সদ্য চলে গেলেন কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি-র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্ত। বাংলা লিটল ম্যাগাজিন-এর সংরক্ষক হিসাবে এবং লিটল ম্যাগাজিন-এর স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখার আন্দোলনে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি প্রশ্নাতীত। শুধু তাঁর কাজ নয়, প্রথমে শিক্ষক ও পরবর্তী সময়ে কাজের সূত্রে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের স্মৃতিচারণায় সাংবাদিক ও কলকাতা-গবেষক গৌতম বসুমল্লিক।
কাছাকাছি পাড়াতেই বাড়ি তাই সন্দীপদার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হত মাঝে-মধ্যেই। শান্তশিষ্ট মানুষ, কথা বলতেন যেমন আস্তে আস্তে হাঁটতেনও বেশ ধীর গতিতে, কিন্তু শেষের বেশ কয়েক বছর ধরেই তাঁর হাঁটার গতি যেন ক্রমেই কমে আসছিল। জানতাম পায়ের সমস্যা, ব্লাড-সুগারের জন্য সে সমস্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছিল। তবে সে সব নিয়ে যে তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন, তেমনটা কখনও মনে হয়নি। কোনও দিন হয়ত রাস্তায় দেখা হল, জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন? ছোট্ট উত্তর— ভালো। হয়ত বললাম, পায়ের ব্যথা কেমন? বললেন, ওই আছে এক রকম!
সন্দীপদা অর্থাৎ, সন্দীপ দত্তকে আমি চিনতাম আমার শিক্ষক হিসেবে। ১৯৮১ সাল। মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে ভর্তি হলাম বাড়ির প্রায় লাগোয়া সিটি কলেজিয়েট স্কুলে। সেখানেই প্রথম পরিচয় বাংলার শিক্ষক সন্দীপ দত্তের সঙ্গে। আমি অন্য স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে সিটি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম ফলে সেখানকার শিক্ষকদের আলাদা পরিচয় কিছু জানতাম না। সহপাঠীদের কেউ একজন কথা প্রসঙ্গে জানায় যে স্যারের বাড়িতে নাকি একটা লাইব্রেরি আছে এবং সেটা স্যার নিজেই তৈরি করেছেন। একদিন সুযোগ বুঝে স্যারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। স্যার আমন্ত্রণ জানালেন লাইব্রেরিতে।
লিটল ম্যাগাজিন শব্দটার সঙ্গে পরিচয় থাকলেও সত্যি কথা বলতে, সেই বয়সে বাণিজ্যিক পত্রিকাই পড়তাম। সেগুলোর মধ্যে আমার চেনা ছিল সন্দেশ, আনন্দমেলা, শুকতারা, কিশোর ভারতী, নবকল্লোল আর দেশ। যদিও শেষোক্ত দুটো পত্রিকা ঠিক আমাদের মতো বয়সীদের পক্ষে একটু কঠিন, তবু পড়ার নেশা ছিল বলে সেগুলোও পড়ে ফেলতাম। পড়ার বইয়ের বাইরে গল্পের বই এবং পত্রপত্রিকা নিয়মিত পড়বার অভ্যেস থাকলেও, লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে তেমন কোনও ধারনা তখনও পর্যন্ত ছিল না। সেই ধারনাটা বদলে গেল স্যারের লাইব্রেরিতে এসে।
১৯৮১-৮২ সালে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি আজকের মতো ছিল না (সম্ভবত নামের আগে কলকাতার শব্দটাও তখন যুক্ত হয়নি)। এবং এখনকার মতো তার কলেবরও এত বড় ছিল না, তবু যা পত্রপত্রিকার সম্ভার তা দেখে বিস্মিত না হয়ে থাকার উপায় ছিল না! কিন্তু সে সব পত্রপত্রিকা নিয়ে লেখালিখি বা গবেষণা করবার বয়স তখন নয় তাই নিয়মিত লাইব্রেরিতে যাওয়া হয়ে উঠত না। আর তা ছাড়া আমার প্রথম জীবনের পড়াশোনা ছিল বিজ্ঞান নিয়ে ফলে খুব বিশেষ দরকার না হলে স্যারের কাছে যাওয়ার দরকার হত না।
