গ্রাউন্ডজিরো রিপোর্ট
বিভিন্ন ক্ষেত্রের রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের প্রায় চৌত্রিশটি সংগঠনের যৌথ মঞ্চ “সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ”র ডাকে গতকাল অর্থাৎ ১৩ ফেব্রুয়ারি সারা রাজ্যব্যাপী পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করা হল। রাজ্য সরকারি গ্রুপ-সি গ্রুপ-ডি কর্মী, শিক্ষক, ডাক্তার ও নার্স, আদালত কর্মী, পৌরনিগম কর্মী-সহ সরকারি বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত কর্মীরা গতকাল সারাদিন নিজেদের কাজ বন্ধ রাখলেন। সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ মূলত দু’টি প্রধান দাবিকে সামনে রেখে এই আন্দোলন শুরু করেছে। একটি হল এআইসিপিআই অনুযায়ী রাজ্য সরকারকে অবিলম্বে বকেয়া মহার্ঘভাতা বা ডিএ মেটাতে হবে এবং রাজ্য সরকারের বিভিন্ন পদে যে বিপুল শূন্যপদ তৈরি হয়েছে তা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় পূরণ করতে হবে।
কর্মচারীদের আন্দোলন আজ শুরু হয়েছে এমনটা নয়। বেশ কয়েকদিন ধরেই কলকাতার শহিদ মিনারে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের পক্ষ থেকে অবস্থান মঞ্চ করে আন্দোলন শুরু করা হয়েছে। তার আগে বেশ কয়েকবছর ধরেই বিভিন্ন দপ্তরে বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা নিজেদের সংগঠনের মাধ্যমে নিজ নিজ দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যেই তিন মাস আগে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে একটি সংগঠন মামলাও করে। নিম্ন আদালতে রাজ্য সরকার মামলাটি হেরে যায়। এরপর তারা হাই কোর্টে যান। সেখানেও তারা পর্যুদস্ত হন। অবশেষে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে গেছে মামলাটি। সেই মামলাটির শুনানি হবে আগামী ১৫ মার্চ। মঞ্চের নেতৃত্বের দাবি, রাজ্য সরকার কোর্টে হারবে জেনেই শুধুমাত্র সময় এবং তাঁদের আন্দোলনকে নষ্ট করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে গেছে। কিন্তু তাঁরা বদ্ধপরিকর।
রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বঞ্চনা নতুন নয়। এর আগে বাম সরকারের আমলেও দেখা গেছে একই ঘটনা। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর এই বঞ্চনা মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন মঞ্চের নেতৃত্ব। মঞ্চের অন্যতম সদস্য অর্জুন সেনগুপ্ত বলেন, “আমাদের রাজ্যে তিন শতাংশ হারে কর্মচারীরা মহার্ঘভাতা পাচ্ছেন। অন্যান্য বেশিরভাগ রাজ্যে সেখানকার কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় হারেই মহার্ঘভাতা পেয়ে থাকেন। রাজ্য সরকারের দপ্তরগুলোতে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ শূন্যপদ। এর ফলে নতুন প্রজন্মের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের একটা ধারণা আছে যে সরকারি কর্মচারী এবং শিক্ষকরা প্রায় কাজ না করেই বসে বসে মাইনে নেন, এটা একেবারেই ভুল ধারণা। এর কারণ হচ্ছে যে, আজ থেকে দশ বছর আগে যে কাজ দশজন মিলে করা হতো সেটা আজকের দিনে এক বা দুজনে করতে হচ্ছে। শূন্যপদ থাকার কারণেই কাজের বোঝা মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে গেছে।”
