সুধা ভরদ্বাজ একজন স্বনামধন্য সমাজ ও মানবাধিকার কর্মী। বিগত তিন দশক ধরে তিনি মূলত ছত্তীশগঢ়ের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে, আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন। একজন আইনজীবী হিসেবে তিনি আদিবাসী এবং দলিত শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য, বা মাওবাদী সন্দেহে অভিযুক্ত এবং নিগৃহীত নিরপরাধ আদিবাসী ও অন্যান্য বন্দিদের হয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। ২৮ আগস্ট, ২০১৮-এ ভীমা কোরেগাঁও—এলগার পরিষদ ষড়যন্ত্র মামলায়, মাওবাদীদের সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগ তুলে, কুখ্যত ইউএপিএ আইনে মিথ্যা ও বানানো অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিন বছর পর, ৮ ডিসেম্বর ২০২১, তিনি জামিনে জেল থেকে মুক্তি পেলেও, জামিনের শর্ত হিসাবে তাঁর গতিবিধি ও বাকস্বাধীনতা এখনও খুবই সীমিত।
তাঁর মুক্তির এক বছর উপলক্ষে, ওয়ার্কার্স ইউনিটি’র পক্ষ থেকে তাঁর যে সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল, তার বাংলা অনুবাদ আমরা প্রকাশ করলাম।
প্র: এক বছর হল আপনি জামিন পেয়েছেন। কেমন আছেন?
সুধা: আমি সৌভাগ্যবান যে আমার প্রতি এতো সংহতি দেখানো হয়েছে—সেটা আমার মায়ের [বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৃষ্ণা ভরদ্বাজ] জন্যই হোক বা ইউনিয়নের [ছত্তীশগঢ় মুক্তি মোর্চা] জন্যই হোক, নিয়োগীজির [ছত্তীশগঢ় মুক্তি মোর্চার প্রতিষ্ঠাতা শঙ্কর গুহ নিয়োগী] জন্যেই বা আমার যে ওকালতির কাজ, বা পড়ানোর কাজ, বা যে কোনও কারণেই হোক, অনেক মানুষ আমার পাশে এসেছেন, আমাকে সাহায্য করেছেন। নাহলে আমার পক্ষে লড়ে যাওয়া, বেঁচে থাকাটাই মুশকিল হয়ে যেত। না আমার এখানে [মুম্বাইতে] থাকার জায়গা আছে, না কোনও কাজ আছে, জিরো ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স দিয়ে শুরু করা, আর তার থেকেও বেশি অসুবিধার, আমার যে কাজের জায়গা—ছত্তীশগঢ় সেখান থেকে দূরে থাকা… মনে হয় যেন নির্বাসনে আছি, নিজেকে নির্বাসিত মনে হয়। কিন্তু, তাও কতো মানুষকে পেলাম, যাঁরা আমার জামিনের সিকিউরিটি দিতে এগিয়ে এলেন, কেউ অধ্যাপক, কেউ ট্রেড ইউনিয়নিস্ট, আম আদমি পার্টি থেকেও লোক এসেছিল, সামাজিক আন্দোলনকর্মীও অনেকে ছিলেন। এমন বিভিন্ন রকমের মানুষ আমার জামিনের ব্যাপারে সাহায্য করলেন। বন্ধুরা আমার থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দিল। সবচেয়ে কষ্টকর ছিল, চেনা লোকেদের থেকে দূরে থাকা। ২৫ বছর বয়স থেকে আমি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, একজন সিনিয়র অ্যাডভোকেটের অফিসে বসছি এখন। উনিও লেবার লইয়ার, আর আমি নিজেও কিছু শ্রমিকদের ম্যাটার্স নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি। আমার ইচ্ছা এই বিষয় নিয়ে লোয়ার কোর্টে কাজ করার। এই কাজ ছাড়াও, শ্রমিকদের নিয়ে কিছু রিসার্চের কাজও করছি।
জেলে আমার অনেক বন্ধু হয়েছিল, আমাকে ‘লইয়ার আন্টি’ বলত ওঁরা। “আন্টি আমার অ্যাপ্লিকেশন লিখে দাও”, “আমার চার্জশিট পড়ে দাও”, “আমার এই হেল্পটা করে দাও”,… এখনও চিঠি আসে, আর আমি চেষ্টা করি যদি কারোর কোনও উপকার করা যায়। ওঁদের উকিলদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। খোঁজ নিই কেসে কোথাও কিছু অসুবিধা হচ্ছে কি না।
প্র: এখনো চিঠি আসে?
সুধা: হ্যাঁ। কিন্তু এখন একটা সমস্যা হয়েছে, জেলের লোকজন ওঁদের জিজ্ঞেস করে, এঁকে কেন চিঠি লিখছ? উনি তো তোমাদের উকিল নন। আসলে আমি বুঝতে পারি, যে মানুষগুলো এতদিন ধরে জেলে রয়েছে, বিশেষত যাঁদের পরিবার বলে কিছুই নেই বা যাঁদের উকিল সে রকম সাড়া দিচ্ছেন না, এমন অনেকে আছেন, যাঁদের উকিল টাকা তো নিয়ে নিয়েছেন, কিন্তু বছর ঘুরে গেছে, কিছু কাজ করেননি—এমন অনেক মহিলা রয়েছেন। যাই হোক, আমি চেষ্টা করি, যতটা পারি তাদের সাহায্য করার।
হ্যাঁ, পরিবারের থেকে এত দূরে থাকা, বিশেষ করে আমার ইউনিয়নের সহকর্মীদের থেকে দূরে থাকা খুবই কঠিন। কখনও কখনও ফোনে কথা হয়।
প্র: ছত্তীশগঢ় যাওয়ার পরিকল্পনা নেই?
