আধিপত্যবাদী সরকারের হাতে আদিবাসী জীবন তো বটেই প্রকৃতি-পরিবেশ চরম বিপন্ন। এ কথার সূত্র ধরেই বলা যায়—এই খনিজ সমৃদ্ধ পাহাড়-জঙ্গল যে দু’হাত ভরে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া হবে তার আগাম আন্দাজ আমাদের কাছে না থাকলেও বহুজাতিক কর্পোরেশনের কাছে ছিল। তাই ডোঙ্গারিয়া কন্ধদের মরিয়া লড়াই এবং বনাধিকার আইনের বলে নিয়মগিরি হাতছাড়া হয়ে গেলেও এতটুকু বিচলিত হননি বেদান্তের আধিকারিকরা। সেই ২০১৩ সালেই এক আধিকারিক ডাউন টু আর্থ- কে বলেছিলেন, “নরেন্দ্র মোদী অ্যাজ দ্য নেক্সট প্রাইম মিনিস্টার উইল ইজ আস আউট।“ বিশ্ব আদিবাসী দিবস-এ বিপন্নতার এক সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত লিখলেন দেবাশিস আইচ।
উন্নয়নের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে উচ্ছেদ। উন্নয়নের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে প্রাণ-প্রকৃতির ধ্বংসলীলা। উন্নয়ন ও উচ্ছেদ, বিশেষ ভাব আদিবাসী সমাজের কাছে, সমার্থক শব্দ বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। বিশেষ তফসিলে অন্তর্ভুক্তি থেকে বনাধিকার আইন। সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিল থেকে সমতা আইন, পেসা আদিবাসীদের রক্ষাকবচ কিছু কম নেই। এই রক্ষাকবচ আদিবাসীদের রক্ষা করেনি। উত্তরপূর্ব ভারতের আদিবাসী বা জনজাতি প্রধান রাজ্যগুলি ইংরেজ আমল থেকেই বহিরাগতদের জন্য ‘ইনার লাইন পারমিট’ ব্যবস্থার জেরে, যা আজও অরুণাচল, মিজোরাম, নাগাল্যান্ডে বহাল এবং সম্প্রতি মণিপুর রাজ্যও সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে—যা তাঁদের ভাষা-সংস্কৃতি-জমিজমা রক্ষা করতে পেরেছে। স্বাধীন ভারতে ষষ্ঠ তফসিলের জোরে তাঁদের জায়গা-জমি থেকে উৎখাত হতে হয়নি। পূর্ব ও মধ্যভারতে তেমনটি হয়নি। ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশার মতো রাজ্যগুলিতে যেখানে আদিবাসীদের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে বেশি কিংবা মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্রে অর্থাৎ পূর্ব ও মধ্যভারতে আদিবাসীরা চরম নিপীড়ণের শিকার। এই সেই অঞ্চল, যে অঞ্চল খনিজ ও বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। ইংরেজ আমল থেকেই এই সম্পদের লুন্ঠন এবং আদিবাসী সমাজের বাসচ্যুতি সমার্থক হয়ে গিয়েছে। আজও এই মিনারেল করিডর সম্পূর্ণ ভাবে দখলে আনতে রাষ্ট্র তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে চলেছে। বহু বহু আদিবাসী বিদ্রোহ দেখেছে এই অঞ্চল। বহু পরাজয়ও রয়েছে তবুও লড়াই থেমে যায়নি। তবে, আরও অনেক ক্ঠিন হয়ে পড়েছে। সারা দেশ জুড়েই আদিবাসী জনসমাজ ‘অমৃতের মহোৎসব’ উদ্গাতাদের হাতে এখন চরম বিপন্ন। আইনের রক্ষাকবচগুলি, সে আদিবাসী বিষয়ক আইন হোক কিংবা বন ও পরিবেশ, জমিজমা সংক্রান্ত আইন, সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারগুলি তছনছ করে—প্রতিটি জল-জঙ্গল-জমি-পাহাড় কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর এই