নারীর অধিকারের লড়াই বহুস্তরীয়। ক্ষমতায়নের কোনও একটি লেন্স দিয়ে তাকে ধরা সম্ভব নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিন্তাভাবনায় নারীকে শুধু দমিয়ে রাখাই নয়, কর্পোরেট মডেলে তাদের মধ্যে সুস্পষ্ট শ্রেণীবিভাগ তৈরি করে দিয়ে তৈরি করে দেওয়া হয় নারীর ক্ষমতায়নের স্টিরিওটাইপ। এর স্বরূপ না চিনলে নারীর অধিকারের লড়াই একপেশেই রয়ে যাবে। লিখলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
নারীর ক্ষমতায়ন – শব্দবন্ধটি শুনতে যতটা চমৎকার, তার বাস্তব ছবিটা হয়তো ঠিক ততটা সুখকর নয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসলে মহিলাদের অনেকখানিই শক্তি জোগায় বটে, তবে সার্বিক ক্ষমতায়নে তা যে সব ক্ষেত্রেই সমান ভূমিকা নিতে পারে, তা আদপেই নয়। বরং পরিবার সামলাতে রুটি-রুজির দায়িত্ব পুরোপুরি নিজের কাঁধে নিয়ে নেওয়া মহিলাদের উপরে পরিবারের ভেতরে ও সমাজের নানা স্তরে হিংসার ঘটনা ক্রমশ বেড়েছে এমন উদাহরণ আমাদের চারপাশে চোখ রাখলেই দেখতে পাওয়া যাবে। এদেশে এর কারণ খুঁজতে বসলে অবশ্য আর্থ-সামাজিক যে দিকটি সামনে চলে আসে তা এখন হঠাৎ তৈরি হওয়া কোনও সমস্যা নয়, বছরের পর বছর ধরে এই সমস্যাগুলিই একাধারে মেয়েদের ক্ষমতায়ন ও সমান্তরালভাবে তাদের প্রতি বাড়তে থাকা হিংসার কারণ ছিল।
অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়ে উঠলেই যে একটি মেয়ে নিজের অধিকার বুঝে নিতে চায় এবং সেটা শুধু টাকাপয়সা সংক্রান্ত স্বাধীনতা নয়, নিজের শরীর ও যৌনতা, স্বাস্থ্য, প্রজনন, শিক্ষা – অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে নিতে চায়, এই সমাজটিকে অনেক বেশি করে নারীর বসবাসযোগ্য করে তুলতে চায়, শুধু নারী, পুরুষের মধ্যে সমানাধিকার নয়, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও স্তরের নারীদের মধ্যেও সমানাধিকার ও ক্ষমতায়নের বিষয়টি তুলে ধরতে চায় – তা নিয়ন্ত্রণপ্রিয়, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার মেনে নেওয়া সহজ নয়। সেই কারণেই যত বেশি তারা নিজেদের অবস্থান জোরদার করেন পরিবার, কর্মক্ষেত্র, সামাজিক পরিসরে বৈষম্য, হিংসা, নানাবিধ নিয়ম-নীতি চাপিয়ে দিয়ে নারীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা আরও বেশি প্রবল হয়ে ওঠে।
আসলে আশ্চর্য এক পৃথিবী চোখের সামনে রেখে দেওয়া হয়, যা অতিক্রম করে দেখার পরিশ্রমটুকু করার সদিচ্ছা আমাদের অধিকাংশেরই থাকে না। রাজনীতি, কর্পোরেট, বিনোদনের দুনিয়ায় সফল মহিলাদের আইকন হিসাবে উপস্থাপিত করা হয় সমানে এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই এক ধরনের শ্রেণীবিভাগ তৈরি করে দেওয়া হয়। এবং এ কথাও সত্যি যত বেশি আর্থিক দূরত্ব তৈরি হয় তত বেশি শ্রেণীগত দূরত্বও তৈরি হয়ে যায়। কারণ, বাস্তব সত্যি এটাই যে এখনও আমাদের দেশে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো এমন হয়ে যায়নি যে মেয়েরা চাইলেই নিজেদের পেশাগত পছন্দের স্বপ্নগুলিকে সফল করে তুলতে পারেন। স্রেফ ঋতুকালীন স্বাস্থ্য অপ্রতুল বলে যে সংখ্যক মেয়ে নির্দিষ্ট একটা বয়সে স্কুলছুট হয়ে যায় তার পরিসংখ্যান দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া শিক্ষার অধিকার খাতায়-কলমে থাকলেও দারিদ্র্যের সঙ্গে দিনরাত যুঝতে থাকা পরিবারে নাবালিকা মেয়ের বিয়ে, শিশুশ্রম ইত্যাদি কারণে প্রাথমিক থেকে উচ্চ – শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ অনেক ক্ষেত্রেই বাধা পেতে থাকে। ফলে সকলেরই বিরাট অঙ্কের বেতনের চাকরি পাওয়া যে সম্ভব হয়ে ওঠে না তা স্বাভাবিক। তবে প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও মেয়েরা যত নিজেদের পরিস্থিতি শোধরানোর দায়িত্ব নিজের হাতে নিতে থাকে ততই বাড়তে থাকে তাদের প্রতি হিংসা ও বৈষম্য।
