[ডুয়ার্সের বনগ্রামে বসবাসকারী অরণ্যনির্ভর জনজাতি শিশুদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে উত্তরবঙ্গ বন-জন শ্রমজীবী মঞ্চ এক ক্ষেত্রসমীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রথম দফায়, ২০২১ সালের ৮ অগস্ট থেকে ১৮ অগস্ট, চিলাপাতা ও বক্সা টাইগার রিজার্ভের বনগ্রামের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন জানা-বোঝার এই প্রক্রিয়া চলে। এই রচনাটি সেই প্রথম পর্বের সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি। এখানে প্রধানত বেগারপ্রথা, জীবন-জীবিকা, খাদ্যাভ্যাসের কথা বলা হয়েছে। তবে তা ওই অঞ্চলের জীবন-জীবিকা-খাদ্যাভ্যাসের সামগ্রিক চিত্র নয়— লেখক দেবাশিস আইচ।]
(৫)
জঙ্গলটা আছে আর রেশনের চাল, তাই ভরপেট না খেতে পেলেও অতিমারির কাল পার করে দিতে পেরেছেন রুজিরোজগারহীন অরণ্যবাসীরা। আর যে কালে রুজিরোজগারই ছিল না, সেই কালে কীভাবে খেয়েপরে বাঁচতেন তাঁরা? এই অতিমারির দিনে বনের শাকপাতাই সম্বল ছিল দিন আনি দিন খাই বনবস্তির বাসিন্দাদের। সকাল থেকে দলে দলে বনের উপর হামলে পড়ত। হাতি, বাইসন, চিতাবাঘ, সাপখোপের ভয় তাঁদের কোনোদিনও ছিল না। থাকলে চলে না। এই সময় বনে কী জাতীয় খাবার মেলে? নানা জনে জিজ্ঞাসা করে তার একটা অতি সংক্ষিপ্ত একটা তালিকা পাওয়া গেল। এর মধ্যে যেগুলির রাভা নামের পাশাপাশি বাংলা নাম মিলেছে সেগুলি দেওয়া গেল।
শাকপাতা : কালো কচুশাক, কোচিংচাক (ঢেকিশাক), কুলুংশাক (কলমিশাক), লাইকুড়িচাক (রাইশাক), সরষেশাক;
সব্জি : পুরুন্ডি, কান্দা বা কন্দ (নানা জাতীয় আলু), বন-করলা, কাঁকরোল, কচু;
মাশরুম : বিভিন্ন মরশুমে বিভিন্ন ধরনের ছাতু পাওয়া যায়, যেমন : মৌ বা কুরকুরে ছাতু, মার্বেল ছাতু, পরচুল ছাতু, সুন্দরী ছাতু;
মাছ : নাচেং না (নাচেং—চিংড়ি; না—মাছ।), শেল না (শোল মাছ), মঙ্গর না (মাগুর মাছ);
এছাড়াও, স্থানীয় নদী, ঝোরায় মাছ ছাড়াও মেলে শামুক, গেঁড়ি-গুগলি, কাঁকড়া।
টুনু রাভা আমাদের জানিয়েছিলেন, বানিয়া, কুরমাই, তোর্সা, নদীতে তিনি সপ্তাহের সাত দিনই মাছ মারতেন। তিন-চার কেজি মাছ পেতেন। তাঁর যৌবনে কুরমাইয়ে এমন স্রোত ছিল যে বর্ষায় হাতি ডুবে যেত। সাত-আট কেজি বোয়াল খেলত। ১৯৭২-’৭৩ সালের বন্যায় না কি এমন বালি-পাথর নেমেছিল—”নদী ডাঙ্গা হয়ে গেছে।“
শাকসব্জি, মাছ যে সবই তাঁরা নিজেরাই খান এমন নয়। বেচার মতো থাকলে সাপ্তাহিক হাটবারেও বিক্রি করেন। এই পরম্পরা দীর্ঘকালের। ঔষধি লতাপাতা, বনের ফলমূল, বনের কাঠ দিয়ে তৈরি লাঙল, রাভা জনজাতির মাছ ধরার বেত-বাঁশের জাকোই (হাতাওয়ালা চারকোনা ছাকনির মতো। রাভামেয়েরা এই জাকোই নিয়ে নদীতে নেমে মাছ ধরেন) কিংবা সানাই কিংবা চোঙার মতো মাছ ধরার ধকসা যা আদিবাসীরা ব্যবহার করেন (এই লম্বা চোঙের মতো যন্ত্রটি স্রোতের মুখে পেতে রাখা হয়। মাছ ভেসে এলে এর বড় মুখ দিয়ে ঢুকে আটকে পড়ে)। জ্বালানি কাঠ এসবই গ্রামের মানুষ হাটে বেচাকেনা করে এসেছেন।
পুরনো দিনের তাঁদের খাওয়ার কষ্টটা বুঝিয়েছিলেন মহেন্দ্র রাভা :
—তখনকার দিনে খাওয়া খুব কষ্ট ছিল। কষ্ট বলতে যবাটা, যবাটা শুনছেন?
