যশোর রোডের গাছ কাটার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায় তুলে দিল একাধিক প্রশ্ন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সিলেবাসে পরিবেশবিদ্যা পড়ানো বাধ্যতামূলক। বইগুলিতে বড়ো বড়ো হরফে লেখা থাকে গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়, গাছ লাগাও প্রাণ বাঁচাও, গাছ কাটা অপরাধ ইত্যাদি সব নীতিবাক্য। এবার বইগুলোকে পুনঃমুদ্রণে পাঠানোর সময় এসেছে। উন্নয়নের নামে গাছ কাটা ভালো, গাছ কেটে রাস্তা তৈরি করা ভালো; এইসমস্ত নীতিপাঠ দেওয়ার প্রক্রিয়া বোধহয় শুরু হবে পরিবেশবিদ্যার সিলেবাসে। আর প্রয়োজন নেই সভা, সেমিনারের; ৫ জুনের লোক দেখানো অনুষ্ঠানগুলোর। অন্তত সুপ্রিম কোর্টের রায় সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে। লিখলেন অনিমেষ দত্ত।
কমিটির সদস্য পাভেলের মতে, “সুপ্রিমকোর্টের এই রায় খুবই অনুমানযোগ্য। কারণ গত পাঁচ বছরে পরিবেশ রক্ষার জন্য যতগুলো মামলা হয়েছে প্রায় সবক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে হাইকোর্ট কিংবা সুপ্রিমকোর্ট পরিবেশ রক্ষার পক্ষে রায় দেননি। আমরা খুব অবাক হইনি এই রায়ে। আমরা এই রায় মানতে পারছি না।” পাভেলের দাবী, “আদালত এবং সরকার কর্পোরেট পুঁজির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। আর কোনো রাখঢাক নেই। সরাসরি এই প্রতিষ্ঠানগুলি কর্পোরেটদের পক্ষে কাজ করে চলেছে।” মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের রাজ্য সম্পাদক রঞ্জিত সূরের মতে, “আদালতের গ্রীন বেঞ্চ এই রায় দিয়েছেন, এটাই মজার বিষয়। সরকারের যে পলিসি এবং আদালত দুটো খুব মিলে যাচ্ছে। এটাই আশঙ্কার জায়গা, যে আদালত স্বাধীন ভাবে বিচার করেন, কিন্তু এই ধরনের রায়গুলি সাধারণ মানুষের যে আস্থা বা বিশ্বাস আদালতের প্রতি সেটাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।”
সুপ্রিমকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, “one hand, there is a necessity to protect the trees and in the event it is not possible to protect, to direct afforestation, and on the other hand, there is a need to have ROBs, which are part of Setu Bharatam Project.” [SLP (C) No.25047/2918 ITEM NO. 5)] যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, একদিকে যেমন গাছগুলি রক্ষা করা জরুরি, অন্যদিকে রেলওয়ে ওভারব্রিজেরও প্রয়োজন আছে যা ‘সেতু ভারতম’ প্রকল্পের অংশ। এরপর রায়ে আরও বলা হয়েছে, “The High Court has restricted the number of trees to be felled to only 356 and further put the State Government on terms for compensatory afforestation. The special leave petition is, therefore, dismissed.” অর্থাৎ কলকাতা হাই কোর্টের যে রায় তাতে চার হাজারের জায়গায় ৩৫৬টি গাছ কাটার কথা বলা হয়েছে, হাই কোর্ট গাছ কাটার সংখ্যাটা অনেকটাই কমিয়েছে। তাই এই আবেদনটি খারিজ করা হল।
সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে বলছেন রাস্তা ছোট হওয়ার কারণে আপতকালীন সময়ে অয়াম্বুলেন্স নিয়ে তাড়াতাড়ি কলকাতার হাসপাতালে পৌঁছানো মুশকিল। অনেকে বলছেন রাস্তার পাশে গাছের ডাল পড়ে আহত হয়েছেন পথচারীরা। এই প্রশ্নগুলির জবাবে শোভিক মুখার্জি বলেন, “বনগাঁয় কেউ অসুস্থ হলে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে ছুটে আসার দরকার কেন হবে? বনগাঁয় কেন এসএসকেএম কিংবা মেডিকেল কলেজের মতো হাসপাতাল নেই? প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর পরিষেবা ও পরিকাঠামো খারাপ করে রাখা হয়েছে কেন? হাবড়া হাসপাতালের উপর চাপ কমিয়ে যশোর রোড সংলগ্ন এলাকায় আরও সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল করলে তো এই অসুবিধা হয় না। আর গাছের ডাল পড়ে পথচারীদের আহত হওয়ার দায় পুরোপুরি প্রশাসনের। কারণ আমরা একাধিকবার বিভিন্ন দপ্তরে ডেপুটেশন দিলেও এই গাছগুলির রক্ষণাবেক্ষণ করার উদ্যোগ তারা নেয়নি।”
