সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট
গত কয়েক বছরে শহরাঞ্চলে, বিশেষত শহর কলকাতায় বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের যাতায়াত, কাজকর্ম, পাড়া-প্রতিবেশ, পরিবার ইত্যাদি বিভিন্ন পরিসরে যেসব বাধা ও বিশেষত হিংসার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে তা অনেক সময়েই আলোচনার বাইরে রয়ে যায়। বিশেষ কোনও ঘটনা না ঘটলে যা মূলত নেতিবাচক কিছু তার পরেই খবর হয় আর কিছুদিন সরগরম থাকার পর, আবার সব কিছুই চুপচাপ হয়ে যায়। সরকার বা প্রশাসনেরও বিশেষ মাথাব্যথা থাকে না। মহিলাদের উপর লিঙ্গ পরিচিতি ও যৌনতা ভিত্তিক হিংসা ও বৈষম্যর বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি ও তা বন্ধ করার লক্ষ্যে কাজ করেন যারা তারা সব সময়েই চেষ্টা করেন বিষয়টিকে আলোচনার পরিসরে রাখার। তবে নির্দিষ্টভাবে মহিলাদের বিষয় বলেই হয়তো অনেক সময়েই তা তেমনভাবে আলোয় আসে না। ‘ছোট’ ঘটনা হিসাবেই রয়ে যায় আর হিংসা, বৈষম্য বাড়তেই থাকে প্রতিদিন।
শহরের প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত ও স্বল্প আয়ের পরিবারের মেয়েরা প্রতিদিন যে ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয় ঘরে ও বাইরে তার উপরেই সম্প্রতি একটি সমীক্ষা করেছিল নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন পরিচিতি। শহর কলকাতার ৫টি এলাকায় একটি সেফটি অডিট ও ১৭টি এলাকায় পার্টিসিপেটরি আর্বান অ্যাপরেইজাল করা হয়েছিল এই সমীক্ষায়। দুই ভাগে বিভক্ত এই সমীক্ষায় পারিবারিক নির্যাতন, বসবাসের এলাকার ভেতরে সমস্যা ও নির্যাতন ও বসবাসের এলাকার বাইরে সমস্যা ও নির্যাতন – কী কী হয় ও কেন হয় সেগুলিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। নির্দিষ্ট এলাকাগুলির কিশোরী মেয়ে, মহিলা ও বয়স্ক মহিলারা এই সমীক্ষায় নিজেরা অংশগ্রহণ করে নিজেদের সমস্যাগুলির কথা জানিয়েছেন।
মেয়েদের উপর প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া হিংসার ঘটনার মধ্যে যে ছোট ছোট পরতগুলো রয়ে যায়, যাকে অনেক সময়েই হিংসা বা বৈষম্য হিসাবে চিহ্নিত করতে অসুবিধা হয় শুধু বৃহত্তরভাবে সমাজেরই নয় হয়তো মহিলাদের নিজেদেরও, সেগুলিকে চিনতে শেখাও জরুরি মনে হয় এই পরিপ্রেক্ষিতে। শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মহিলারা যখন নিজেদের নিরাপত্তাহীনতা, তাদের উপর ঘটতে থাকা নির্যাতনের কথাগুলি বলেন তখন বোঝা যায় সামগ্রিকভাবে কোন্ কোন্ কারণগুলি এরজন্য দায়ি থাকছে, সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কোথায় মহিলাদের সঙ্গে বৈষম্য করছে এবং প্রশাসনিকভাবেও গাফিলতি রয়ে যাচ্ছে কোথায়। সমস্যাগুলি নতুন নয়, কিন্তু সেগুলিকে চেনা জরুরি।
