মাইগ্রেশন : আর্থ-সামাজিক বর্মহীন এক মজুরি-অভিযান


  • December 26, 2022
  • (0 Comments)
  • 1088 Views

করোনা ফের চোখ রাঙাচ্ছে। সংবাদমাধ্যম ও সরকারগুলিও। ফের আমাদের লোকাল ট্রেন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ, আংশিক লকডাউনের ‘অসমর্থিত সূত্র’-এর নানা খবর বেশ জোর গলায় প্রচারিত হওয়া শুরু হয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে করোনাকাল এবং বর্তমানের পরিযায়ী শ্রমিক এবং এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে চলমান মামলার কথা স্মরণ করলেন দেবাশিস আইচ

 

এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন

শরীর দিয়েছ শুধু, বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে?

– শঙ্খ ঘোষ

 

শঙ্খবাবুর এই কবিতার এই পঙক্তির সঙ্গে আমাদের বিষয় এবং শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে যে তেমন কোনও সম্পর্ক আছে তা ঠিক নয়। যেমন রয়েছে, যমুনাবতী কবিতায় ‘নিভন্ত এই চুল্লিতে মা/ একটু আগুন দে/ আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি/ বাঁচার আনন্দে’—ভুখা মিছিলে এক কিশোরীর গুলিতে মৃত্যুর ঘটনার প্রেক্ষিতে যা রচিত। বা ‘লজ্জা’ কবিতাটি—বাবুদের লজ্জা হল/ আমি যে  কুড়িয়ে খাব/ সেটা ঠিক সইল না আর/ আজ তাই ধর্মাবতার/ আমি এই জেলহাজতে/ দেখে নিই শাঠ্যে শঠে। কিন্তু, প্রচলিত রীতি অনুযায়ী শিরোনামের কথা ভাবতে ভাবতে এই পঙক্তি দু’টি হঠাৎ মনে পড়ে গেল। কর্মহীনতা, দারিদ্র, বৈষম্য, শ্রমের অমর্যাদা, অধিকারহীনতা, মনুষ্যত্বের অবমাননার এই যে ‘ব্যূহ চক্র’; ঠিকাদার, মালিক, মনিব, শ্রম দফতর, সরকারের মতো ‘তীর তীরন্দাজ’—যাদের হাতে একদিন প্রতিদিন ক্ষতবিক্ষত হতে থাকেন এক জন দিনমজুর, ঠিকাশ্রমিক। তখন আক্ষেপ মেশানো অভিমানী স্বর যেন বলে ‘শরীর দিয়েছ শুধু’, খেটেখাওয়ার শরীরটুকু; শ্রমিকের আইনি অধিকার, ন্যায্য মজুরি ও মর্যাদার ‘বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে’।

 

একটি উজ্জ্বল ছবি দিয়েই শুরু করা যাক।

 

ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক তার এক সাম্প্রতিক ‘মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্রিফ’-এ বলছে, জগতজোড়া মূল্যবৃদ্ধির এই সময়েও, এই ২০২২ সালে ভারতীয় মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কাররা ১০০ বিলিয়ন ইউএস ডলার পাঠাতে চলেছেন। ভারত যে রিমিটটান্স প্রাপ্তিতে দীর্ঘকাল প্রথম সারিতে তা আমরা জানি। কিন্তু, খবরটার গুরুত্ব হচ্ছে, এই বাজারে যে রিমিটটান্স আসছে তা গত বছরের তুলনায় ১২% বৃদ্ধি পেতে চলেছে। যা এক রেকর্ড বলে জানাচ্ছে বিশ্বব্যাঙ্ক। শুধু ভারত নয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতেও রিমিটটান্সের বলার মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে, ভারতের সঙ্গে তার একটা বড় ধরনের ফারাক রয়েছে।

 

এই যে অর্থ দেশে আসছে, আমাদের মতো দেশগুলির গরিব পরিবারগুলির কাছে তা একটা অপরিহার্য আয়ের পথ। যে আয়ের ফলে একটা শ্রমিক পরিবার দৈনন্দিন পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার খেতে পারে। বাচ্চারা চায়ের দোকানের বদলে স্কুলে যেতে পারে, জড়িবুটি ছেড়ে ডাক্তারের কাছে যায় শ্রমিক পরিবার, বাড়ি ঘরদোর পাকাপোক্ত হয়, হাসি মুখে উৎসব-পরব পালন করে। অভ্যন্তরীন শ্রমিকরাও বাড়িতে টাকা পাঠান। খুবই পুরনো ২০০৮ সালের একটা হিসাব হল, আন্তঃরাজ্য এই রিমিটট্যান্স মার্কেটটির আর্থিক পরিমাণ ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার ৮০ ভাগ গ্রামে পৌঁছায়। [চিন্ময় তুম্বে, ২০১৮]

 

