ভার্চুয়াল নয়, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই লড়তে হবে 


  • November 2, 2022
  • (0 Comments)
  • 592 Views

প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন কলমধারীদের কেটে ছেঁটে ফেলতে হবে। এও একইরকমভাবে সাধারণ মানুষের মনে ভয় আর সন্দেহ তৈরি করে দেওয়ার প্রচেষ্টা। এ ধরনের রাজনীতি তো চলতেই থাকবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদই যেন সবটুকু না হয়ে ওঠে। সাবধান থাকতে হবে। সবটা হাসি-ঠাট্টা-মশকরা-তামাশা নয়। রাজনীতির মোকাবিলায় আরও ঋজু রাজনীতিই হাতিয়ার হতে পারে। লিখলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

পৃথিবীটা না কি ছোট হতে হতে আজ শুধুই সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্দি। অতি পরিচিত গানের পঙক্তি হয়তো এভাবে বদলে দেওয়া যেতে পারে এখন। সবটাই লাইক, কমেন্ট, শেয়ার-এর খেলা। গণমাধ্যম হিসাবে সোশ্যাল মিডিয়া বিকল্প মাধ্যম হিসাবে যেভাবে গড়ে উঠতে পারত, তা না হয়ে আজ তা অনেকাংশেই শুধু ক্ষণিকের জনপ্রিয়তা, মনোরঞ্জনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ডিসকোর্স হোক বা বিকল্প প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিসর কোনওটাই হয়ে উঠতে পারল না তা, বিশেষত ভারতের মতো দেশে। অথচ তা ছিল সময়ের দাবি। কিন্তু তা হয়ে উঠবে না কারণ যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার হাত ধরে এর উত্থান তা কোনওভাবেই এই মাধ্যমটিকে বিরোধী স্বর হয়ে উঠতে দেবে না। নজরদারি তীব্র থেকে তীব্রতর হবে এবং যে মুহূর্তে মনে হবে কাঠামোকে আঘাতের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করা হচ্ছে তখনই সেই সমস্ত কন্টেন্ট নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। একটা ক্লিক করে যেমন অনেক কিছু প্রচার করা যায়, তেমনি একটা ক্লিক করেই নিষিদ্ধ করে দেওয়া যায় শাসক, পুঁজিপতি, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে করা যেকোনও বক্তব্য। এ এমনই এক গোলকধাঁধা যেখানে স্বেচ্ছায় ঢুকে তো পড়া যায়, অথচ তারপরে খেলাটা খেলতে হয় অন্য কারওর নিয়মে। আর সেই নিয়মেই আমরা ক্রমশ হারিয়ে যাই মিম, মজার ভিডিও, আরও মজাদার জোকস্‌-এর দুনিয়ায়।

 

ভুলে যাই শব্দের পরে শব্দ বসে যে কথারা গড়ে ওঠে তার মধ্যে অর্থ, আবেগ ছাড়াও আর যা রয়ে যায় তা হল রাজনীতি। ভাষার রাজনীতি। শব্দের রাজনীতি। তাই অবশ্যম্ভাবী ভাবেই যখন কোনও রাজনৈতিক দলের বিবৃতিতে, কোনও রাজনৈতিক নেতার মন্তব্যে, কোনও প্রশাসনিক প্রধানের কথায়, বিচারব্যবস্থার কোনও বক্তব্যে বা রায়দানে উল্লেখিত কোনও শব্দ বা শব্দবন্ধ বিশেষ মাত্রা পেয়ে যায়– তখন তার ভেতরে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। তা হল সামগ্রিকভাবে এক বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে প্রভাবিত করা। এবং অবশ্যই তা নেতিবাচকভাবে। আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে সরকার, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, মিডিয়ায় শব্দের ব্যবহার তাই খেয়াল করতে হয় বৈ কি। কারণ এইসব কথা যেভাবে যখন বলা হয় তার বিরুদ্ধে সচেতনভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। মানসিকভাবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন যাতে এর কোনও প্রভাব কোনওভাবেই মস্তিষ্কে না পড়ে। আশেপাশের মানুষের সঙ্গেও প্রতিনিয়ত আলোচনা জারি থাকা প্রয়োজন এই সূক্ষ্ম রাজনীতির ফাঁদ যাতে এড়িয়ে যাওয়া যায়।

