কতবার মৃত্যু হলে তবে কৃষক বলা যায়?


  • March 26, 2023
  • (1 Comments)
  • 9572 Views

একদিকে কম দাম, আরেকদিকে অকাল বৃষ্টি। কেমন আছেন আলু চাষিরা? চাষের খরচটুকুও যে উঠবে না। কীভাবে পরিশোধ করবেন মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থার ঋণ? সারা রাজ্যেই আলু চাষিরা সঙ্কটে। উত্তরবঙ্গের সঙ্কটের কথা তুলে ধরলেন মৌমিতা আলম

 

আকাশ মেঘে কালো হয়ে আসছে। অসহায় ফজলুল, আকাশের দিকে তাকিয়ে তারপর খেতের আলুর দিকে তাকিয়ে থাকল খানিকক্ষণ। সেই তাকানোর মধ্যে বিষাদ, যন্ত্রণা আর অসহায়ত্বের তীব্র আকুতি মিলে যে মৃত্যু সমান ঔদাসীন্য তৈরি হয়েছে তা যেন ছড়িয়ে গেল চারপাশে। পশ্চিম কোণের মেঘগুলো সরে গিয়ে এক অদ্ভুত আলো দেখা গেল। ঝড়ের আলো। যে আলো আরও গভীর আঁধারে চারপাশ ঢেকে দিয়ে সব হারানোর ক্যানভাসে বদলে দিল পৃথিবীকে। শুকিয়ে আসা ঠোঁটে বৃষ্টির ফোঁটা জিভ দিয়ে চেটে নিল। তারপর রুগ্ন বাছুরের খুঁটটা তুলে, দড়ি গুটিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। রাস্তায় শুনল মাগরিবের আজান। ততক্ষণে বৃষ্টি আরেকটু জোরে শুরু হয়েছে। কোনওরকমে বাড়ি পৌঁছে, ওজু করেই জুম্মা ঘর।

 

নামাজ শেষ, দুয়া। সব নামাজি মিলে ঠিক করল, দুয়া করবে, আল্লাহর রহমতের জন্য। আলুর জন্য। যে আলু সারা বছরের একটু নিশ্চিন্তে ভালো করে দু’মুঠো খেয়ে ঘুমানোর উপায়। পেছনে বসা হাকিম একটু গাঁইগুঁই করছিল। সে ইউটিউবে দেখেছে, দুনিয়ার জন্য দুয়া করা হারাম, সে আখেরাত চায়, বেহেশত চায়। সে দুয়া না পড়েই হাঁটা দিল।

 

দুয়া করতে গিয়ে চোখ ভিজে আসছিল ইমাম সাহেবের। হাতের বুড়ো আঙুলের নখে তখনও মাটি লেগে। বৃষ্টি আসার আগে যতটা সম্ভব তুলে নিয়েছে আলু। মাত্র কয়েক বস্তা। হে খোদা তোমার বান্দাদের বালা, মুসিবত দূর করে দু’বেলা খেতে দাও —বলতে গিয়ে যেন কেঁপে উঠল ঠোঁট। দুয়া শেষ করে মোসাবা (আলিঙ্গন) করে হাঁটা দিল বাড়ির দিকে। পেছনে বাকি সব নামাজি। কারও মুখে শব্দ নেই। বৃষ্টি ততক্ষণে টিনের ঘরের চালে উন্মাদ নৃত্য শুরু করেছে। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা ব্যারেলের বুলেট হয়ে নিরুপায় নামাজিদের পাঁজর এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর জম্বিদের মতো নামাজিরা বাড়ি ফিরছে। প্রতিটি অকাল বৃষ্টিতে কৃষকরা মরে। শুধু লাশ হয়ে গেলেই কি মৃত্যু হয়?

 

আচ্ছা কৃষকরা স্মার্ট ফোনে আবহাওয়ার রিপোর্ট দেখলেই তো পারে! সত্যিই তো পারে! সারাজীবন কৃষি দপ্তরের টিকির দেখা না পাওয়া কৃষক, চাষ করার সময় ডিএপি-র তীব্র অভাবে, কালোবাজারে সার কিনতে বাধ্য হওয়া কৃষক, দিনের পর দিন ফসল কম দামে বা ফেলে দিতে বাধ্য হওয়া কৃষক, ২০-২৭% সুদের রেটে মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থার লোন নিতে বাধ্য হওয়া কৃষক, টকাশ করে ফোনে আবহাওয়ার রিপোর্ট চেক করে ফসল ঘরে তুললেই তো পারে!

 

কৃষকের ঘরের চাল, ভাবুনি, খড় পেরিয়ে টিনের হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই ঘরে আলুর বস্তা টেনে নিয়ে গিয়ে রাখতে বস্তা প্রতি যা খরচ তা ব্যয় করার সামর্থ্য থাকলে আমাদের কৃষকদের হাড় জিরজিরে শরীরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হত না। এবার পোখরাজ আলু বিক্রি হয়েছে কুড়ি থেকে ত্রিশ হাজার প্রতি ট্রাক। এক ট্রাকে দু’শো প্যাকেট আলু ধরে। আর এক বস্তায় পঞ্চাশ কেজি। সেই হিসেবে এক কেজি আলুর দাম ছিল এক-দু’টাকার মধ্যে। পোখরাজ আলু হিমঘরে রাখা হয় না। তাই যা দাম আসে তাই বিক্রি করতে হয়। জ্যোতি ভ্যারাইটি বাজারে আসে ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে। জ্যোতি আসার পর দাম একটু বেড়েছিল। এক গাড়ি আলুর দাম হয় ৫৫-৬০ হাজার টাকা। কেজি ২.৫-৩ টাকা।