—না।
মাইলো। ওগুলো বাজারে বিক্রি করত। এমন দিন গেছে খাওয়া থাকে না আরকি চাল থাকে না। আর চাল, বল্ডার চাল। বল্ডার চাল বলতে এই যে রান্না করল যতই রান্না করুক, যতই সিদ্ধ করুক ওই চাল ভাত রান্না হত, রান্নার পরে যদি এইভাবে ছিটানো যায়, মুড়ি যেমন ছিটায় ওইভাবে ছড়িয়ে যায়।
—সেই জন্য বোল্ডার চাল! চালের নাম বোল্ডার! মানে, পাথরের গুঁড়োর মতো!
—না, চাল তো খুব দেখতে খুব সুন্দর। বড় বড় দানা, লম্বা লম্বা…কিন্তু কোনও ভাতের সাথে মিল খায় না। খেতে কোনও স্বাদ নেই, রস নেই। কী জানি কোথা থেকে আসত! বাজার থেকে কিনত। আর মাইলো…এই যে আটাটা (গমের আটা) আমরা খাচ্ছি, সেটা বাজারে পাওয়া যেত না। নাই, আমরা দেখি নাই কখনো। ওই যবাটা (যবের আটা) বানাইলে পড়ে… বানাইল…যদি রুটি ভাল করে ভাঁজ করা যায় টুকরা হয়া যায়। এই তো গোল তো রুটি, যদি দু’ভাঁজ করা যায় চার টুকরা হয়ে যাবে। এইভাবে খায়া আসতাম। তখন তো আমরা মোষগুলা চড়াইয়া মানুষের বাড়ি খাইটা এই বর্তমানে…
(৬)
ধান গাড়ার কাজ করতে আন্ধারি যান কুমোরপাড়ায়। রাজবংশী চাষিদের (আন্ধারিদের ভাষায় দেশি বাঙালি) জমিতে তিনি কাজ করেন। আন্দু থেকে দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার। হেঁটেই যাতায়াত। আন্দু থেকে আরও অনেকের সঙ্গে এক সঙ্গে যান। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ভাত/রুটি আর সঙ্গে ডাল, সব্জি রান্না করে খেয়ে বেরিয়ে যান। কাজের সময় মোটামুটি বাঁধাধরা। সকাল আটটা থেকে সাড়ে চারটে। তারপর বাড়ি ফেরা। বিছন (চারা গাছ) উঠিয়ে আঁটি বেঁধে নিয়ে যান ধান রুইতে। বা ওঁদের ভাষায় ধান গাড়তে। ১০-১২ জন কামলা/ দিনমজুর দিনে দু’বিঘা জমিতে সার দিয়ে ধান বুনতে পারেন বলে তিনি জানান। বিকেলে খাবার হিসেবে সব্জি-ভাত দেন জমির মালিক। দুপুরে কেউ কেউ চা-মুড়িও খাওয়ান। মজুরি ২২০-২৩০ টাকা। দিনে দিনেই কি টাকা পান? “কাদো (কাদা) করা থাকলে আবার ডাকে।“ জানালেন তিনি। অর্থাৎ, জমির কাজ শেষ হলেই টাকা পান। জেলা বা রাজ্যের বাইরে কাজে যান না।
আন্ধারি রাভার বয়স বছর চল্লিশ। ক্লাস ফোর পাশ। বাবার মৃত্যুর পর সেই যে স্কুল ছেড়ে সংসারের হাল ধরেছেন সে মুঠি ধীরে ধীরে আরও শক্ত হয়েছে। পরিবারের মাত্র চার বিঘা জমি। গরু, হাল বলদ রয়েছে। স্বামী-স্ত্রী এবং ছেলে ও ছেলের বউ নিয়ে সংসার। নিজের জমিতে কাজের পরও ১০০ দিনের কাজ (যখন হয়), ধান গাড়তে যাওয়া, ফরেস্টে হাজিরা (যদি হয়), জঙ্গল থেকে জ্বালানির জোগাড়—সবই করতে হয় তাঁকে। তবে, মনে করার কোনও কারণ নেই যে বাকিরা বসে খান। শ্রমজীবীর সংসারে সে বিলাসিতার কোনও জায়গা নেই। এরই পাশাপাশি আন্ধারি রাভা লোকনৃত্য ও লোকগানের স্বীকৃত শিল্পী, ডুয়ার্সের রাভা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য। সেই সুবাদে মাসে মাসে ১০০০ টাকা সরকারি লোকশিল্পী ভাতা পান। নানা জেলায় কিংবা কলকাতা শহরেও অনুষ্ঠানে ডাক পান।