প্রাথমিক ভাবে বিজ্ঞান নিয়ে পড়লেও আমার আগ্রহ ছিল ইতিহাস ও সাহিত্যে। ১৯৮৬ সালের গোড়ার দিকে আলাপ হল কলকাতার মেডিকেল কলেজের ছাত্র তথা ইতিহাস-প্রেমী দেবাশিস বসুর সঙ্গে। তিনিই একদিন নিয়ে গেলেন আঞ্চলিক ইতিহাস-গবেষক তারাপদ সাঁতরার কাছে। পেশায় তিনি ছিলেন রাজ্য সরকারের আইন অনুবাদ বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মী। কলকাতা নগর দেওয়ানি আদালতের প্রথমতলের অফিস ছিল আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক ও ক্ষেত্র সমীক্ষকদের আড্ডাখানা বিশেষ। দেবাশিস বসু ছাড়াও সে আড্ডায় নিয়মিত আসতেন পূর্ণেন্দুনাথ নাথ, শিবেন্দু মান্না, অমিত রায়, ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী-সহ আরও অনেক কৃতবিদ্য মানুষ, যাঁরা পরবর্তীকালে স্ব স্ব ক্ষেত্রে পরিচিত হয়েছেন নিজেদের কর্মদক্ষতায়। বয়সে তাঁদের থেকে ছোট হলেও, অচিরে আমিও সদস্য হয়ে গেলাম সেই আড্ডার সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে আগ্রহ বাড়তে লাগলো আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা জগতের প্রতি।
আমার লেখালিখি জগতের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগটাও সন্দীপ দত্তের মাধ্যমে। সন্দীপদার লাইব্রেরিতে প্রায়ই আসতেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন ঘোষ। ওই লাইব্রেরিতেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হল। তিনি আমার সংগ্রহে থাকা একটা নথি নিয়ে একটা লেখা লিখলেন। তার পর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার কলকাতার কড়চা বিভাগের তৎকালীন সম্পাদক নিখিল সরকারের সঙ্গে। নিখিলবাবুর সঙ্গে আগেই আলাপ ছিল, চিত্তবাবুর সৌজন্যে সে আলাপ আরও দৃঢ হল। সেই সুবাদে সংস্কৃতি বিষয়ক ছোট ছোট লেখা মাঝে মাঝে লেখার সুযোগ পেয়ে গেলাম সেই ছাত্র বয়স থেকেই।
আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা করতে গেলে ক্ষেত্র সমীক্ষার পাশাপাশি বইপত্রও পড়তে হয় অনেক। দেবাশিস বসুর মাধ্যমে যোগাযোগ হল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গ্রন্থাগারের সঙ্গে। প্রয়োজনীয় বই ছাড়াও উনিশ ও বিশ শতকের পত্রপত্রিকার বিপুল সম্ভার সেখানে রয়েছে। সদস্য হলাম সেখানে। ফলে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিতে তেমন প্রয়োজন না পড়লেও স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েই গেল।
সম্পর্কে মাস্টারমশাই বলে প্রথম থেকে তাঁকে ‘স্যার’ সম্বোধন করতাম, কিন্তু আস্তে আস্তে সেটা সন্দীপদাতে পরিণত হয়েছিল নিজের অজান্তেই। লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির নিয়মিত সদস্য আমি কোনও কালেই ছিলাম না তবু যাতায়াত ছিল নানা দরকারে-অদরকারে। হয়ত কোনও তথ্য দরকার। স্যারের সঙ্গে রাস্তাতে দেখা হওয়াতে সেটা জিজ্ঞেস করলাম। সন্দীপদা বললেন, ‘‘কাল লাইব্রেরিতে আয়, বলে দেব।’’ গেলাম পরের দিন। শুধু সেই বিশেষ তথ্য নয়, পাশাপাশি ওই বিষয়ের আরও কিছু তথ্যও তিনি দিয়ে দিলেন। পেশাগত ব্যস্ততা যখন খুব একটা ছিল না, মাঝে মাঝে সন্ধের দিকে লাইব্রেরিতে উঁকি মারতাম। এক-এক দিন হয়ত সঙ্গে কেউ থাকতও। যদি সে দিন লাইব্রেরিতে লোকজন কম থাকতো, তাহলে হয়ত বসে খানিক গল্পও করে আসতাম স্যারের সঙ্গে। কী ভাবে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি তৈরি হল, তার নানা কাহিনির অনেকটাই শুনেছিলাম সন্দীপদার মুখ থেকে।
সন্দীপ দত্তের ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’ শুধু লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহশালা নয়। একজন মানুষ নিজের উদ্যোগে সারা বাংলা তো বটেই ভারতের, এমনকী বিশ্বের অনেক জায়গা থেকে বাঙলা ভাষায় প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ করে এক জায়গায় জড়ো করেই থেমে থাকেননি। সেই সব পত্রিকা যাতে গবেষকদের কাজে লাগে তার জন্যে পরিশ্রম করে গেলেন সারা জীবন। প্রথম জীবনে নিজে কবিতা লিখতেন। ‘পত্রপুট’ নামে একটা ছোট পত্রিকাও করতেন নিজের উদ্যোগে। লাইব্রেরির কাজের চাপে নিজের লেখালিখি প্রায় বন্ধই করে দেন। তবে গবেষক ও অনুসন্ধিৎষ্ণু পাঠকদের জন্য বিভিন্ন পুরনো পত্রপত্রিকা ও পুরনো বই থেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় নির্বাচন করে ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ নাম দিয়ে ছেপে বের করতেন মাঝে মাঝে।