অল ইন্ডিয়া কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স (এআইসিপিআই)-র ওঠানামার উপর ডিএ-র গণনা নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত দাম যে হারে বাড়ছে তার ভিত্তিতে বর্তমান বেতনে যে ঘাটতি থাকছে তা গণনা করেই ডিএ নির্ধারণ করা হয়। কেন্দ্র এবং অধিকাংশ রাজ্যই এই হারে ডিএ দেয়। ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল অবধি পঞ্চম পে কমিশনের যা যা বকেয়া ডিএ তা মেটানোর কথা জানায় আদালত। ২০১৬ সালে ষষ্ঠ পে কমিশন ঘোষণা হয়। কিন্তু এখানেই একটা নজিরবিহীন ঘটনা ঘটায় রাজ্য সরকার। অর্জুন সেনগুপ্ত বলেন, “চার বছর অর্থাৎ ২০১৬ থেকে ২০২০ অভিরূপ সরকারের নেতৃত্বে একটি বেতন কমিশন চলে। কিন্তু তা সূর্যের আলোর মুখ দেখেনি। কোথাও পেশ করার কথা, সরকারের পোর্টালে সেটা ডিসপ্লে করার কথা। সেখানেই আমরা খবর পেলাম যে ওখানে মহার্ঘভাতা বিষয়টিকেই উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার প্রমাণ আমরা পেলাম ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে। যে বেতন আমরা পাই, তার পে-স্লিপে ডিএ-র কলামটাই হাওয়া হয়ে গেছে।”
এর আগে পঞ্চম পে কমিশনে উনচল্লিশ মাসের মধ্যে বারো মাসের বকেয়া বাম সরকার মেটায়। সাতাশ মাসের বকেয়া মেটানো হয়নি। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার আগে ২০১১ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে বাকি সাতাশ মাসের বকেয়াও তারা মিটিয়ে দেবে। কিন্তু বাস্তবত সেই সাতাশ মাসের বকেয়া তো মেটায়ইনি, উল্টে ষষ্ঠ পে কমিশনে আটচল্লিশ মাসের বকেয়া না দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন মঞ্চের নেতৃত্ব।
রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের অবস্থান মঞ্চে হাজির হয়েছেন দীর্ঘ সাতশো দিন ধরে আন্দোলনরত নবম থেকে দ্বাদশ এসএসসি এসএলএসটি শিক্ষক চাকরিপ্রার্থী, প্রাইমারি টেট নন-ইনক্লুডেড চাকরিপ্রার্থী, আপার প্রাইমারি ও সরকারি গ্রুপ-সি গ্রুপ-ডি চাকরিপ্রার্থীরাও। শূন্যপদে স্বচ্ছ নিয়োগের দাবির সাথে তাঁরাও সম্পৃক্ত হয়েছেন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি একটি কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়েছে অবস্থান মঞ্চে। ১৩ ফেব্রুয়ারি গোটা রাজ্যে বিভিন্ন দপ্তরে কর্মবিরতি সফলভাবে পালিত হয়েছে বলে জানিয়েছে মঞ্চ।
রাজ্য সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে এখন একটু ঘুরলেই দেখা যাবে যে স্থায়ী নিয়োগ প্রায় নেই। কয়েক লক্ষ শূন্যপদ। আর অনেক দপ্তরেই অস্থায়ী কর্মচারীদের দিয়ে কম বেতনে কাজ করানো হচ্ছে। তবে কি সরকারি স্কুলগুলোর মতো রাজ্য সরকারের দপ্তরগুলিতেও আগামীদিনে কর্মীর অভাবে তালা ঝুলবে? না কম মাইনে দিয়ে অস্থায়ী কর্মী দিয়েই চলবে কাজ? নাকি সরকারি দপ্তরগুলিও চলে যাবে বেসরকারি হাতে? রাজ্য সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষকরা মহার্ঘভাতা আদৌ পাবেন? ১৫ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট কর্মচারীদের পক্ষে ইতিবাচক রায় দিলেও তারপরও কি এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান মিলবে? আর কতদিন শহিদ মিনারের মঞ্চে বিভিন্ন জেলা থেকে কর্মীদের এসে ধর্না অবস্থান চালিয়ে যেতে হবে? পশ্চিমবঙ্গে এর পরবর্তীতে সরকারি পদে আদৌ কোনো দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ নিয়োগ হবে? একাধিক প্রশ্ন কিন্তু রয়েই গেল।