রাভা, মেচ, নেপালি জনজাতিই হোক কিংবা জঙ্গলে কাজ করতে নিয়ে আসা ঝাড়খণ্ডী ওঁরাও আদিবাসী সম্প্রদায়—বনগ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দাকেই নানা হাজিরার কাজ করতে হয়। সে নদী থেকে পাথর-বালি তোলা হোক কিংবা খেত মজুরের কাজ অথবা বনের হাজিরা। মহিলারাই এ জাতীয় হাজিরার কাজ বেশি করেন। চাষের কাজের মধ্যে অন্যের জমিতে ধান গাড়া (২২০-২৩০ টাকা রোজ), পাট কাটা (৩০০ টাকা রোজ), পাট জাঁক দেওয়া, ধোয়া (৩০০ টাকা রোজ), পাট মেলা (২৫০-৩০০ টাকা রোজ)। মেয়ে-বউ মেলে পাথর তুলতে যাওয়াও এক অন্যতম প্রধান কাজ।
সারাদিনের জন্য কাজে বেরোলে শ্রমজীবী মানুষ পেটভরে ভাত-রুটি, সব্জি খেয়েই বের হন। তারতিদের ভোর হয় চারটেয়। কুরমাই বনবস্তির ২১ ঘর ওঁরাও পরিবারের একজন তারতি। মাঠের কাজ যখন থাকে না তখন দলসিংপাড়ায় তোর্সা নদীতে যান পাথর তুলতে। যেতে হলে এই ভোরেই রান্নাবান্না সেরে খেয়ে ছ’টা সাড়ে ছ’টায় বেরিয়ে পড়েন। বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথে চিলাপাতা হাটের মোড় থেকে আরও অনেকের সঙ্গে পিক-আপ ভ্যান ধরেন। নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় ৪০-৫০ জন, যার মধ্যে মেয়েরাই সিংহভাগ। ঠাসাঠাসি, গাদাগাদি করে রওনা দেন প্রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরের গন্তব্যে। সময় লাগে ঘণ্টা খানেক। আসা-যাওয়ার ভাড়া মাথাপিছু ৫০ টাকা। সকাল ৮টার মধ্যে পৌঁছতে হয়। এরপর পাঁচ-ছ’জনের দলে ভাগ ভাগ হয়ে গিয়ে কড়াই/ গামলা হাতে নদীতে নামা।
ট্র্যাক্টরের সঙ্গে জুতে দেওয়া এক-একটা ট্রলির সঙ্গে এক-একটি দল নদীর বুকে ঘুরে ঘুরে পাথর তুলতে থাকে। দলটিকে নিয়ন্ত্রণ করে ট্র্যাক্টরের চালক। এক জায়গায় প্রয়োজনীয় মাপ ও মানের পাথর শেষ হলে আরেক স্থানে তার খোঁজ চলে। ট্রলি সেখানে পৌঁছে যায়। যার ফলে ট্রলির চার-পাঁচ মিটার দূরত্বের মধ্য থেকেই পাথর সংগ্রহ করা যায়। এক-একটি গামলায় এক-একবারে ৩০-৩৫ কেজি পাথর তুলে ট্রলিতে তুলে দেন মজুররা। একটি দলের এক ট্রলি পাথর ভর্তি করতে ছোট পাথর হলে লাগে এক ঘণ্টা। বড় পাথর হলে আধ ঘণ্টা। এরপর তা চলে যায় ডাম্পিং গ্রাউন্ডে। খালি করে ফিরে আসতে সময় লাগে মিনিট পনেরো। এই পনেরো মিনিট যা একটু হাঁপ ছাড়ার সময়। দিনে সবচেয়ে বেশি আয় হতে পারে ৫০০ টাকা। ১০ ট্রিপ অর্থাৎ পাঁচ জন মিলে ১০ ট্রলি পাথর বোঝাই করতে পারলে তবেই এই পরিমাণ টাকা মিলবে। এবং তা প্রথমত নির্ভর করে নদীর বুকে যথেষ্ট পরিমাণ পাথর জড়ো হওয়ার উপর। একটি ট্রলি ভর্তি করার মজুরি ২৫০০ টাকা। যা ওই পাঁচ বা ছ’জনের মধ্যে ভাগ হয়। এমন ১০/১১ ট্রিপ করতে পারলে দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি মেলে। সাধারণভাবে গড়ে দৈনিক ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পাওয়া যায়। পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত