্র করে বোঝা গেল একটা কিছু হচ্ছে। তারপর ২০১৯ সালে একটা কম্পিউটার ল্যাব তৈরি হল, ই-রিসোর্স রুম নাম দিয়ে। তখন মাস্টারমশাইরা, বা অধিকাংশ মানুষই ভেবেছিলেন ওদের কিছু ফেসিলিটি আছে, তাই এটা নিয়ে আলাদা করে কনসার্ন হওয়ার কিছু নেই। সেইজন্য এই যে ডিসএবিলিটি সেন্টার-এর সেট-আপ এটা আমাদের কেন দরকার, সেটা আমরা কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না। এই সেট-আপটা একটা অফিস, সেখানে রিসার্চ হয়, সেখানে একটা পরিকাঠামো আছে, এই সবই একটা নির্দিষ্ট পারপাস-এ ব্যবহার করা হয়, সেটাকে ডিস্টার্ব না করে তোমাদের জন্য আলাদা করে সেট-আপ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে – এইটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে যুক্তি। আর আমাদের সম্পর্কে বারবারই এটা বলা হত যে, “যতই দাও, ওদের দাবি মিটবে না।” আমরা বোঝাতে পারিনি তখন যে আমরা বেশি চাইছি না, আমাদের জন্য যেটা তৈরি করা হয়েছিল, সেটাই আমাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হোক। ধরুন, ডিসএবিলিটি নিয়ে রিসার্চ কেউ যেকোনও অন্য বিল্ডিং-এ করতে পারেন, কিন্তু প্রতিবন্ধী মানুষকে আপনি যেকোনও জায়গায় পাঠিয়ে দিতে পারেন না। যেখানে কম্পিউটার ল্যাব বলে আমাদের পাঠানো হয়েছিল, সেই জায়গাটা ইনঅ্যাক্সিসেবল তো বটেই বিপজ্জনকও ছিল। তার বাঁ দিকে একটা পুকুর, রেলিং-এর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যেকেউ পুকুরে পড়ে যেতে পারেন। এই বিষয়গুলি তাঁরা ভাবেননি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা আমরা বারবার বলেছি – এই সেন্টারটা যে দু’জন চালাতেন মনোজিৎ মন্ডল আর মুক্তিপদ সিনহা, তাঁদের মধ্যে মুক্তিপদ সিনহার বলা যেতে পারে স্টুডেন্টদের প্রতি একটা সাবমিসিভ অ্যাপ্রোচ ছিল – “আমি তোদের সমস্যাগুলো বুঝি”, কিন্তু মনোজিৎ মন্ডল কখনওই কোনও কমিউনিকেশন প্রসেস-এ আসেননি এবং আমরা যতটা দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রত্যেকটি লোক তাকে ভয় পায়। ভাইস-চ্যান্সেলার থেকে রেজিস্ট্রার। তাই যতবার আমরা ভাইস-চ্যান্সেলারকে বলেছি যে সেন্টার-এ আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে, আমাদের ঘরটা অ্যাক্সেস করতে দেওয়া হোক, তখন উনি বলেছিলেন, “ওটা ছেড়ে দাও, তোমাদের জন্য আলাদা অ্যাকোমোডেশন আমি বানিয়ে দেব। একটু ধৈর্য ধরো, ওটা নিয়ে তোমরা ঘাঁটিয়ো না।” কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর পর যখন থেকে স্টুডেন্টদের সংখ্যা হু-হু করে বাড়তে লাগল, যেমন এখন এফএসডি-র সদস্যই প্রায় ১০০, তার বাইরেও প্রতিবন্ধী স্টুডেন্টরা রয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুমানিক ২৫০ জন প্রতিবন্ধী পড়ুয়া আছেন – সেই সংখ্যা মিলিয়ে সেন্টার-এর এই ঘরটাও যথেষ্ট নয়। আর যে ঘরটা দেওয়া হচ্ছিল সেটা ছিল ২০-২২ জনের বসার মতো।