আর এটুকু সুখ—যা একজন নাগরিকের অধিকার—অর্জন করতে একজন শ্রমিককে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পরিবার ছেড়ে দূর দেশে অবর্ণনীয় পরিবেশে বাস করতে হয়। থাকা, খাওয়াদাওয়ার জন্য যেটুকু খরচ না করলেই নয় সেটুকুই—নাহলে বাড়ির জন্য টাকা আর পাঠানো হবে না। তাঁরা কীভাবে থাকেন খান আমরা-আপনারা তা দেখেছি— নির্মীয়মান বহুতল বাড়ির পাশে ইট বা টিনের গুমটিতে, ইটভাটার এক ধারে আলগা ইটের মুরগির খোঁয়াড়ের মতো ঘরে, খালপাড়ে, রেললাইনের ধারে, শ্রমিক বস্তিতে—কিন্তু, কোভিড আর লকডাউন আমদের আরও গভীর ভাবে দেখতে বাধ্য করেছে। শুধু চোখের দেখা নয়, অনুভব করা। এতকাল এই এক বিপুল শ্রমশক্তি যা আমাদের কাছে অদৃশ্য ছিল তা যখন আকস্মিক ভাবে চোখের সামনে ফেটে পড়ল—আমরা তো বটেই, দেশের সরকার, কী কেন্দ্র কী রাজ্যগুলি সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। এই যে একটি রোগ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ অবধি কেন্দ্রীয় সরকার তা কার্যত স্বীকার করতেই চায়নি। যখন স্বীকার করল তখন কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে সারা দেশের তাবড় গতিময়তা স্তব্ধ করে দেওয়া হল। যাঁরা প্রিভিলেজড, মাস মাইনে নিশ্চিত, তাঁরা অনেকটাই নিশ্চিত হলেন।

 

যাক ছোঁয়াছুঁয়ির হাত থেকে তো বাঁচা গেল। খুব তাড়াতাড়ি আমরা শিখে ফেললাম কীভাবে হাত ধুতে হয়, কীভাবে হাঁচতে কাশতে হয়, কীভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আমাদের শব্দ ভাণ্ডারে নতুন নতুন শব্দ যোগ হল এবং তা দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠল—করোনা, স্যানেটাইজার, মাস্ক, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং, ফিজিক্যাল ডিস্টেন্সিং, কোয়রান্টিন, সেফ হোম এমন অনেক। এছাড়া আরও কত প্রোটোকলের গেরোতে যে বাঁধা হল সারা দেশকে তার ইয়ত্তা নেই।

 

এই যে যাঁরা দেশের মানুষকে রোগভোগ, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে এত কিছু ভেবেছিলেন, তাঁরা কি এ কথা ভেবেছিলেন—যাঁরা দিন আনেন দিন খান, কাজ বন্ধ হলে তাঁরা খাবে্ন কী? দেশের শ্রমিক শ্রেণির ৯০ শতাংশই তো তাই। যাঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। দেশের সরকার, সরকারের থিংকট্যাঙ্ক যারা এক নিমেষেই যাবতীয় কর্মকাণ্ডে দাঁড়ি টেনে দিয়েছিল—তাঁদের হিসাবে কি এই মানুষগুলোর অস্তিত্ব ছিল? যাঁরা নির্মীয়মান শিল্পে সেতু, রাস্তাঘাট, আবাসন তৈরির কাজে যুক্ত রয়েছেন, যাঁরা মুম্বাই, হায়দরাবাদ, ব্যাঙ্গালোরে জরিশিল্পে কাজ করতে গিয়েছেন? এমন অসংখ্য ধরনের কাজ রয়েছে অসংখ্য ছোটখাট কলকারখানায়, বড়ো কারখানায় ছোট ছোট চুক্তি বা ঠিকাকাজে। বড়ো বড়ো শহরের বাজারে রয়েছেন বহু মুটেমজুর। সে সব শহরের যাবতীয় বর্জ্য সাফসুতরো রাখেন যাঁরা তাঁদের বড় অংশটিই ভিনদেশি। এছাড়াও তো রয়েছেন, গৃহ সহায়িকা, ছুতোর মিস্ত্রি, কলের মিস্ত্রি, হোটেল-রেস্তোরাঁর রাঁধুনি, বেলবয়, ওয়েটার আরও কত পেশা। এঁদের কথা ভাবা হয়েছিল? সরকার কি ভেবেছিল কাজ বন্ধ হয়ে গেলেও এঁদের খাইয়ে পরিয়ে রাখবে মালিক কিংবা মনিবরা?