সুধা: না, না, এখন ছত্তীশগঢ় যাওয়ার পরিকল্পনা নেই। আমার ক্লায়েন্টরা ফোন করেন ছত্তীশগঢ় থেকে, “ম্যাডাম আমাদের কেসটার কী হবে?” আমি বলি, অন্য উকিল যোগাড় করে নিন ভাই। (হেসে) কী আর বলি আমি… অনেক লোকের ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন ম্যাটার্স, ফরেস্ট রাইটস ম্যাটার্স, লেবার ম্যাটার্স নিয়ে কাজ করতাম ওখানে আমি। ওঁরা অবশ্যই চান আমি ওখানে ফিরে যাই। দেখা যাক… একটু সময় যাক, যদি আমার এই জামিনের শর্তগুলি একটু রিল্যাক্স হয়।
প্র: এই গত এক বছরে আপনার মেয়ে আপনার কাছে থাকতে এসেছিল?
সুধা: হ্যাঁ, এসেছিল। যখন আমি জেল থেকে ছাড়া পেলাম, তখন এক সপ্তাহ এসে থেকে গেছে। তারপর মাঝে একবার এক সপ্তাহের জন্য এসেছিল। এই দেওয়ালিতেও এসেছিল।
প্র: আপনি মিস করেন ওকে?
সুধা: অবশ্যই মিস করি। এই তিন বছর আমি যে জেলে ছিলাম, বা যখন লকডাউন চলছিল, যাতায়াত করা খুব অসুবিধার ছিল, সত্যিই ওর জন্য খুব কষ্টকর ছিল। তারপর ও জেলে আসতোও যখন, দেখা করাটাও একদমই সহজে হত না। মনে আছে, আমার জন্মদিনের দিনে ও এলো, ওকে অনেক ঘুরতে হয়েছিল—এই অফিস থেকে এটা করে আনো, ওই অফিস থেকে ওটা নিয়ে এসো… নিজের আইডি কার্ড থানা থেকে এনডোর্স করিয়ে আনো… এই রকম বিভিন্ন কিছু। এই সব ওকেই সামলাতে হয়েছে।
যখন দিল্লি গেছি, আমার ইচ্ছা ছিল… সারা জীবন তো ট্রেড ইউনিয়নের কাজ করলাম…ওকে তখন বিশেষ সময় দিতে পারিনি। এখন ও জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে। কলেজ যাওয়া শুরু করবে… আমার ওকে একটু সময় দেওয়া উচিৎ। এই ভেবেই আমি, প্রথম বার একটা ফর্মাল চাকরি নিলাম ন্যাশনাল ল’ ইউনিভার্সিটি দিল্লিতে অধ্যাপক হিসাবে। ভেবেছিলাম, এবার একটু পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পাওয়া যাবে, আর তখনই গ্রেফতার হয়ে গেলাম। এটা সত্যি খুব বড় একটা দুর্ভোগ ছিল। ওর জন্য খুবই অসুবিধার ছিল। তবু যাই হোক, এখন কিছু না হলেও, কথা বলতে পারি ওর সাথে, এটাই অনেক। জেলে থাকাকালীন তো সেটাও হত না।
প্র: জেলে এই তিন বছরে আপনার কেমন অভিজ্ঞতা হল?
সুধা: জেলে তো প্রায় তিন বছর ছিলাম। তার মধ্যে অর্ধেক সময় ইয়েরওয়াদা জেলে ছিলাম, বাকিটা বাইকুল্লা জেলে। দুটো জায়গার অভিজ্ঞতা খুবই আলাদা। কারণ যখন আমি ইয়েরওয়াদা জেলে ছিলাম, তখন আমি আলাদা সেলে থাকতাম। ফাঁসি ইয়ার্ডের মধ্যে, আলাদা সেল ছিল। আমার পক্ষে অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করা প্রায় অসম্ভব ছিল। যদিও আমাদের যে জায়গাটায় রাখা হত, সেই ফাঁসি ইয়ার্ড, একটা খাঁচার মতো ছিল। মানে গরাদের ভেতর থেকে আমরা বাইরেটা দেখতে পেতাম, বাকি লোকজন বা যে মাঠটা ছিল, সেগুলো দেখা যেত। বা আমরা যখন দেখা করতে যেতাম, কোর্টে যেতাম বা ক্যান্টিনে যেতাম, বা জল ভরতে বা অন্য কোনও কাজে যেতাম, তখন বাকিদের সঙ্গে কথাবার্তার সুযোগ হত। কিন্তু বেশিরভাগ সময়টাই আমরা বন্দি থাকতাম। ভাবুন, সন্ধ্যাবেলায় সেলে যে ঢুকিয়ে দেওয়া হল, সকাল অবধি আপনাকে একলাই ওখানে বন্ধ থাকতে হবে। ঐ সময়টা আমি কাটাতাম লেখালিখি করে। দেখুন, একজন উকিল হিসেবে, আমি জানতাম যে অনেকেই যারা বিচারাধীন—আন্ডার ট্রায়াল রয়েছেন, তাঁদের বেল হয়ে যাওয়া উচিত বা তাঁদের ছাড়া পেয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু তাঁরা হয়ত ঠিকঠাক আইনি সহায়তা (লিগ্যাল এইড) পাচ্ছেন না। বা আইনি সহায়তা পরিষেবা ব্যবস্থা (লিগাল এইড সিস্টেম) তাদের ক্ষেত্রে কার্যকর (এফেক্টিভ) হচ্ছে না, বা তাঁদেরকে রিলিফ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, এই সমস্ত কিছুই কিন্তু আমার কাছে অজানা ছিল না। কিন্তু নিজে যখন জেলে রয়েছি, এই জানা জিনিসগুলোই আরো গভীরভাবে বোঝার সুযোগ হয়। মানে, আশেপাশে এইগুলো জীবন্ত ঘটতে দেখা যায়। আমি তখন ওই চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়েই লিখতে শুরু করলাম।
প্র: এই রকম কোনও একটা ঘটনার কথা বলবেন?