এই পরিস্থিতিতে আমরা সাংগঠনিকভাবে চাপ তৈরি করতে থাকি। জানতে চাই – একদিকে আপনি বলছেন ফান্ড-এর অভাব আছে, ইউজিসি-র প্রজেক্ট-এর টাকা পুরোটা পাইনি, তখন একটা পরিকাঠামো পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে, এবং উল্লেখ করব যে ডিসএবিলিটি রিসার্চ তখন বন্ধ হয়ে গেছে ২০১৯ থেকেই, তাহলে কেন এই জায়গাটা অন্য লোক দখল করে থাকবেন? আস্তে আস্তে শিক্ষকরা বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন, রাজনৈতিক কারণে অনেকেই হয়তো সরাসরি সামনে কথা বলেননি, কিন্তু আমাদের বক্তব্যের যেহেতু একটা যৌক্তিকতা ছিল, সেইজন্যই বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সেটাও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে বিশ্ববিদ্যালয় পারেনি। সেইজন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আমরা আর কোনও উপায় না দেখেই ডেমোনস্ট্রেশন করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এবং আমরা বিশ্বাস করি, সেটার জন্যই আমরা এই সিপিডি-র ঘরটা ফিরে পেয়েছি।
প্র: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আন্দোলন ও বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনগুলিতে সব সময়েই স্পষ্ট ও দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের অধিকার আন্দোলনে একইরকম বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর জোটবদ্ধ অংশগ্রহন কি দেখা গেছে?
[সিমারুল এফএসডি যখন সিপিডি নিয়ে আন্দোলন করছিলেন তখন তাতে অংশ নিয়ে অনশন করেছিলেন এবং ছাত্র ইউনিয়নের বিক্ষোভ অবস্থানেও ছিলেন]
উঃ (সিমারুল) সত্যিই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা রাজনৈতিক বাতাবরণ আছে। এফএসডি জন্মলগ্ন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বৃহত্তর ছাত্রসমাজ তার সঙ্গে প্রতিবন্ধকতার ইস্যু ছাড়াও বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলেছে। এটা বলতে পারব না যে, প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ যে রাজনৈতিক সমাজ তা পুরোপুরি মিশে গেছে, আবার একেবারে যে মেশেনি তাও নয়। ২০১৭তে যখন এফএসডি তৈরি হয় তখন আমাদের যে আন্দোলন, দাবি-দাওয়া তাতে সাড়া পেয়েছি সাধারণ ছাত্রসমাজের থেকে। সিপিডি নিয়ে আমাদের আন্দোলন যখন জোরদার হয়ে ওঠে তখন যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রসমাজ আমাদের পাশেই ছিল। সে সময়ে আমাদের প্রতিবন্ধীবান্ধব স্পেস তৈরি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও পরবর্তীতে তা হয়নি। এরপরেই কোভিড-১৯ মহামারী শুরু হল। আন্দোলনে কিছুটা ছেদ পড়ল। তারপর লকডাউন উঠে যাওয়ার পর আবার আমরা যখন আন্দোলন শুরু করলাম, সাধারণ ছাত্রসমাজকে তখনও পাশে পেলাম। এই বিষয়ে কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই জনবল আমাদের একটু কম তো ছিলই। কারণ সংখ্যার নিরিখে যদি বলেন তাহলে সেখানে সাধারণ ছাত্রসমাজের সাপোর্ট কোথাও কোথাও আমাদের জন্য কম হয়েছে তা সত্যি। আসলে বাস্তব হল – লকডাউনের পর কোনও সংগঠনই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন