তিথি রায়-এর প্রতিবেদন।
“আমরা চলি সমুখ পানে, কে আমাদের বাঁধবে,
রইল যারা পিছুর টানে কাঁদবে তারা কাঁদবে-”
উদাত্ত কণ্ঠে মঞ্চের ওপর এই কবিতা বলে চলেছেন রিষড়ার ঝুমা সাঁতরা। ঝুমার মুখ অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়া, দুটো চোখ দৃষ্টিহীন। ২০১৪ সালে, প্রেমের প্রস্তাব নাকচ করায় তাঁর ওপর এই আক্রমণ ঘটে। তবুও, সেসবের ক্ষত তার কন্ঠকে, স্পর্ধাকে, টিঁকে থাকার জেদকে পুড়িয়ে ফেলতে পারেনি।
ওই একই মঞ্চে উপস্থিত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি চৌধুরী আলি জিয়া কবীর জানাচ্ছেন, “অ্যাসিড-আক্রান্তদের মধ্যে মহিলারা সংখ্যায় বেশি। এবং আপনারা যদি খেয়াল করে দেখেন আমাদের দেশে অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনাগুলো বেশিরভাগটাই ঘটে সমাজে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের মধ্যে। তাই, তথাকথিত সমাজের উঁচু তলার মানুষ যারা আইন তৈরি করে, শাসনকার্য চালায় তাদের এই জাতীয় অপরাধ দমনে সদিচ্ছার অভাব চূড়ান্ত।”
অদম্যসাহসী অ্যাসিড আক্রমণ সার্ভাইভারদের পাশে দাঁড়াচ্ছে ব্রেভ সোলস
গত ৩০ শে মার্চ কলকাতার ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে, অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে আলাপ-আলোচনার আয়োজন করেছিলেন দিল্লিবাসী শাহীন মালিক ও তাঁর সংগঠন ব্রেভ সোলস ফাউন্ডেশন। শাহীনের উপরেও অ্যাসিড আক্রমণ হয়েছিল ২০০৯-এ। নিজের সেই লড়াই লড়তে লড়তেই তিনি মনস্থির করেন দেশের আরও অ্যাসিড আক্রমণ সার্ভাইভারদের পাশে দাঁড়াবেন। সেখান থেকেই, ২০২১-এ তাঁর সংগঠন ব্রেভ সোলস ফাউন্ডেশন তৈরি হয়। দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানার পরে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই তাঁরা গত এক বছর ধরে অ্যাসিড আক্রান্ত মহিলা ও পুরুষদের চিকিৎসা, আইনি সহায়তা এবং কর্মসংস্থানের কাজ করে চলেছেন নিরলস ভাবে। এ লড়াইয়ে তিনি একা নন। মীর ফাউন্ডেশন-এর মতো বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁর এই উদ্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। শাহীনের কথায়, “অ্যাসিড আক্রমণে যাঁদের চেহারা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে সমাজে তাদের সঙ্গে কেউ মিশতে চায় না, বাচ্চারা ভয় পায়”। তাই, তিনি সমাজের সব স্তরে এমন এক সচেতনতা তৈরি করতে চান, যার মধ্যে দিয়ে অ্যাসিড আক্রমণ সার্ভাইভার-রা ব্রাত্য না থেকে সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে পারবেন। তিনি আরও বলছেন, “আক্রান্তদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কর্মসংস্থান জরুরী, তবেই তাঁরা তাঁদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অপরাধের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে পারবেন।”
অ্যাসিড আক্রমণ সার্ভাইভার-রা কেমন আছেন
অনুষ্ঠানে উপস্থিত, মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গার আঙ্গুরা বিবি জানাচ্ছেন, তাঁর প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ায়, তাঁর স্বামী তাকে অ্যাসিড খাইয়ে দেয় ২০১৪ সালে। এখনো তাঁর কথা বলা, খাওয়া, হাঁটা-চলার সময় শারীরিক সমস্যা হয়। আবার, সোদপুরের সুনীতি, দেগঙ্গার কল্পনা, সুন্দরবনের পম্পার মত মেয়েরাও স্বামীর নির্যাতনের শিকার। অ্যাসিড আক্রমণ তাদের জীবন পাল্টে দিয়েছিল রাতারাতি। সুনীতির কথায়, “দু’বছর নিজেকে ঘর বন্ধ করে রেখেছিলাম, লোকে দেখলে কি ভাববে সেই ভয়ে।” সার্ভাইভার দমদমের সঞ্চয়িতা জানাচ্ছেন, হসপিটালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তাঁকে কোনো ওয়ার্ড-বয় খেতে দিতো না, এমনকি খাবার আনতে গেলে তাঁকে বারণ করা হতো। কারণ, তাঁর চেহারা দেখে বাকি রোগীরা অনেকেই অস্বস্তিবোধ করত।