সম্প্রতি কলকাতা ও সংলগ্ন জেলায় গৃহ পরিচারিকাদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘পরিচিতি’-র বার্ষিক সম্মেলনে কথা হচ্ছিল বেশ কয়েক জন গৃহ পরিচারিকার সঙ্গে। এ কথা ঠিকই যে কাজের মাধ্যমে তারা নিজেদের সংসার, সন্তানের দায়িত্ব নিয়েছেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রেই নেশাগ্রস্ত বা কর্মহীন স্বামীর উপর ভরসা না করে যথাসাধ্য সঞ্চয় করে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো ইত্যাদির মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যতকে নিরাপদ করে তুলতে চাইছেন। এমনকি পারিবারিক হিংসার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসও পাচ্ছেন। নিজেদের এলাকায় এই মহিলারা তৈরি করছেন ‘সমাধান দল’ যা শুধু তাদের কাজের ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধানে পাশে থাকছে তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে এলকাগুলি যাতে মহিলাদের বসবাসের উপযুক্ত, সুরক্ষিত ও নিরাপদ হয়ে ওঠে সেই বিষয়গুলি নিয়েও কাজ করছে। নগরপল্লী এলাকায় ইভ-টিজিং বন্ধ, শৌচালয় তৈরি ও পরিষ্কার রাখা, কোনও রকম পারিবারিক হিংসার ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদ করা ইত্যাদি কাজ করছেন তারা। তবে ক্ষমতায়ন ঘটলেও তাদের উপর চাপ কমছে কই? “এক তো বাড়ির সব কাজ, বাচ্চাদের ব্যবস্থা করে কাজে যেতে হয়। শুনতে হয় কাজে তো যাচ্ছি না, কোথায় না কোথায় যাচ্ছি। তার উপরে কাজের জায়গায় চলে নানান সমস্যা। এক ঘন্টার কাজ বলে চার ঘন্টা কাজ করানো, টাকা-পয়সা না দেওয়া বা কম দেওয়া। কোনও রকম অভিযোগ করলে পুলিশের ভয় দেখানো। আমাদের কাছে চুপচাপ কাজ করে যাওয়া ছাড়া কোনও চয়েস থাকে না। যদিও এখন আমরা নিজেরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কথা বলে নিচ্ছি, বিশেষ করে কাজ আর মাইনে নিয়ে,” বললেন এরকমই এক সমাধান দলের সদস্য গৃহ পরিচারিকা শ্যামলী মন্ডল।
তবে বিরাট বহুতলগুলিতে তথাকথিত ‘দিদি’ বা ‘বৌদি’রাই অনেক সময়ে তাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছেন, খারাপ ব্যবহার থেকে ‘সোসাইটি’র হোয়্যাটস অ্যাপ গ্রুপে তাদের বিষয়ে লিখে কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছেন এমন অভিযোগ তুললেন শ্যামলী, সুপর্ণারা। কারণ সমাজের তথাকথিত হাই সোসাইটি-তে থাকা হোয়াইট কলার জব করা মহিলারা এই শ্রমজীবী মহিলাদের দাবিগুলির থেকে বরাবর বিচ্ছিন্ন। অথচ একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে পরিবারে বৈষম্য বা হিংসা, কাজের ক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীর থেকে কম বেতন, নারী হওয়ার কারণে যোগ্যতা সত্ত্বেও বৈষম্য, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা, নারীবিদ্বেষী কথা ও ব্যবহার এগুলির সম্মুখীন এই মহিলাদের মধ্যেও অধিকাংশই হয়ে চলেছেন। কিন্তু আর্থ-সামাজিক পার্থক্য পেরিয়ে দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের সঙ্গে এক্ষেত্রে নিজেদের মিল হয় তারা খুঁজে পাচ্ছেন না বা দেখলেও স্বীকার করছেন না। এক নির্দিষ্ট কর্পোরেট মডেল-এর ক্ষমতায়ন যে নারীদের মধ্যেই শ্রেণীগত বৈষম্য তৈরি করছে যা শ্রমজীবী মহিলাদের প্রতি বৈষম্য, শোষন বজায় রাখছে তা বুঝতে খুব বেশি কাঠখড় পোড়ানোর দরকার হয় না।