 

আমরা আজ অনেক কিছু দেখেশুনে, নানা তথ্য পড়ে, বুঝে বলতে পারি—না সরকারের চিন্তাচেতনায় এই মানুষগুলো কোথাও ছিল না। ছিল না, কারণটা খুব পরিষ্কার—এই মানুষগুলো এই শ্রমিকদের কোনও অস্তিত্বই ছিল না কারও কাছে। সে সরকারের শ্রম দফতর হোক কিংবা ট্রেড ইউনিয়ন, সমাজসেবী বা এনজিও। এই কথাগুলো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল তখনই, যখন তাবড় বিধিনিষেধকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হাজারে হাজারে শ্রমিক রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন। আর সরকারের ভূমিকা আমরা দেখেছি—কীভাবে রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে, হোসপাইপ দিয়ে রাসায়নিকে স্নান করানো হয়েছে, কান ধরে ওঠবোস করিয়েছে পুলিশ। তাঁদের একমাত্র অপরাধ ছিল কাজ হারিয়ে, মজুরি হারিয়ে, মাথার ছাদ হারিয়ে অজানা রোগের ভয়ে দলে দলে নেমে পড়েছিলেন রাস্তায়। নিজেদের দেশ-গাঁয় ফিরে যাবেন বলে। এবং ফিরতে গিয়ে ১৬ জন শ্রমিক, যাঁদের প্রায় সকলেই আদিবাসী, রেল লাইনে মালগাড়ির নীচে কাটা প্ড়ে মারা গেলেন। রেলট্র্যাকে পড়ে থাকা রক্তমাখা রুটির সে ছবি আমরা দেখেছি। লকডাউন শুরুর প্রায় ৪০ দিন পর মহারাষ্ট্রের অওরঙ্গাবাদের জলনার এক ইস্পাত কারখানার ২০ জন শ্রমিক বেরিয়ে পড়িয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশে শহদৌল ও উমরিয়া পৌঁছানোর জন্য। কিছুটা পাকা সড়ক ধরে এগোনোর পর তাঁরা বদনাপুর বলে একটি জায়গা থেকে রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকেন। প্রাথমিক গন্তব্য ভুসাবল। যা ১৫০ কিমি। ১ মে থেকে শ্রমিক স্পেশাল চালু হয়েছে। উদ্দেশ্য ভুসাবল থেকে স্পেশাল ধরে বাড়ি ফিরবেন। ৪০ কিমি হাঁটার পর বদনাপুর ও করমাডের মাঝামাঝি ক্লান্ত হয়ে ট্রেন লাইনেই শুয়ে পড়েন তাঁরা। ৯ মে ভোরে ৫.২২ নাগাদ মনমাডের পানেওয়াডিগামী একটি মালগাড়ি ১৪ জনকে কচুকাটা করে দেয়। হাসপাতালে মারা যান আরও দু’জন। যে তিন জন বেঁচে ফিরেছিলেন তাঁরা শুয়েছিলেন লাইনের বাইরে।

 

খিদে-তেষ্টায় পথের মধ্যেই বুক ফেটে মরে যাওয়া ১২ বছরের আদিবাসী শিশু জামলো মাকদামের কথা কাগজে পড়েছি। জামলো তার ছত্তীশগঢ়ের গ্রাম থেকে ১৫০ কিমি দূরে তেলেঙ্গানার এক গ্রামের লংকাখেতে কাজে করতে গিয়েছিল। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত আটকে থাকার পর ওদের পুরো দলটাই হেঁটেই বাড়ির পথ ধরে। তিন দিনে প্রায় ১০০ কিমি হাঁটার পর ক্লান্তি আর জলের অভাবে মাকদাম মারা যায়। ডাক্তাররা বলেছিলেন, যা কাগজে বেরিয়েছে—’ডিউ টু এক্সজশন অ্যান্ড ডিহাইড্রেশন’। এখানে তিনটে বিষয় উঠে আসে। প্রথমত, লকডাউন জারি করা হয়েছিল ২১ দিনের জন্য। অর্থাৎ, ২৪ মার্চ রাত ১২টা থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। ১৪ এপ্রিল ফের বাড়ল লকডাউনের সময় সীমা। ১৫ এপ্রিল তাঁরা বাধ্য হলেন বেড়িয়ে পড়তে। কেন? দুটো সমীক্ষার তথ্য দিই। একটি ১১ হাজার ১৫৯ জনের উপর ২৭ মার্চ-১৩ এপ্রিল সময়ে করা ‘স্ট্রান্ডেড ওয়ার্কাস অ্যাকশন নেটওয়ার্ক’-এর করা; দ্বিতীয়টি, ১৩ এপ্রিল থেকে ২৩ মে সময় পর্যন্ত ১২টি রাজ্যের ৫০০০ জন অসংগঠিত ও দৈনিক মজুরির শ্রমিকের উপর আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটি’র ‘কোভিড-১৯ অ্যান্ড লাইভলিহুড সার্ভে’। আমরা এখানে এই সমীক্ষার পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটি দেখব।

 

