হাজারো শ্রী-প্রদীপের নীচে এত অন্ধকার জমল কবে, কী ভাবে? সরকার এই প্রশ্নের উত্তর দেবে এমন আশা করাটাই বৃথা। শাসক তো ছবির মতো স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েইছে, এমন বেয়াদপ প্রশ্ন করলে তার উত্তর শরীরের ঠিক কোন স্থান বিদ্ধ করবে। লিখেছেন দেবাশিস আইচ।
শিরোনামটি ধার করা। চার দশক আগে দেশ পত্রিকায় এই শিরোনামেই একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন অর্থনীতিবিদ অশোক রুদ্র । বিপন্ন অর্থনীতি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব প্রত্যক্ষ করে তাঁর মনে হয়েছিল দেশটা যে অসন্তোষের আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠেছে, সে বিষয়ে যেন কোনও স্থির ধারণাই নেই শাসকগোষ্ঠীর। তাঁরা দিব্য আছেন।
পশ্চিমবঙ্গ নামক প্রমোদরাজ্যটির বাসিন্দা হয়ে প্রবচন হয়ে ওঠা এই শিরোনামটি বার বার মনে পড়ে যায়। দেশে অনাবৃষ্টির কারণে খরিফ চাষ সঙ্কটে। সঙ্কটাপন্ন রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম। মানে ধান উৎপাদন এ বছর লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছবে না। ওদিকে সরকারি পরিসংখ্যান বলছে দেশের খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার ফের মাথা চারা দিয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গে যা সহনসীমা মাত্রার উপরে পৌঁছে গিয়েছে। বিগত দু-আড়াই মাসে নানা ধরনের চালের দাম ৫-১০ টাকা বেড়েছে। এবং আগামিদিনে কৃষিসঙ্কটের কারণে আরও বাড়ার সম্ভাবনাও বিস্তর। অথচ, রাজ্যের কৃষি উপেদেষ্টা এক রকম র্ভৎসনার সুরেই জানিয়ে দিয়েছেন, হা-হুতাশ করার মতো কিছু হয়নি। আর এগিয়ে থাকা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পুজোর এক মাস আগে ‘পুজো শুরু’র ‘টাক ডুমা ডুম’ বাদ্যি বাজিয়ে দিয়েছেন।
কেন্দ্রের পরিসংখ্যান মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী অগস্টে দেশের খুচরো বাজারের মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশে। বলা হচ্ছে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্যই এই বৃদ্ধি। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৬২%। কেন্দ্র ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নির্ধারিত খুচরো মূল্যবৃদ্ধির সহনসীমা ৬ শতাংশ। ঘটনা এই যে বিগত আট মাস ধরে খুচরো মূল্যবৃদ্ধি সহনসীমা ৬ শতাংশের উপরে। দেশের সর্বত্র এই পরিস্থিতি সন্দেহ নেই। ২২টি প্রধান রাজ্যের মধ্যে ১০টি রাজ্যে মূল্যবৃদ্ধি দেশের গড় মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় বেশি। মূল্যবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গে (৮.৯৪%)। অন্যান্য রাজ্যগুলি হল গুজরাট (৮.২২%), তেলেঙ্গানা (৮.১১%), মহারাষ্ট্র (৭.৯৯%), মধ্যপ্রদেশ (৭.৮৩%), আসাম (৭.৭৩%), হরিয়ানা (৭.৭১%) ও উত্তরপ্রদেশ (৭.৬২%)।
এদিকে বৃষ্টির অভাবে সরকারি হিসেব মতো এই খরিফ মরসুমে দেশে ৫.৬২% কম জমিতে ধান রোপন করা গিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী কতটা কম উৎপাদন হবে তা নিয়েও দিল্লি বিভ্রান্ত। ১১ সেপ্টেম্বর সকালে খাদ্যসচিব শুধাংশু পাণ্ডে জানিয়েছিলেন, ১ থেকে ১.২০ কোটি টন উৎপাদন ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। সন্ধ্যায় খাদ্য মন্ত্রক ইঙ্গিত দিয়েছে ঘাটতি হতে পারে ৪০-৫০ লক্ষ টন থেকে ৬০-৭০ লক্ষ টন। কেন্দ্রীয় খাদ্য মন্ত্রক এ মাসের প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ-সহ চার প্রধান ধান উৎপাদনকারী রাজ্যে ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এই আশঙ্কা থেকেই বাসমতী ও সিদ্ধ চাল বাদে অন্য চালের রফতানিতে ২০% শুল্ক বসিয়েছে কেন্দ্র। আর তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে খুদ ও ভাঙা চাল রফতানিতে। কেন্দ্র জানিয়েছে খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং খাদ্য সুরক্ষা আইনে গরিবদের মুখে খাদ্য তুলে দেওয়ার জন্যই এই পদক্ষেপ। সঙ্কট যে দুয়ার পেরিয়ে অন্দরমহলে জাঁকিয়ে বসেছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