করে দানা বাঁধাতে পারছিল না। ইদানীং তারা ধীরে ধীরে আবার সংঘবদ্ধ হচ্ছে। অন্যদিকে, এফএসডি লকডাউন পরিস্থিতিতেও প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের যোগাযোগ বজায় রেখেছিল, রাজনৈতিক চর্চা-আলোচনা চালিয়ে গেছিল। এফএসডি শুরু থেকেই যাদবপুরের বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠেছিল। ২০১৮তে অ্যাডমিশন টেস্ট-কে কেন্দ্র করে যখন অনশন হয়েছিল আমাদের প্রতিনিধিও সেখানে অনশন করেছিলেন।
মনজিৎ: প্রতিবন্ধী আন্দোলনে এফএসডি-র স্টুডেন্টরা যখনই সাহায্য চেয়েছে বাকি রাজনৈতিক সংগঠনগুলি এসেছে। কিন্তু প্রতিবন্ধকতার খুব কোর বা মূলের যে ইস্যুগুলো, যেমন সংরক্ষণ অথবা কোনও প্রতিবন্ধী ছাত্রকে হেনস্থা করা হল, ধরা যাক কাওকে পিএইচডি-তে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না, এই ক্ষেত্রগুলোতে অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন পাশে এসে দাঁড়ায়নি। হয়তো তাদের কাছ থেকে আশা করাও যায় না। তবুও যদি মৌখিক সমর্থনটুকুও অন্তত পাওয়া যেত, আমরা মনে হয় আরেকটু বল পেতাম। কারণ, এই ধরনের তথাকথিত ছোটখাটো হেনস্থাগুলি যখন প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষ করে তখন তাঁদের মনেও ভয় থাকে যে সংখ্যা যেন বেশি না হয়ে যায় ছাত্রদের, যাতে একজোট হয়ে কথা না বলতে পারে। তখন আমরা ১০-১২ জন গিয়ে নিজেদের দাবি জানাতে থাকলে তাঁরা ঝোলাতে থাকেন, দিন পিছোতে থাকে। এফএসডি যদিও লড়াই থেকে কখনও পিছু হটে না, দিনের পর দিন লেগে থেকে নিজেদের দাবি আদায় করে; কিন্তু তা সব সংগঠনের পক্ষে সম্ভব নয়।
সূরজ: এফএসডি-র যেটা মূল বৈশিষ্ট্য তা হল এটি এমন একটি ছাত্র সংগঠন যারা প্রতিবন্ধীদের মূলত দু’টি বিষয় নিয়ে কথা বলবে। এক – প্রতিবন্ধীদের জন্য আইনে যে অধিকারগুলি আছে, আরপিডি অ্যাক্ট-এ এবং দুই – আমাদের মর্যাদা যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে। আমি ভেবেছিলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা শুরু হওয়ার পর অন্যান্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও তা ছড়াবে কারণ সবখানেই প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী আছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ না হলেও একটা সেন্টার ছিল, এমন বহু বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে এটাই নেই। কিন্তু এই বিস্তারলাভটা ততটা গতি পায়নি। যেসব ইস্যুগুলো আমরা খুব ভালোভাবে অ্যাড্রেস করে জনসাধারণের কাছে নিয়ে যেতে পেরেছি, সার্বিকভাবে বোঝাতে পেরেছি, সেগুলোতে তত বেশি সাপোর্ট পেয়েছি। আমার মনে হয় ভবিষ্যতে সিপিডি-র আন্ডার-এ নানান ইস্যু নিয়ে, ডিসেবিলিটি সংক্রান্ত রিসার্চ, ডিসএবিলিটি নিয়ে স্টাডিজ – অপ্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের সরাসরি ইনক্লুড করে একটা ইনক্লুসিভ এনভায়রনমেন্ট তৈরি করে যদি তার মধ্যে দিয়ে রিসার্চটা হয় তাহলে আরও বৃহত্তর পরিসরে ছড়ানো যাবে। ডিসএবলড মানুষরাই শুধু ডিসএবিলিটি নিয়ে পড়াশোনা-রিসার্চ করবেন, জানবেন, এমনটা ভাবলে হবে না, তাহলে একটা নির্দিষ্ট পরিসরেই আটকে থাকা হবে।
