রোজকার জীবনে বিজ্ঞানকে জীবনের অংশ করে তোলা গুরুত্বপূর্ণ হলেও সহজ নয়। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জটিল। অথচ লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে বিজ্ঞানচর্চা এক জরুরি বিষয়। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধ না থাকলে কুসংস্কার আর প্রচলিত সামাজিক নিয়ম-নীতির নামে মেয়েদের প্রতি বৈষম্য চালিয়ে যাওয়া সহজ হয়। তাই প্রশ্ন করতে শেখা আর বুনিয়াদী স্তর থেকে বিজ্ঞান শিক্ষা মেয়েদের অধিকার, ভালো থাকা, সুস্থ থাকার এক অতি প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। কীভাবে? লিখলেন তিথি রায়।
এ কথা বলাই যায় যে, বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধ, আমাদের সমাজে একটি সমালোচনার পরিসর তৈরি করতে পারে। সেই পরিসরে, আমাদের এমন এক সাংস্কৃতিক আলাপ-আলোচনা সম্ভব যা, উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজে, প্রথাগত পিতৃতান্ত্রিকতার মধ্যে বসবাসকারী নারীদের আত্মপরিচয় গঠন করবে।
–মীরা নন্দা (লেখিকা, বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসবিদ)
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমে, জঙ্গল মহলের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। ঠা ঠা করা রোদে মাঠের কাজ সেরে ফিরেছেন বাড়ির পুরুষেরা। বাড়ির মহিলারাও ফিরেছেন কাছের টাউন থেকে, কয়েকবাড়ি রান্নার কাজ সেরে। তারপর, নিজের ঘর গেরস্থালির কাজ গুছিয়ে খেতে বসা। খেতে বসে দেখা গেল ডাল কম পড়ছে। চপ ডাল পুরুষদের জন্য আগে তুলে রেখে, মহিলারা ডালের জল আর নুন মেখে ভাত খাওয়া সারলেন। যখন সেই মহিলাদের জিজ্ঞেস করা হল, ডাল কম থাকলেও সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়া যাবে না কেন? তারা জানাচ্ছেন যে, ডালের জলেই নাকি বেশি পুষ্টি। আবার প্রশ্ন করা হল, একথা তাদের শেখাল কে? তারা উত্তর দেন, তাদের স্বামীরাই নাকি তাদের এসব বলেছে। পুরুষেরা কিছুটা হলেও তাদের চেয়ে বাইরের দুনিয়ার খবর বেশি রাখে। সেজন্য, ডাল কম হলেও তাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই, ডালের জলেই তাদের পুষ্টির প্রয়জন মিটে যায়।
এখানে লক্ষ্য করার মতো বিষয় হল, প্রশ্নহীনভাবে সেই মহিলারা পুরুষদের কথা বিশ্বাস করছেন, মেনেও নিচ্ছেন। কেননা, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মেয়েরা শিখে এসেছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান জানার অধিকার পুরুষদের। পড়াশোনা না জানলেও মেয়েদের জীবন সংসার-সন্তান নিয়ে একরকম কেটেই যাবে। সে এও জেনেছে, যতই সংসারের হাল ফেরাতে কাকভোরে উঠে কাজে বেরোক না কেন, পুরুষের কথা বিনা তর্কে মেনে নেওয়াটাই দস্তুর।
পরিবারের মধ্যে এই পুরুষতান্ত্রিক নির্মাণ ভাঙবে কে? ভাঙা তখনই সম্ভব, যদি গৃহস্থ বাড়ির মহিলাদের কাছে বুনিয়াদী শিক্ষা, পুষ্টি-জ্ঞান পৌঁছে দেওয়া যায়। যদি তাদের মধ্যে যুক্তিবোধ তৈরি করা যায়, তবেই তারা তাদের পুরুষসঙ্গীকে প্রশ্ন করতে পারে। প্রশ্নের উত্তর যাচাই করে নেওয়ার জোরও পেতে পারে।
আবার, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার এক ঘিঞ্জি মফস্বলের, দশম শ্রেণীর এক ছাত্রী আক্ষেপ করে বলছে, সপ্তম শ্রেণীতে তার ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার পর থেকেই, ওই দিনগুলিতে তার মা-দিদিমা তাকে অনেক ব্যাপারে বাধা-নিষেধ করে থাকেন। এমনকী, একথাও বলে যে, মাসের ওইদিনগুলোতে মেয়েদের শরীর অশুচি হয়ে যায়। কিন্তু, কেন এমন ঘটে সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে তার যথাযথ উত্তর তো পায়ইনা, উলটে পায় গঞ্জনা। পরে অবশ্য সে স্কুলের দিদিমণিদের কাছে শিখেছে, খিদে, ঘুমের মতোই ঋতুস্রাব একটি জৈবিক ঘটনামাত্র। তার পিছনের বিজ্ঞানও মেয়েটি জেনেছে বই পড়ে। এখন, মুশকিল হল মা-দিদিমা কে সেসব কথা কিছুতেই বোঝাতে পারে না। তবুও, সে হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। সে মনে করে, যতবার তাকে কেউ ভুল কথা বলবে, সে তাকে তর্কে হারিয়ে দেবে, কেননা ঋতুস্রাবের বৈজ্ঞানিক কারণ তার জানা।