সুধা: হ্যাঁ। যেমন একটি মেয়ে ছিল, ওর স্বামী ওঁকে মারধোর করত। একবার, মাঝ রাতে ওঁকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল। একটা ৩ বছরের বাচ্চা আর একটা একদম কোলের বাচ্চা ছিল ওঁর। তাদের নিয়ে রাত্রিবেলায় বেরিয়ে পড়ে। এতটাই অবসাদগ্রস্ত অবস্থা ছিল যে, হাঁটতে হাঁটতে যখন একটা নদী পড়েছে রাস্তায়—ঠিক করে ফেলল নদীতে আত্মহত্যা করবে। বাচ্চাদের নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে দিল। এবার এটা ওঁর দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য, কী বলব জানি না, বাচ্চারা মারা গেলেও, বেঁচে গেল মেয়েটা। খুব তাড়াতাড়ি ট্রায়ালও হয়ে গেল, আর বাচ্চাদের খুন করার অভিযোগে মেয়েটার কনভিকশন হয়ে গেল। কখনো কখনো এইসব ঘটনা শুনে এতো অবাক লাগে, ওঁর নিজের জন্য এটা কত বড় একটা ট্র্যাজেডি…কিন্তু ও তো নিজের বাচ্চাদের খুন করেনি। এই কথাগুলো বলার মতো উকিল হয়তো ওঁর ছিল না, আর নিজেও বলে উঠতে পারেনি। এই রকম আরও অসংখ্য ঘটনা আছে। যেমন একটা মেয়ে, যাঁর মাত্র ১৫ দিন হল বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি গেছে, আর সেখানে তাঁর বড় জা আত্মহত্যা করেছে, আর ওঁর জেল হয়েছে—পণের জন্য হত্যার অপরাধে। আর একজন মহিলা, যাঁর স্বামী মাতাল অবস্থায় তাঁর নিজের মেয়েকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করছিল, রেগে গিয়ে সে স্বামীর মাথায় পাথর দিয়ে মেরেছে। এক সপ্তাহের বাচ্চা নিয়ে সে জেলে এসেছিল, এখন বাচ্চাটার প্রায় ৪ বছর বয়স। এই রকম কত যে ঘটনা চোখের সামনে দেখেছি… গ্যাংস্টারদের মা, গার্লফ্রেন্ড বা বউ, যাঁরা কিছু জানতোই না যে তাঁদের ছেলে বা বর কী করে, তাঁদেরকে জেলে রাখা মানে তো এক প্রকার লিগ্যাল হোস্টেজ রাখা, তাই না?
কখনও কেউ মারা গেল, চারদিকে কান্নাকাটি পরে গেল। বা কিছু মানসিক প্রতিবন্ধী মহিলা ছিলেন। তাঁদের নিজের নিজের দুঃখ… মানে, অনেক কিছু দেখতে পেলাম। যেমন সাধারণত হয়, বেশির ভাগ লোক যাঁরা থাকেন, গরিব। অনেকে ছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের—মুসলমান মহিলাও ছিলেন। সবচেয়ে বড় বৈষম্য যদি কিছু দেখে থাকি, সেটা হল পার্ধিদের (যাযাবার সম্প্রদায়, এক সময় ব্রিটিশরা এঁদের ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’ আখ্যা দিয়েছিল] সঙ্গে যেটা হয়। পার্ধি সম্প্রদায়ের যাঁরা আছেন, যাঁদের, এলাকায় কোথাও কোনও কিছু চুরি হলেই, ওঁদের ধরে নিয়ে আসা হয় থানায়। আর এটা বার বার হয়, পুরো পরিবারকে, বাচ্চাদের সুদ্ধ ধরে নিয়ে চলে এল। এ রকম কত কেস দেখলাম।
এই সব হল ইয়েরওয়াদা-র কথা। ওখানে এইভাবেই ছিলাম।
যখন বাইকুল্লা গেলাম, ওখানে তো ব্যারাকে ছিলাম। এক তো, গিজগিজে ভিড়ের সমস্যা ছিলই, সব কিছুর জন্য লাইন। টয়লেটের জন্য লাইন, খাবার জন্য, ওষুধের জন্য, ফোনের জন্য…সব কিছুর জন্য লাইন দিতে হত। ঝগড়াঝাঁটিও খুব হত ছোটখাটো জিনিস নিয়ে।
কিন্তু ওখানে একজন আইনজীবী হিসাবে আমি খুবই ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম। ওখানে সবাই খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। কোনও ছোট একটা গসিপ ওখানে একদম সবার কানে চলে যেত। কিন্তু যখন ওঁরা বুঝতে পারলেন যে আমি এক জনের কেসের কথা অন্য কারোর সঙ্গে আলোচনা করি না, মানে যেটা একজন আইনজীবীর এথিকস, আমরা সব সময়ই আমাদের ক্লায়েন্টদের কথা গোপন রাখি—এটা যখন ওঁরা বুঝতে পারল, ওঁরা আমার কাছে আসতে শুরু করল। “আন্টি আমার চার্জশিট পড়ে দাও”, “কী করতে হবে বলো”, বা “আমাকে পয়েন্টস লিখে দাও”। অবাক লাগবে শুনতে, যে প্রায় ৮০-৮৫% মানুষ নিরক্ষর! মানে পড়তে লিখতে জানেন না। আর বাকিদের ক্ষেত্রে ওই মারাঠী চার্জশিট পড়া সম্ভব নয়, মানে যে বাংলাদেশী সে পড়তে পারবে না, বা যে উর্দুভাষী, বা কন্নড়ভাষী তিনি পড়তে পারবেন না।
প্র: রাষ্ট্রপতি মুর্মুর জেল নিয়ে যে বক্তব্য, তাতে আপনার কী মতামত?