 

ধরা যাক অধ্যাপক জি.এন. সাইবাবা-র মামলার কথা। ১৪ অক্টোবর ২০২২ ৯০ শতাংশ প্রতিবন্ধী অধ্যাপক জি.এন. সাইবাবা-কে মুক্তি দিয়েছিল বোম্বে হাইকোর্ট-এর নাগপুর বেঞ্চ। সেই মুক্তি রদ করতে সুপ্রিম কোর্টে যখন বিশেষ বেঞ্চ গঠন করল, শুরু হল দুই পক্ষের আইনজীবীর সওয়াল-জবাব তখন ভারতের সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহতা অধ্যাপক সাইবাবা ও অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দীদের বিষয়ে বলতে গিয়ে ‘আর্বান নক্সাল’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন। বলেন, “নকশাল, আর্বান নকশালদের কাছ থেকে প্রায়শঃই গৃহবন্দী রাখার আবেদন করা হচ্ছে।’ কবে থেকে এই শব্দবন্ধ অভিধানে চলে এল? প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ব্যক্তি মানুষদের, বুদ্ধিজীবীদের এ দেশের এখনকার ‘গোদী মিডিয়া’, সরকার ঘনিষ্ঠ শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতারা ‘আর্বান নক্সাল’ নামে প্রচার করতে শুরু করে দিয়েছিল। ‘ভক্ত’রাও হৈহৈ করে তাই বলেই ডাকতে শুরু করেন তাঁদের। আর এখন দেখা গেল এ দেশের বিচারব্যবস্থায়, এহেন অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি রায়দানের দ মামলায় দেশের শীর্ষ আদালতে খোদ দেশের সলিসিটার জেনারেল এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করলেন, সম্ভবত এই প্রথমবার। কীভাবে বিচারপতি এই শব্দবন্ধ মেনে নিলেন আদালত কক্ষে? আমরা খবরে দেখলাম অধ্যাপক সাইবাবা-র মুক্তি রদ হল। দু’একদিনের আলোচনা-সমালোচনা, অথচ এই শব্দরা রায়দানে কতটা প্রভাব ফেলল তা আলোচিত হল না। মুক্তি রদ করার সময় বিচারপতি এম.আর শাহ যা বললেন তার সারমর্ম হল অধ্যাপক সাইবাবা-র সমস্ত রকম প্রতিবন্ধকতার কথা খেয়াল রেখেও তাঁকে কারগারবন্দী রাখা হচ্ছে কারণ তার মস্তিষ্ক সক্রিয় এবং মস্তিষ্কই সবচেয়ে বিপজ্জনক অঙ্গ – এবং যা উহ্য থাকল তা হল, এই মস্তিষ্কই সরকারবিরোধী, দেশদ্রোহী করে তুলতে পারে। গণহত্যাকারী, বিভেদকামী, সাম্প্রদায়িক, উন্নয়নবিরোধী, হিন্দুত্ববাদী, পুঁজিপতিদের ধামাধরা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে, কলম ধরলে সেই মস্তিষ্কের অধিকারীকে এভাবেই দেশদ্রোহী, ‘আর্বান নক্সাল’ দেগে দেওয়া হচ্ছে আর সেই প্রক্রিয়ায় এবার সায় দিয়ে দিল দেশের বিচারব্যবস্থাও। নেটিজেনরা চাইলে এই মামলাটিকে কেন্দ্রে রেখে কীভাবে দেশের প্রতিবাদী লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী-অধ্যাপক-আইনজীবী-মানবাধিকার ও পরিবেশকর্মীদের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব প্রচার করা হচ্ছে, হিংসা ছড়ানো হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনার পরিসর তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু তা হল না। সোশ্যাল মিডিয়ায় অধ্যাপক সাইবাবা-র মুক্তি রদ, শীর্ষ আদালতে ‘আর্বান নক্সাল’ শব্দবন্ধের স্বীকৃতি কিছুই ঝড় তুলল না।

 