কাজ চলে। ফিরতে ফিরতে সন্ধে গড়িয়ে সাতটা-আটটা হয়ে যায়। হপ্তার দিন রাতও হয়ে যায়। সোম থেকে শনি টানা কাজ হওয়ার পর শনিবার মজুরি মেলে। এতোয়া বা রবিবার ছূটি। সোমবার থেকে ফের শুরু। সাধারণভাবে ঝুটঝামেলা না থাকলেও ক্খনও-সখনও বিএলআরও, বন দফতর, ডিএফও হানা দেয় বেআইনি কাজ দেখতে। আইনি ও বেআইনি রাস্তায় নদী থেকে পাথর-বালি তোলা সারা রাজ্যে সব নদীতেই ঘটে চলেছে। হানা দিলে তখন কাজ বন্ধ থাকে, শ্রমিকদের কিছু না বললেও ট্র্যাক্টর ও চালকদের ধরে, ফাইন করে, মালিক ছাড়িয়ে আনে।
নদীর বুকে গড়ে ঠিক কতটা এলাকা ঘুরলে কী পরিমাণ রোজগার হয় তার কোনও তৈরি হিসেব তারতিদের কাছে নেই। তবে, গরমের বেলায় মাথার উপর গনগনে সূর্য, পায়ের নীচে তপ্ত বালি-পাথর, কিংবা প্রবল ঠান্ডায় কাজের গতি কম হয়। এমন আবহাওয়ায় টানা বেশি দিন কাজ করা সম্ভব হয় না। রোদে তেতে, বৃষ্টিতে ভিজে কিংবা খোলা নদীর বুকে হু হু হাওয়ায় শীতের দিনে আট-নয় ঘণ্টা কাজ করলে যে কোনও সময় জ্বরজারি হতেই পারে। তারতি জানান, রোদে চোখ-মুখ ঝলসে যাওয়ার কথা। হাত-পা শরীর পোড়া পোড়া হয়ে যাওয়ার কথা। তবে, তাঁর সবচেয়ে বড় সমস্যা হল শরীরের সন্ধিতে সন্ধিতে ব্যথা। ঘাড়, কোমর, কনুই, হাঁটুতে হাত রাখতে রাখতে তারতি সে কথা বোঝানোর চেষ্টা করলেন। এর সঙ্গে হাওয়ায় ওড়া ধুলোবালি তো রয়েইছে। তার জন্য গামছা দিয়ে মাথা-মুখ ঢেকে কাজ করতে হয়। আর চিকিৎসা? বাড়িতে বাড়িতে স্থানীয় ডাক্তার ‘ভিজিট করেন’, তিনিই দেখেন। ওষুধপত্তর তিনিই লিখে দেন, জ্বরজারি বেশি হলে ইঞ্জেকশনও দেন। একবার দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে অন্তত ৬০০-৭০০ টাকা খরচ আছে। ভিজিট ১৬০ টাকা। আধ কিলোমিটারের মধ্যেই আন্দু বনবস্তিতেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। সেখানে যান না কেন? জানালেন, প্রতিদিন হেলথ সেন্টার খোলে না। সপ্তাহে সোম, বুধ, শনি খোলে। বিপদের সময় তাই ওই বাড়িতে আসা ডাক্তারেই ভরসা। তবে তিনি রেজিস্টার্ড প্র্যাকটিশনার না-হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাঁর আত্মীয় জানালেন, চিলাপাতা মোড়ের বাজারে ওষুধের দোকানে ডাক্তার বসেন। তবে পাশ করা নয়। তাঁরাই বস্তিতে বস্তিতে ভিজিট করেন।
(৭)
অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় রাভারাই প্রথম উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, তৎকালীন জলপাইগুড়ি, বক্সার বনগ্রাম জুড়ে বেগারি প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন রমেশ রায়। দল হিসাবে ফরোয়ার্ড ব্লক এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। ১৯০৫ সাল থেকে তরাই ও বক্সা অঞ্চলে ব্রিটিশরা স্থায়ী বনগ্রাম বসাতে শুরু করে। প্রথম থেকেই তারা চুক্তি করে বেগারি প্রথা চালু করেছিল ১৯৬৬ সালের শেষ থেকে হাসিমারা, কোদালবস্তি, মেন্দাবাড়ি, চিলাপাতা