সুধা: জেলের সংখ্যা বাড়িয়ে লাভ নেই—আমি ভীষণ খুশি হয়েছি এটা শুনে। যখন শ্রীমতি দ্রৌপদী মুর্মু-কে রাষ্ট্রপতি করা হল, তখন আমি একটা লেখা লিখেছিলাম। আমি লিখেছিলাম যে, যদি সত্যি সত্যিই আদিবাসীদের সুবিচার দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়, সেটা প্রায় অসাধ্যসাধন হবে। ঐ লেখাটায় আমি লিখেছিলাম যে, যখন উনি রাজ্যপাল ছিলেন, তখনকার বিজেপি সরকার, ছোটনাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট বা সান্থাল পরগনাস অ্যাক্ট-এ যে সংশোধন আনার চেষ্টা করেছিল, যেটা নিয়ে তখন ঝাড়খণ্ডে খুবই আন্দোলন হয়েছিল, উনি রাজ্যপাল হিসাবে খুবই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। উনি ওইগুলো আবার বিধানসভায় ফেরত পাঠান। বলেছিলেন, আমি এগুলোতে স্বাক্ষর করব না, আপনারা আবার ভাবনাচিন্তা করুন। এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে, আমি ওঁকে বলতে চেয়েছিলাম, যে এখন যে রকম পরস্থিতি, এ রকম পদক্ষেপ আরো নিতে হবে। এই যেমন হিমাংশু কুমারের কেসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে আদিবাসীরা সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দিতে পারবেন না এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। এমন একটা সময়ে, আদিবাসীদের সুবিচার দিতে গেলে, অনেক কিছু করতে হবে। আমি আসলে খুবই খুশী হয়েছি শুনে যে উনি এইভাবে বলেছেন। আর এইসব উনি একদম মন থেকে বলেছেন।
প্র: কী কী করা যেতে পারে?
সুধা: প্রথমে এটা বুঝতে হবে, একজন আদিবাসী জেলে কেন আছে। এতো সেই বৃটিশ আমল থেকে চলে আসছে। যখন থেকে জঙ্গল রাষ্ট্রের সম্পত্তি হয়ে গেছে, সেই ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট’র সময় থেকে আদিবাসীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। আসলে, যদি ভেবে দেখেন—স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ, সেই ১৮৫৭ সাল; সেই সাঁওতাল হুল তখনও হাজার হাজার আদিবাসী শহিদ হয়েছিলেন। আর ঐ আন্দোলনের জন্যই, ‘পার্শিয়ালি এক্সক্লুডেড অ্যান্ড এক্সক্লুডেড এরিয়াজ’ বলে বিভিন্ন এলাকা তৈরি করতে বৃটিশরা বাধ্য হয়েছিল। মানে যেখানে বৃটিশ আইন চলবে না। এই ‘এক্সক্লুডেড এরিয়াজ’, যেটা হল আজকের উত্তর-পূর্ব—সিক্সথ শিডিউল [স্বাধীনতার পর সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত] আর ‘পার্শিয়ালি এক্সক্লুডেড এরিয়াজ’ হল এখনকার ফিফথ শিডিউল [ বিভিন্ন রাজ্যে আদিবাসী প্রধান এলাকা পঞ্চম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত]।
ঐ সব জায়গায়ে বৃটিশ আইন বহাল রাখা যাবে না, সেটা বৃটিশ সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। না হলে আরো অশান্তি সৃষ্টি হতো। তাই নতুন আইন তৈরি করা হয়েছে, যেমন গোদাবরী এজেন্সি অ্যাক্ট, ছোটনাগপুর অ্যাক্ট, সাঁওতাল পরগনা অ্যাক্ট। আলাদা আলাদা আদিবাসী অধ্যুষিত জায়গায়, এই সমস্ত আইন যে পরিবর্তন করা হল, সবই আদিবাসীদের জমি বাঁচানোর জন্য করা হয়েছিল। দুঃখের বিষয় হল, আজ এই স্বাধীন ভারতের সরকার এই আইনগুলো মানছে না। আর মাইনিং বা আরও বিভিন্ন জিনিস নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। আদিবাসীদের জন্য যাঁরা কাজ করছিলেন, অনেক পরিশ্রম করে তারা প্রথমে পেসা অ্যাক্ট, ১৯৯৬ আর তারপরে ফরেস্ট রাইট অ্যাক্ট ২০০৬ নিয়ে আসেন। কিন্তু এই আইনগুলো, যেমন কমিউনিটি ফরেস্ট রাইট অ্যাক্ট, এখনো সম্পূর্ণ ভাবে মেনে চলা হচ্ছে না।
আদিবাসীদের জেল হওয়ার একটা বড় কারণ হল, ওয়াইল্ড লাইফ আইনের তথাকথিত অবমাননা। কারণ এটা তাদের জীবনশৈলীর সঙ্গে জড়িয়ে, তাঁদের জীবিকা এটা, জীবন এটা। অন্য আরেকটা কারণ হল, আদিবাসীদের যে সনাতন রীতিনীতি (ট্র্যাডিশনাল কাস্টমস) বা তাদের যে কাস্টমারি ল’গুলো আছে, সেগুলো আমাদের আইনের সঙ্গে মেলে না। যেমন মহুয়া দিয়ে যে মদ তৈরি করা, সেই সবের জন্যও জেল হয়।
প্র: যেমন তাড়ি বানানোর জন্য অপরাধী সাব্যস্ত করা…
সুধা: হ্যাঁ। এইসবের জন্যে অপরাধী দাগিয়ে দেওয়া হয়। তৃতীয় কারণ যেখানে, বামপন্থী চরমপন্থা আছে, মানে ধরুন যেখানে, কোনও থানায় নকশাল হামলা হয়েছে। এফআইআর কী হবে? যে ২০০ অজানা মানুষ হামলা করেছে। তারপর সার্চ কর্ডন অপারেশন বেরোবে, একজন দু’জন তো নয়, তাতে ২০০-৪০০ লোক থাকবে। এবার আপনিই ভাবুন, ওরা যখন গ্রামে গিয়ে পৌঁছাবে, তখন কোনও নকশাল ধরা পড়বে? ওখানে থাকবে গ্রামেরই লোকজন। গ্রামের লোকের মধ্যেও, যাঁরা পারবেন, তাঁরা জঙ্গলে পালিয়ে যাবেন। পড়ে থাকবেন যাঁরা অথর্ব, বা মহিলারা, বয়স্ক বা বাচ্চারা। এবার এঁদেরকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, আর এঁদের বিরুদ্ধে, সিরিয়াস এফআইআর লজ করে দেওয়া হয়। সেগুলো এতই সিরিয়াস হয়, যে জামিন পাওয়া