এ কথা ঠিক, আইন ও আদালত এবং কেন্দ্রীয় এজেন্সির বেড়াজালে তৃণমূল দলটি ও সরকার এখন বন্দি। কিন্তু, বিধাননগরে অনশন আন্দোলনরত চাকরি প্রার্থীদের নির্মমভাবে হঠিয়ে দিয়ে সরকার যে শ্বেতসন্ত্রাসের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে—আগামি দিনে তা আরও ধারালো হবে। মোদী ভাল, শাহ দুষ্টু কিংবা আরএসএস খারাপ নয়—জপতে জপতে কখন রাজনীতির খেলা ঘুরে যাবে তা বুঝে ওঠা দুষ্কর। এই প্রবল দাম্ভিক, ক্ষমতার মদে মত্ত শাসকের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগঠিত সংগ্রাম গড়ে না তুলতে পারলে, যা ঘটে চলেছে তা আরও বেশি বেশি করে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। লিখলেন দেবাশিস আইচ।
নখ থেকে চুল পর্যন্ত একটি অগণতান্ত্রিক সরকার; নখ থেকে চুল পর্যন্ত একটি দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রিসভা; নখ থেকে চুল পর্যন্ত একটি নীতি ও আদর্শহীন দল; নখ থেকে চুল পর্যন্ত এক পরমত বিদ্বেষী, অসহিষ্ণু, অহংমন্য মুখ্যমন্ত্রী—আর কিই-বা করতে পারেন, মধ্যরাতে শ্বেতসন্ত্রাস কায়েম করা ছাড়া?
এমনটি নয় যে, এই প্রথম নখ-দাঁত দেখালেন মুখ্যমন্ত্রী। এমনটিও নয় যে, ‘উর্দি পরা গুন্ডা’দের লেলিয়ে দেওয়া হল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। বিগত ১১টি বছর এমনটাই তো হয়ে চলেছে। বিগত ১১ বছরে রাজ্যে একটিও প্রতিষ্ঠান নেই যাকে স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বলা যায়। প্রতিটি বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়; বাংলা আকাদেমি, নাট্য আকাদেমি থেকে কলকাতা পুস্তকমেলা; মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন, শিশু কমিশন, তথ্যের অধিকার রক্ষা কমিশন—সবই হয় দলদাস কবলিত নয় মস্তিষ্কহীন ও পঙ্গু। এবং সর্বত্র এক একক ব্যক্তিই শেষ কথা বলার অধিকারী।
এ যদি স্বৈরাচার না হয়, তবে স্বৈরাচার কী? শাসক স্বৈরাচারী বলেই ৮৬ ঘণ্টা ধরে অনশনরত চাকরিপ্রার্থীদের—যাঁদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন—উপর পুলিশ লেলিয়ে দিতে পারে। অনতি অতীতে তো বটেই সাম্প্রতিক কালে আনিশ হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে প্রতিবাদী ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতীদের উপর এমন ধারাবাহিক নৃশংসতা আমরা দেখেছি। কথায় কথায়, বিনাকারণে পুলিশ দিয়ে মানবাধিকার কর্মীদের পথসভা পুলিশ দিয়ে পণ্ড করে দেওয়া এক রুটিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে তাঁরা এ রাজ্যের কোনও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় প্রতিবাদী সভার আয়োজন করুন কিংবা অন্য রাজ্যের কোনও ঘটনার প্রেক্ষিতে।
একটি শাসনব্যবস্থা ঠিক কতদূর পচে গেলে, তার কুশীলবরা এ কথা বলতে পারেন যে, সাদা খাতা জমা দিয়ে, লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অশিক্ষক কর্মচারীদের চাকরি যাক, তা তাঁরা চান না। বামাল সমেত চুরির দায়ে ধরা পড়াদের এক মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রিসভা এমন এক ষড়যন্ত্রমূলক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, অর্থবরাদ্দ করতে পারেন যে—নোংরা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে অসৎপথে চাকরি পাওয়া ব্যক্তিরাও বহাল তবিয়তে টিকে যেতে পারে। এই অলীক কুনাট্য মঞ্চস্থ করার দায় বর্তেছে নাট্যকার, অভিনেতা ও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর উপর। এই নাট্যকার যে নিয়োগগুলিকে ‘ব্যতিক্রমী’ আখ্যা দিয়েছেন।