ও খয়েরবাড়ির হাতেগোনা কয়েকটি রাভা প্রধান বনবস্তিতে বেগার বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ক্রমে তা সারা ডুয়ার্সেই ছড়িয়ে পড়ে। এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষরাও যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন রাজ্যপাল ধরমবীরের কাছে এক গণ ডেপুটেশন দেওয়া হয়। যার প্রথম দাবিই ছিল—অবিলম্বে বেগারপ্রথা বন্ধ করতে হবে। এবং দৈনিক মজুরি চালু করতে হবে। ইতিমধ্যেই ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বনগ্রামবাসীরা কোচবিহার, বক্সা, বৈকুণ্ঠপুর, জলপাইগুড়ি বনবিভাগের কিছু অংশে কিছু কিছু কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ক্রমে চালসা থেকে সঙ্কোশ, সমগ্র ডুয়ার্স অঞ্চলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে বনবিভাগের সমস্ত ধরনের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে, বন দপ্তর দৈনিক ১ টাকা ৫০ পয়সা দৈনিক মজুরি দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করে। বনগ্রামবাসীদের দাবি ছিল দৈনিক আড়াই টাকা। ফের শুরু হয় প্রবল আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত কলকাতায় আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে তৎকালীন বনম্নত্রী, বন দফতরের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর দৈনিক তিন টাকা মজুরি বন দপ্তর মেনে নেয়। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই আন্দোলন জারি ছিল।
এই বেগার বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে বনবস্তি উচ্ছেদ, বনের কাজ বহিরাগত শ্রমিকদের নিয়ে আসার বিরুদ্ধেও আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এমন এক আন্দোলনের সময় এক রাতে গোঁসাইগাঁও বনবস্তিতে পুলিশ আন্দোলনের প্রধান প্রধান নেতাদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালায়। প্রবল ঝড়বৃষ্টি্র সেই রাতে গ্রামবাসীরা প্রবল বাধা দেয়। এই সময় পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে মারা যান পাঁচ জন। বন-আন্দোলনের এই পাঁচ শহিদ হলেন : সাধু ওঁরাও, মোংরা ওঁরাও, ছান্দু ওঁরাও, আজমন রাভা ও জেঠা রাই। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১০ জুন।
(৮)
অরণ্যবাসী জনজাতি ও অরণ্যনির্ভর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীগুলির লড়াই যেন শেষ হওয়ার নয়। ঔপনিবেশিক আমল থেকেই সারা দেশ জুড়েই অরণ্যের অধিকার, জল-জমির অধিকারের জন্য বহু লড়াই লড়তে হয়েছে আদিবাসীদের। এই পূর্বাঞ্চলেই সর্দার বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ, চুয়ার বিদ্রোহ ঘটেছিল। বিদেশি ইংরেজ আর ইংরেজদের হাত ধরে জমি-জঙ্গল দখল নিতে এসেছিল স্বদেশী ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, মহাজন, ফড়ের দল। প্রতিটি