প্রথম সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে : ৮-১৩ এপ্রিল ওই শ্রমিকদের ৯৬% কোনও রেশন পাননি। লকডাউন ঘোষণার পর ৮৯% মজুরি পাননি। ৭৪ শতাংশের হাতে মজুরির অর্ধেক পড়ে রয়েছে। ৭০ শতাংশের হাতে পড়ে রয়েছে ২০০ টাকার মতো। এঁদের মধ্যে ১৭% দিনমজুর, কারখানার বা নির্মাণশ্রমিক, ৮% গৃহ সহায়িকা, গাড়ির চালক, ৮% ভেন্ডার, হকার। যাঁদের গড় দৈনিক আয় ৪০২ টাকা।

 

দ্বিতীয় সমীক্ষায় এ রাজ্যের চিত্রটি এরকম :

  • ৭৮% জানিয়ছেন, তাঁরা অতিমারির সময় কাজ হারিয়েছেন।
  • ৪৮% পরিবারের কাছে এক সপ্তাহের অত্যাবশকীয় পণ্য কেনার টাকা নেই।
  • ৯৩% জানিয়েছেন আগের তুলনায় তাঁরা কম খাচ্ছেন।
  • ৯৪% জানিয়েছেন, তাঁরা রেশন পেয়েছেন।
  • ৫১% বলেছেন, তাঁরা কোনও আর্থিক সাহায্য পাননি।

 

মাকদামরা তো সাধে বেরিয়ে পড়েননি। কৃষিকাজে যেমন কোনও লকডাউন ছিল না। তেমনি চাষের কাজে আসা মানুষদের তো মনিবরা বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবেন না। অতএব হেঁটে বাড়ি ফেরাই একমাত্র উপায়। এবং আশ্চর্য হওয়ার কোনও কারণ নেই যে, ১০০ কিমি পথে, এপ্রিলের ওই গরমে, একটি ১২ বছরের শিশুকে প্রশাসন একটু খাবার বা জল দিয়ে সাহায্য করেনি বা কোনও শিবিরে নিয়ে যায়নি।

 

কিন্তু, জামলো মাকদাম কিংবা ওই ১৬ জনের বা আরও যে অসংখ্য জন দুর্ঘটনায়, অসুস্থ  হয়ে মারা গিয়েছেন তাঁদের কোনও তথ্যই নেই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ সংসদে শ্রম প্রতিমন্ত্রী সন্তোষকুমার গাঙ্গোয়ার বিরোধী সদস্যদের এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন, সরকারের কাছে এমন কোনও তথ্য নেই। এ শুধু কেন্দ্রের বিষয় নয়। রাজ্যেরও বিষয়। যে অঞ্চলে দুর্ঘটনা ঘটবে, সেই থানা এলাকাতেই তো প্রথম আহত, নিহতের নামধাম নথিভুক্ত হবে। ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরো বা এনসিআরবি রাজ্য থেকে তা সংগ্রহ করে তথ্যভাণ্ডার তৈরি করবে। সন্দেহ নেই কেউই সেই দায়িত্ব পালন করেনি। এমন অজস্র উদাহরণ টেনে আনা যায়। যে উদাহরণ দিয়ে বার বার প্রমাণ করা যায় পুঁজির চক্রব্যূহে তাঁরা যেন অভিমন্যু।

 

এই যে প্রায় পৌনে তিন বছর হতে চলল মাইগ্রেন্টদের জীবনে কোথাও কি কোনও বদল ঘটল? আমরা কি জানতে পারলাম দেশে মাইগ্রেন্ট লেবারের সংখ্যা ঠিক কত? আমাদের রাজ্যেই বা কত? তাঁদের যতটুকু আইনি অধিকার লিখিত-পড়িত ভাবে আছে, তা কি পালিত হচ্ছে? এই যে, পরিযায়ীদের জন্য বাসস্থানের যে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা তা কি বাস্তবায়িত হয়েছে? আমাদের রাজ্যেই যেমন বলা হয়েছিল যে, এ রাজ্যে কাজের কোনও অভাব নেই। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে আর কেউ যেন ভিন রাজ্যে না যায়। সেই নিশ্চয়তা কি পাওয়া গিয়েছে। জেলাশাসকদের বলা হয়েছিল, জেলায় কতজন এই জাতীয় কত শ্রমিক আছেন, তাঁরা কী কী জাতীয় কাজ করেন, কত জন স্কিলড, কতজন আনস্কি্লড—তা সেই সব জেলাওয়ারি তথ্য কি সব সংগৃীহত হয়েছে? পরিকল্পনা অনুযায়ী কি শ্রমিকদের কাজে ডাকা হচ্ছে? উত্তরে বলা যায়, পরিযায়ী শ্রমিক বিষয়ক এইসব তথ্য জনপরিসরে নেই। বাসস্থানের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। এ রাজ্য থেকে ভিন রাজ্যে কাজে যাওয়া অব্যাহত। এ প্রসঙ্গে এসেই আমাদের আলোচনা শেষ করব। তার আগে নিজেদের রাজ্যের দিকে চোখ বুলিয়ে নিই।