পেশায় সাংবাদিক হলেও আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে ক্ষেত্র সমীক্ষার সুবাদে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো ও বক্তৃতা দেওয়ার ডাক পাই। সেই সূত্রে ছাত্রছাত্রীদের কারোর যদি কোনও লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তথ্য বা পত্রপত্রিকার দরকার হত, স্যারকে ফোন করে জানাতাম। স্যার বলতেন, ‘‘পাঠিয়ে দে লাইব্রেরিতে। আমি দেখছি, আমার কাছে কী আছে ওই বিষয়ে।’’ অনেককেই সে ভাবে স্যারের কাছে পাঠিয়েছি। কাউকেই নিরাশ করেননি স্যার। পরে তাদের মুখে শুনেছি, কত দরদ দিয়ে স্যার তাদের কাজে সহযোগিতা করতেন। ব্যক্তি নাকি কখনও প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বে হতে পারে না। কথাটার ব্যতিক্রমও আছে, যার জ্বলন্ত উদাহরণ সন্দীপ দত্ত। বাংলা লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণ আন্দোলনের পুরোধা সন্দীপ দত্ত সব অর্থেই ছিলেন তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’-র প্রাণপুরুষ।
নামে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি হলেও সন্দীপ দত্তের সংগ্রহে কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন ছাড়াও অনেক পুরনো দিনের বই ও পত্রপত্রিকা রয়েছে। যদিও কলকাতার আরও কিছু পুরনো গ্রন্থাগারে সেই সব বই পাওয়া যায় তবুও গবেষণার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বই-পত্রিকা এক জায়গায় থাকার সুবিধে যে অনেকটাই তা গবেষক মাত্রেই বোঝেন।
লিটল ম্যাগাজিনের মতো আধুনিক পত্রপত্রিকার সংগ্রাহক হয়েও একটা ব্যাপারে সন্দীপ দত্ত কিন্তু বেশ প্রাচীনপন্থী ছিলেন। তা হল, তিনি তাঁর সংগ্রহের বই-পত্রিকা ডিজিটালাইসড করবার বিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু আজকের এই ডিজিটাল যুগে সেটা খুবই জরুরি। তার কয়েকটা কারণ আছে। প্রথমত, এখানকার স্যাঁতস্যাতে আবহাওয়া ও দূষণের জন্য বহু পুরনো পত্রিকার পৃষ্ঠা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। আরও কিছুকাল পরে হয়ত সে সবের অনেকগুলোই হাতে নিয়ে ব্যবহার করার মতো অবস্থায় থাকবে না। সেই সব পত্রিকা ডিজিটাল ভাবে সংরক্ষণ করে রাখতে পারলে আখেরে গবেষকদেরই লাভ হবে। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল পদ্ধতিতে বই-পত্রপত্রিকা রাখার জন্য জায়গা অনেক কম লাগে এবং একই সময়ে একাধিক জন সেগুলো ব্যবহার করবার সুযোগ পেতে পারে। তৃতীয়ত, যাঁরা অন্য কোনও ভিন্ন পেশায় থেকে গবেষণা করেন, তাঁদের পক্ষে সব সময়ে লাইব্রেরির নির্দিষ্ট সময় মেনে সেখানে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ডিজিটাল কপি ওয়েবের মাধ্যমে পাওয়া গেলে গবেষকরা নিজের সময় মতো বাড়িতে বসেও কাজ করতে পারেন সেগুলো নিয়ে।
যতদূর শুনেছি, লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির সংগ্রহের খুব অল্প একটা অংশ ডিজিটাইসড করা হয়েছিল কিন্তু অধিকাংশই হয়নি। এ বার বোধ হয় বিষয়টা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা দরকার।
সন্দীপ দত্তের প্রয়াণের পর তাঁর এই বিশাল সংগ্রহের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন! তিনি যে ভালোবাসা ও মমতা দিয়ে তিল তিল করে লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন, সেটার কী গতি হবে? সন্দীপ দত্ত প্রতিষ্ঠিত ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’-র একটা কার্যনির্বাহী সমিতি আছে। তারা এবং দত্ত পরিবার মিলে কিছু একটা সিদ্ধান্ত যে অবশ্যই নেওয়া হবে, এমনটাই আশা করা যায়।
ছবি : লেখক