আমরা ভুলে যাচ্ছি উল্টোদিকে থাকা শাসক, পুঁজিপতি, মৌলবাদীরা অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন মাঠে-ঘাটে-জনসভায় উপস্থিত থেকে, রক্ত-গরম করা উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখে। এবং সেই সংখ্যাটি আমাদের ভার্চুয়াল উপস্থিতির থেকে অনেক বেশি। বারবার একই কথার পুনরাবৃত্তিতে মিথ্যাগুলিই বহু সংখ্যক মানুষের মাথায় সত্যি বলে গেঁথে যাচ্ছে। শহুরে ভার্চুয়াল প্রতিবাদী হয়ে তার মোকাবিলা করা নেহাতই কঠিন।  মিম, জোকস, ভিডিও-র আপাত সারবত্তাহীন কন্টেন্ট-এ আর যাইহোক প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় না। কারণ এই ধরনের কন্টেন্টগুলি একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক নেটিজেন গোষ্ঠীর মধ্যেই ঘোরাফেরা করে, সাময়িকভাবে জনপ্রিয় হয় ও তারপর হারিয়ে যায়। বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠীর নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় তা কোনও প্রভাবই ফেলতে পারে না। এগুলি নেহাতই তাদের অবসরে বা গল্পগুজবের মাঝে হাসি-মশকরার বিষয় হয়েই থেকে যায়। এগুলি দিয়ে যে সরকার, প্রশাসন, শাসকের সমালোচনা করা যায়, প্রতিবাদ করা যায় তা বৃহত্তর জনগণের কাছে কোনও আবেনই তৈরি করে না। তারা বরং শাসক, সরকার, প্রশাসনের তৈরি করা ন্যারেটিভ-এ অনেক বেশি প্রভাবিত হয়, তাদের কুমীরছানার মতো দেখানো ছোটখাটো উন্নয়ন-দানখয়রাতিকে দেশের বা রাজ্যের উন্নয়নের পরাকাষ্ঠা বলে ধরে নেয়, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা প্রতিবাদীদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। অথচ প্রতিরোধ রাস্তায় নেমে করলে যে শাসককে পিছু হঠতে বাধ্য করা যায় তা সাম্প্রতিক সময়ের কৃষক আন্দোলন করে দেখিয়েছে।

 

কি আশ্চর্য আমরা এরকম বিষয়টিকে উপেক্ষা করে গেলাম আর মিম বানাতে লাগলাম দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন-এর বক্তব্যকে ঘিরে। উনি বললেন, টাকার দর কমেনি, ডলার শক্তিশালী হয়েছে। ব্যস, এই কথাটিকে প্রেক্ষিত বদলে বদলে আমরা নানান মজার মজার মিম ইত্যাদি বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসির ঝড় তুললাম। আর একটি ক্রমশ ধসে পড়তে থাকা, বিপর্যস্ত অর্থনীতির মাঝখানে বসে দেশের অর্থমন্ত্রী সমস্ত দায়-দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে যে এহেন একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য করলেন তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সমালোচনা, প্রতিবাদ, সিরিয়াস বক্তব্য আদানপ্রদানের পরিসর তৈরি হল না। আমরা আসলে বারেবারেই এটা ভুলে যাই যে নেতা-মন্ত্রীদের এই যাবতীয় কথাবার্তা, শব্দচয়ন অত্যন্ত সচেতনভাবে করা – তা তাঁরা নিজেরাই করুন বা তাঁদের পিআর দল। ঠিক কোন সময়ে কোন কথাটি বললে সমস্যার থেকে নজর ঘুরিয়ে দিয়ে শব্দগুলি নিয়ে মাতিয়ে দেওয়া যাবে জনগণকে, সোশ্যাল মিডিয়ার আকর্ষণ হয়ে ওঠা যাবে – তা একেবারে নিখুঁত স্ট্র্যাটেজিতে ঠিক করা থাকে এবং আমরা ঠিক গিয়ে সেই ফাঁদটিতেই ধরা দিয়ে। দেশে মূল্যবদ্ধি, টাকার ক্রমাগত পড়তে থাকা দর সবকিছু আলোচনার বাইরে চলে যায়। অর্থমন্ত্রীর হাস্যকর মন্তব্য নিয়ে মেতে থাকি, আরও বড় ষড়যন্ত্রের অভিমুখ দেখতে পাই না।

 