যীশু: বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও তাদের বিভিন্ন চিন্তাভাবনা আছে। ২০১৮-র ১০ জানুয়ারি যখন প্রথম মিছিল করেছিলাম আমরা ফিরে আসার সময়ে রাস্তায় শুনি একজন বলছেন, “কী অবস্থা, প্রতিবন্ধীরাও এখন মিছিল করছে!” মানে তখন একটা সেনশেসন তৈরি হয়েছিল আর ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছিল – প্রতিবন্ধীরাও রাস্তায় নেমেছে, না গেলে কী চলে? এই জায়গা থেকে ছাত্র সংগঠনগুলোর একটা পার্টিসিপেশন ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হল – ইস্যুটাকে কতটা বুঝে মিছিলে গিয়েছিলেন তাঁরা? সেইজন্য পরে প্রতিবন্ধকতার নানা ইস্যু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন তাদের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে, প্রতিনিধিত্ব আছে কিন্তু পার্টিসিপেশন কম, এটা ২০১৯-এ বিশেষভাবে দেখেছি।
প্র: মানে, বৃহত্তর রাজনীতির সঙ্গে প্রতিবন্ধী আন্দোলনের বিষয়টাকে তাঁরা জুড়তে পারছেন না?
উঃ (যীশু) সূক্ষ্মভাবে দেখলে, ব্যাপারটা একটা হাই পলিটিক্স-এর জায়গায় চলে গেছে। এখানে যে রাজনীতির কাঠামো সেখানে হাই পলিটিক্স – ওদের (প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী/এফএসডি) সঙ্গে থাকতে হবে। কিন্তু মাস পলিটিক্স-এ যেভাবে এটা আসার কথা, সবাই মিলে ডিসএবিলিটি নিয়ে কনসার্ন হওয়া, এটা হয়নি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীবাদী আন্দোলনেরও একই সমস্যা। ধরুন, একটা মিছিল বেরোল যৌন হেনস্থার কোনও ঘটনার প্রতিবাদে, তাতে লোকজন যাবে। কিন্তু স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে কোনও ক্যাম্পেইন করতে গেলে লোকজনের আর কোনও ইন্টারেস্ট থাকবে না। এফএসডি তৈরি হওয়ার পর থেকে প্রত্যেক বছর আমরা মাস কনভেনশন করি, প্রথমে ছিল যে কোনও একটা সমস্যা ও তার সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে করা। প্রথমদিকে প্রচুর ছাত্র, অধ্যাপকেরা এসেছিলেন। যত দিন গেছে সংখ্যাটা কমেছে আর এখন এফএসডি-র কয়েক জন থাকি এবং যে সংগঠনগুলোর সদস্যসংখ্যা বেশি তারা তাদের প্রতিনিধি পাঠায়। ডিসএবিলিটি নিয়ে আবার চর্চাটা কমে যাচ্ছে। ২০১৮তে এটা জোরালো ছিল। যদিও এই কমে যাওয়ার পেছনে মহামারী একটা বড় কারণ। ২০১৮-১৯-এ যারা ছিলেন তারা তো বেরিয়ে গেছেন, তারা কী দেখেছিলেন ডিসএবিলিটি আন্দোলনে সেটা তাদের সংগঠনে জানানোর মতো এখন তো কেউ নেই।
প্র: মনজিৎ মন্ডল শাসক গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ। সিপিডি দখল করা নিয়ে আপনারা সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক রাজনৈতিক ইস্যু নিয়েই ছাত্র সংগঠনেরা প্রতিবাদ করে। এক্ষেত্রেও আপনাদের সহপাঠীরা যাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা কি আপনাদের সঙ্গে ছিলেন?
