কন্যা শিশু দিবস পালনের সঙ্গে ভাবব কি মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা?


  • October 11, 2022
  • (0 Comments)
  • 818 Views

…বহুজাতিক বিজ্ঞাপন সংস্থার দৌলতে নারীর এই তথাকথিত ‘দশভুজা’ হয়ে ওঠা চেহারাটিকেই আধুনিক করে তোলা হচ্ছে। এ এক আশ্চর্য ফাঁদ। আর এই ফাঁদে আটকে পড়ে নিজেদের ক্রমাগত প্রমাণ করার জন্য, পরিবারে, কাজের জায়গায় দায়িত্ব পালনে কোনওভাবেই যাতে অসফল না হতে হয়, তার জন্য, ক্রমাগত নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা করে যেতে থাকেন বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা। এবং সবচেয়ে চিন্তার কথা হল, এটি যে ঘটছে তা নিয়েও অধিকাংশ সময়ে তাঁরা নিজেরাও অবগত থাকেন না। হয়তো যখন বুঝতে পারেন তখন অনেকটাই ক্ষতি হয়ে যায়। লিখছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

 

আর্ন্তজাতিক কন্যা শিশু দিবস দিনটির সঙ্গে যেন জড়িয়ে যায় জামলো মাকদামের নাম। ১২ বছরের যে মেয়েটি কোভিড লকডাউনের সময় হেঁটে হেঁটে নিজের গ্রামে ফিরতে গিয়ে পথেই মরে যায়। জামলো তার ছত্তিশগড়ের গ্রাম থেকে ১৫০ কিমি দূরে তেলেঙ্গানার এক গ্রামের লঙ্কা খেতে কাজ করতে গিয়েছিল। এপ্রিল মাসে অন্যান্য খেত মজুরদের সঙ্গে জামলো হেটেঁ হেঁটেই বাড়ির দিকে রওয়ানা দিয়েছিল। পাড়ি দিয়ে ফেলেছিল ১০০ কিমি পথ। ১৭ এপ্রিল বাড়ি থেকে ৫০ কিমি দূরে ছত্তিশগড়ের এক গ্রামের কাছে পৌঁছে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ১৮ এপ্রিল মারা যায় সে। দীর্ঘ পথের ক্লান্তি, আর ছাতিফাটা জলের কষ্টেই মারা গিয়েছিল সে। অন্তত, চিকিৎসকরা তাই মনে করেছেন।

 

জামলোর মায়ের কথা আমরা জানি না। জানি না ঠিক কতটা দারিদ্র্য গ্রাস করলে ১২ বছরের এক মেয়েকে বাড়ি ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে শ্রমিক হয়ে যেতে হয়। সেই কাজের জায়গায় পরিশ্রম শেষে তার শরীর, মনে কী প্রভাব পড়ত আমরা জানি না। জানি ১২ বছরের জামলো বাড়ি পৌঁছতে চেয়েছিল। আমরা জানি না নিজের শিশুকন্যাটির এই মৃত্যুর পর তার মায়ের মানসিক স্বাস্হ্য ঠিক কেমন আছে। জামলোর মৃত্যু শিরোনাম তৈরি করে। বাকিটা খবর হয় না।

 

১১ অক্টোবর আর্ন্তজাতিক কন্যা শিশু দিবস। ঠিক তার এক দিন আগে ১০ অক্টোবর মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। আপাতভাবে দু’টি আলাদা দিন এবং সে অর্থে দেখলে আপাতভাবে সম্পর্কহীন। বাস্তব যদিও আলাদা কথা বলে। আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমরা যখন সদা সর্বদা কোনও এক যোগসূত্রে বাঁধা থাকার কথা বলতে থাকি তখন এই দিনগুলি এবং তার সঙ্গে যুক্ত কারণগুলি তো অবশ্যই সম্পর্কিত হয়ে পড়ে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, ভৌগোলিক অবস্থান একেক দেশে একেক ভাবে এই বিষয়গুলিকে বিশেষ করে তোলে, প্রাসঙ্গিক করে তোলে। যেমন আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে এই কন্যা শিশু দিবস আর মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের যোগসূত্র অস্বীকার করার জায়গা নেই। কোভিড মহামারী পরবর্তী এই দেশে, এমনকি তার আগে থেকেও এই দু’টি বিষয় গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়ছে।