মনোবিদ নিবেদিতা বসু চৌধুরীর মতে, “এধরনের ঘটনায় আক্রান্তদের কাছে নিজেদের পাল্টে যাওয়া চেহারা মেনে নেওয়া সহজ নয়। কিন্তু, একবার নিজেকে ভেতর থেকে মেনে নিতে পারলে, তখন সে ভিকটিম থেকে উইনারস হয়ে উঠবে”।
সার্ভাইভারদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট তাঁদের সামাজিক অবস্থান মোটেও ভালো না। তবে, তার চেয়েও বেশি দুর্ভোগ তৈরি হয় চিকিৎসার খরচ জোগাড় করা এবং আইনি পরিকাঠামোর মধ্য দিয়ে সুবিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে। ভুক্তভোগীরা প্রত্যেককেই বারবার করে জানাচ্ছেন, চিকিৎসার জন্য এক হসপিটাল থেকে আরেক হসপিটালে ঘুরতে হয়, বিচারের জন্য কোর্টে তারিখের পর তারিখ অপেক্ষা করতে হয়। মামলা করেও, অপরাধীর শাস্তি তো দূর অস্ত, যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণও জোটে না। আর, এই ক্ষোভই তাঁরা উগরে দিচ্ছেন নানা কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে। জোর গলায় তাঁরা দাবি জানাচ্ছেন, খোলা বাজারে অ্যাসিড বিক্রি বন্ধ হোক। তাঁদের তালিকায় আর যেন কোনও নাম যোগ না হয়। জেলা এবং দূরবর্তী মফস্বল থেকে চিকিৎসার জন্য, আইনি কাজে তাঁদের কলকাতায় ছুটে আসতে হয়। যা বেশ সময়সাপেক্ষ, বহু খরচাও হয়। সেকারণেই, কলকাতায় তাঁদের থাকার একটি হোম তৈরির দাবিতেও তাঁরা সরব হন।
সার্ভাইভার মনীষা পৈলানের কথায়, “প্রত্যেকটি মেয়ের সঙ্গে ঘটা অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সেখানে রয়েছে পিতৃতন্ত্রের দম্ভ। তুমি মেয়ে, তাই তোমায় ভোগ করব, নাহলে অ্যাসিড ছুঁড়ে দেব।” বিচারের আশায় কোর্ট চত্বরে চক্কর দিতে দিতে ক্লান্ত তিনিও। মনীষা আরও বলেন, “একজন অপরাধী যখন শাস্তি না পেয়ে ঘুরে বেড়ায় তখন, আমাদের চারপাশের সমাজে সেই অপরাধের মান্যতা তৈরি হয়।”
পশ্চিমবঙ্গে অপরাধের ছবিটা কেমন
অ্যাসিড আক্রমণ শুধুমাত্র একটি লিঙ্গ-ভিত্তিক হিংসা নয়। এমন সহজলভ্য হিংসা অনেক বেশি সর্বাত্মক হয়ে উঠেছে। গঙ্গাসাগরের স্কুলশিক্ষক সূর্যশংকর-এর মতো পুরুষ কিংবা বিরাটির সুরজিৎ কামাল-এর মত কিশোরও এই অপরাধের শিকার। কেন্দ্রীয় সংস্থা, এনসিআরবি-র তথ্য অনুযায়ী গোটা দেশে অ্যাসিড আক্রমণের মতো জঘন্য অপরাধের তালিকার উপরের দিকেই রয়েছে আমাদের রাজ্য অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ। অথচ, খোলা বাজারে দেদার বিকোচ্ছে অ্যাসিড। পাশাপাশি, ভুক্তভোগীদের দাবি অনুযায়ী, চিকিৎসার খরচ আকাশছোঁয়া, আইনি পরিকাঠামোও দুর্বল, প্রশাসনিক উদাসীনতা রয়েছে যথেষ্ট। সব মিলিয়ে অবস্থা শোচনীয়। হাইকোর্টের আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো এরকম যে, নির্যাতনের পরেও সবসময় মানুষের অভিযোগ জানাতে আসাটা সম্ভব হয় না। কোথাও কোথাও মামলা দায়ের হলেও, নির্যাতিত বা নির্যাতিতারা চিকিৎসা করাতেই ব্যস্ত। আগে নিজে বাঁচবেন, তবে না তিনি ভাববেন আদালত রায় দিচ্ছে কিনা, আসামী ধরা পড়ছে কিনা। তিনি আরো বলেন, “প্রশাসন এবং মিডিয়ার মধ্যে এই বিষয়টা নিয়ে সচেতনতার বড়সড় অভাব রয়েছে ।”
লড়াই চলছে
পম্পা, ঝুমা, মনীষা, সুনীতি কিংবা সূর্যশংকর – কেউই তাদের লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে দেননি। শুধু চিকিৎসা, আইনি সহায়তা, জীবিকা বা সামাজিক প্রতিষ্ঠা নয়, নাচ, গান, নাটক – এসবের মধ্য দিয়েও তাঁদের জীবনের ছন্দ ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
মণীষার নাচের মুদ্রায় ফুটে ওঠে জীবনের স্রোতকে নিজেদের দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার অদম্য স্পৃহা। সুর ভাসে – “কাগজ কে দো পঙ্খ লেকে উড়া চলা যায় রে/যাঁহা নেহি যানা থা ইয়ে ওহি চলা হায় রে”।