সেফটি অডিট যে পাঁচটি এলাকায় করা হয়েছে সেখানে মহিলাদের নিত্যদিনের যাতায়াত ও বসবাসের ক্ষেত্রে এলাকায় যে সমস্যাগুলির মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সেগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অডিটে ৮৩ জন মহিলা অংশ নিয়েছিলেন। বয়ঃসন্ধি, ১৮ থেকে ৫০ বছর ও ৫০ ও তার উর্দ্ধের মহিলাদের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে মূলত ন’টি সমস্যার কথা –
১) আলো (স্ট্রিট লাইট)
২) স্বচ্ছন্দ্যে, সুরক্ষিতভাবে যাতায়াত
৩) দৃশ্যমানতা
৪) ভিড় ও লোকজনের উপস্থিতি
৫) মহিলা, পুরুষ ও অন্য লিঙ্গ পরিচিতির মানুষদের সমান উপস্থিতি
৬) নিরাপত্তা
৭) হাঁটাচলার রাস্তায় অনুকূল পরিবেশ
৮) গণ পরিবহনের কাছাকাছি থাকা
৯) শৌচালয়
সমীক্ষায় যে অসুবিধাগুলির কথা বিভিন্ন বয়সের মহিলারা এই পাঁচটি এলাকা থেকেই বলেছেন সেগুলি হল – ইভ টিজিং বা যৌন অর্থবাহী কটূক্তি, পুরুষদের যৌনাঙ্গ প্রদর্শন, যৌন হেনস্থা, প্রকাশ্য রাস্তায় মদ ও অন্যান্য নেশা করা ও জুয়া খেলা যার জন্য মেয়েদের সন্ধ্যা বা রাতে রাস্তায় বেরোনো সমস্যাজনক হয়ে যায় যা তাদের খোলামেলা ও স্বাধীন যাতায়াতকে বিঘ্নিত করে, অতিরিক্ত মদ ও অন্যান্য নেশার কারণে পারিবারিক হিংসার ঘটনা বেড়ে যাওয়া।
পার্টিসিপেটরি আর্বান অ্যাপরেইজাল-এর সমীক্ষাটি করা হয় ১৭টি এলাকায়, অংশগ্রহণ করেন ২১৯ জন মহিলা। এই সমীক্ষায় মূলত বাড়ির ভেতরে বিভিন্ন বয়সের মহিলাদের যে ধরনের নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেগুলিকে জানার চেষ্টা করা হয়েছে। সন্তানদের মারা, অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলা, মদ খেয়ে অকথ্য গালিগালাজ, স্ত্রীদের মারা, কটূক্তি, মানসিক নির্যাতন, শাশুড়িদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতন, মদ খেয়ে শারীরিক নির্যাতন, বয়স্ক মহিলাদের উপর শারীরিক নির্যাতন, আর্থিক হেনস্থা, স্ত্রীকে বন্ধক রাখা, যৌন নির্যাতন, বয়স্ক মহিলাদের খাবার না দেওয়া, স্ত্রীদের খাবার না দেওয়া – এই ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্যগুলি এই সমীক্ষায় উঠে আসে। এর মধ্যে শারীরীক নির্যাতন ও মানসিক নির্যাতন যথাক্রমে সবচেয়ে বেশি হয় বলে মহিলারা জানিয়েছেন। যৌন নির্যাতনকে অনেক ক্ষেত্রেই তারা শারীরিক নির্যাতনের সঙ্গেই চিহ্নিত করেছেন এবং এ ক্ষেত্রেও যৌন নির্যাতনকে আলাদা করে চিনতে না পারার ক্ষেত্রে যে সচেতনতার অভাব মহিলাদের মধ্যেই এখনও রয়েছে সেই বাস্তব ছবিটিই উঠে আসে।
দুই ভাগের এই সমীক্ষা থেকে আপাতত যে ৬’টি প্রস্তাবনা উঠে এসেছে সেগুলি হল –
১) এলাকাগুলিতে পুলিশের টহলদারি বাড়াতে হবে ও নিয়মিত করতে হবে
২) রাস্তায় যথেষ্ঠ পরিমাণে আলোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং পৃথক ও পরিষ্কার কমিউনিটি শৌচালয়ের ব্যবস্থা করতে হবে মহিলাদের জন্য
৩) পুলিশ স্টেশন ও পুলিশকর্মীদের অনেক বেশি সংবেদনশীল হতে হবে মহিলাদের ইস্যুগুলি নিয়ে, প্রয়োজনে তাদের এ বিষয়ে সচেতনতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে
৪) এলাকার মানুষদের বোঝাতে হবে মহিলাদের স্বাধীন ও নিজেদের ইচ্ছে মতো চলাফেরার অধিকার থাকার কথা, নীতিপুলিশগিরি কেন ঠিক নয় বোঝাতে হবে
