বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক ছাত্রকে দশ লক্ষ টাকার মানহানি মামলার নোটিশ পাঠালেন শিক্ষক


  • January 2, 2023
  • (0 Comments)
  • 1188 Views

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে এলএলএম (স্নাতকোত্তর)-এর প্রথম সেমেস্টারের ছাত্র সনৎ চন্দ্রকে দশ লক্ষ পাঁচ হাজার টাকার মানহানি মামলার নোটিশ পাঠালেন তাঁরই বিভাগের টিচার-ইন-চার্জ রাকেশ মণ্ডল। সনৎকে একমাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। আইন বিভাগের এই ঘটনা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর তো বটেই, একইসাথে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এই অবস্থা যা কোর্ট অবধি গড়াতে চলেছে তা দেখে হতবাক অনেকেই। অনিমেষ দত্তর প্রতিবেদন।

 

গত ২৬শে ডিসেম্বর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে এলএলএম (স্নাতকোত্তর)-এর প্রথম সেমেস্টারের ছাত্র সনৎ চন্দ্রকে দশ লক্ষ পাঁচ হাজার টাকার মানহানি মামলার নোটিশ পাঠালেন তাঁরই বিভাগের টিচার-ইন-চার্জ রাকেশ মণ্ডল। সঙ্গে এও বলা হয়েছে যে আগামী ১৪ দিনের মধ্যে সনৎ নিঃশর্ত ক্ষমা না চাইলে অধ্যাপক রাকেশ মণ্ডল সনৎ চন্দ্রের বিরুদ্ধে মামলা করবেন।

 

সনৎ চন্দ্র বিভাগীয় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অধ্যাপক রাকেশ মণ্ডলকে উদ্দেশ্য করে কিছু ম্যাসেজ পাঠান। আর সেই ম্যাসেজগুলিই রাকেশ মণ্ডলের মতে “ধিক্কারজনক” ও “অসম্মানসূচক”। আইনি নোটিস  রাকেশ মণ্ডলের  অভিযোগ  যে সনৎ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে লিখেছিলেন, “স্যার আপনি তো অফিসেই থাকেন না… আপনার সাথে তো কথা বলতে গেলে মোনালিসা ম্যাম এর থ্রু কথা বলতে হয়। আর আপনি তো সবকিছু ম্যামের ইন্সট্রাকশনসেই করেন তাই এই গ্রুপে বলতে হচ্ছে।”

 

মানহানি মামলার নোটিশ

 

এই ম্যাসেজ সম্পর্কে সনৎ গ্রাউন্ডজিরোকে জানিয়েছেন – “গত কয়েকদিন ধরেই মোনালিসা ম্যামের ক্লাস রুটিন অনুযায়ী হচ্ছিল না। দেড়টায় সময় ক্লাস থাকলে উনি বারোটায় ক্লাস নিয়ে নিতেন। আমার বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেতে প্রায় আড়াই-তিনঘন্টা সময় লাগে। রুটিন অনুযায়ী যদি ক্লাসগুলো না হয় তাহলে খুবই অসুবিধা হতো৷ তাই রুটিনের সময় মতো ক্লাসগুলো যাতে হয় তার জন্যই আমি টিচার-ইন-চার্জের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু উনি আমায় ফোন এবং হোয়াটসঅ্যাপে ব্লক করে রেখেছিলেন। তাই আমি বাধ্য হয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে জানাই।”

 

নোটিশ পাঠানোর পরেরদিন অর্থাৎ ২৭শে ডিসেম্বর সনৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছলে নোটিশবোর্ডে দেখতে পায় তাঁকে একমাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। সনৎের বক্তব্য, “আমায় কেউ আগে থেকে কিছু না জানিয়ে, আমার কথাটুকু না শুনে, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়েই সাসপেন্ড করা হয়েছে। তারপর আমি স্যারের কাছে গিয়ে কোনো অন্যায় না করেও ক্ষমা চাই এবং ছাত্র – শিক্ষক সম্পর্ক যাতে অবনতির দিকে না যায় তার চেষ্টা করি।” সনৎ আরও বলেন, “আমায় বলা হয় যে আমি যেন আমার বন্ধু রবিউল হালদার-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করি, একমাত্র এই শর্তেই আমার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করা হবে।”