উঃ (যীশু): যখন এফএসডি তৈরি হয় তখন মনজিৎ মন্ডলের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার কথা মাথায় রেখেই আমরা টিচারদের অ্যাসোসিয়েশনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করি, যাতে তাঁরা আমাদের সাহায্য করেন। কোনও পলিটিকাল ফায়দার জন্য নয়, বিষয়টা বোঝার জন্য। জুটা-র সেক্রেটারি ছিলেন তখন অধ্যাপক নীলাঞ্জনা গুপ্ত। মনজিৎ মন্ডল যে দল করেন, অধ্যাপক গুপ্ত তার বিরোধী দলের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন বলে শুনেছি। আমরা যখন এই সমস্যার প্রথম দিকে তাঁকে বিষয়টি জানাতে গেলাম, তিনি শুনলেনই না, গুরুত্বও দিলেন না। এখন যদিও জুটা-র নেতৃবৃন্দ বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট কনসার্ন, মাস্টারমশাইরাও অনেকটা সচেতন। আমি অন দ্য রেকর্ডই বলছি, তখনই আমি বুঝেছিলাম খেলাটা হাই-পলিটিক্স-এর। ডিসএবিলিটি-কে সামনে রেখে মনজিৎ মন্ডল নিজের রাজনীতির জায়গা তৈরি করছে, সেটায় বাধা দিতে গেলে অনেকেরই অনেক অসুবিধা তৈরি হবে। সেইজন্যই আমি কোন্ ইস্যুতে কথা বলছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ডিসএবিলিটি নিয়ে কথা বলার মূল্যে কী আমি আমার কোনও সুবিধা ছাড়ব? সেইজন্যই অনেক মানুষ, অনেক অর্গানাইজেশন শেষ পর্যন্ত পার্টিসিপেট করেনি, এখনও যখন আমরা আন্দোলন করি, ডিসএবিলিটি নিয়ে কথা বলি, তখনও অনেকে পার্টিসিপেট করেন না, যাঁদের আলাদা কোনও ‘ভেস্টেড ইন্টারেস্ট’ আছে।
প্র: ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ যেদিন এই ভবনটি নতুন করে খুলল, তখন আপনাদের নিজেদের মিছিলে অংশগ্রহন ছাড়াও বাকিদের অংশগ্রহন কেমন ছিল?
উঃ (সূরজ) সেদিন আমাদের দিক থেকে অংশগ্রহন ভালো ছিল, কিন্তু অপ্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের তরফ থেকে অংশগ্রহন আশানুরূপ হয়নি, কারণ সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও দু’টো মিছিল ছিল একই সময়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ও আর্টস ফ্যাকাল্টির। তবে সব মিলিয়ে ১০০ জন অংশগ্রহন করেছিলেন। সিপিডি-র অনুষ্ঠান যেহেতু তাই কর্তৃপক্ষের তরফে কয়েক জন ছিলেন। প্রো-ভিসি, কয়েক জন অধ্যাপক উপস্থিত ছিলেন।
প্র: সিপিডি-তে যে রিসার্চ বন্ধ হয়ে গেছিল সেটার কারণটা সংক্ষেপে একটু বলুন এবং এখন এই নতুন করে খোলার পর আপনারা কী ধরনের কাজ করবেন বলে ভাবছেন?
