এত বছরের মেলামেশার মধ্যে কী এমন খামতি থাকল যে তাদের হিংস্র চাহনি আমাকে প্রতিনিয়ত ভয় দেখাচ্ছে এবং ভয় পেতে থাকছি। খালি বারবার ১৯৯২ সালের সেই ছোট্ট আমি ও কয়েকজন মানুষের আতঙ্কিত মুখটা ভেসে উঠছে। লিখলেন জেসমিন হোসেন।
আমি তখন চতুর্থ শ্রেণি। সেদিনের কথা যতটা মনে পরে, সেদিন বিকেলটা ছিল অন্যরকম। অন্যরকম বলতে কেমন যেন থমথমে। পাখিদের কলতান সেদিন শুনতে পাইনি। বন্ধুরাও খেলতে ডাকল না। ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে দাঁড়ালাম। তখন আমরা ভাড়া বাড়িতে থাকি। আমাদের পাশে আর একটা পরিবার ছিল। আমরা ও ওরা একটা গোটা পরিবারের মতই ছিলাম। ওই আন্টির কাছে আমি টিউশন পড়তাম। সেদিন যেন কিছুই ভালো লাগছিল না, মনটাও ভালো নেই, খেলা হয়নি। শীতের রাত তাড়াতাড়ি অন্ধকার ঘনিয়ে এল, সন্ধ্যা নামে নামে। এমন সময় ওই আন্টি ও আঙ্কেল তাদের ঘরে তালা বন্ধ করে বিচলিত, ভয়ার্ত ফ্যাকাসে মুখ করে আমাদের বাড়িতে এল এবং মাকে বলল, “ভাবি আমরা চলে যাচ্ছি ওরা আমাদের মেরে ফেলবে আপনারাও চলুন এখান থেকে।” সবাই বাইরে বেরিয়ে আসতে শুনতে পেলাম হো হো আওয়াজ পুরো পাড়া জুড়ে। ওই আসছে, ওই আসছে। আন্টি তখন কোথা থেকে একটা বাঁশ জোগাড় করেছে, মাও দেখলাম কিছু একটা নিল। আমিও একটা কঞ্চি মত নিলাম। কী করব জানিনা তবে ভিতরে ভিতরে ভাবছিলাম, “আসুক না আমিও মারব।”এটা বলে কঞ্চি নিয়ে কসরত করছিলাম। আমার পুরো মনে আছে সেই বিকেল সন্ধের কথা।
আমার বাবা আন্টিদের বোঝালো, “কিছুই হবে না। এসব গুজব। কেউ কাউকে মারতে আসবে না। তোমরা বাড়িতে থাকো কোথাও যেও না।” আন্টিরা থেকে গেল। মা আমাকে স্কুলে যেতে দিল না বেশ কিছুদিন। আরো যেন মনটা কেমন কেমন করছিল বন্ধুদের জন্য।
সালটা ছিল ১৯৯২, দিনটা ছিল ৬ ডিসেম্বর। হ্যাঁ আমি সেই দিনের কথা বলছিলাম যেদিন ভারতের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন স্মৃতিসৌধ বাবরি মসজিদকে ভেঙে ধূলিসাৎ করা হল। ১৫২৮ খ্রিষ্টাব্দে বাবর এই মসজিদটি তৈরি করেছিলেন। কারা, কেন, কীভাবে কার মদতে এমন একটা হিংসাত্মক, আক্রমণাত্মক কাজ ঘটাল তা এই মাঝবয়সে এসে কিছুটা অনুধাবন করতে পারি। পরে এর ওর মুখ থেকে সেই সময়কার হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ঐক্যের ভাঙন ধরার চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মানুষের আগে ধর্মটাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। ঘৃণা বিদ্বেষ হিংস্রতা নিয়ে বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। “সকলেই আড় চোখে সকলকে দেখে।”
সাম্প্রদায়িক ভাইরাস যাতে না ছড়ায় তার জন্য সম্প্রীতি মঞ্চ, মিটিং মিছিলে পাড়ায় পাড়ায় “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান” বাজতে থাকতো। আমিও অনেক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছি। তখন সাম্প্রদায়িকতাই কী আর সম্প্রীতিই বা কী জানা বোঝার বয়স ছিল না। এখন পরিণত বয়সে এসেও মানে খুঁজতে খুঁজতে চলেছি।