সাসপেনশন নোটিস

অন্যদিকে বিভাগের আরেক শিক্ষক অধ্যাপিকা মোনালিসা সাহার বিরুদ্ধে রুটিন মাফিক ক্লাস না নেওয়ার অভিযোগ করেন সনৎ। এ ব্যাপারে আমরা যোগাযোগ করি মোনালিসা সাহার সঙ্গে, তাঁর বক্তব্য- “সনৎ আমায় দিনের পর দিন ‘স্টক’ করে গেছে এবং হোয়াটসঅ্যাপে ইঙ্গিতপূর্ণ ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। মানসিকভাবে যা আমার কাছে একরকম হেনস্থা। আমি সেই কারণে সনৎকে হোয়াটসঅ্যাপে ব্লক করি। আর সনৎ এবং ওর কিছু বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত করেছে বেশ কয়েকবার।” মোনালিসা সাহা গত ২৮শে ডিসেম্বর বর্ধমান থানায় সনৎ চন্দ্রের বিরুদ্ধে একটি জেনারেল ডাইরিও (জিডি) করেন। তাঁর অভিযোগ “আমি বার বার বারণ করা সত্ত্বেও সনৎ আমায় ম্যাসেজ পাঠাতো, এমনকি যখন ও এলএলএম এ ভর্তি হয়নি তখনও। বাধ্য হয়েই ওকে ব্লক করেছিলাম।”

 

 

এব্যাপারে সনৎের বক্তব্য, “মোনালিসা ম্যাম আমার খুবই প্রিয় একজন শিক্ষক ছিলেন। আমি এলএলবি (স্নাতক) পড়েছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখনও উনি আমাদের ছাত্রদের নিয়ে ঘুরতে গিয়েছেন। এলএলবি শেষ ও এলএলএম এ ভর্তির মাঝের সময়ে ম্যামকে আমি একাডেমিক বিষয়ে কিছু গাইড করার আবেদন জানিয়েছিলাম। একজন শিক্ষকের কাছে এই আবেদন করা কি অন্যায়? তারপরেও আমি ম্যামের কাছে ক্ষমা চেয়েছি। কিন্তু উনি আমায় বিভিন্ন সময়ে ক্লাসে ছোট ছোট বিষয়কে অজুহাত করে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছেন। উনি অভিযোগ করেছেন যে আমি নাকি ওনাকে স্টক করেছি বা মানসিক ভাবে হেনস্থা করেছি যা একেবারেই ভিত্তিহীন। তবুও আমি ওনার কাছে ক্ষমা চেয়েছি, আমার কোনো ভুল থাকলেও তা নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছি। উনি কোনো ভাবেই সহযোগিতা করেননি।”

 

আরেক ছাত্র রবিউল হালদার, যিনি সনৎের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধেও একটি কমিটি বসানো হয়েছে বলে জানা গেছে। রবিউল জানাচ্ছেন, “সনৎের সাথে অন্যায় হচ্ছে দেখেই আমি ওর পাশে দাঁড়িয়েছি। আমরা আইনের ছাত্র, আমরা নিজেরাই যদি নিজেদের অধিকারের দাবী না করতে পারি তাহলে আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সময় অন্যের অধিকার নিয়ে লড়ব কীভাবে?” রবিউল আরও বলেন, “আসলে সনৎের মাধ্যমে ওনারা আমাদের সকলের মুখ বন্ধ করতে চাইছেন। আমরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান সমস্যা নিয়ে বারবার মুখ খুলেছি। ছোট বড়ো বিভিন্ন প্রয়োজনে যা আমাদের অধিকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তা চাইতে যাওয়া হয়েছে রাজবাটীতে। ২০১৫ সাল থেকে আমাদের ইউনিয়ন ইলেকশন হয়নি। যার ফলে সমস্যায় পড়ছিল ছাত্রছাত্রীরা। ২০১৮ সাল থেকে আমরা বেশকয়েকবার ডেপুটেশন দিয়েছি উপাচার্যের কাছে ইউনিয়ন গঠনের জন্য। কিন্তু আমাদের ইউনিয়ন করার অধিকার আমাদের দেওয়া হয়নি। আর লাগাতার আমরা আমাদের অধিকার চাইতে থাকায় ওনাদের সমস্যা হয়েছে। সনৎও ওর ঠিকমতো ক্লাসের অধিকারের দাবীই জানিয়েছিল, তাই ওর উপর এই মামলা। আমার মনে হয় না পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে কোনো শিক্ষক তাঁর ছাত্রের বিরুদ্ধে এরকম অন্যায় পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে৷”