 

এবার ফলন কম। বিঘা প্রতি ৮০ বস্তা। দু’শো বস্তা আলু চাষে খরচ প্রায় ৬০ হাজার টাকা। খরচের টাকাটাও উঠছে না এবার। হিমঘরে রাখা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। সারের দোকানে বাকি, মাইক্রোক্রেডিট লোনের কিস্তি, পরবর্তী চাষের পয়সা।

 

শুরু হল বৃষ্টি অবিরাম। ভিজছে আলু। নিদ্রাহীন কৃষক। দুয়া পৌঁছাতেও সময় লাগে! তাই কৃষকের মনে প্রশ্ন জাগে না। আর প্রশ্ন জাগলেও তার উত্তর দিতে ঈশ্বর ও সরকারের প্রবল অনীহা।

 

আলু চাষি মহাবুবর রহমানের প্রশ্ন থাকে উত্তরহীন। যখন তিনি জিজ্ঞেস করেন, কেন আজ অবধি উন্নত বীজের জন্য পঞ্জাবের উপর নির্ভর করতে হয়? কেন পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব উন্নত বীজ পাওয়া যায় না? কেন হিমঘরের বন্ডের সুস্থ, স্বচ্ছ বণ্টন সম্ভব হল না আজও? কেন সরকারের নিজস্ব হিমঘর নেই? বেসরকারি হিমঘর মানেই সরকারি নিয়ন্ত্রণ ক্ষীণ। কেন আলু রপ্তানির কোনও ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়? কেন হিমঘরগুলো আলু নেওয়া শুরু করতে এত দেরি করল?

 

কৃষকের “মন কি বাত” শোনার জন্য রাষ্ট্রের কোনও চ্যানেল নেই। রাষ্ট্র কানে শোনে না। বলে শুধু। কখনও রেডিওতে, কখনও টিয়ার গ্যাস, লাঠির মাথায়। রাষ্ট্র চুপ করে দেখে কীভাবে মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থাগুলির লোন কৃষকের হাতের টাকা স্পঞ্জের মতন চুষে নিচ্ছে। আগে যদি এক টাকাও বাঁচত, সেটা জমিয়ে ছাগল, মুরগি, গরু কিনে রাখত ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু এখন গাছের সুপারি থেকে পুকুরের মাছ সব বিক্রি করতে হয় কিস্তি মেটাতে। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে সব চাঙ্গা সি! কোনওরকমে ফিনফিনে দড়ির ওপর টাল সামলে হাঁটতে থাকা কৃষককে দেখে কারও ভয় অনুভূত হয় না। দড়ি থেকে পড়লেই শেষ। কার যায় আসে!

 

আজ ফজলুলের ঘুম নেই। সে হিসেব করে কত লস হল। ভোরের আলো ফুটলে জমির আলে দাঁড়ায়। আর মাছ ধরার মতন ছেঁচে তোলে এক মুঠো আলু। বস্তায় ভরে মুঠো মুঠো ফসল। নজরুল এসে থমকে দাঁড়ায় পাশে। এ যেন এক রোবট, মরা মাছের মতন স্থির চোখে, মেশিনের মতন বস্তার পর বস্তা ভরছে। জলে ভিজে কুঁচকে গেছে চামড়া। কোনও হুঁশ নেই। নজরুল জড়িয়ে ধরে ফজলুলকে। নজরুলের মুখের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে ফজলুল। সার খেয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠা মরা ব্যাঙ জমির আলে পড়ে ছিল, লাল পিঁপড়ে তার ওপর ভোজ করছে। পা দিয়ে লাথি মেরে ব্যাঙ সরিয়ে দিয়ে নজরুল, হাত ধরে বসাল ফজলুল কে। সূর্যের দেখা তখনও নাই। ফজলুলের বৌ সালেহার ভিজে শরীর বেয়ে কাদা কাদা গন্ধ। আবার বৃষ্টি শুরু হল। হাতের বিড়ি ফেলে সবাই বাড়ির দিকে। আধপেটা ছাগলটা ম্যা ম্যা করে খুঁট ছিড়ে ঘরে ফিরতে চাইছে। তার মনিবের কোনও হুঁশ নেই আজ।

 

কতবার মৃত্যু হলে তবে কৃষক বলা যায়?

 

 

(জলপাইগুড়ি জেলার বাসিন্দা মৌমিতা আলম এক জন কবি ও শিক্ষিকা।)

 

Share this
Recent Comments
1
  • চমৎকার লেখা। এখানে একটা হিসেব পাওয়া গেল, এক বিঘা জমিতে প্রায় ৪০০ কেজি আলু হয়। ফলন কম হলে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা শহরের মানুষরা এসব হিসেবের কিছুই জানি না। ভবিষ্যতে যদি এমন লেখায় এই হিসেবগুলো আরও একটু আসে ভাল হয়। আর খামখেয়ালি আবহাওয়া ব্যতিরেকেই অবস্থা যে শোচনীয় সেই হিসেবটাও একটু এলে ভাল হত।

Leave a Comment