 

পূর্ব বর্ধমান জেলার খবর। রাজ্যের শস্যগোলা। সেই শস্যগোলার ভাতার, মঙ্গলকোট, আউশগ্রাম, মেমারি, মন্তেশ্বরের খেতমজুররা দলে দলে পাড়ি দেন দক্ষিণের বড় রাজ্যগুলিতে। এঁদের একটা বড় অংশ সেখানে চাষের কাজে যান। পুজোর পর থেকেই তাঁরা রওনা দেওয়া শুরু করেন। ভাতারের শুধুমাত্র বামসোর গ্রামেরই ৯৫৬ জন মহিলা-পুরুষ পাড়ি দিয়েছেন কেরালা, মহারাষ্ট্র, গুজরাটে। ঠিকাদার শিবু মণ্ডলের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে দিনে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় হয়। যেখানে বর্ধমানে দিনে ২৫০ টাকা মজুরি। ভাতারের একটি গ্রামের দুই মহিলা খেতমজুর সাংবাদিককে জানিয়েছেন, ধানকাটার যন্ত্র আসায়, জমিতে কাজ কমেছে। বছরে ৪৫ দিন কাজ জোটে না মেয়েদের। তাই বাইরে না গিয়ে উপায় নেই। খোদ পূর্ব বর্ধমানের যদি এই পরিস্থিতি হয়, যেখানে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া থেকে সংলগ্ন ঝাড়খণ্ড থেকে দলে দলে আদিবাসী খেতমজুর নামালে আসেন, আসেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে তবে পিছিয়ে থাকা জেলাগুলির পরিস্থিতি অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। [গণশক্তি, ৮.১০.২২ ও আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩.১১.২২]

 

সম্প্রতি দক্ষিণবঙ্গে চাষের কাজে অনাবৃষ্টির প্রভাব বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানা গেল, এ বছর ধানরোয়ার জন্য পুরুলিয়া থেকে খেতমজুর আনার জন্য লোক পাঠাননি বর্ধমানের মনিবরা। এক-একটি ছোট ট্রাকে গাদাগাদি করে ৪০-৪৫ জন খেতমজুরের নামাল যাত্রা, ট্রেনে-বাসে ছাপিয়ে ওঠা ভিড়—এ বছর সে দৃশ্য দেখা যায়নি।

 

সে কথা স্বীকার করেছিলেন, গলসি ২ ব্লকের ভারিচা গ্রামের মানস হাজরা। জানিয়েছিলেন, অনিয়মিত এবং স্থানীয়ভাবে বৃষ্টি হয়েছে এবার, ডিভিসিও জল ছেড়েছে দেরিতে। এক যোগে সারা জেলা জুড়ে বৃষ্টি হয়নি। তাই যেখানে যখন জল পাওয়া গিয়েছে সেখানেই দ্রুত ট্রাক্টর দিয়ে স্থানীয় কৃষিমজুর দিয়ে চাষ শুরু করে দিয়েছেন চাষিরা। যেমন, মন্তেশ্বর, মঙ্গলকোটে আলু চাষ বেশি। ধান তুলেই আলু চাষ হবে। সেখানকার চাষিরা ডিপ টিউবয়েল আর কিছুটা বৃষ্টির জল পেতেই ধান রোয়া শুরু করে দেন। ১০ দিনের মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে যায়। ভিন জেলা থেকে শ্রমিক আনার সময় কই? আবার যখন মেমারির রোয়া শেষ হয়েছে মজুররা ট্রেন ধরে চলে গিয়েছেন গলসি। এক মৌজার কাজ শেষ হলে তাঁরাই পৌঁছে গিয়েছেন আরেক মৌজায়। জলের অভাবে চাষের অনিশ্চয়তায় রোয়ার কাজ হারালেন শত শত আদিবাসী শ্রমিক। যে গ্রামগুলি থেকে তাঁরা আসবেন সেখানে তো ক্ষুধার রাজত্ব। অথচ, দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে বৃষ্টির আকাল, রাজ্য জুড়ে সারের কালোবাজারি, ১৪৫০ টাকার সার বিক্রি হয়েছে, কোথাও ১৯৮০ টাকা্,‌ কোথাও বা ২০২২ টাকা। দাম বেড়েছে কীটনাশকের। আবার বর্ষার জল নির্ভর চাষে যথেচ্ছ ব্যবহার করতে হচ্ছে মাটির নীচের জল। ব্যয় বাড়ছে বিদ্যুৎ ও ডিজেলের পিছনে। নিরুপায় তাঁদের সাবেক মনিবরাও। মনে হয়েছিল, রাজ্যে চাষবাস যে সঙ্কটে তার এক অন্যতম সূচক আদিবাসী শ্রমিকদের ঘরবন্দি হয়ে থাকা। [গ্রাউন্ডজিরো ডট ইন, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২]।

