অযোধ্যার বামনি ঝর্নায় একটি পর্যটন কেন্দ্র উদ্বোধন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যে পর্যটন কেন্দ্রটি পরিচালনা করবে বাড়ুয়াজারা বাঁধঘুটু দুলুগবেড়া গ্রামসভা। ১৫ নভেম্বর, বিরসা মুন্ডার জন্মদিনে এই কেন্দ্রটি উদ্বোধন করার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে কোথাও ‘সংঘর্ষ ও নির্মাণ’-এর এক নতুন পথ খুলে দেওয়ার সম্ভাবনাকে তুলে ধরল প্রকৃতি বাঁচাও ও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ। লিখছেন দেবাশিস আইচ।
২০০৬ সালে বনাধিকার আইন তৈরি হয়েছে। আদিবাসীদের অধিকার ও বনরক্ষার এই আইনকে মর্যাদা দেয়নি কোনও সরকার। পাহাড় উড়িয়ে, ঝর্না বেঁধে, জঙ্গল ডুবিয়ে পাম্প স্টোরেজ প্রকল্প হয়েছে। আরও একাধিক পাম্প স্টোরেজ প্রকল্প গড়ে তুলতে তৎপর বর্তমান সরকার। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অযোধ্যা পাহাড়ে, পাহাড় ঘিরে অরণ্যভূমিতে গড়ে উঠেছে বহু বহু রিসর্ট, হোটেল। তার দীর্ঘ আগে মূলত অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায় মূলত সরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল কিছু লজ ও বনবাংলো। এই উন্নয়নী তৎপরতার ভালোমন্দ নিয়ে কখনও অযোধ্যার স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কোনও আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন মনে করেনি কোনও সরকারই। অথচ সুযোগ ছিল। পঞ্চায়েতে, গ্রামসংসদে আলোচনা করা যেত। প্রকৃতি যাঁদের কাছে উপাস্য, অরণ্য যাঁদের জীবন-জীবিকার এক অন্যতম আধার—পাহাড় ভেঙে, জঙ্গল সাফ করে, ঝর্নার অবিরাম জলস্রোতকে সুড়ঙ্গবন্দি করে ফেলার আগে তাঁদের জানাতে হবে না, মতামত নিতে হবে না—এই উন্নয়নে আম-আদিবাসীর লাভ কী? বড় ঝর্না বন্দি হলে আর কত ছোট ঝর্না শুকিয়ে যায়—এইসব জলস্রোত কত গ্রাম, কত প্রাণীর বেঁচেবর্তে থাকার একমাত্র উৎস। তার বিকল্প কী হবে? এই যে রিজার্ভারের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হল বনাঞ্চল— এর ফলে কত শত পাখি গৃহহীন হয়েছে, কত শত কোটি কীট-পতঙ্গ, ছোট ছোট প্রাণীর সলিল সমাধি হয়েছে? ধ্বংস হয়ে গেছে এক বিপুল জীববৈচিত্র। জীবিকা হারিয়েছেন কত মানুষ? আবারও পাম্প স্টোরেজ গড়ার আগে তার হিসাব দিতে হবে তো। তেলা মাথায় তেল দেওয়া এই উন্নয়নের পিলসুজ চুইয়ে ক’ফোঁটাই বা গড়িয়ে পড়ল অন্ধকার টোলাতে? সেই হিসাবও তো চাইবে মানুষ।
এই হিসাবটা এবার বুঝে নিতে চাইছে পুরুলিয়ার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। সংগঠন গড়ে ঠুরগা, বান্দু পাম্প স্টোরেজ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে জেহাদ ঘোষণা করেছেন পুরুলিয়ার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। এই লড়াই পথে-পাহাড়ে-আদালতে লড়তে লড়তে বনাধিকার আইনকে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার করে তুলেছে ‘প্রকৃতি বাঁচাও ও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ’। ইতিমধ্যেই বনাধিকার আইন মোতাবেক গঠন করা হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রামসভা। এবার অযোধ্যা পাহাড়ে তাদের হকের পাওনা আদায়ে নামল মঞ্চ। মঞ্চ জানাচ্ছে, “ আমাদের বীরবুরুকে রক্ষা করার মাধ্যমে নিজেদের প্রয়োজনীয় উন্নয়নের ন্যায্য চেষ্টা আমরা করব। এটা আমাদের হক। বাপ দাদাদের যেমন ক্ষমতা ছিল জঙ্গলে, সেই ক্ষমতা আবার প্রতিষ্ঠা করতে…” একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। যেমন:
“গ্রামসভার আওতাভুক্ত জঙ্গলে থাকা গ্রাম সংলগ্ন যে কোনো দর্শনীয় স্থান ১০০% নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিক গ্রামসভা।” আগামী ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিটি গ্রামসভা যাতে গ্রামসভার বৈঠক ডেকে এই সিদ্ধান্ত নথিভুক্ত করে সেই সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তের পিছনে রয়েছে এক প্রবল বঞ্চনাবোধ। মঞ্চের ইস্তাহার বলছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য উপভোগ করতে দেশবিদেশ থেকে মানুষ আসেন। ফলে ট্যুরিজম একটি বড় ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই ব্যবসার ‘একশো শতাংশই বহিরাগতদের দখলে’, শুধু তাই নয়, “সরকারের দফতর, বনবিভাগ নানা দর্শনীয় স্থানকে দখল করে ব্যবসা করতে চাইছে।”
সন্দেহ নেই, নীতিগত ভাবে তো বটেই, ২০০৬-এর আইন অনুযায়ী এই উন্নয়নের এক প্রধান উপভোক্তা হওয়ার কথা ছিল অযোধ্যার আদিবাসী ও পুরুষানুক্রমে বসবাসকারী অন্যান্য সম্প্রদায়ের। কিন্তু তা হয়নি। এবার তাই ষোলআনা হকের হিস্যার লক্ষ্যে অযোধ্যার বামনি ঝর্নায় একটি পর্যটন কেন্দ্র উদ্বোধন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যে পর্যটন কেন্দ্রটি পরিচালনা করবে বাড়ুয়াজারা বাঁধঘুটু দুলুগবেড়া গ্রামসভা। ১৫ নভেম্বর, বিরসা মুন্ডার জন্মদিনে এই কেন্দ্রটি উদ্বোধন করার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে কোথাও ‘সংঘর্ষ ও নির্মাণ’-এর এক নতুন পথ খুলে দেওয়ার সম্ভাবনাকে তুলে ধরল অযোধ্যা বাঁচাও ও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ। যখন ফরেস্ট কনজারভেশন রুল, ২০২২ এনে বনের উপর আদিবাসীদের তাবড় অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্যগুলি নীরব—তখন মঞ্চের এমন এক প্রতিস্পর্ধী সিদ্ধান্ত আরও এক উলগুলানের লক্ষ্যে দৃঢ় পদক্ষপ।