 

বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও বলে এ দেশের সরকারকে শ্লোগান তুলতে হয়। কারণ— এ দেশে মেয়েদের বেঁচে থাকা ও লেখাপড়া শেখার মতো মৌলিক অধিকারটুকুও বহু ক্ষেত্রে থাকে না। আইন করে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ ও কন্যাভ্রূণ হত্যা বন্ধের কথা বলা থাকলেও কাজের সুবাদে শহর, গ্রাম, মফস্বলে গিয়ে দেখেছি উচ্চ শিক্ষিত থেকে অক্ষর পরিচিতিহীন পরিবার, ধনী থেকে দরিদ্র – সমাজের নানা স্তরে কন্যাশিশুর জন্ম এখনও এক অপরাধ, এবং খাতায়-কলমে হাসপাতালে না হলেও গোপনে কন্যাভ্রূণ হত্যা এখনও চলে। তা খবর হয় না, অথচ কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য বা পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার চাপে অসংখ্য মহিলার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, এমনকি প্রাণও দিতে হয়।

 

এই মহিলাদের, মায়েদের মনের উপরে প্রতিনিয়ত যে চাপ তৈরি হতে থাকে তার খবর কেউ রাখে না। ঘর-সংসার করে যেতে হয় নিয়ম মেনে, যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতে হয়, কিন্তু এই যে মেয়ে জন্ম দেওয়ার জন্য বা ছেলের জন্ম দিতে না পারার জন্য তাদের যে দিনরাত হেনস্থা, অপমান, অত্যাচার, এমনকি যৌন নির্যাতনের মধ্যে দিয়েও যেতে হয় তার দায় নেয় না সমাজ বা রাষ্ট্র। আর যে কন্যাশিশুটি নিজের মায়ের এই অপমান দেখতে দেখতেই বড় হয়ে ওঠে তার আত্মসম্মানবোধ, নিজের উপর নির্ভরশীলতা, আত্মবিশ্বাস—এগুলি শুরু থেকেই তলানিতে ঠেকে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়। তার কাছে তো তখন নিজের জন্মটাই সবচেয়ে বড় সমস্যাজনক বিষয়। এই কন্যাশিশুগুলির মানসিক স্বাস্থ্য অধরাই রয়ে যায়। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গেই তাদের যে কত ধরনের ট্রমা-র মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তার হদিশ মেলে না। অবশ্যই নিজেদের মনের জোরে ও পারিপার্শ্বিক কিছু সহায়তায় অনেক মেয়ে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠে, নিজেদের জীবনের রাশ নেয় নিজেদের হাতে। কিন্তু ‘মনের জোর’ কথাটাই কি অনেক সময় বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়ে ওঠে না? পরিস্থিতির শিকার হয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার কথা নিশ্চয়ই নয়, কিন্তু তা কাটিয়ে ওঠার জন্য মানসিকভাবে যতটা লড়াই করতে হয়, নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে প্রতিদিন নতুন করে শুরু করতে হয় – সেই কথাগুলি সামনে আসে না। যেন তা গোপনে রেখে দেওয়ার কথা, যেন তা অস্বস্তির, লজ্জার। এভাবেই মেয়েরা আর তাদের মানসিক স্বাস্থ্য পেছনের সারিতে রয়ে যায়।

 