১৯৯২ থেকে ২০২২ – ৩০ টা বছর পার হয়ে গেল। পৃথিবীর বয়স আরো কিছুটা বাড়ল। সভ্যতা, প্রযুক্তির উন্নতি, বিজ্ঞানের অগ্রগতি যত দ্রুত হয়েছে মানুষও যেন ততটা কুসংস্কারচ্ছন্ন, অলৌকিকবাদ, অবৈজ্ঞানিক ও ধর্মান্ধতায় বুঁদ হয়ে পড়েছে।
বেশ কিছু বছর ধরে গরু, গরু গন্ধে চারিদিকে মানুষ আতঙ্কিত। গরু দেখলেই নাকি মায়ের মুখ ভেসে ওঠে। তাই এর নাম উচ্চারণ করলেই দাঙ্গা বেঁধে যেতে পারে। রাজস্থানে গরু মন্ত্রীর খবরটা দু’বছর আগে হাস্যকর শোনালেও এখন বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৩ বছর আগেকার কথা—আমাদের শিক্ষিত, ভদ্র, সাংস্কৃতিক প্রতিবেশী পাড়া মহেশতলায় কে বা কারা মন্দিরে গরুর মাংস ফেলে দিয়েছিল। এলাকায় চরম উত্তেজনা, পুলিশ র্যাফ নামাতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু মজার বিষয় হল, এলাকার হিন্দু ও মুসলমান যারা প্রতিদিন না খাটলে পেটে খাবার জুটবে না তারা কিন্তু ‘মুসলমানরা করেছে ওদের মেরে তাড়িয়ে দাও’ এ কথা না বলে বলছে—”আমাদের হিন্দু মুসলমান ঐক্যকে ভাঙতে চাইছে তৃতীয় কোনও শক্তি। যারা করেছে তাদের উদ্দেশ্যটা খুব স্পষ্ট।” আমি ওই এলাকার কিছু মানুষদের সাথে কথা বলেছিলাম, তারা ওই ‘তৃতীয়’ শক্তির কথা বললেন।
আর একটা শ্রেণির মানুষের কথা বলি — যারা আমার খুবই পরিচিত। শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান প্রগতিশীল বলে পাড়ায় নামডাক। সেই মানুষদের নখ দাঁত বের করা হিংস্র চাহনি সেদিন আমি দেখেছিলাম। কান গরম করা গালাগালি, অপবাদ—মুসলিমদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দাও ইত্যাদি ইত্যাদি। যা আর লিখতে ভালো লাগছে না। আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধবরাও কেমন যেন বদলে যেতে থাকে। এত বছরের মেলামেশার মধ্যে কী এমন খামতি থাকল যে তাদের হিংস্র চাহনি আমাকে প্রতিনিয়ত ভয় দেখাচ্ছে এবং ভয় পেতে থাকছি। খালি বারবার ১৯৯২ সালের সেই ছোট্ট আমি ও কয়েকজন মানুষের আতঙ্কিত মুখটা ভেসে উঠছে। সেই আতঙ্ক কিন্তু ঘৃণায় পরিণত হয়নি, ছিল না কোনো বিদ্বেষ। শুধু ছিল ভালোভাবে সুস্থভাবে বাঁচার আকুতি।
বন্ধুত্বের মুখোশ পরা পরিচিত সেই লোকজনরা এখনও আমার সোশ্যাল সাইটে বন্ধুই থেকে গেল। বারবার ভেবেও তাদের উদ্দেশে দু-এক কথা লিখেও মুছে দিয়েছি। আমার দিক থেকে ফুঁসে ওঠা বা বোঝানো কোনোটাই হয়নি। তাদের বন্ধুত্বের তালিকায় রেখে আপোষ করে চলেছি দিনের পর দিন। তাতে যন্ত্রণা হচ্ছে খুবই। কী যে করি! আমাদের করার কি কিছুই নেই? ভীষণ আশঙ্কিত আমি। আশঙ্কিত ঐ স্টেশনের চা দোকানের কাকুটিও। যিনি কাল বারবার বলছিলেন, “আমাদের হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কে বা কারা দাঙ্গা বাঁধাতে চাইছে? আমাদের একতা কাদের সহ্য হচ্ছে না! যতদিন বাঁচবো এইভাবেই কি একা একা ভয়ে ভয়ে কাটাবো?”
প্রশ্ন আমারও। প্রশ্ন তোমারও। তাই এর উত্তর খোঁজার দায় আমাদের সকলের।
(জেসমিন হোসেন পেশায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক।এছাড়া গান করতে, তথ্যচিত্র বানাতে ভালবাসেন।)