উঃ (যীশু) ২০১২-১৭ পর্যন্ত ইউপি ওয়ান-এর আন্ডার-এ ফান্ডিং থাকায় ডিসএবিলিটি স্টাডিস চলেছিল। এই সেন্টারে যখন শিফটিং-এর কাজ চলছে, তখন আমরা বলি যে আপনারা ডিসএবিলিটি নিয়ে কাজ করেন না, তাহলে যে বইপত্রগুলো ডিসএবিলিটি সংক্রান্ত কিনেছিলেন, সেগুলো আমাদের দিয়ে যান। তখন একটা অদ্ভূত কথা জানলাম, ওনারা বললেন – ডিসএবিলিটি স্টাডিজ-এর কোনও বই তো আমরা কিনিনি। ২০১২-১৭ পর্যন্ত রিসার্চ চলেছে, অথচ বই কেনা হয়নি! তাহলে কিসের উপর রিসার্চ চলেছে? নিশ্চয়ই সার্ভে ভিত্তিক কাজ হয়েছে। সেগুলোর কোনও কাগজও আমরা পাইনি। কোনও ডকুমেন্ট সিপিডি-কে দিয়ে যাওয়া হয়নি। ২০১৭-তে যখন আমরা সার্ভিস দাবি করলাম আর ওরা বললেন যে এখানে সার্ভিস দেওয়া হয় না, শুধু রিসার্চ হয়, তখন থেকে সার্ভিস সেন্টার আলাদা করে তৈরি হল এবং ডিসএবিলিটি স্টাডিস তখন পুরোদমে রিসার্চ করবে। ২০১৭-১৯ পর্যন্ত ওরা প্রজেক্ট-টা এক্সটেন্ড করল। ২০১৯-এ যখন রাষ্ট্রীয় উচ্চ শিক্ষা অভিযানের টাকা এল, তখন এক কোটি টাকা বরাদ্দ হল ডিসএবিলিটি খাতে খরচ হওয়ার জন্য। তার মধ্যে ৪০ লক্ষ টাকা রিসার্চ এবং ৬০ লক্ষ টাকা সার্ভিসের জন্য ব্যয় হল। যদিও পুরো টাকাটা আসেনি, কিছুটা টাকা এসেছিল, বাকি টাকাটা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা জানতে চেয়েছিলাম ডিসএবিলিটি স্টাডিস রিসার্চের বরাদ্দ ৪০ লক্ষ টাকা কীভাবে ব্যয় করবে? জানলাম ১৫ লক্ষ টাকা খরচ হবে অডিও-বুক তৈরিতে, ডিসএবিলিটি স্টাডিজের ভেতরে! এটা আসলে সার্ভিস। ২৫ লক্ষ টাকা খরচ হবে প্রশান্ত পালের লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনীর বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদে। ২০১৯-এর মার্চে আমরা এটি নিয়ে এগজিকিউটিভ কাউন্সিলে যাই – ঘরভর্তি অধ্যাপক, অফিসার, ভাইস-চ্যান্সেলর। আমরা শুধু বলেছিলাম – এই প্রজেক্টগুলোর সঙ্গে ডিসএবিলিটির কী সম্পর্ক বুঝিয়ে বলুন। ইসি-র সবাই চুপ। শেষ পর্যন্ত আমরা তাঁদের এক সপ্তাহ সময় দিয়ে অবস্থান শুরু করে বলেছিলাম, আলোচনা করে আমাদের জানান। কিন্তু ওরা উত্তর দিতে পারেননি। ইসি ভেঙে যায়, অধ্যাপকরা ঘরে তালা দিয়ে চলে যান। আমরা অবস্থানটা চালিয়েছিলাম। এক সপ্তাহ পরে তাঁরা এসে জানান – এটা ঠিক হচ্ছে না, সে সময়ে নানা ব্যাকডোর কমিউনিকেশন করার চেষ্টা করেন। আমরা বলেছিলাম – আপনারা ডিসএবিলিটি রিসার্চটা বন্ধ করতে বলুন। ২০১৯-এ সেন্টার ফর ডিসএবিলিটি স্টাডিজ বন্ধ হয় ও ৪০ লক্ষ টাকা সার্ভিসের জন্যই দেওয়া হয়। ডিসএবিলিটি স্টাডিজ বন্ধ হওয়ার পর জায়গাটা দখল করে রাখতে ওরা নতুন নামে আরেকটা সেন্টার খুলল – সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন কালচারাল ডাইভার্সিটি । মানে ২০১২-২০১৯ ডিসএবিলিটি স্টাডিজের আউটকাম জিরো। সুতরাং আমাদের শুরু করতে হলে জিরো থেকেই শুরু করতে হবে। বিশেষত রিসার্চ।