যায় না। কিন্তু কোথাও কোনও প্রমাণ নেই। একদিন ওদের ছেড়ে দিতেই হবে। কিন্তু সেটা হয়তো ৫ বছর বাদে, বা ৭ বছর বাদে। এই ক’দিন আগেই তো একটা বড় ইস্যু হল, যখন ১২১ জন মানুষ, ৫ বছর বাদে ছাড়া পেলেন। কিন্তু জেলে যে আধিকারিকরা রয়েছেন, তাঁরা যে ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমটা বোঝেন না, তাতে আমি আশ্চর্য হই না। সমস্যা হল, অনেক সাধারণ গ্রামের মানুষ, গুরুতর অভিযোগে, অকারণে জেলে আটকে থাকছেন। ছত্তীশগঢ়ে যেমন অনেক বার অনেক কমিটি তৈরি হয়েছে, নির্মলা বুজ কমিটি, জাস্টিস পট্টনায়েক কমিটি, কিন্তু ওঁদের সুপারিশও কোর্ট অনেক সময় মানে না। এই যেমন, প্রভাকর গোয়েল বলে একজন ছিলেন—দলিত বিচারপতি, উনি এ রকমও বলেছেন, যে এর তো চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিরপরাধ, একে আমি জেলে পাঠাব না। ওখানে যাঁরা এসপি ছিলেন, তাঁরা হাই কোর্টে অভিযোগ করে দিয়েছিল, যে ওঁর জন্য সুরক্ষা বাহিনীর নৈতিকবোধ আহত হচ্ছে, আর ওঁকে তারপর বিচারপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
তারপর যখন ট্রায়াল চলে, সাক্ষী হিসেবে থাকে সব পুলিশের লোক, যাঁরা আসেই না। বিরাট লম্বা চার্জশিট হয়, জামিন পাওয়াই যায় না। এইসব কারণেও অনেক মানুষ জেলে আটকে আছেন।
প্র : রাষ্ট্রপতি মুর্মুর উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কী কী ব্যবস্থা নিতে পারে?
সুধা: প্রথমত, প্রত্যন্ত এলাকার কোর্টগুলোয় যারা অভিযুক্ত, তাঁরা গোন্দী হালবি ভাষায় কথা বলে। আর সেই ভাষা কেউ বোঝে না। তাই কমিউনিকেশন একটা ভীষণ বড় সমস্যা। আর কিছু না হোক, ওই সব জায়গায়, এমন সমাজকর্মী বা স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ করা উচিত, যাঁরা আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে এসেছেন বা আদিবাসী ভাষা বুঝতে পারেন, যাঁরা আদিবাসীদের সাহায্য করতে পারেন। বাকি পরিবার কোনও প্রত্যন্ত জায়াগায় থাকে, তারা কোনও সেন্ট্রাল জেলে আটকে আছেন, কেউ দেখা করতে আসতে পারেন না, টাকাপয়সা নেই, এগুলো তো সমস্যাই। তারপর, এই লিগাল এইড সিস্টেম সেটাও শক্তিশালী করা দরকার। চিন্তা করা যায় না, তাঁদের কত কম বেতন দেওয়া হয়। এই ক’দিন আগে, একটা ভালো প্রস্তাব এসেছিল, মনে হয় জাস্টিস ললিত-এর সময় থেকে রূপায়িত হয়েছে কিছু জায়গায়, ‘লিগাল এইড ডিফেন্স কাউন্সিল সিস্টেম’ সরকারি প্যানেলগুলোয় যেমন ভালো মাইনে দেওয়া হয়, লিগ্যাল এইড-দের কেন তেমন দেওয়া হবে না? তাঁরা তো রাষ্ট্রকে ডিফেন্ড করছে, নাগরিকদের ডিফেন্ড করছে। সেটাও তো একই রকম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ভালো পারিশ্রমিক পাওয়া আর দক্ষ আইনজীবী দরকার। সেটা দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর তৃতীয় বিষয় হল, চার্জ দেওয়ার সময় বা জামিনের স্টেজে, যদি বিচারপতিরা, এগজিকিউটিভদের চাপ থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটু ভালোভাবে বিষয়গুলোকে দেখেন। একটা ঘটনা মনে আছে, একজন অনেকদিন বাদে জেল থেকে ছাড়া পেল, যার নাম এফআইআর বা পুরো চার্জশিটে, কোত্থাও ছিলই না। আসলে, ওই আর কি, নকশালদের কেস দেখেই, কিছু না ভেবেই জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই তো কখনো গিয়ে রেহাই পেয়েই যাবে, কারণ আসলে তো তাঁর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণই নেই। নাম ভুলভাল লেখা থাকে। আর তারপর, বাবার নাম জানা নেই, কোথায় থাকে জানা নেই, বয়স জানা নেই। এমন কাউকে, এত কম আইডেন্টিফিকেশনে, কীভাবে গ্রেফতার করা যায়! ওই একই নামে তো কত লোক থাকতে পারে। জুডিশিয়ারিকেও ভাবতে হবে যে, এগজিকিউটিভরা নিজেদের কাজ করছে, সুরক্ষা বাহিনী নিজের মতো কাজ করছে, কিন্তু আমি তো একজন বিচারপতি। আমার কোনও একজন মানুষকে একক ব্যক্তি হিসেবে দেখতে হবে যে, সে অন্যায় করেছে কী করেনি। চারদিকে অনেক খারাপ কিছু হচ্ছে, অনেক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে, সিআরপিএফ বা সুরক্ষা বাহিনী আছে, তারা সেগুলো ডিল করুক, সেটাই ওদের কাজ। কিন্তু আমার সামনে যে মানুষটা রয়েছে, সে দোষী কি না, আমার কাজ তো সেটা দেখা। আমি ঐসব চাপের জন্য, এই মানুষটাকে জেলে পাঠাতে পারি না। এমন একটা নিজস্ব চিন্তা ভাবনা নিয়ে বিচারপতিদের কাজ করা উচিত।
আরোও একটা ব্যাপার আছে। যাঁরা ‘ক্রিমিনাল ট্রাইবস’, [স্বাধীনতার পর অপরাধী জনজাতি তকমা তুলে নেওয়া হলেও, তাঁদের সঙ্গে যে আজও ঔপনিবেশিক প্রশাসনের মতোই ব্যবহার করা হয়।] যেমন পার্ধীরা, তাঁদেরও একই অবস্থা। কোথাও কোনও চুরি হলে, তাঁদের ধরে এনে জেলে পুরে দেওয়া হয়। কোনও প্রমাণ থাকে না কখনও। এইসব দিকগুলোতে একটু নজর দিতে হবে।
প্র: এখানকার জেলগুলোতে ন্যূনতম মজুরির ব্যবস্থা কী রকম?