মনে করার কারণ আছে যে, এই দুর্নীতিগ্রস্তরা চাকরি হারালে তৃণমূল কংগ্রেসের ভিত্তি টলে যাবে। কেননা এই দলটির রাজ্যজুড়ে একছত্র আধিপত্যের অন্যতম দু’টি স্তম্ভ হল, দুর্নীতি এবং দলীয় ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। অন্য দুই প্রধান স্তম্ভ হচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তথাকথিত ‘সৎ, লড়াকু, শক্তিশালী’ ভাবমূর্তি এবং বিভিন্ন জনপ্রিয় সর্বজনীন প্রকল্প। ‘সততার প্রতীক’ শব্দবন্ধে যে ভাবমূর্তি গড়ে তোলা হয়েছিল, তা এখন আর কেউ ব্যবহার করেন না। উপহাস করেন। মমতারা জানেন, আধিপত্য বজায় রাখতে গেলে, এমন এক ফৌজ গড়ে তুলতে হবে, যে ফৌজিরা তাঁকেই একমাত্র একমেবাদ্বিতীয়ম নেতা-নেত্রী মেনে নেবে। এবং এর জন্য কোনও আদর্শের প্রয়োজন পড়ে না। তিনি জানেন, ভাত ছড়ালে যেমন কাকের অভাব হয় না, তেমনি খালিপদ ফৌজি বা বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী পুষতেও আনুকূল্য ছড়ালেই হয়। এই ফৌজিদের দু’হাতে লুটতে দাও, ভোটের দিন জান হাজির করে দেবে। তাদের সাতখুন মাপ। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচন কিংবা বিধানসভা নির্বাচন পরবর্তী হিংসা যার সাম্প্রতিকতম নিদর্শন। আবার বিশিষ্টজনদের বড় অঙ্কের ভাতা, গাড়ি, ফ্ল্যাট-সহ কমিশন থেকে আকাদেমিতে জুড়ে দিতে পারলেই কলমের কালি শুকিয়ে যাবে। ‘শাসকের প্রতি’ আর কোনও কবিতা কিংবা নাটক, গান কিংবা ছবি দিনের আলোর মুখ দেখবে না। মূক ও বধির বুদ্ধিজীবিতার জন্য মিলবে বঙ্গশ্রী, বঙ্গবিভূষণ খেতাব দুর্নীতি, সুপারিশ কিংবা উৎকোচের বিনিময়ে চাকরি যুগে যুগে ছিল। মমতা এইভাবেই এই দুর্নীতিকে শুধুমাত্র জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির অচ্ছেদ্য অঙ্গ করে তোলেননি, এক সর্বজনীন রূপ দিয়েছেন।
বিগত বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে কাটমানি নিয়ে একপ্রস্থ খুব হইচই হল। বিভিন্ন জেলায় পঞ্চায়েত প্রধান থেকে সদস্যরা বেশ হেনস্থার মুখে পড়েছিলেন। মমতা স্বয়ং কাটমানির বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। কিন্তু, একজনের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অনেকেই বেআইনি উপায়ে নেওয়া অর্থ ফিরিয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। আমপান-ত্রাণ আর এক মস্তবড় উদাহরণ। পঞ্চায়েতের পর পঞ্চায়েত, তৃণমূল দলীয় নেতৃত্ব ত্রাণের কোটি কোটি টাকা তছরূপ করেছিল। চরম দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ যখন জেলায় জেলায় বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন, উত্তমমধ্যম দেওয়া শুরু হল, তখন বিপাকে পড়ে হুকুম দেওয়া হল, তছরূপকারীদের ত্রাণের অর্থ ফেরত দিতে হবে। সংবাদমাধ্যমে এই দুর্নীতির যেটুকু খবর প্রকাশিত হয়েছে, দুর্নীতির বহর ছিল তার থেকে ঢের বেশি। এরপর প্রশাসনিক চাপে লাইন দিয়ে টাকা ফেরত দেওয়া শুরু হল। যত লুট হয়েছিল, ততটাই ফেরত এসেছে এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু, প্রশ্ন হল, যারা এইভাবে ত্রাণের অর্থ তছরূপ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কি একটিও অভিযোগ দায়ের হয়েছে? হলে, পঞ্চায়েতের পর পঞ্চায়েত উজার হয়ে যেত। আজ ১০০ দিনের প্রকল্পের কাজে চরম দুর্নীতি, লক্ষ লক্ষ ভুয়ো জবকার্ডের উপস্থিতি ধরা পড়ার পর কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক ওই প্রকল্প আটকে দেওয়ার ফলে, আপোষ-মীমাংসার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে ছুটতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। বরফ যেমন গলেনি, তেমনি রাজ্য সরকার যে কোমর বেঁধে দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে তাও হয়নি। এই গণদুর্নীতি, দুর্নীতিগ্রস্তদের দলীয়, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আইনি শাস্তির হাত থেকে রক্ষা করা এবং রেহাই দেওয়া মমতার জনপ্রিয়তার এক অন্যতম প্রধান কারণ।
সিবিআই-ইডি তদন্তে, বাগ কমিটির রিপোর্টে, হাই কোর্টের রায়ে যেখানে শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতি দৃষ্টত প্রমাণিত, মুখ্যমন্ত্রী ‘আমি চাই না কারোর চাকরি যাক’ মন্তব্যে যা পরোক্ষে স্বীকার করে নিচ্ছেন—সেখানে দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? কেন সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে হেনস্থার ঘটনা ঘটল? কেন বারবার সিঙ্গেল বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে গিয়ে মুখ পোড়াল সরকার?