মনজিৎ: যাদবপুরে ডিসএবিলিটি নিয়ে রিসার্চ আগে হয়েছে বলে তো শুনিনি। আমরা আলোচনা করেছি, প্রাথমিকভাবে আমরা কী চাইব, কী দরকার আমাদের প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্রে। আমার মনে হয়েছিল, বাংলায় তো এ ধরনের আলোচনা হয় না, তাই অনুবাদ থেকে যদি আমরা শুরু করি তাহলে দৃষ্টিহীন যাঁরা বা শারীরিকভাবে যাঁরা প্রতিবন্ধী তাঁদের যে অটোবায়োগ্রাফি রয়েছে, সেগুলোকেই যদি আমরা বাংলায় অনুবাদ শুরু করি, যে বইগুলো ডিসএবিলিটি স্টাডিজ-এর গোড়ার দিককার বই, সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী – সেগুলোকে অনুবাদ করে বাংলার পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করতে চাই। সমস্যা হল প্রতিবন্ধী মানুষেরা নিজেরাই অনেক সময় জানেন না তাঁদের কী প্রয়োজন। শিক্ষা, সংরক্ষণ, ভাতা এগুলোর জন্য মানুষ জানে লড়াই করতে হয়, অধিকার চাইতে হয়, কিন্তু আমার যে যৌনতার অধিকার আছে, বিনোদনের অধিকার আছে বা এফএসডি- যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও তো একটা বড় জগৎ আছে, যেখানে বিরাট রাস্তা, তার পাশে ফুটপাথ আর সেই ফুটপাথে প্রচুর ভিড় হয়, সেই ভিড়ে মানুষ কীভাবে দেখে আমাদের, তাঁদের মানসিকতা কীরকম? আমরা যখন ঐ ফুটপাথে, ঐ ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতে ভয় পাই, সেই ভয়টাকে আমরা নিজেরা কীভাবে দেখব? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা খুব দরকার। এছাড়াও প্রতিবন্ধকতার যে ইতিহাস, প্রতিবন্ধীরা ইতিহাসে নিজেদের ইতিহাস কোথায় দেখে? পৃথিবীর ইতিহাস হোক, রাষ্ট্রের গড়ে ওঠার ইতিহাস, একটা গোটা সংস্কৃতি তৈরি হওয়ার যে ইতিহাস তার নিরিখে প্রতিবন্ধীরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? কাল যদি প্রতিবন্ধীদের কোনও প্রয়োজন না থাকে তাহলে তো রাষ্ট্র বলতে পারে, এদের ধ্বংস করা হোক। সেই প্রয়োজনীয়তা আমরা দেখাব কীভাবে? কোনও উত্তর আমাদের কাছে আছে? সেই উত্তরটা খোঁজার জন্য রিসার্চ প্রয়োজন, নিজেদের খোঁজা প্রয়োজন – আমরা কোথায় আছি এবং আমরা নিজেদের সম্পর্কে জেনে সমাজকে কিছু জানাতে পারি কি না। তারপর আশা করতে পারি যে সমাজ আমাদের জন্য এগিয়ে আসবে।
প্র: মনজিৎ মন্ডলের দখলদারি থেকে এই সেন্টারকে মুক্ত করার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে বলে মনে হয় এবং সেন্টার থেকে আপনাদের কাজের যে পরিকল্পনা তাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কতটা সহায়তা করবে বলে মনে হয়?