সুধা: ওখানে শ্রমিকদের পারিশ্রমিক নিয়েও একটা অদ্ভুত জিনিস জানতে পারলাম, মানে ওখানে মজুরি কী কম!
প্র: ন্যূনতম মজুরিও নয়?
সুধা: ন্যূনতম মজুরির কথা কী বলছেন আপনি! শুধু বোর্ডিং/লজিং কার্ড দেওয়া হয়। ভাবুন! যেমন তিহার জেলেও দেখছি, ওখানে ন্যূনতম মজুরি দেওয়া হত। কিন্তু, এখানে বোর্ডিং/লজিং-এর পর তো কিছুই বাঁচে না। খাবারটাও খেতে হচ্ছে পয়সা দিয়ে। এখানে ন্যূনতম মজুরির কোনও ব্যাপারই নেই। একটা উদাহরণ দিই। যাঁরা ধূপকাঠি বানাতেন, আড়াই কিলো ধূপকাঠির মশলা দেওয়া হত তাঁদের, পুরোটা তৈরি করতে তাঁদের দেড় দিন লেগে যেত। আমার যতদূর মনে পড়ছে, ওই পুরোটার মাত্র ৬৩ টাকা বা ওইরকম কিছু পেতেন তাঁরা। ওঁরা কাজ করেন যাতে নিজেরা মানসিকভাবে স্থির থাকতে পারেন। মানে, মানুষ তো কাজ না করে থাকতে পারবে না।
প্র: বন্দিদের ন্যূনতম মজুরিও দেওয়া হত না?
সুধা: না। দেওয়া হত না। ন্যূনতম মজুরি দেওয়া হত না। আমার তো আরো একটা ভয় হয়। সুপ্রিম কোর্ট-এর কোনও বিচারপতি সম্প্রতি মন্তব্য করেছিলেন যে, জেলগুলো বেসরকারিকরণ করে দেওয়া হোক। আমেরিকাতে সেটাই হয়েছে। সব জেল বেসরকারি। ওখানে বন্দিদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া হয়। আর তার থেকে লাভজনক কী হতে পারে? ওখানে তো ইউনিয়নও তৈরি করা যাবে না। বিরাট সুবিধা, যা ইচ্ছে মজুরি দিয়ে কাজ করিয়ে নাও। এটা তো এক রকম ক্রীতদাসদের মতো শ্রমিক তৈরি হয়ে গেল! এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। বন্দিদের সঠিক মজুরি দেওয়া উচিত। ওঁরা তো পরিশ্রম করছেন। যেমন ছেলেদের জেলে তো ছুতোরের কাজ হয়, তাঁতের কাজ হয় বা আরো নানা রকম কাজ করেন তাঁরা। এমনটা হওয়া উচিত, যাতে যখন বন্দিরা ছাড়া পাবেন, তাঁদের হাতে কিছু টাকা থাকে।
প্র: আপনি দির্ঘদিন ধরে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।একজন মহিলা ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী হিসাবে আপনার অভিজ্ঞতার কথা বলুন।
সুধা: সাধারণত, ইউনিয়নের যে পরিসর, সেখানে পুরুষদেরই আধিপত্য। আগেও তাই ছিল, এখনও সেটাই আছে। নিয়োগীজি, ওঁর সময় কিছু চেষ্টা করেছিলেন, যেমন মহিলা মুক্তি মোর্চা বা মদ বন্ধ করার যে পুরো লড়াইটা, যেখানে মাতাল স্বামীর মাইনেটা ইউনিয়ন তাঁর বউয়ের হাতে দিত। তবে নিয়োগীজি বা আমাদের ইউনিয়ন-এ মহিলাদের একটা বিশেষ জায়গা থাকার একটা বড় কারণ হল, মাইনসে জোড়ায় জোড়ায় কাজ হত। মানে স্বামী-স্ত্রী একসাথে কাজে যেত। দু’জনের মাইনেও সমান হত। এই স্বামী স্ত্রীর সমান মাইনের জন্যও ইউনিয়ন লড়েছে। আগে সমান মাইনে হত না। বলা হত, যে দুজনে আলাদা রকমের কাজ করছে। কিন্তু আলাদা আলাদা কাজ বলে কিছু হয় না। একজনের কাজ পাথর ভাঙা, আর অন্যজনের কাজ লোড করা। শ্রমিকদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা যথেষ্ট ছিল, আর তাঁরা চিন্তা ভাবনাতেও অনেক এগিয়ে ছিলেন। এটাও সত্যি, মহিলারা নিজে থেকে কখনোই, নেতৃত্বের জন্য এগিয়ে আসেন না, যতক্ষণ না তাঁদেরকে সামনে আনার চেষ্টা করা হবে, তাঁরা সামনে আসবেন না। কিন্তু নিয়োগীজি সেই চেষ্টাটা করেছিলেন। যেমন, লীলা বাঈ, হাসনিন বাঈ—এঁদেরকে নেত্রী হিসাবে নিয়ে এসেছিলেন।
আরো একটা সমস্যা হল, যখনই মেকানাইজেশন বা ওই রকম কিছু হয়, কারখানার মহিলাদের সবার আগে চাকরি যায়। স্থায়ী চাকরিতে পুরুষরাই বেশি থাকেন। মহিলারা থাকে ক্লিনিং, বা যে কাজগুলোকে ‘সিভিল’ কাজ বলা হয়, সেগুলোতে। যখন পরে আমি ভিলাইতে গেলাম, ওখানে কেডিয়া ডিস্টিলারিজ যেটা একটা বটলিং প্ল্যান্ট, ওখানে অনেক মহিলা ছিলেন। আপনাকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। কেডিয়া ডিস্টিলারিজ-এর আন্দোলনটায়, অনেক মহিলা ছিলেন। তখন, মহিলারাই নেতৃত্বের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ওখানে