অথচ ভাবা হয় না এই পরিস্থিতি বদলানোর দায় ছিল সমাজের, রাষ্ট্রের, সরকারের। আইন আছে, তার প্রয়োগ যাতে যথোচিত হয় মেয়েদের বেঁচে থাকা আর শিক্ষার অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য সে কথা বারেবারেই মনে করিয়ে দিতে হয়। আসলে শুধু মেয়েদের নামে কিছু প্রকল্প তৈরি করে দিলেই বদলে যায় না তাদের জীবন। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী নানা ‘শ্রী’ দিয়ে প্রশাসনের দায়িত্ব শেষ হয় না। এই টাকা দিয়ে আটকানো যায়নি নাবালিকা পাচার, নাবালিকা বিবাহ, যৌন নির্যাতনের মতো ভয়াবহ বাস্তব। এই ধরনের প্রকল্পের টাকা অনেক ক্ষেত্রেই কীভাবে খরচ হচ্ছে তা নিয়ে কোনও নজরদারির ব্যবস্থাও নেই। ফলে সরকারি শ্লোগান, সরকারি প্রকল্প মেয়েদের সুরক্ষিত করে না যদি না তার প্রয়োগ সুনিশ্চিত ও যথাযথ হয়।

 

নিশ্চিতভাবেই অতীতের তুলনায় পরিস্থিতি বদলেছে। মেয়েদের, মহিলাদের অবস্থান অনেকটা সুদৃঢ় হয়েছে। কিন্তু যা স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল, তার জন্য দীর্ঘ লড়াই থামে না, প্রজন্মের পর প্রজন্মে তার রূপ বদলে যায় শুধু। মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে অনেক বেশি সচেতন হওয়ার প্রয়োজন আছে পরিবার, সমাজ, নাগরিক সমাজ, সরকার, প্রশাসন, রাষ্ট্রর— সে কথা কখনওই বৃহত্তর পরিসরে উঠে আসে না। যথাযথ কাউন্সেলিং, চিকিৎসা, পরিবার তথা কর্মক্ষেত্রে সহায়ক পরিবেশ তৈরির প্রয়োজনীয়তা আলোচনায় আসে না। নারী অধিকার আন্দোলনেও সব সময়ে মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি যে গুরুত্ব পেয়েছে তাও নয়। বিগত বেশ কয়েক বছরে নানা কারণে নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত একটি অংশ ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তাঁরা এই দু’টি ক্ষেত্রর মধ্যে স্পষ্ট যোগসূত্রটি দেখিয়ে দেওয়ার কারণে এই বিষয়ে আলোচনা ও আন্দোলন দুই’ই জোরদার হয়ে উঠেছে। গুরুত্ব অনুধাবন করা যাচ্ছে।

 

একটি কন্যা শিশু জন্মানোর পর থেকেই তার উপরে নানাভাবে যে চাপ ও দায়িত্ব এসে পড়তে থাকে তাতে টিকে থাকার জন্যই যেন তাকে প্রতিনিয়ত নানা পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সমাজ যতই প্রগতিশীল, আধুনিক হয়ে উঠুক না কেন সেই যে মেয়েদের ঘরে-বাইরে সব দিক সামলে চলার গুরুদায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার বিষয়টি মাথার মধ্যে চেপে বসে আছে, তা থেকে বেরোনোর উপায় নেই। বরং বহুজাতিক বিজ্ঞাপন সংস্থার দৌলতে নারীর এই তথাকথিত ‘দশভুজা’ হয়ে ওঠা চেহারাটিকেই আধুনিক করে তোলা হচ্ছে। এ এক আশ্চর্য ফাঁদ। আর এই ফাঁদে আটকে পড়ে নিজেদের ক্রমাগত প্রমাণ করার জন্য, পরিবারে, কাজের জায়গায় দায়িত্ব পালনে কোনওভাবেই যাতে অসফল না হতে হয়, তার জন্য, ক্রমাগত নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা করে যেতে থাকেন বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা। এবং সবচেয়ে চিন্তার কথা হল, এটি যে ঘটছে তা নিয়েও অধিকাংশ সময়ে তাঁরা নিজেরাও অবগত থাকেন না। হয়তো যখন বুঝতে পারেন তখন অনেকটাই ক্ষতি হয়ে যায়।

 