৫) পুলিশকে অতি দ্রুত বেআইনি মদ তৈরির কারখানাগুলি বন্ধ করতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে পুরুষদের যে দলগুলি নারী অধিকার নিয়ে কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের ক্রমশ বাড়তে থাকা পারিবারিক হিংসার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করতে হবে
৬) পারিবারিক নির্যাতন ও শিশুদের মারার বিরুদ্ধে শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যেই একজোট হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে
সমীক্ষাকারী সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয় আগামী দিনে শহরের আরও বিভিন্ন এলাকায় এই সমীক্ষা চালিয়ে একটি সামগ্রিক চিত্র উপস্থাপনের প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে। সমীক্ষা সম্পূর্ণ হলে স্থির করা হবে পরবর্তী পদক্ষেপ, যার মধ্যে হয়তো থাকতে পারে সরকারের কাছে দাবিসনদ পেশ করা। কারণ এলাকাভিত্তিকভাবে মহিলাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার প্রশ্নে যে বিষয়গুলি চিহ্নিত হচ্ছে সেখানে পুলিশ-প্রশাসন, পৌরসভারও দায়িত্ব রয়ে যাচ্ছে।
যে এলাকাগুলিতে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে ও হবে সেখানে পুরুষেরা মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন আর মহিলারা বেশিরভাগই গৃহশ্রমিকের কাজ করে উপার্জন করেন। এলাকাগুলিকতে পুরুষদের যে দলগুলি নারী অধিকার নিয়ে কাজের সঙ্গে যুক্ত তার সদস্যদের বক্তব্য অনুযায়ী গত কয়েক বছরে মদ ও অন্য নেশা ও জুয়ার প্রকোপ অত্যন্ত বেড়েছে। তৎপর হয়ে দ্রুত এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন বয়সের পুরুষদের সচেতন করতে না পারলে মহিলাদের উপর ঘরে ও বাইরে নির্যাতন বন্ধ সম্ভব নয় বা তাদের স্বাধীন ও নিরাপদ চলাফেরার অধিকারকেও সুরক্ষিত করা যাবে না। মহিলাদের কথাতেও স্পষ্ট মদ ও অন্যান্য নেশার জন্য পারিবারিক হিংসার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে আর তারজন্য মহিলাদের জোটবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করতে হবে। জুয়া বা সম্প্রতি ‘পাবজি’ খেলার ঠেক তৈরি হয়ে গেছে পাড়ায় পাড়ায়, সেখান থেকে বয়ঃসন্ধির মেয়েরা একা যখন টিউশন-এ যায় বা ভালো পোশাক পরে বেরোয় তখন কটূক্তি ভেসে আসে। বিশেষত মোবাইল ফোন-এর অতিরিক্ত ব্যবহার অল্প বয়সেই ছেলেদের মধ্যে মেয়েদের প্রতি এ ধরনের ব্যবহার বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। এক্ষেত্রে পরিবারের অভিভাবকদের মানসিকতা বদলাতে হবে ও সচেতন করতে হবে। ‘অত্যাচার হলে আমরা আর মানব না। বাড়িতে হোক বা বাইরে। পড়ে পড়ে মার খাব না। সব বয়সের মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য একজোট হয়ে লড়ব, প্রতিবাদ করব,’ বললেন এই গোষ্ঠীর জয়া, পূর্বাশা – অন্য সব মহিলার কথাই যেন বেজে উঠল।