দেশের থেকে দৃষ্টি যদি ফিরিয়ে আনা যায় আমাদের নিজেদের রাজ্যের দিকে, তার চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? এ রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান তাঁর যাবতীয় বক্তব্যকে অত্যন্ত সচেতনভাবে অধিকাংশ সময়ে হাস্যকর করে রাখেন। এ কথা যদি আমরা এখনও অস্বীকার করি যে উনি যা বলেন এবং যেভাবে বলেন তা সহজাত, কোনও রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি নয়, তাহলে আমরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছি। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়, হ্যাঁ নিশ্চিতভাবেই তিনি বরাবরের ‘এক্সেন্ট্রিক’। কিন্তু তাঁর শরীরী ভাষা, কথা বলার ধরণ ও কী বলছেন, কোথায় বলছেন তা প্রশাসনিক প্রধান হওয়ার পর ক্রমেই বদলেছে। প্রচুর হৈ-চৈ হয়েছিল পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কান্ডকে তিনি ‘ছোট্ট ঘটনা’ বলে উল্লেখ করায়। অথচ সেই ঘটনার পর থেকে এ রাজ্যে মহিলাদের উপর সংঘটিত ধর্ষণ ও যৌন হেনস্থার ঘটনা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা এ বিষয়ে খানিক খোঁজ রাখলেই বলা যায়। দলের ক্ষমতা যত বেড়েছে, দলনেত্রী সরকারের প্রধান হয়ে এরকম মন্তব্য করে দেওয়ার পর অপরাধ না কমে যে ততই বেড়েছে তা আজ এ রাজ্যের বাস্তব।

 

তিনি অত্যন্ত ভালোভাবেই জানেন যে তাঁর কথাগুলি নিয়ে মিম হবে, জনসভায় তাঁর বক্তৃতাগুলি এডিট করে এমন সব ভিডিও তৈরি হবে যা কয়েক হাজার শেয়ার হবে। আর তার ফলে কী হবে? এ রাজ্যের বেকারত্ব, সরকারের দুর্নীতি, রাজ্যজুড়ে বাড়তে থাকা অপরাধ-সন্ত্রাস, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের বেহাল দশা, প্রশাসনিক দুরাবস্থা কিছুই তেমন করে সামনে আসবে না। যতবার কোনও বড় দুর্নীতি সামনে আসবে, নেতা-মন্ত্রীরা ধরা পড়বেন তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এমন মন্তব্য করবেন যা নিয়ে আমরা আবার ঠাট্টা-তামাশা করব আর রাজ্যটি ক্রমেই উন্নয়নের থেকে পিছিয়ে আসতে থাকবে। তাঁরই স্নেহভাজন নেতা যখন দুষ্কৃতীরা যেভাবে হুমকি দেয় সেই কায়দায় রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে থাকা বা নকুলদানা খাওয়ানোর কথা বলেন–কত সহজেই তিনি সেই নেতার মাথায় অক্সিজেন কম যাওয়ার কথা বলে সেই নেতার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোকে লঘু করে দেন। আমরা হেসে লুটোপুটি খাই আর ভুলে যাই এভাবেই একটি রাজ্যে লুম্পেনদের আধিপত্য বেড়ে যায়।

 

যোগ্য প্রার্থীরা চাকরি না পেয়ে মাসের পর মাস ধর্না দিলে কী এক আশ্চর্য কারণে এ রাজ্যের মূলস্রোতের মিডিয়া তা খবর করে না। খবর হয় তখন যখন রাজ্যের পুলিশ তাদের রাতের অন্ধকারে অমানবিকভাবে তুলে নিয়ে যায়। খবর হতে গেলে তো স্পেকটাকল দরকার হয়। তিনি এই ঘটনার ঠিক আগে বলেছিলেন তিনি ধর্না থাকা চাকরীপ্রার্থীদের ভালবাসেন। আর তারপরেই এই ঘটনা। তাদের দাবিপূরণের কোনও চিহ্নই নেই আপাতত। এ বিষয়ে তিনি একটিও মন্তব্য আর করেননি। কারণ তিনি জানেন, তিনি মন্তব্য না করলেই এই দাবি-দাওয়া, ধর্না, অনশন আর খবর হবে না, সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে আসবে না। একদল মানুষ ন্যায্য দাবি নিয়ে ছ’শো দিন পেরিয়ে রাস্তায় বসে থাকবেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায়। আর তাঁদের ঘিরেই শহরের নাগরিক জীবন দিব্যি চলবে, বাধাহীন, প্রতিবাদহীন।