 

আমাদের দেশে ৯৩% প্রান্তিক বা ছোট চাষি। মাত্র ৭% গ্রামীণ পরিবার ৪৭% জমির  মালিক, ৪০% কৃষিশ্রমিক দিনমজুরির উপর নির্ভরশীল [নিলসেন, ২০১৮]। তার উপর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে, ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ার জন্য, জমি হারিয়ে বা মেকানাইজেশনের জন্য কাজ হারিয়ে তাঁরা দলে দলে শহরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। এই যে বর্ধমানের খেতমজুররা ধানকাটা মেশিনের জন্য ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, এটাও নতুন নয়। কেরালায় তো বহুকাল ধরেই যাচ্ছেন। কিন্তু, এই বর্ধমানের কথা তোলা কেন? তোলা এই জন্য যে, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে—ভুল হতে পারি—এখানে একটা সিরিয়াস স্টাডি হওয়া প্রয়োজন। সেপ্টেম্বরে জানতে পারলাম, জলের অভাবে চাষের ক্ষতি হয়েছে। তার সঙ্গে সারের কালোবাজারি আর সমস্ত উপাদানের দাম বৃদ্ধি তো রয়েইছে। অক্টোবর, নভেম্বরে কাগজে পড়লাম দলে দলে খেতমজুররা ভিন রাজ্যে যাচ্ছেন। এর পিছনে কারণ কি শুধু হারভেস্টারের আগমন? এটা অবশ্যই একটা কারণ? এর সঙ্গে কি যোগ করা যাচ্ছে ঘোর বর্ষাকালে অনাবৃষ্টিকে? মানে, জলবায়ুর কুপ্রভাব কে? আরও একটি বিষয় অবশ্য রয়েছে এবং তা হল এক বছরের উপর ১০০ দিনের কাজ বন্ধ থাকা। শুধু তাই নয়, বিগত বছরের কাজের টাকা আটকে যাওয়া। মানে, মেকানাইজেশন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। অন্যান্য ফ্যাক্টর তো রইলই—যেমন, কৃষি উপাদানের মূল্যবৃদ্ধি, ফসলের ন্যায্য দাম না মেলা এরকম। আমাদের খাদ্যগোলার উপর এই ‘কেস স্টাডি’টা একটা ইনস্টিটিশনই করতে পারে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়। এই জন্যই বর্ধমান নিয়ে এতগুলো কথা বললাম। এবার আসব মাইগ্রেন্ট অধিকার বিষয়ক সুপ্রিম কোর্টে বর্তমানে চলা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিষয়ে। এবং শেষ করব।

 

বাড়ি ফিরতে চাওয়া শ্রমিকদের দুর্দশা দেখে ২৬ মে ২০২০ সুপ্রিম কোর্ট একটা সুয়ো মোটো মামলা গ্রহণ করে। পাশাপাশি, বন্ধুয়া মুক্তি মোর্চা’র একটি রিটও গ্রহণ করেছিল। পরবর্তীতে অন্যান্য অনেক সংগঠন, ব্যক্তি মামলায় অন্তর্ভুক্ত হন। এই সময় সুপ্রিম কোর্ট একগুচ্ছ রায় দিয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল অসংগঠিত মাইগ্রেন্ট শ্রমিকদের জন্য, নির্মাণ শ্রমিক এবং সাধারণ ভাবে অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য যে কল্যাণকামী আইনগুলি রয়েছে তা যেন ঠিক ভাবে পালিত হয় তার উপর। আইনগুলি হচ্ছে, ইন্টার-স্টেট মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কমেন অ্যাক্ট, ১৯৭৯ (আইএসএমডব্লিউএ), বিল্ডিং অ্যান্ড অদার কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কাস (রেগুলেশন অফ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড কন্ডিশনস অফ সার্ভিস অ্যাক্ট, ১৯৯৬ (বিসিওডব্লিউও), আর আনঅর্গানাইজড ওয়ার্কাস সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ২০০৮, (ইউডব্লিউএসএসএ)। আইন তো আছে কিন্তু অধিকাংশ শ্রমিকের নামই নথিভুক্ত নেই। তাঁরা কোনও ওয়েলফেয়ার বেনিফিট পান না। ইন্টার-স্টেট মাইগ্রেন্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী সমস্ত কন্ট্রাকটরদের লাইসেন্স এবং প্রিন্সিপাল এস্টাবলিশমেন্টগুলির রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। কিন্তু, সরকারের তরফ থেকে তার উদ্যোগই নেই। সেই সময় সুপ্রিম কোর্ট পরিস্থিতি দেখে সরকারগুলোকে লাইসেন্স আর রেজিস্ট্রেশনের উদ্যোগ নিতে আদেশ দেয়। পাশাপাশি, শীর্ষ আদালত এও লক্ষ্য করে অনেক রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আইএসএমডব্লিউ অ্যাক্ট অনুযায়ী মাইগ্রেন্ট লেবাররা কী কী সুবিধা উপভোগ করেন তার কোনও তথ্যই দেয়নি। তখনই আদালত এই রেজিস্ট্রেশনের আদেশ দেয়।