এই সবকিছুর কারণ একটাই, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের এক সর্বব্যাপী, রাজ্যজোড়া জাল ছড়াতে ছড়াতে তৃণমূল কংগ্রেস দল ও সরকার আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেই বাঁধা পড়ে গিয়েছে। এবং এই সত্যকে অস্বীকার করার আর কোনও উপায় নেই। শিক্ষা-নিয়োগেই তো শুধু নয়, কয়লা ও গরু পাচারের মতো, বেআইনি পাথর-বালি খাদানের মতো চিরাচরিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও দল হিসাবে তৃণমূল গলা জলে ডুবে আছে। অতীতে ডান-বাম ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলি এই জাতীয় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে যথেষ্ট মদত দিয়েছে সন্দেহ নেই, এমনকি নানাভাবে লাভবানও হয়েছে। কিন্তু, তৃণমূলের মতো সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে অপরাধ ও অপরাধীদের সঙ্গে আসঙ্গ জড়িত হয়ে পড়েনি। অন্যরা যেখানে এই অপরাধীদের প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে রেখেছিল, সেখানে তৃণমূল এদের শুধু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী করে তোলেনি, দলের প্রভাবশালী রাজনীতিকদের এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকতে প্রশ্রয় দিয়ে গিয়েছে। এবং অনুব্রত-কাণ্ডে প্রমাণিত এখনও দিয়ে চলেছে।
এ কথা ঠিক, আইন ও আদালত এবং কেন্দ্রীয় এজেন্সির বেড়াজালে তৃণমূল দলটি ও সরকার এখন বন্দি। কিন্তু, বিধাননগরে অনশন আন্দোলনরত চাকরি প্রার্থীদের নির্মমভাবে হঠিয়ে দিয়ে সরকার যে শ্বেতসন্ত্রাসের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে—আগামি দিনে তা আরও ধারালো হবে। মোদী ভাল, শাহ দুষ্টু কিংবা আরএসএস খারাপ নয়—জপতে জপতে কখন রাজনীতির খেলা ঘুরে যাবে তা বুঝে ওঠা দুষ্কর। এই প্রবল দাম্ভিক, ক্ষমতার মদে মত্ত শাসকের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগঠিত সংগ্রাম গড়ে না তুলতে পারলে, যা ঘটে চলেছে তা আরও বেশি বেশি করে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। একজোট হয়ে চাকরি প্রার্থীদের মরণপণ ম্যারাথন অবস্থান আন্দোলন, অনশন, আইনি লড়াই থেকে কি বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি শিক্ষা নেবে? প্রাক্তন হলেও শিক্ষা-দুর্নীতিতে আপাতদৃষ্টিতে অপরাধী শিক্ষামন্ত্রী থেকে উপাচার্য, বিধায়ক ও শিক্ষা-প্রশাসনের মাথাদের জেলে পোরা যায়—তা হবু শিক্ষকদের আন্দোলনই না প্রমাণ করল। ইতিহাসে এমন কোনও দৃষ্টান্ত আছে কি?
ছবি – তীর্থঙ্কর দাস