সুপর্ণা জয়সওয়াল গৃহ পরিচারিকার কাজ করেন, কিন্তু শান্ত, মুখচোরা সুপর্ণা এক সময়ে স্বামীর অত্যাচার ও পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণে থাকতে থাকতে প্রায় মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। পরিচিতি-র ক্রাইসিস সেন্টার-এ যোগাযোগ করে আজ তিনি নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছেন। সাজগোজ, কাজ, খুশি থাকা এগুলো সবই আজ নিজের পছন্দ ও ইচ্ছে মতো করছেন। কাজ, সমাজ ও সর্বোপরি পরিবারে যে পরিমাণ শোষন, নিগ্রহের মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয়, তা সামলে উঠে সুস্থ জীবন কাটানোর জন্য সুপর্ণার মতো অনেকেরই কাউন্সেলিং ও সহায়তা প্রয়োজন হয়, তারজন্য সামাজিক লজ্জা ও অস্বস্তি কাটিয়ে ‘সাহায্য দরকার’ এটা বলাও প্রয়োজন। মীরা মন্ডল যেমন বলছিলেন, “আগে আমি একা প্রতিবাদ করতাম। কোথাও নির্যাতন, মারপিটের খবর পেলে ছুটে যেতাম, থানা-পুলিশ করতাম। এখন সমাধান দলের সদস্য হিসাবে আমরা জোট বেঁধে যাই, মেয়েদের বলি কেন মুখ বুজে সহ্য করছো? প্রতিবাদ করি, দরকারে পুলিশের কাছে নিয়ে যাই। প্রতিবেশিরা পাশে থাকেন আর একটু হলেও ভয় পায় আমাদের। জানে আমরা অত্যাচার মুখ বুজে সইব না।”
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলা মিনুজা খাতুন গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। সমাধান দলেরও সদস্য। সাফ বললেন, “সবচেয়ে বড় কথা হল, একজন মেয়ে যতক্ষণ না স্বাবলম্বী হতে পারবে কোনও আওয়াজ সে করতে পারবে না। যদি নিজের হাতে পয়সা না থাকে, যদি স্বামীর পকেটের দিকে চেয়ে থাকে তাহলে দশ বারের মধ্যে দু’বার প্রতিবাদ করলেও আট বার মুখ বন্ধ রাখতে হবে। কর্মক্ষেত্রটা তাই ঠিক রাখতে হবে মেয়েদের।” তাদের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় তারা দল বেঁধে এগিয়ে আসায় “মেয়েরা অন্যায়ের প্রতিবাদটা করতে শিখেছে, শুরুয়াৎটা হয়েছে। নিজেদের পোশাক-আশাক নিজেদের ইচ্ছে মতো পরতে পারছে, কারওর পারমিশন ছাড়া কোথাও যেতে পারছে, নিজের ইচ্ছে মতো চলাফেরা করতে পারছে,” এমনটাই মনে করেন রাখিজা খাতুন লস্কর।
নিজেদের পরিবারে, এলাকায়, কাজের জায়গায় নিজেদের দাবি আর অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা করাই শ্রমজীবী মেয়েদের নিরন্তর লড়াইয়ের জায়গা। সেইসঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের জনপ্রিয় চিত্রের সঙ্গেও তাদের পাল্লা দিয়ে যেতে হয়। এতটুকু দম ফেলবার, ক্লান্ত হওয়ার উপায় নেই। তাহলেই ‘জিতে যাওয়া’ নারীর স্টিরিওটাইপ ভেঙে যাবে। অসহায়, দুর্বল না হওয়া আর নিজের ভয়, শ্রান্তির কথা স্বীকার করা, তার সঙ্গে যুঝতে সাহায্য চাওয়া যে এক ব্যাপার নয়, তা এই নারীদের বুঝতে দিতে নারাজ নারীকে সর্বংসহা অথবা শক্তিরূপেন করে তোলা সমাজ। আর অন্যদিকে বহুতলের কর্পোরেট নারী আর নগরপল্লীর শ্রমজীবী নারীদের মধ্যে কর্পোরেট তথা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মডেলে যত্নে তৈরি করা দেওয়াল না ভাঙলে নারীর শ্রমের মূল্য, সম কাজে সম বেতন তথা সমানাধিকারের বিষয়টি অমীমাংসিতই রয়ে যাবে, সন্দেহ নেই।