 

সনৎকে সাসপেন্ড করার পরের দিনই ছাত্ররা প্রতিবাদ জানিয়ে কিছু পোস্টার লাগায় বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই পোস্টারগুলিও ছিড়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন রবিউল। আগামী ৪ঠা জানুয়ারী কমিটি তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছে। রবিউলের বক্তব্য, “আমি বা আমরা কেউ ভয় পাই না। নিজের অধিকার চাওয়াটা অন্যায় নয়৷ আমি কোনো দোষ করে থাকলেও সেটা আমায় পরিষ্কার করে বলা হোক, সনৎকে যে সুযোগটাই দেওয়া হয়নি। আমি কমিটির সামনে যাব, আমরা কথা রাখব৷ আন্দোলন চালিয়ে যাব।”

ছেড়া পোস্টার

সনৎ দশ লক্ষ পাঁচ হাজার টাকা কোথা থেকে জোগাড় করবে? এব্যাপারে সনৎ জানিয়েছে, “ইতিমধ্যেই আমার বন্ধুরা চাঁদা তোলা শুরু করেছে। স্যার যদি কোর্টেই নিয়ে যেতে চান, তাহলে আমিও তাই যাব। মাথা নত করব না। ভালো করে পড়াশোনা করব বলে এসেছিলাম, কিন্তু এইধরনের অন্যায় হবে আমার সাথে তা আমার পরিবারের কেউও কল্পনা করতে পারেননি। টাকা জোগাড় করে মামলা লড়তে গিয়ে হয়তো আমার আর পড়াশোনা করাটাই হবে না।”

 

অধ্যাপক রাকেশ মণ্ডলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম আমরা, কিন্তু উনি ফোন ধরেননি। আইন বিভাগের এই ঘটনা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর তো বটেই, একইসাথে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এই অবস্থা যা কোর্ট অবধি গড়াতে চলেছে তা দেখে হতবাক অনেকেই। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগ মিলিয়ে একটি ছাত্র ইউনিয়ন আছে। আইন বিভাগের ইউনিয়নটি ছিল স্বতন্ত্র একটি ইউনিয়ন যা শুধুমাত্র আইন বিভাগের জন্যই। কিন্তু গত আট বছর ইউনিয়নহীন আইনবিভাগ। নতুন বছর সবে শুরু হল। এই ঘটনা কোনদিকে গড়াতে চলেছে আগামীদিনে? সুষ্ঠুভাবে পড়াশোনার পরিবেশ কি ফিরবে বিভাগে? ছাত্র-শিক্ষিক সম্পর্কে কি আদৌ কোনো উন্নতি হবে? মামলা হলে ছাত্রটি কি আর আগামীদিনে পড়াশোনায় ফিরতে পারবে? মানহানির সংজ্ঞাই বা কি? অধিকার চাওয়া কি অপরাধ? এরকম একাধিক প্রশ্ন উস্কে দিয়েই আমাদের আপাতত অপেক্ষা করতে হবে ঘটনাটি কোন দিকে এগোয়ে পরবর্তী দিনগুলোতে।

 

Share this
Leave a Comment