নানাজনের অভিমত এই সঙ্কট থেকে সাধারণের মনোযোগ সরিয়ে নিতে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতিতেই বেশি বেশি করে মনসংযোগ করেছে মোদী-শাহের দল। আর আমরা এ রাজ্যে ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন’। এ কোন রাজ্য? যেখানে বিগত ৭-৮ মাস যাবৎ ১০০ দিনের প্রকল্পের কাজ বন্ধ। এ কাজে নানা দুর্নীতি ও প্রক্রিয়াগত গাফিলতির নিদর্শন তুলে ধরে শুধু বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া হয়নি, বিগত আট মাসের বকেয়া প্রায় ২৬০০ কোটি টাকাও মেটায়নি কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো চাষের সঙ্কটে কাজ হারিয়েছেন, বিশেষভাবে নামালে আসা খেতমজুররা। এদিকে কেন্দ্রীয় সরকার ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’য় যে অতিরিক্ত খাদ্যশস্য রেশনের মাধ্যমে বিলি করছিল তার মেয়াদ এই মাসেই শেষ হওয়ার কথা। খাদ্য সুরক্ষায় একটি পাঁচ জনের পরিবার ২ থেকে ৩ টাকা কেজি দরে ২৫ কেজি চাল পায়। অতিমারির কারণে অন্ন যোজনায় আরও ২৫ কেজি খাদ্যশস্য বিনামূল্যে দেওয়া শুরু হয়। এবং খাদ্য সুরক্ষায় প্রাপ্ত খাদ্য শস্যও বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এবার রাজকোষে টান এবং অতিমারির পর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার ওজর দেখিয়ে অন্ন যোজনা বন্ধ করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপের ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রক।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার কথা শুনতেই ভাল লাগে, কিন্তু সরকারের তথ্যই বলে দিচ্ছে শিল্পে বৃদ্ধি এমন কোনও জায়গায় পৌঁছয়নি যে অতিমারিতে কাজ হারানো মানুষেরা কাজ ফিরে পেয়েছেন। উল্টে জুনে যে শিল্পোৎপাদন বেড়ে হয়েছিল ১২.৭% জুলাইয়ে তা এক ধাক্কায় ২.৪ শতাংশে নেমেছে। বেকারত্বের হার দেখলেই তা বোঝা যাচ্ছে। সিএমআইই-র তথ্য অনুযায়ী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৭.১%। ৩১ অগস্টের তুলনায় তা (৮.২৮%) কমলেও ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় (৬.৮৬%) তা বেড়ে গিয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত অন্যান্য তথ্য বলছে, ২০১৯-২১ সালে অন্তত ৫৬ কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে ভুগেছেন। এখানেই শেষ নয়, ২০১৫-১৭ সালে খাদ্য নিরাপত্তার চূড়ান্ত অভাবে ছিলেন ১৯ কোটি মানুষ বর্তমানে তা ৩০ লক্ষে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তায় জোর না দিয়ে অন্ন যোজনার মতো প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ার মতো ভাবনা গরিব মানুষের মুখ থেকে অন্ন কেড়ে নেওয়ারই সামিল হবে।
এ রাজ্যে আরও একটি সমীক্ষা যে কোনও সংবেদী মানুষের শরীর বেয়ে হিমস্রোত নেমে আসতে পারে। একটি অসরকারি সমীক্ষায় “গত বছর ডিসেম্বর থেকে এ বছর জানুয়ারি, এই সময়ে ষোলোটি জেলার প্রায় দু’হাজার পরিবারের থেকে সংগৃহীত তথ্য দেখা যাচ্ছে, প্রতি দশ জনে প্রায় সাত জন (৬৯%) অন্তত একটা সম্পূর্ণ দিন অনাহারে কাটিয়েছেন। খিদে থাকা সত্ত্বেও খাননি, এমন মানুষের সংখ্যা দশ জনে প্রায় ছ’জন।” (খিদের হিসাব, সম্পাদকীয়, আবাপ, ৬ অগস্ট ২০২২)। এই তথ্য বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। বিশেষত যখন রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী গত বছর খরিফ মরসুমে ‘রেকর্ড’ পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়েছে। রেশনে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য দেওয়া হয়েছে। তবুও এত মানুষ দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করতে পারল না কেন? হাজারো শ্রী-প্রদীপের নীচে এত অন্ধকার জমল কবে, কী ভাবে? সরকার এই প্রশ্নের উত্তর দেবে এমন আশা করাটাই বৃথা। শাসক তো ছবির মতো স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েইছে, এমন বেয়াদপ প্রশ্ন করলে তার উত্তর শরীরের ঠিক কোন স্থান বিদ্ধ করবে।
আগ্নেয়গিরির শিখরে পিকনিক অশোক মিত্রর লেখা নয়,প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং প্রাবন্ধিক অশোক রুদ্রর লেখা।