লালকেল্লার ভাষণ আর সরকারি পদক্ষেপের পরস্পর বিরোধিতা


  • October 27, 2022
  • (0 Comments)
  • 706 Views

প্রত্যেকের ভাবা উচিত, শাসকের এই নির্লজ্জ আচরণে কি হবে সেই নারীদের যারা অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে, ন্যায্য বিচার পেতে নিরন্তর যুদ্ধ করে চলেছেন। বিষয়টি শুধু দুই সাধ্বী ও বিলকিস বানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রত্যেক মেয়ের জন্য যারা এই ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে আদালতে লড়ছে। শাসকের আচরণে তাদের লড়াই অপমানিত হচ্ছে। লিখেছেন আশিস গুপ্ত। 

 

“আমরা কি এমন সব কিছু থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি যা প্রকৃতি, সংস্কৃতি, দৈনন্দিন জীবনে নারীদের অপমান করে? জাতির স্বপ্ন পূরণে নারীর অহংকার একটি বিশাল সম্পদ হতে যাচ্ছে। আমি এই সম্ভাবনা দেখছি এবং তাই আমি এটির উপর জোর দিচ্ছি।” স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষে গত ১৫ আগস্ট দিল্লির লালকেল্লা থেকে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে একথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেদিন তাঁর ভাষণের অনেকটা জুড়ে ছিল নারীর ক্ষমতায়ন, সশক্তিকরণের কথা। নরেন্দ্র মোদির ওই স্পর্শকাতর আবেদনের পর গত তিনমাসে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনকে আলোড়িত করেছে, শংকিত করে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রীর বাণী লালকেল্লার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হওয়ার মুহূর্তে গুজরাটের গোধরা সাব-জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে ১১ জন ধর্ষক ও খুনি। এই মুক্তি আদালতের নির্দেশে নয়, গুজরাট সরকার ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বদান্যতায়। অর্থাৎ বিশেষ ক্ষমাদান কর্মসূচির আওতায়। গত ১৪ অক্টোবর হরিয়ানার রোহতকের পুলিশ সুপার উদয় সিং মীনা ঘোষণা করেন, ধর্ষণ ও খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী ‘গুরমিত রাম রহিমের ৪০ দিনের প্যারোল মঞ্জুর করা হয়েছে’। লাল কেল্লার ময়দান থেকে প্রধানমন্ত্রী আবেদন করেছিলেন, ‘কোনো না কোনো কারণে আমাদের মধ্যে এমন বিকৃতি এসেছে, আমাদের কথাবার্তায়, আচরণে, কোনো কোনো কথায় আমরা নারীদের অপমান করছি। আমরা কি এটা থেকে পরিত্রাণ পেতে একটি সংকল্প গ্রহণ করতে পারি ?’ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ আর রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ কে কিভাবে চিহ্নিত করবো, পরস্পরবিরোধী নাকি দেশের শাসন ক্ষমতার শীর্ষে থাকা মানুষটিকে অপমান? ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে সাজা ভোগ করার পর মুক্তি পাওয়া এই ১১ জনের জন্য ১৫ আগস্টের দিনটি সত্যিই অমৃত নিয়ে এসেছে। কত গর্বের সাথে তারা জেলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেওয়া হয়েছে। পরে তাদের মিষ্টি দিয়ে বরণ করা হয়। এটি যথেষ্ট ছিল না, তাই ধর্ষণের অপরাধীদের টিকা দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। শাসক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় এধরণের আচরণে ন্যায়বিচারকে উপহাস করা হচ্ছে নাকি জনগণকে উপহাস করা হচ্ছে? নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষে সরকার ঘোষিত ‘অমৃত মহোৎসব’ কালে ১৫ আগস্ট ধর্ষণ ও হত্যার আসামিদের বিশেষ মুক্তি দিনটিকে কলংকিত করেছে। এরকম একটা ঘটনা যে ঘটতে চলেছে, ভাষণ দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী কি তা জানতেন না! গত ২৮ জুন গুজরাট সরকার ১১ জন ধর্ষক ও খুনিকে ক্ষমাদানের জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অনুমোদন চেয়েছিলো। ১১ জুলাই, অর্থাৎ দু’সপ্তাহের মধ্যে অমিত শাহ’র কর্তৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এক পৃষ্ঠার (সাইন-অফ) অনুমোদন দিয়েও দেয়। সিবিআইয়ের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও দেওয়া হয়েছিল এই অনুমোদন। প্রধানমন্ত্রী জানতেন না সেকথা?