 

মজাটা হল, অনেক সময়েই নিজেরা বুঝে বা না বুঝে আমরা এই কথাগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা মারাত্মক রাজনীতি যা ঘৃণা ছড়ায়, বিভেদ তৈরি করে, বিরোধী স্বরের কণ্ঠরোধ করতে চায় তাকে চিহ্নিত না করে – তার যে তাৎক্ষণিক প্রভাব তা নিয়ে মেতে থাকি। আসলে আমরা যা করে থাকি, তা আর কিছুই না—বিষয়গুলির, কথাগুলির, শব্দগুলির গুরুত্ব লঘু করে দিই। যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী, কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁদের বেতনভুক কর্মীরা, তাঁদের দলের সদস্যরা, আমাদের ভোটে জিতে সংসদে, বিধানসভায় যাওয়া নেতারা কথাগুলি বলেন– সেগুলি এভাবে আরও বেশি প্রচার পেয়ে যায়। আমরা হাসি, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি সাময়িকভাবে, তারপর ভুলে যাই।

 

আমরা ভুলে যাচ্ছি উল্টোদিকে থাকা শাসক, পুঁজিপতি, মৌলবাদীরা অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন মাঠে-ঘাটে-জনসভায় উপস্থিত থেকে, রক্ত-গরম করা উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখে। এবং সেই সংখ্যাটি আমাদের ভার্চুয়াল উপস্থিতির থেকে অনেক বেশি। বারবার একই কথার পুনরাবৃত্তিতে মিথ্যাগুলিই বহু সংখ্যক মানুষের মাথায় সত্যি বলে গেঁথে যাচ্ছে। শহুরে ভার্চুয়াল প্রতিবাদী হয়ে তার মোকাবিলা করা নেহাতই কঠিন।  মিম, জোকস, ভিডিও-র আপাত সারবত্তাহীন কন্টেন্ট-এ আর যাইহোক প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় না। কারণ এই ধরনের কন্টেন্টগুলি একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক নেটিজেন গোষ্ঠীর মধ্যেই ঘোরাফেরা করে, সাময়িকভাবে জনপ্রিয় হয় ও তারপর হারিয়ে যায়। বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠীর নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় তা কোনও প্রভাবই ফেলতে পারে না। এগুলি নেহাতই তাদের অবসরে বা গল্পগুজবের মাঝে হাসি-মশকরার বিষয় হয়েই থেকে যায়। এগুলি দিয়ে যে সরকার, প্রশাসন, শাসকের সমালোচনা করা যায়, প্রতিবাদ করা যায় তা বৃহত্তর জনগণের কাছে কোনও আবেনই তৈরি করে না। তারা বরং শাসক, সরকার, প্রশাসনের তৈরি করা ন্যারেটিভ-এ অনেক বেশি প্রভাবিত হয়, তাদের কুমীরছানার মতো দেখানো ছোটখাটো উন্নয়ন-দানখয়রাতিকে দেশের বা রাজ্যের উন্নয়নের পরাকাষ্ঠা বলে ধরে নেয়, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা প্রতিবাদীদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। অথচ প্রতিরোধ রাস্তায় নেমে করলে যে শাসককে পিছু হঠতে বাধ্য করা যায় তা সাম্প্রতিক সময়ের কৃষক আন্দোলন করে দেখিয়েছে।

 

প্রধানমন্ত্র্রী সম্প্রতি বলেছেন কলমধারীদের কেটে ছেঁটে ফেলতে হবে। এও একইরকমভাবে সাধারণ মানুষের মনে ভয় আর সন্দেহ তৈরি করে দেওয়ার প্রচেষ্টা। এ ধরনের রাজনীতি তো চলতেই থাকবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদই যেন সবটুকু না হয়ে ওঠে। সাবধান থাকতে হবে। সবটা হাসি-ঠাট্টা-মশকরা-তামাশা নয়। রাজনীতির মোকাবিলায় আরও ঋজু রাজনীতিই হাতিয়ার হতে পারে।

 

Share this
Leave a Comment