 

এর আগে ২০১৮ সালের এক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাক্টে রেজিস্ট্রেশন করার জন্য সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে মডিউল পাঠানোর জন্য কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রককে নির্দেশ দিয়েছিল। মন্ত্রক একটি কুটোও নাড়েনি। ২০২১ সালের ৫ মে কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ একটা প্রেস রিলিজের মাধমে ঘোষণা করে ডেটাবেস রেজিস্ট্রেশন এখন অ্যাডভান্সড স্টেজে রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ২৪ মে কেন্দ্রকে বলে, আনঅর্গানাইজড লেবারদের রেজিস্ট্রেশন বিষয়ে বিস্তারিত জানাও। কেন্দ্র তখন বলে তারা একটা ‘ন্যাশনাল ডেটাবেস ফর আনঅরগানাইজড ওয়ার্কাস’ (এনডিডব্লিউও) তৈরি করছে। এবং তা নাকি একটা সর্বাঙ্গীন, ডাইন্যামিক ডেটাবেস। এবং সেখানে পরিযায়ীরা ছাড়াও, গিগ ওয়ার্কার, প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্কার, নির্মাণশ্রমিক, গৃহসহায়িকা এবং এমন অন্যান্যদের তথ্য থাকবে। প্রায় ৪০০টি ক্যাটাগরি।

 

২৯ জুন.২০২১ সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রের এই এড়িয়ে যাওয়া মনোভাবের এবং কাজকর্মের নিন্দা করে বলে, “When the unorganised workers are wating for registration and are wating to reap the benefit of various welfare schemes of the states and centre, the apathy and lackadaisical attitude by the Ministry of the labour and Employment is unpardonable.” এর সঙ্গে শীর্ষ আদালত যোগ করে, “to provide access to the migrant workers to different schemes of state government and central government, registration is a must.”

 

কী কী করতে হবে তা বিস্তারিত রায়ে জানিয়ে শীর্ষ আদালত জানিয়ে দেয়, ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন শেষ করতে হবে।

 

তো এই যে ন্যাশনাল ডেটাবেসের কথা বলা হচ্ছে তার জন্য কেন্দ্র ২০২১ সালের ২৬ অগস্ট একটা e-Shram পোর্টাল লঞ্চ করে। তা সরকারের হিসাব হচ্ছে আনঅর্গানাইজড সেক্টরে ৩৮০ মিলিয়ন শ্রমিক রয়েছে। অনেকেই আপত্তি করে জানান যে এর সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল নেই। পাশাপাশি, আপনারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অন্যত্র খোঁজ নিয়ে দেখুন ই-শ্রম সম্বন্ধে তাঁরা কে কতটা জানেন। আমি নিশ্চিত খুব খুশি হওয়ার মতো তথ্য পাওয়া যাবে না। যাই হোক, এবার দেখা যাক ঠিক কত জন রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন:

 

২০২২ সালের ৪ অগস্ট পর্যন্ত মোট রেজিস্ট্রিকৃত শ্রমিকের সংখ্যা ২৮০.৫৯ মিলিয়ন। নথিভুক্তির নিরিখে প্রথম পাঁচটা রাজ্য, রেজিস্ট্রিকৃতের মোট সংখ্যা ও শতাংশের হিসাব হল : (১) উত্তরপ্রদেশ, ৮,২৯,০৮,৭২৩, মোট রেজিস্ট্রিকৃতের ২৯.৫৫%; (২) বিহার, ২,৮৩,৮৫,২১৮ (১০.১২%); (৩) পশ্চিমবঙ্গ, ২,৫৫,৮৮,৪৩২ (৯.১২%); মধ্যপ্রদেশ, ১,৬৩,৯০,২২৬ (৫.৮৪%); ওড়িশা, ১,৩২,৮১,১৫৭ (৪,৭৩%)। সর্বমোট, ১৬,৬৫,৫৩,৭৫; মোট রেজিস্ট্রিকৃতের ৫৯.৩৬% এই পাঁচটি রাজ্যের শ্রমিক।

 

পেশাগত বা বৃত্তি অনুযায়ী রেজিস্ট্রিকৃতের হিসাবটা এরকম :

 

কৃষি— ১৪,৬৬,৬৩,১৮৫ (১৪৬,৬৬ মিলিয়ন), ৫২,২৭%

গৃহসহায়িকা (ডোমেস্টিক অ্যান্ড হাউসহোল্ড ওয়ার্কার্স— ২,৭৭,০৬,২৪২ (২.৭৭ মিলিয়ন), ৯,৮৭%।