আমরা দু’তিন জন মহিলাই তো অনশনে বসেছিলাম, তারপরই তো সমস্যা সমাধান হল। তখন ঠিক হয়েছিল, কোম্পানির তরফ থেকে কিছু টাকা দেওয়া হবে। প্রতি মাসে সেটা নিতে যেতে হত। জায়গাটা ছিল একটু অন্ধকার, ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা আর অনেক রাত অবধি চলত এই টাকা দেওয়া। এবার ইউনিয়নের কিছু ছেলেরা যাঁরা এই টাকাটা দিত, দেখা গেল তাঁরা ঠিকভাবে কাজ করছন না, মানে কাউকে বেশি দিচ্ছে, কারোর থেকে পয়সা কেটে নিচ্ছে ইত্যাদি। এবার এই সবের নালিশ আসতে শুরু করল। বেশিরভাগ মহিলারাই অভিযোগ করছিল। আমি তখন ওঁদের একটাই জিনিস বলেছিলাম। যে ঠিক আছে, আমরা এটার জন্যও লড়ব। কিন্তু তোমরা নিজেরা কি এই কাজটা করার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত? মানে তাহলে ওঁদের নিজের পরিবারকে বলে, সারা রাত ওখানে থাকতে হবে। কাজটাও ঝুঁকিবহুল, অতো টাকা নিয়ে বসতে হবে, আশে পাশে গুন্ডামি হতে পারে। আমরা যদি সাহস করে নিজেরা এই কাজটা করতে পারি, তবেই লোকে আমাদের অভিযোগ শুনবে। ওঁরা বলল, হ্যাঁ পারব আর সত্যিই সত্যিই করে দেখাল।
মানে, দুটো জিনিস বলার আছে। এটাও সত্যি যে নিয়োগীজির সময়ের যে মহিলা মুক্তি মোর্চা ছিল, তাঁরা সাধারণ আন্দোলনে সামনেই থাকতেন, কিন্তু আন্দোলনের একটা শাখা হিসাবে। ভিলাইতে যে মহিলা মুক্তি মোর্চা তৈরি হয়েছিল, সেখানে আমরা মহিলাদের যে নিজস্ব সব সমস্যা সেই নিয়ে কাজ করেছি। একটা উদাহরণ হল, আমাদের নিজেদের ট্রেড ইউনিয়ন নেতাই যদি কোনও মহিলাকে মারধোর করে। এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। আমরা মহিলারা জনসমক্ষে তাঁকে নিন্দা করেছিলাম। কিন্তু এই কাজটা বেশ কঠিন।
যেটা বলেছিলাম, উকিল হয়ে যাওয়ার পর আমার পক্ষে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। মানে তখন দলের লোকেদেরও মনে হয়েছিল, এর তো একটা ভূমিকা আছে, এ তো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ তো আমাদের হয়ে কথা বলছে। একটা প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়ে যায়, তাই না? কিন্তু আবার সেটার জন্য নানা কথাও শুনতে হয়। যাই হোক, এটার জন্য অবশ্যই আমার উপকার হয়েছে। আর আমি অন্য মহিলাদের জন্যও একটা জায়গা তৈরি করতে পেরেছি।
যদিও শ্রমিকদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা অনেকই, তাও নেতার ভূমিকায় মহিলাদের খুবই কম দেখা যায়। কিন্তু আমার আজকাল মনে হয়, পরিবর্তন তো আসছেই। বিশেষত আশা কর্মী বা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের মধ্যে মহিলাদের দেখে আমার আশা যে এবার প্রথাগত ইউনিয়নগুলোতেও মহিলারা সামনে আসতে পারবে। কারণ প্রতিবাদী তো হয়ই মহিলারা। তাই এই পরিবর্তনটা আসবেই। কিন্তু তার জন্যে অনেক চেষ্টা করতে হবে, সচেতন ভাবে চেষ্টা চালাতে হবে। একটা ছোট্ট উদাহরণ। কোথাও একটা মিটিং ডাকা হল। ছেলেরা সাধারণত, সাইকেলে আসবে। মেয়েরা যাবে হেঁটে। একলা যেতে পারবে না, সঙ্গে কাউকে নিয়ে যেতে হবে। আমার মনে আছে একটা ঘটনা। মিটিং যতক্ষণে শেষ হয়েছে, রাত হয়ে গেছে। আমরা নিশ্চিত করতাম যে প্রত্যেক মহিলাকে কোনও পুরুষ সাইকেলে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে। খুব ছোট ব্যাপার এটা। কিন্তু যতক্ষণ না মুখে বলা হচ্ছে, কেউ নিজে থেকে করবে না। যেমন প্রথম দিকে যখন আমি বক্তৃতা দিতে বলতাম মেয়েদের, ওঁরা বলত, না না দিদি, আমি বলতে পারব না। আমি বলতাম, আরে কিছু তো বলো স্টেজে উঠে। কিছু না হলে, ইনকিলাব জিন্দাবাদ তো বলো। এই যে পদ্ধতিটা, যেখানে ওঁদেরও একটা জায়গা তৈরি করে দিতে হবে, ওঁদেরকে দিয়ে কথা বলাতে হবে, যেমন, ৮ মার্চের অনুষ্ঠান, পুরোটাই ওঁদের দিয়েই করানো হবে। এইগুলোতে অনেকটা উপকার হয়। মানে, জোর করে করতে হবে, এমনি এমনি হয়ে যাবে না।