বিদ্রোহ এই বহিরাগত দিকুদের সহযোগিতায় নির্মমভাবে দমন করেছিল ইংরেজ। ধ্বংস করে ছেড়েছিল আদিবাসী জীবন-জীবিকা-সংস্কৃতি। বেআইনি উপায়ে, গাজোয়ারি করে আদিবাসী জমি লুটে জমিদার বনে গিয়েছে ভাগ্যান্বেষণে আসা দিকুরা। ইংরেজ আদালত আর ভারতীয় উকিলরা তার আইনি মদত দিয়েছে। সেই পরম্পরা আজও চলেছে। বনাধিকার আইন (২০০৬) যা বহু লড়াইয়ের ফসল তা আজ আর মানতে রাজি নয় কোনও সরকারই। পুঁজির পূজারী তারা। পাজির পাঝাড়া। সরকারগুলি কর্পোরেটের স্বার্থে আইনের রদবদল ঘটিয়ে, আইন অমান্য করে, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একের পর এক সর্বনাশ ঘটিয়েই চলেছে। আদিবাসীদের বন থেকে তাড়াতে বদ্ধপরিকর একদল প্রাক্তন বন-আমলা, কতিপয় মানুষহীন বন সংরক্ষণের প্রবক্তা এনজিও দেশের শীর্ষ আদালতে মামলা দায়ের করেছিল। ২০১৯ সালে সেই আইনি ষড়যন্ত্রে সায় দিয়ে ১১.৮ লক্ষ অরণ্যবাসীকে উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। অন্যদিকে উন্নয়নের দোহাই পেড়ে ঔপনিবেশিক শাসনামলের চেয়েও আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে দেশীয় শাসকদের কার্যকলাপ। বনাধিকার আইনের বলে পাওয়া অধিকার বন সংরক্ষণ বিধির (২০২২) মধ্য দিয়ে অরণ্যের অধিকার নসাৎ করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই বিধি কার্যকর হলে আইনিভাবে প্রতিষ্ঠিত বন গ্রামসভার মতামতের তোয়াক্কা না করেই তারা বন-পাহাড় বিলিয়ে দিতে পারবে সাঙ্গাৎ পুঁজিপতিদের হাতে।
এই কর্তৃত্ববাদী সর্বগ্রাসী নরেন্দ্র মোদী সরকার নিকোবর দ্বীপের গভীর অরণ্য ধ্বংস করে গড়ে তুলতে চাইছে সামুদ্রিক বন্দর ও প্রমোদনগরী। ৯৫ শতাংশ বৃষ্টি অরণ্যে ঢাকা শোম্পেন ও নিকোবরী জনজাতির বাসস্থান। এবং অতি সংকটাপন্ন নিকোবর মেগাপড, বিপন্ন প্রজাতির পেঁচা, কাঁকড়া খেকো বাঁদর ও লেদারব্যাক কচ্ছপের আবাস গ্রেট নিকোবর এবং গ্রেট নিকোবর বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ এবং গ্যালাথিয়া বে-র সাড়ে ৮ লক্ষ গাছ কেটে তৈরি হবে এই বন্দরনগরী। বন দফতর তথাকথিত ‘কম্পেনসেটরি ফরেস্ট্রি’র শর্ত চাপিয়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকার এই ‘ইন্টারন্যাশনাল কন্টেনার ট্রানশিপমেন্ট টার্মিনাল’-র ছাড়পত্র দিয়েছে। গাছ কাটা হবে নিকোবরে আর সে গাছ কাটার ক্ষতিপূরণ করতে গাছ লাগানো হবে মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানায়। ষড়যন্ত্রমূলক নিঃশব্দে এই কাজটা করে ফেলেছে কেন্দ্র। কোথাও কোনও তর্কবিতর্কের অবকাশ রাখা হয়নি। বনাধিকার আইনে নিকোবরীদের অনুমতি ও মতামত নেওয়ার কথা ভাবাও হয়নি। এ বছরই লক্ষদ্বীপ ও লিটল আন্দামান দ্বীপে পর্যটননগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে নীতি আয়োগ। অর্থাৎ, পূর্ব ও মধ্যভারতের খনিজ করিডোর, পূর্ব ও পশ্চিমঘাট, লক্ষদ্বীপ থেকে আন্দামান ও নিকোবর, হিমালয় থেকে সমুদ্র উপকূল—কোথাও আর নিরাপদ নয় প্রকৃতি-পরিবেশ-জীববৈচিত্র। নিরাপদ নয় জনজাতি, আদিবাসী, মৎস্যজীবী, দলিত ভারত।