উঃ (মনজিৎ) : সবে তো নতুন করে শুরু হল, আবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে দরবার করতে হবে, যাতে আমরা এফএসডি-র সঙ্গে যাঁরা যুক্ত সকলেই অভ্যস্ত। কর্তৃপক্ষের একটা ঔদাসীন্য আমাদের প্রতি আছে। যাতে শিক্ষক বা প্রশাসকদের কোনও স্বার্থ নেই তার পেছনে তাঁরা কেন সময় বা শ্রম খরচ করবেন – এমন একটা মনোভাব। আমাদের বারবার বলতে হবে, বারবার ফিরে আসতে হবে। প্রাপ্তি বলতে এটুকুই যে সেন্টারটা পুনরুদ্ধার করতে পারলাম। এখনও আগের মতোই কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে যেমন একবারে কিছু পাওয়া যেত না, এবারেও সেটাই হবে। সচেতনতার পরিসর এখনও কর্তৃপক্ষের মধ্যে তৈরি হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের তরফ থেকে উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেলে এটাও বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা সেটা করব না।
যীশু: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ক্যাম্পাসে মনোজিৎ মন্ডলের মতো মানুষের যে প্রতিপত্তি ছিল, বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি রাজনৈতিকভাবেও যখন তাকে পরাস্ত করতে পারেনি, তখন শুধু প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের ইস্যুর ভিত্তিতে ওনাকে এই জায়গাটা ছাড়তে হল, এটা নিশ্চয়ই খুব ভালোভাবে নেবেন না আর প্রতিশোধস্পৃহা বশত কিছু যে করবেন না, এটা আমি বিশ্বাস করি না। সেই কারণেই প্রতিকূলতা আছেই, তা আসবেই। এই ক্যাম্পাসে ডিসএবিলিটি নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে প্রশাসনের তরফে কিছু সমস্যা তো আছেই। তাই কোনও ছাত্র যদি ইন্ডিভিজুয়ালি টার্গেট হলে ওনারা যে খুব সাহায্য করবেন তা আমি আশা করি না। তবে, যাদবপুর ক্যাম্পাসে ডিসএবিলিটি নিয়ে চর্চা দু-এক বছর হয়েছে, আবার কিছুটা কমে গেছে, কিন্তু একটা ছাত্র সংগঠন যদি প্রতিবন্ধকতা নিয়ে নিরন্তর চর্চা করে বা কথা বলে তাহলে এই ক্যাম্পাস থেকে ডিসএবিলিটি নিয়ে আলোচনা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে তা নয় বরং তা ধীরে ধীরে আরও শক্তিশালী হবে আর তার দায়িত্ব আমাদের সবার। একদিকে যেমন সমাজ, প্রতিষ্ঠান বা বাইরের জগৎ আছে, সেরকম কমিউনিটির ভেতরেরও কিছু সমস্যা আছে। এটা চর্চায় একদম আসে না। যেমন এফএসডি-র ভেতরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনেও দেখা যায় যেহেতু তাঁরা অন্যদের তুলনায় কিছুটা প্রিভিলেজড, তাঁরা অন্যদের তুলনায় বেশি এগিয়ে আসতে পারেন। তবু আমরা চেষ্টা করেছি বিভিন্ন ক্যাটাগরির প্রতিবন্ধী মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করার। কিন্তু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষেরা প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনে তাঁদের স্টেক সম্পর্কে কী ভাবেন? তাঁরা কি এমন মনে করেন যে তাঁরা একমাত্র স্টেক হোল্ডার? বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আমরা আসি – কেউ স্পেশাল স্কুল, কেউ ইনক্লুসিভ এডুকেশন, বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থান, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যাকগ্রাউন্ড। আমরা কি কোনও হোমোজেনাস কালচার তৈরির চেষ্টা করছি? না কি সাংস্কৃতিক যে দ্বন্দ্ব সেটা চলতেই থাকবে? আমরা কি এই বৈচিত্র্যটা বজায় রাখতে চাইছি? এটা শুধু থিওরি নয়, বাস্তব জীবনে প্রভাব ফেলে। যেমন প্রতিবন্ধী পুরুষদের প্রতিবন্ধী নারীদের প্রতি অ্যাপ্রোচ বা মানসিকতা কী? তাঁরা কি পিতৃতন্ত্র থেকে বেরোতে পেরেছেন? এগুলো না ভাবলে সংগঠনও স্টিরিওটাইপ হয়ে যাবে।