 

আসলে ২০১৪ সালে কেন্দ্রের ক্ষমতা দখলের পর সরকার এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব কথায় এবং কাজে পরস্পরবিরোধিতার নিত্য নতুন নজির সৃষ্টি করে চলেছেন। এটা একটু অন্যভাবেও বলা যেতে পারে। সরকার বা বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব প্রতিদিন কোনও না কোনোভাবে অপমানিত হচ্ছেন দল বা দল পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলির পদক্ষেপে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে বলছেন, কোনো না কোনো কারণে আমাদের মধ্যে এমন বিকৃতি এসেছে, আমাদের কথাবার্তায়, আচরণে, কোনো কোনো কথায় আমরা নারীদের অপমান করছি। আমরা কি এটা থেকে পরিত্রাণ পেতে একটি সংকল্প গ্রহণ করতে পারিনা? প্রধানমন্ত্রী সংকল্প নিতে বলছেন, আর তাঁর দলের সরকার হরিয়ানায় ধর্ষণ ও খুনের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে বার বার প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বাইরে থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে বিশেষ নিরাপত্তা সহ। এক্ষেত্রেও প্যারোল আদালতের নির্দেশে নয়, প্রশাসনিক আদেশে। ধর্ষণ, খুনে দোষী সাব্যস্ত ডেরা সাচ্চা সৌদা প্রধান গুরমিত রাম রহিম সিং প্যারোলে মুক্তি পেয়েছেন রোহতক জেলার সুনারিয়া জেল থেকে, ৪০ দিনের জন্য। চলতি বছরে এই নিয়ে তিনবার প্যারোল পেলেন তথাকথিত ধর্মগুরু। সিবিআই আদালতের দ্বারা ২০১৭ সালের আগস্টে প্রথম দোষী সাব্যস্ত হওয়া ডেরা প্রধান বর্তমানে ডেরা সদর দফতরে তার দুই মহিলা শিষ্যকে ধর্ষণের জন্য ২০ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। ২০১৯ সালে, রাম রহিম এবং অন্য তিনজনকে ২০০২ সালে সাংবাদিক রাম চন্দর ছত্রপতি হত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। গত বছর, তাকে, অন্য চারজনের সাথে, ডেরার প্রাক্তন ম্যানেজার রঞ্জিত সিংকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, যিনি ২০০২ সালে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। কোথাও খুন-ধর্ষণ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা জেল থেকে বের হলে মালা পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আবার কোথাও খুন-ধর্ষণ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের বাণী শোনা যাচ্ছে। একজন দণ্ডিত ব্যক্তির কাছ থেকে ধর্মীয় উপদেশ শুনছে মানুষ-আবার প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনে হাততালি দিচ্ছে তারাই। ধর্মের রাজনীতি কি নাগরিকদের এতটাই দুর্বল করে দেয় যে তারা ধর্মের নামে জঘন্য অপরাধীর আশীর্বাদ নেয়? ধর্মের রাজনীতি কি শিক্ষা দেয় যে হত্যা করা পাপ নয়? ধর্ষণ কোন পাপ নয়?

 

লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ আর কেন্দ্র ও রাজ্যে তার দলের সরকারের পদক্ষেপ সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী। অথচ প্রধানমন্ত্রী মৌন সাধুর ভূমিকায় অবতীর্ন। আমার প্রশ্ন পরিষ্কার। যারা বিলকিস বানোকে গণধর্ষণ করেছে এবং তার শিশু কন্যা সহ পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে তাদের শাস্তি মকুব করা, মালা পরিয়ে সংবর্ধনা জানানো, এটা কি নারীদের অবমাননার বিষয় নয়? প্রধানমন্ত্রী মোদি আপনি কি বলবেন যে, এসব ঘটনা নারীকে অপমান করে এমন সবকিছু থেকে মুক্তির সংকল্প বাস্তবায়ন? বিজেপি নেতারা হরিয়ানায় খুন-ধর্ষণ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত গুরমিত সিংয়ের সৎসঙ্গে যান, এমনকি বিধানসভার ডেপুটি স্পিকারও তার কাছে যান, এটাই কি নারীদের অপমানিত করে এমন সব কিছু থেকে মুক্তি পাওয়ার সংকল্প রক্ষা? প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ”জাতির স্বপ্ন পূরণে নারীর অহংকার একটি বিশাল শক্তি হতে যাচ্ছে। আমি এই শক্তি দেখতে পাই, এবং তাই আমি এটির উপর জোর দিই।” ভাষণে বর্ণিত ‘বিশাল শক্তির’ প্রকৃত রূপ সম্পর্কে কিছু বলেননি প্রধানমন্ত্রী। যা তার বলা উচিত ছিল। বিলকিস বানো এবং দুই সাধ্বীর ধর্ষককে জেল থেকে বের করে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্মান দেখালে প্রধানমন্ত্রীর কথার অনুরণন হয় ভিন্ন আঙ্গিকে। জনগণের সঙ্গে তঞ্চকতা। তথাকথিত ধর্মগুরু, দুইজন সাধ্বীকে ধর্ষণ করা, সাংবাদিক সহ দু’জনকে হত্যা করা তথাকথিত ধর্মগুরুর পাশে দাঁড়াবে আমাদের রাজনীতি ও সমাজ? তাহলে বিলকিস বানো ও ওই দুই সাধ্বীর সঙ্গে কে দাঁড়াবেন? এদেশের নারীরা কোথায় গেল? নাকি তারা এতে দোষের কিছু দেখেন না? রাম রহিমকে দুই শিষ্যকে ধর্ষণের মামলায়, তার নিজের ম্যানেজার রঞ্জিত কুমারকে হত্যার মামলায়, দৈনিক পুরা সাচের সম্পাদক রাম চন্দ্র ছত্রপতি জি হত্যার মামলায় শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। এর আগে কখনো খুন-ধর্ষণ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির সঙ্গে রাজনীতিবিদদের এমন আচরণ দেখেছেন, আমরা কাকে কী বার্তা দিচ্ছি? গুরমিত সিং প্যারোলে মুক্তি পেয়ে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বাগপত থেকে সৎসঙ্গ করছেন। হিসারের নলওয়া বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক রণবীর গাংওয়াও করনালের চৌধুরী রিসোর্টে সৎসঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তারা ছাড়াও এই সৎসঙ্গে অংশ নিয়েছেন করনাল শহরের মেয়র রেণুবালা গুপ্ত, ডেপুটি মেয়র নবীন কুমার, সিনিয়র ডেপুটি মেয়র রাজেশ অগ্গি, বিজেপি জেলা সভাপতি যোগেন্দ্র রানা। রণবীর গাংওয়া হরিয়ানা বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার। একটি ভাইরাল হওয়া ভিডিও -তে দেখা গেছে ডেপুটি স্পিকার খুন ও ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত গুরমিত সিং এর সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়েছেন। মোদী সরকারের মন্ত্রীরা কি এর বিরুদ্ধে কথা না বলে একজন ধর্ষক, খুনিকে রাজনৈতিক সম্মানের বার্তা দেননি? এতকিছুর পরও প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা তাঁর ভাষণের অন্তসারশূন্যতাকেই মেলে ধরে। খুন-ধর্ষণ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি জেল থেকে বেরিয়ে সৎসঙ্গ করে, বিজেপি নেতারা সেখানে যান, বিজেপি ও সংঘ পরিবার এটাকে কীভাবে দেখে? এই প্রশ্নটি কি ধর্মের নৈতিকতার তালিকায় স্থান পায় না? প্রত্যেকের ভাবা উচিত, শাসকের এই নির্লজ্জ আচরণে কি হবে সেই নারীদের যারা অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে, ন্যায্য বিচার পেতে নিরন্তর যুদ্ধ করে চলেছেন। বিষয়টি শুধু দুই সাধ্বী ও বিলকিস বানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রত্যেক মেয়ের জন্য যারা এই ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে আদালতে লড়ছে। শাসকের আচরণে তাদের লড়াই অপমানিত হচ্ছে। এটা ভোটারেরও অপমান, যার ভোটের নামে ধর্ষকদের মালা পরানো হচ্ছে। নারীর সম্মান রক্ষায় বিজেপির পদক্ষেপের সর্বশেষ খবর, কর্ণাটকের পরিবহনমন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় চড় মেরেছেন এক মহিলাকে।

 

লেখক সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।

Share this
Leave a Comment