গ্রাউন্ডজিরোর রিপোর্ট। দেবাশিস আইচ
নাগরিক মিছিল-এর ডাক দিয়েছিল ‘নাগরিকপঞ্জী বিরোধী যুক্তমঞ্চ’। একটি নাগরিক সংগঠন। ‘পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্ত গণতন্ত্র রক্ষার্থে’ এই মিছিলের ডাক। সমাজ মাধ্যমে প্রচারিত পোস্টে বড়ো হরফে তা লেখা হয়েছে। আরও লেখা হয়েছে, ‘বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী-সহ গ্রেপ্তার হওয়া সকল আইএসএফ কর্মীদের মুক্তির দাবিতে’ এই নাগরিক মিছিল। দলমত নির্বিশেষে সকল নাগরিককে মিছিলে যোগ দেওয়ার আবেদনও রাখা হয়েছিল।
সংবাদপত্র সেই মিছিলকে ‘আইএসএফ’-এর মিছিল বলে দাগিয়ে দিল। শুধু তাই নয়, এ কথাও লেখা হল, “ভাঙড়ের দলীয় বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে আজ, বুধবার আইএসএফের (ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট) ডাকা মিছিলের অনুমতি দিল না লালবাজার।” বিভ্রান্তি ছড়াল সংবাদমাধ্যম। কিন্তু, মিছিলও হল যথারীতি। যথা সময়ে। দুপুর দুটো নাগাদ। উদ্যোক্তারা পুলিশকে জানিয়েছিলেন, শ’তিনেক মানুষের শান্তিপূর্ণ নাগরিক মিছিল হবে শিয়ালদহ বিগবাজার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত। বুধবার (২৫ জানুয়ারি) প্রতিবাদী মিছিলে হাঁটলেন সরকারি হিসাবেই তার অন্তত দশ গুন মানুষ। উদ্যোক্তাদের দাবি ছ’হাজার মানুষ ছিলেন মিছিলে। যার সিংহভাগ গ্রাম-গ্রামান্তরের তরুণ ও যুবক। প্রকৃতপক্ষেই এই মিছিল হয়ে উঠল গ্রামীণ রাজনৈতিক সমাজের মিছিল। মহানগরের নাগরিক প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ছিল, তবে ছিটেফোঁটা।
সংবাদমাধ্যমের ভুল, বিভ্রান্তিকর এবং বাছাই করা খবর প্রচারের ইতিহাস সুবিদিত। সেই প্রচারের শিকার হলেন কি কলকাতার নাগরিক সমাজ? মনে হয় না। সম্ভবত পিরজাদার বংশধর এবং তাঁর দল ও দলীয় কর্মীদের সঙ্গে, মানবাধিকারের স্বার্থেও, একসঙ্গে পথ হাঁটার ঔচিত্য নিয়ে তাঁরা বিভ্রান্ত। এ দলে ও দলে ছোঁয়াছুঁয়ির এই বাতিকও তো আমাদের মজ্জাগত।
নাগরিক মিছিলের দ্বিতীয় দাবিটি ছিল, “ভাঙর বিধানসভার তৃণমূল কংগ্রেস আশ্রিত সমাজবিরোধীদের গ্রেপ্তার করতে হবে।” আইএসএফের প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সভা কলকাতায় কেন ‘হিংসাত্মক’ হয়ে উঠল, তার কারণ লুকিয়ে রয়েছে ভাঙরে। এবং বিরোধী দল— যা আবার সংখ্যালঘু প্রধান—বিরোধী মতের প্রতি তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দলের স্বভাবজ অসহিষ্ণুতা ও বৈরী মনোভাবের মধ্যে।
না, এ অভিযোগ তোলার মানে কলকাতার হিংসাকে বৈধতা দেওয়া নয়। আইএসএফের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানকে বানচাল করতে ভাঙরে আরাবুল বাহিনীর অবৈধতার বিরোধিতা করা। নওশাদ সিদ্দিকী ভাঙরের বিধায়ক। সেই বিধানসভা থেকেই যে সবচেয়ে বেশি দলীয় সভ্য, সমর্থক কলকাতার অনুষ্ঠানে হাজির হবেন সেটাই স্বাভাবিক। গত শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত পুলিশ-প্রশাসনের উপস্থিতিতে, না কি মদতে, বিধায়কের সমর্থকদের উপর আরাবুল বাহিনীর লাগাতার সন্ত্রাস চলল, নৌশাদ আক্রান্ত হলেন, গাড়ি ভাঙচুর হল।
তার আঁচ কলকাতায় এসে পড়ত না, যদি পুলিশ-প্রশাসন ভাঙরে যথাযথ ব্যবস্থা নিত। তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্বৃত্তরা জেলায় জেলায় গণতন্ত্রের মরুভূমি গড়ে তুলবে আর মহানগর কলকাতা মরুদ্যান হয়ে থাকবে— এমনটা হয় না। অন্যায়, অবিচারের উৎসস্থলে এই বিশৃঙ্খলাই ন্যায়, সুবিচার ফিরে পাওয়ার অন্যতম পদক্ষেপ। যুগে যুগে তাই হয়েছে।
যোগীর শহর হলে এতক্ষণে নৌশাদদের ঘরবাড়িতে বুলডোজার লেলিয়ে দেওয়া হত। বাংলার রীতিনীতি চিরকালই আলাদা। দলীয় বাহিনীই ঘরবাড়ি ভেঙে, আগুন লাগিয়ে বিরোধীদের গ্রামছাড়া করে দিতে যথেষ্ট। নবান্নের নির্দেশেই যে এক জন বিরোধী বিধায়ক পুলিশি হেফাজতে, নবান্নের নির্দেশেই যে বিধায়ক, তাঁর সঙ্গী শিক্ষক, সমাজকর্মীদের গায়ে আজ বন্দির পোশাক। এবং নবান্নের নির্দেশেই যে তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে জামিন অযোগ্য রূঢ় ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সংবাদপত্রে স্বয়ং বিধানসভার অধ্যক্ষের উক্তি প্রমাণ করে দেয় এ রাজ্যে বিরোধী বিধায়কের কোনও রক্ষাকবচ নেই। পুলিশ তাঁকে গলা ধাক্কা দিয়ে, টেনেহিঁচড়ে লকআপে পুরে দিতে পারে। অধ্যক্ষের অনুমতি, বিধানসভার অনুমতির কোনও প্রয়োজন পড়ে না। অধ্যক্ষ এর মধ্যে ধর্মের খোঁটা দিতেও ভুলে যাননি। মঙ্গলবার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “কোনও বিধায়ক তাঁর দল নিয়ে রাস্তায় নেমে ভাঙচুর করবেন, জনজীবন স্তব্ধ করে দেবেন আর ধর্ম বা বিধায়ক-পদের আশ্রয় নিতে চাইবেন, তা হতে পারে না। কেউই দেশের আইনের ঊর্ধ্বে নন।” অধ্যক্ষের মনোভাব থেকেই স্পষ্ট পুলিশ-প্রশাসনও প্রতিহিংসামূলক মনোভাব থেকেই লালবাজার লকআপে বন্দিদের প্রতি অমানবিক আচরণের ঘটনা ঘটিয়েছে—সুচিকিৎসা, শীত-পোশাক, পেটভরা খাবার থেকে বন্দিরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
এই স্বৈরাচার, এই গুন্ডারাজ, এই পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হবে না! যাঁরা যখন শাসকের শিকার হবেন তখন প্রতিবাদ করবেন শুধু তাঁরাই! আর কবে আমরা একযোগে বলতে পারব—পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র আক্রান্ত, তাকে রক্ষা করতে হবে।