নির্মাণশ্রমিক— ২,৫৫,৮০,‌১৬৫ (২৫.৫৮ মিলিয়ন), ৯,১২%

অ্যাপারেল বা বস্ত্রশিল্পে—১,৭৬,০২,৬১৪ (১৭.৬০ মিলিয়ন), ৬.২৭%

অন্যান্য— ১,১৯,২৪,৯৭৭ (১১,৯২ মিলিয়ন), ৪.২৫%

 

[এই অন্যান্যদের মধ্যে ১৩টি উপবিভাগ রয়েছে। যেমন, স্ট্রিট ভেন্ডার, গারবেজ ও লোহালক্কর-প্লাস্টিক সংগ্রাহক, মেসেঞ্জার, পোর্টার, রিসেপশনিস্ট, ফ্রন্ট ডেস্ক  অ্যাসিস্ট্যান্ট, ডোমেস্টিক হাউসকিপার, স্টল বা বাজারের বিক্রেতা প্রভৃতি।]

 

নিবন্ধীকৃত শ্রমিকদের পাঁচ ভাগের চার ভাগই হল এই পাঁচটি ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বিশ্লেষণকারীরা কৃষি শ্রমিকদের এই আধিপত্যে খুবই বিস্মিত। তাদের হিসাব কষে দেখাচ্ছেন মোট কৃষি শ্রমিকের (১৯৯.২ মিলিয়ন, সন্তোষ মেহরোত্রা ও যযাতি পারিদা, ২০২১) ৭৫ শতাংশ নাম নথিভুক্ত হয়েছে। অথচ, আনুমানিক ৫১ মিলিয়ন নির্মাণশ্রমিকের অর্ধেক নথিভুক্ত হয়েছেন। ৪ অগস্ট পর্যন্ত ২০২২ পর্যন্ত ৫২.৮৪% পুরুষ এবং ৪৭.১৬% মহিলাকর্মী নথিভুক্ত হয়েছেন। নির্মাণ ক্ষেত্রে নথিভুক্তদের ৭৫% পুরুষ। পোষাক শিল্পে যাঁরা নথিভুক্ত হয়েছেন তাঁদের ৮৯.০৩% এবং ডোমেস্টিক ওয়ার্কারদের ৯৫.৮৫% মহিলা।[ই-শ্রম সম্পর্কিত তথ্য: e-Shram miles to go, Dr. K R Shyam Sundar, The Leaflet, August 8 2022]

 

এই মামলার শুনানি এখনও চলছে। ৫ ডিসেম্বর ওই মামলায় শীর্ষ আদালত কেন্দ্রকে নির্দেশ দেয় নথিভুক্তদের বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার জন্য রাজ্যগুলিকে নির্দেশ পাঠাতে। যেমন, এই শ্রমিকদের কতজনের রেশন কার্ড আছে, কতজনের আধার সংযুক্তি হয়েছে এই তথ্য জরুরি। তা না হলে ফের নানা প্রকল্পের সুযোগ শ্রমিকরা পাবেন না। এদিকে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া ডেটলাইন হল ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২। তার মধ্যে আর কত জন নথিভুক্ত হন সেটাও দেখার। অর্থাৎ, মাইগ্রেশন অ্যাক্ট ১৯৭৯ ধরলে ৪৩ বছর এবং কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার অ্যাক্ট ১৯৯৬ ধরলে ২৬ বছর লাগল অসংগঠিত শ্রমিকদের নথিভুক্ত করার প্রয়াস শুরু করতে। এই কাজ শেষ হলেও শ্রমিকরা কী কী অধিকার কতটা পাবেন, তা না আঁচিয়ে বিশ্বাস করা যাবে না। কেননা, চার শ্রমকোডের মধ্যেই অসংগঠিত ও মাইগ্রেন্ট শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট আইনগুলি বিলুপ্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বিস্তর। চারটি শ্রমকোডের রুল এখনও জারি হয়নি। ফলত, ওই তিনটি আইন ধরেই শীর্ষ আদালত নানা নির্দেশ জারি করে চলেছে। ইতিমধ্যেই ফের করোনা, পুরো না হলেও আংশিক লকডাউন, সোশ্যাল ডিসটেন্সিং আলোচনার উঠে এসেছে। এবং তা কার্যকর হলে কিংবা করোনা ফের অতিমারির আকার নিলে অশেষ দুর্ভোগে ভুগবে সারা দেশ।

 

কৃতজ্ঞতা: অধ্যাপক ব্যাসদেব দাশগুপ্ত, বিভাগীয় প্রধান, অর্থনীতি, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়

 

[কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের আমন্ত্রণে, ২২ডিসেম্বর ২০২২, শ্রমজীবী-পরিযাণ বিষয়ক বক্তৃতার ঈষৎ পরিমার্জিত রূপ।]

 

Share this
Leave a Comment