প্র: এই মূহূর্তে ভারতের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন নিয়ে কিছু বলুন।
সুধা: দেখুন, শ্রমিকদের জন্য এটা খুবই খারাপ সময়। এই লকডাউন-এর পর, অসংগঠিত ক্ষেত্রে, মাইনে আরও কমে গেছে। আগে তো আমরা চুক্তি শ্রমিকদের স্থায়ী করার কথা বলতাম। এখন তো স্থায়ী কর্মীদেরই চাকরি চলে যাচ্ছে। এখন তো সবাই চুক্তি কর্মী হচ্ছে। পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ইউনিয়নাইজড শ্রমিক খুব কম। যেখানে স্থায়ী ইউনিয়ন আছে, সেখানে স্থায়ী কর্মীদের সংখ্যাই কমে যাচ্ছে। চুক্তি কর্মীদের অবস্থা তো দেখছেন, যেমন মানেসর-এর ঘটনা, একটা ইউনিয়ন তৈরি করার চেষ্টা করার অপরাধে মানুষের কত বছর জেল হয়ে যাচ্ছে। আর আরও কত কী হল। অবস্থা খুবই খারাপ। তবে হ্যাঁ, একদম কোনও আশা নেই, এমনও নয়। একটা বড় সমস্যা হল, চুক্তি বা ক্যাজুয়াল কর্মীদের নিজেদের মাইনেই এত কম যে, তাঁরা ইউনিয়নের চাঁদা দিতে পারেন না। আর ইউনিয়নের তো নিজস্ব কোনও রিসোর্স নেই। আমরা নিয়োগীজির সময়টা দেখেছি। যখন খনি শ্রমিকরা মিলে এমন একটা ইউনিয়ন তৈরি করেছিল, যেটা পরে পুরো ভিলাই আন্দোলনে সাহায্য করেছিল, ওখানে চাল পাঠিয়েছিল, বায়লাডিলাতেও চাল পাঠিয়েছিল। একটা সংহতি তৈরি হয়েছিল, এমনকি কৃষক আন্দোলনেও সাহায্য করেছিল। এটা একটা আদর্শ হওয়া উচিত। কিন্তু এখন আমাদের ইউনিয়নগুলোর কাছে এরকম রিসোর্স নেই।
যুদ্ধটা কঠিন, আর প্রচুর বিভাজন। শ্রমিকরা কিন্তু একতা চায়। দোষটা নেতৃত্বের, আমাদের।
আমি বার বার সবাইকে কৃষক আন্দোলনের উদাহরণ দিয়ে থাকি। ২৮টা ইউনিয়ন ছিল। সবার চিন্তাভাবনা আলাদা। আলাদা জায়গায় তাঁরা কাজ করেন, কাজ করার পদ্ধতিও আলাদা। কিন্তু তাঁরা সবাই একসঙ্গে লড়বে ঠিক করেছিলেন। ওঁদের একটাই সুবিধা ছিল ‘স্টেইং পাওয়ার’, সেটা সম্ভব ছিল কারণ তাঁরা একদম গরিব চাষি ছিলেন না, তাঁরা বড়লোক বা স্বচ্ছল কৃষক। কিন্তু ওঁরা গ্রামের দলিত ভাগচাষি থেকে শুরু করে, কানাডায় বাস করা এনআরআই, সবাইকে আন্দোলনে সামিল করতে পেরেছিলেন। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। আন্দোলনে সবাই যোগ দিয়েছিল, কৃষি বিজ্ঞানী থেকে দিলজিৎ দোসাঞ্জ-র মতো পপ স্টার, সবার সাপোর্ট পেয়েছিলেন তাঁরা। পুরো পাঞ্জাবি সমাজ ওঁদের সাথে ছিল। এরকম একটা অবস্থা আমাদেরও তৈরি করতে হবে। একই জিনিস, মেকানাইজেশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নিয়োগীজি করে দেখিয়েছিলেন। সব চেয়ে গরিব যে ঠিকা শ্রমিক, তাঁর নেতৃত্বে, দোকানদার থেকে ট্রাক ট্রান্সপোর্টার সবাই একসঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। আর মেকানাইজেশনের সেই আন্দোলন, অন্তত সেই প্রজন্মের জন্য সফল হয়েছিল। তার মানে এটা সম্ভব। কিন্তু তার জন্য, আমাদের, মানে যারা ট্রেড ইউনিয়নের যে নেতৃত্ব, তাঁদেরকে আত্মসমালোচনা করতে হবে। ভাবতে হবে কী করে একটা সত্যিকারের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, কী করে সত্যিকারের একতা, সত্যিকারের সংহতি তৈরি করা যায়। ঐক্যের কথা তো সবাই বলে, কিন্তু আসলে বলতে চায়, তোমরা এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দাও। তাঁরা ঐক্য বলতে এটা বোঝায় না যে, দেখো, আমারও কিছু ভালো আছে, তোমারও কিছু ভালো আছে। আর দু’জনেরই কিছু দোষও আছে। কিন্তু তাও চলো আমরা এক সঙ্গে একটা কমন প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করি। এটাই আসল ঐক্য। আমাদের এই রকম মানসিকতা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। করা সম্ভব। কারণ দেশটা চলছে তো শ্রমিকদের জন্যই।
A very good interview by a distinguished person who upholds people’s causes in the face of serious problems.