আমাদের রাজ্যের দিকে তাকালে একই চিত্র খুঁজে পাব। কী পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়, কী সুন্দরবন, দার্জিলিং বা ডুয়ার্স—অরণ্যের অধিকারের প্রশ্নে, প্রকৃতি-পরিবেশের প্রশ্নে বাম আমলের সঙ্গে তৃণমূল আমলের কোনও পার্থ্ক্য নেই। বনাধিকার আইন (২০০৬) প্রয়োগ করতে বামফ্রন্ট চায়নি, তৃণমূল কংগ্রেসও চায় না। বনাধিকার আইন তৈরির সঙ্গে সঙ্গে যে তথাকথিত জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট (জেপিসি) যে তার আইনি যোগ্যতা হারিয়েছে, সে কথা মানা তো দূরের কথা, বেআইনিভাবে তার প্রয়োগ অব্যাহত। উত্তরের বনাঞ্চলে বাম আমলের বন দফতর, পুলিশ-প্রশাসনের দায়ের করা ফৌজদারি মামলা, গ্রেফতার, হুমকি, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তবু এক বড় অংশেই বন-গ্রামসভা প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছে। তবু আইন অনুযায়ী উত্তর ও দক্ষিণ মেন্দাবাড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ খয়েরবাড়ি, জয়ন্তী ও বক্সা পাহাড়ের একাধিক বনগ্রাম রাজস্বগ্রামে পরিণত হয়নি। ফলে এই গ্রামগুলির ২০-২৫ হাজার বাসিন্দাদের জমির পাট্টা অধরা থেকে গিয়েছে। ২০১০-১২ সালে অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলার বনগ্রামবাসীদের প্রায় পাঁচশো পাট্টা বিলি করা হয়। ২০১৪ সালে আলিপুরদুয়ার জেলা তৈরি হয়। বর্তমান আলিপুরদুয়ার প্রশাসন বলছে, সেই সময়ের পাট্টার রেকর্ড তাদের কাছে নেই। ২০২২ সালের জুন মাসে পাট্টার দাবিতে জেলাশাসকের দরবারে এক গণডেপুটেশন দিতে গিয়ে এই অবাক করা তথ্য মিলেছে বন-জন শ্রমজীবী মঞ্চের প্রতিনিধিদের। দক্ষিণবঙ্গে এটুকুও সম্ভব হয়নি। অযোধ্যায় সে প্রচেষ্টা শুরু হতে-না-হতেই সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করেছে পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন। বনকর্তা ও প্রশাসনের আচরণ মনে করিয়ে দিচ্ছে সাগরপারের মহারানির শাসনের কথা। আদিবাসী-জনজাতি না বাঁচলে প্রকৃতি-পরিবেশ, জীববৈচিত্র যে বাঁচবে না, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের এই সর্বগ্রাসী প্রকোপের দিনে সে কথা যত দ্রুত আমরা বুঝব ততই মঙ্গল।
কৃতজ্ঞতা : লালসিং ভুজেল, সুন্দরসিং রাভা, স্বরূপ সাহা, সৌমিত্র ঘোষ, শুভেন্দু দাশগুপ্ত।
১) এল্যুইন ভেরিয়ার (২০০০), আদিবাসী জগৎ, মহাশ্বেতা দেবী ও পৃথ্বীশ সাহা অনূদিত, সাহিত্য অকাদেমি (The Tribal World of Verrier Elwin-শীর্ষক আত্মজীবনীর বাংলা ভাষান্তর)।
২) ঐ
[প্রবন্ধটি আয়নানগর, সপ্তম সংখ্যা, ২০২৩-এ প্রথম প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন : Ph- ৯৮৩০৪১১৫২৫, ৮৯৩০১০৫৪৪৪]
পড়ুন : ডুয়ার্স : বনগ্রামের একাল ও সেকাল (পর্ব-১)