মানসিক স্বাস্থ্যজনিত কোনও প্রতিবন্ধকতা যদি কোনও মহিলার থাকে তাহলে এখনও তা নিয়ে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে যথেষ্ঠ লজ্জা ও অস্বস্তির পরিবেশ থাকে। এ যেন এক মহা অপরাধ। কাউন্সেলিং বা চিকিৎসা তো পরের ধাপ, তা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও অনেক সময়েই অনীহা দেখা যায়। বরং সেই মেয়েটিকেই নিন্দা, সমালোচনা, তীর্যক মন্তব্য, অপমান, হাসি-মস্করা সহ্য করতে হয়। পড়াশোনা, খেলাধূলা, পারিবারিক, সামাজিক জীবন, কাজের জায়গায়– বিভিন্ন ক্ষেত্রেই একঘরে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে পুরো মাত্রায়। আর এ কথাও অস্বীকার করার জায়গা নেই বিষয়টির গভীরে না গিয়ে, তার বহুমাত্রিকতাকে বিশ্লেষণ না করে, কার্যকারণ ও চিকিৎসার গুরুত্ব বিষয়ে সচেতনতা না এনে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকেও প্রায় ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। এর ফলে বিষয়টি তো বটেই সেই সঙ্গে মেয়েদের জীবনের সঙ্গে এর ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকাটিও হয় উপেক্ষিত থাকছে বা একমাত্রিক হয়েই থাকছে। সাধারণের মধ্যে, মূলস্রোতে এখনও সচেতনতার অভাব স্পষ্ট চোখে পড়ে।

 

গত দু’বছরে কোভিড মহামারী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনা কতটা জরুরি। এবং এক্ষেত্রেও মহিলাদের বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ মহামারীকালীন সময়েও পারিবারিক হিংসা হোক অথবা বিভিন্ন ধরনের কর্মক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা সেখানে বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থানের মেয়েদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সেহেতু তাদের মানসিক স্বাস্থ্য কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের কী ধরনের কাউন্সেলিং, চিকিৎসা, পরিবেশ প্রয়োজন তা নিয়ে ধীরে ধীরে আলোচনা শুরু হয়েছে। কারণ মহামারী আমাদের যত ঘরবন্দি করেছে, ততই এই বিষয়গুলি স্পষ্টভাবে দেখা গেছে। যদিও তা চিহ্নিত করা ও সচেতন হতে চাওয়ার প্রয়াস অবশ্যই সর্বস্তরে হয়নি। তা একবারে সম্ভবও নয়। সেই কারণেই মেয়েরা ও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টির মধ্যে যে আন্তঃযোগ রয়েছে তা নিয়ে বারেবারে বিভিন্ন স্তরে কথা বলে যেতে হবে, লিখতে হবে, আন্দোলনের অংশ করে তুলতে হবে। নারী আন্দোলন ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রেও যোগসূত্রটিকে জোরদার করতে হবে। যে কোনও একটি লেন্স দিয়ে বিষয়টিকে দেখলে ফাঁক রয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এবং সেই ফাঁক দিয়েই সরকার, প্রশাসন, রাষ্ট্র দায়িত্ব এড়িয়ে যায়, পরিবার, সমাজ পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার নিগড় শক্ত করে, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভুল ধারণা বাড়তে থাকে, পুঁজিবাদী দাঁত-নখ বেরিয়ে আসে। তাই বারেবারে সবার সঙ্গে কথা বলে যাওয়া জরুরি, জরুরি এই বিষয়ে যারা যথাযথ কাজ করেন ও বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় মানসিক স্বাস্থ্যজনিত যে কোনও সমস্যা সব বয়সের মেয়েদের, সব আর্থ-সামাজিক অবস্থানের মেয়েদের চিনতে সাহায্য করা ও তা নিয়ে লজ্জা, ভয়, অস্বস্তি কাটিয়ে কথা বলা। মেয়েদের অধিকারের লড়াইতে মানসিক স্বাস্থ্য থাকুক প্রথম সারিতেই।

 

Share this
Leave a Comment