উপরের দুটো ঘটনা একটু লক্ষ্য করলে বোঝা যাচ্ছে, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিনির্ভর শিক্ষার একটি পরিসর যদি গড়ে তোলা যায়, তবে তা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের, লিঙ্গ পরিচয় ব্যতিরেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। এই পারার দুটি দিক রয়েছে – এক, বিজ্ঞান বিষয়ে বিদ্যায়তনিক চর্চা। দুই, দৈনন্দিন যাপনে বিজ্ঞানমনস্কতা।
একসময় মেয়েদের শিক্ষার কোনো হক ছিল না। তা যদিবা তারা পেল, তবুও তথাকথিত কিছু ‘সহজ’ বিষয় নিয়ে পড়াই চল ছিল। বিজ্ঞান পড়বে মেয়েরা? ঠিক, এমনটাই ভাবা হত। কিন্তু, বিদ্যায়তনিক চর্চায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চার অধিকার এবং তাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, লিঙ্গভেদের চৌকাঠ পেরিয়ে খোলা উঠোনে এনে দাঁড় করিয়েছে মেয়েদের। আমাদের দেশে, এর উদাহরণ হিসেবে কাদম্বিনী দেবীর কথাই বলা যায়। ডাক্তারি যে পুরুষের একচেটিয়া কারবার নয়, মেয়েরা আয়া বা নার্সের মতো পরিষেবা দেওয়ার কাজ ছাড়াও একজন পূর্ণ ডাক্তার হয়ে উঠতে পারে, তা প্রমাণ করেছিলেন তিনি। তারপর, অনেক লড়াই পেরিয়ে মেয়েরা মহাকাশ বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, কিংবা বা প্রযুক্তিবিদ্যায় অধ্যবসায় দেখিয়েছে, দেখাচ্ছেও। তবে, উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞানে মেয়েদের উপস্থিতি আজও ছেলেদের তুলনায় বহুলাংশে কম।
২০২২ এ প্রকাশিত, BiasWatchIndia-র একটি সার্ভে রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ভারতীয় উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিজ্ঞান গবেষণা ও বিজ্ঞান পড়ানোর কাজে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ মহিলা। কল্পনা চাওলা একজন হন। কিন্তু, আমাদের দেশে, পাড়া-গাঁয়ে, মফস্বলে, কল্পনা চাওলা হওয়ার কত স্বপ্ন যে রোজ মরে যায় তার হিসেব আমরাও রাখি না, রাষ্ট্রের খাতায়ও থাকে না।
এখন, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিজ্ঞান গবেষণাগারে মেয়েদের সংখ্যা বাড়লেই, লিঙ্গভেদ সমূলে উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে, তেমনটা একেবারেই নয়। তাই, সমাজের বুনোটের মধ্যে বিজ্ঞানের মেজাজ অর্থাৎ বিজ্ঞানমনস্কতার দরকার রয়েছে। কিশোরী কিংবা মধ্যবয়স্কা মহিলারা, নিজেদের শরীর, স্বাস্থ্য, আহারাদি ও প্রজনন বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠতে পারলে তাদের জীবনশৈলী আরো সুন্দর হতে পারে। তারা, স্বেচ্ছায় নারীত্ব কিংবা মাতৃত্বকে আরো বেশি করে উপভোগ করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, পুরুষের মুখাপেক্ষী না হয়েও তারা নিজেদের শরীর ও মনকে কিভাবে চালনা করবে তা নিজেরাই ঠিক করতে পারে। তাদের যাপন সংক্রান্ত যে কোন সিদ্ধান্ত নির্দ্বিধায় নিতে পারে। আর, এসবের মধ্যে দিয়ে একটি নারীর ভেতরে যে যুক্তিবোধ, চিন্তা করার ক্ষমতা লালিত হবে, তা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানাবে অনায়াসেই।
কলকাতার প্যারালাল প্রেস থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান বিশ্বে এদেশের মেয়েরা বইটিতে ‘নিজেদের কথা’ অংশে, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে গবেষণারত মুনমুন বিশ্বাস জানিয়েছেন,“লক্ষ্য শুধু মেয়ে হিসেবে বিজ্ঞানের জগতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া নয়, বিজ্ঞানমুখী একটা মনকে উজাড় করে দেওয়া, গোটা সমাজের সমাজমুখী বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠার জন্য কাজ করা।”
লিঙ্গ-সাম্য প্রতিষ্ঠার যে লড়াই তাতে আরো অনেক বিষয়ের মত বিজ্ঞানেরও অবদান রয়েছে। ২৮শে ফেব্রুয়ারি এদেশে পালিত হয় জাতীয় বিজ্ঞান দিবস। আর ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস। উদযাপনের ভিড়ে যেন ভুলে না যাই- সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞানের কাজ নিরন্তর প্রশ্ন করা। বিজ্ঞানমনস্কতা কিন্তু, মেয়েদেরও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা ধর্মীয় বিধিনিষেধকে প্রশ্ন করতে প্রশ্রয় দেয়। প্রশ্নের উত্তরও খুঁজতে শেখায়।
Ref:
https://www.epw.in/journal/1996/16-17/review-womens-studies-review-issues-specials/science-question-post-colonial