সুপ্রিমকোর্টের এই রায় প্রাথমিকভাবে আশা করেননি পরিবেশকর্মী অংশুমান দাস। তিনি বলেন, “এখন আমরা এত পরিবেশ সচেতন, গ্রিন বেঞ্চ আছে, তাও কেন এরকম রায় তা নিয়ে আমি একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম। কিন্তু পরে বিবেচনা করে দেখলাম যেভাবে জল-জঙ্গল-জমি আদিবাসী মানুষের উপর আক্রমণ নেমে আসছে, তাতে বোধহয় কোর্টের থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করারও ছিল না। এমনিতেই এখানে অনেকগুলি কেসকে জুড়ে এক সঙ্গে রায় দেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে এই ধরনের রায় আরও বেরোবে বলেই আমার মনে হয়।” অংশুমান দাস আরও বলেন, “আগামী দিনে জনআন্দোলনের পথেই আমাদের হাঁটতে হবে। এর পাশাপাশি আরও অনেক সংস্থা আছে যেমন বায়োডাইভারসিটি বোর্ড, বনদপ্তর তাদেরকে দায়িত্ব নিতে হবে গাছগুলির জীববৈচিত্র্যগত কী ভূমিকা আছে সেটা দেখার জন্য কমিটি গড়ার কিংবা গাছগুলির স্বাস্থ্য নিয়মিত পরীক্ষা করার ব্যবস্থা নেওয়ার। গাছের ডাল সত্যিই ভেঙে পড়ছে, আর সেটা রক্ষণাবেক্ষণ করাও একটা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে সরকারের।”
একটু তলিয়ে দেখলে আমরা দেখতে পাব এই যশোর রোডের রাস্তা সম্প্রসারণ প্রকল্প এশিয়ান হাইওয়ে-১ (এএইচ-১) প্রকল্পের অংশ যা ২০৫৫৭ কিলোমিটার বিস্তৃত সড়কপথ। জাপানের টোকিও থেকে কোরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, মায়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান হয়ে তুর্কি-বুলগেরিয়া বর্ডার যেখানে ইউরোপের রুট ই-৮০ -তে যুক্ত হচ্ছে যা শেষ হবে একেবারে পর্তুগালের লিসবনে। এই প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করতে অর্থ দিচ্ছে এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক বা এডিবি। এবার এত বড়ো একটা প্রকল্প নেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য আরও উন্নত হবে। যশোর রোডের ক্ষেত্রে দেখলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আমদানি ও রপ্তানি আরও সুবিধাজনক জায়গায় যাবে। পরিবেশকর্মীদের মতে এই বাণিজ্য অন্য কোনো বিকল্প পথেও করা সম্ভব, গাছগুলোকে বাঁচিয়েই সম্ভব। আন্দোলনকারীদের দাবি যানজট এড়াতে শিয়ালদহ-বনগাঁ সমস্ত লোকালগুলিকে ১২ বগির করতে হবে। এর পাশাপাশি তাদের প্রশ্ন, পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও কি রেল একটা মাধ্যম হতে পারে না? রঞ্জিত সূরের মতে, “রেলের তুলনায় সড়ক পরিবহনে পণ্য আদানপ্রদানে মুনাফা বেশি এবং খরচ কম, তাই কর্পোরেটদের সুবিধার্থেই এই পদক্ষেপ।”
একটি গাছ মানে তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আরও কয়েকশো প্রাণীর বেঁচে থাকা, যার মধ্যে মানুষও অন্যতম। অর্থাৎ একটা বাস্তুবাস্তুতন্ত্রের টিকে থাকা। এই গাছগুলিকে কেন্দ্র করেও তো অনেক মানুষ নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন। ২০০২ সালে বন্যার হাত থেকে বহু মানুষকে রক্ষা করেছিল গাছগুলি। গাছকে কেন্দ্র করে অনেক স্থানের নামকরণ আছে এই অঞ্চলে। সুপ্রিম কোর্ট এবং হাই কোর্ট উভয়ই বলেছেন যে একটা গাছ কাটলে তার বদলে কাছাকাছি অন্য এলাকায় পাঁচটি গাছ লাগাতে হবে। ঘনবসতির কারণে আশেপাশে এত গাছ লাগানো প্রায় অসম্ভব! আর একশো দেড়শো বছরের পুরনো মেহগনি, বট, অশ্বত্থ গাছ কেটে নতুন গাছ লাগানো একেবারেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়। দু’ধরনের গাছের বাস্তুতান্ত্রিক ভূমিকা একই হবে না। প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে যশোর রোড ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি হচ্ছে আন্দোলন, জল–জঙ্গল–জমির উপর কর্পোরেট আগ্রাসন যত হচ্ছে ততই সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ক্ষোভ। এই ক্ষোভ কোন দিকে মোড় নেয় এখন সেটাই দেখার।