আধিপত্যবাদী কেন্দ্রীয় সরকার। সরকারি নথিতে অবশ্য আদিবাসী শব্দের স্বীকৃতি নেই। বলা হয় ট্রাইবস। আদিবাসী বললে আর্যতত্ত্বে ঘা লাগে যে। আর আর্যামির গোঁড়া সমর্থকরা বলেন ‘বনবাসী’। নানা লক্ষণ বলছে যত সময় যাবে, ‘উন্নয়নের অজুহাতে’ জল-জঙ্গল-জমি-পাহাড় তুলে দেওয়া হবে দেশি-বিদেশি বণিকের হাতে। সে আইন বাঁকিয়ে হোক বা নয়া বেআইনের আইন তৈরি করে হোক। নিষ্ঠুর পরিহাস এই যে সেইসব বেআইনকে আইনের শিলমোহর এবং প্রকৃতি-পরিবেশ ও আদিবাসীদের মৃত্যু পরোয়ানায় এখন থেকে স্বাক্ষর করবেন সাঁওতাল ‘বনবাসী’ রমণী ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু।
সে কাজ মোদী.০২ আমলে অতি দ্রুত গতিতেই শুরু হয়ে গিয়েছে। বিগত তিন বছরে, ২০১৯-২০২১, ৫৫৪.৩ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি খনি-রাস্তা-সেচ প্রকল্পে বদলে ফেলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বনভূমি, ১১২.৭৮ বর্গ কিমি, পরিবর্তিত করা হয়েছে খনি প্রকল্পের জন্য। ১০০.০৭ বর্গ কিমি সড়ক নির্মাণ, ৯২.২৭ বর্গ কিমি সেচ, ৬৯.৪৭ বর্গ কিমি প্রতিরক্ষা, ৫৩.৪৪ বর্গ কিমি জলবিদ্যুৎ, ৪৭.৪০ বর্গ কিমি বিদ্যুৎ পরিবহন, ১৮.৯৯ বর্গ কিমি রেল প্রকল্পের জন্য বনভূমি থেকে অ-বনজ কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এটি সরকারি তথ্য। ১৮ জুলাই ২০২২, সংসদে এই তথ্য পেশ করেছেন কেন্দ্রীয় বন,পরিবেশ ও জলবায়ু দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী অশ্বিনী চৌবে।
এই তথ্য ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক-আর্থনীতিক-রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি, সেই বোধবুদ্ধি থেকে সঞ্জাত অনুধাবন ক্ষমতা থেকে এমন বার্তা পৌঁছে দিতে পারেই যে—বাঃ, দেশ উন্নয়নের পথে—নিছক রাস্তায় দাঁড়িয়ে নেই—বেশ টগবগিয়ে ছুটে চলেছে।
সকলেরই যে এমন মনে হবে, তেমন মনে করার করার কোনও কারণ নেই। কেউ কেউ মনে করতেই পারেন, বা তাঁদের সন্দেহ হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে যে, এই উন্নয়নের জেরে এক বিপুল পরিমাণ জীববৈচিত্র পৃথিবীর বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। উচ্ছেদ হবেন শত শত মানুষ। এবং তাঁদের জীবন-জীবিকা, ধর্ম থেকে খাদ্যসংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে। এ কথাও মনে করার কারণ আছে যে, এই উচ্ছেদ হওয়া ধ্বংসোন্মুখ মানুষদের সিংহভাগ আদিবাসী ও দলিত শ্রেণির মানুষ। আদিবাসী ভারতে স্বাধীনতা পরবর্তী ৭৫ বছরে উন্নয়নের এই ধ্বংসাত্মক প্রভাবের প্রকৃত তথ্য কোথাও লেখা নেই। বলা ভাল, উন্নয়নের কলের চাকা, বিদ্যুতের আলোর ঝলকানি, সবুজ বিপ্লব, দ্রুতগামী রথ ও পথ, আকাশছোঁয়া অট্টালিকা ও স্মার্ট সিটি আর এক অন্য ইতিহাস গড়ে তুলেছে। তার তাবড় তথ্য মিলবে সরকারি দলিলে।
আবারও ফিরি আরও কিছু তথ্যে। এবার আর ধারণা কিংবা অনুধাবন ক্ষমতার উপর চাপ সৃষ্টি নয়। নির্ভেজাল উচ্ছেদের তথ্য। এবং সরকারি তথ্য। ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি (এনটিসিএ) অর্থাৎ, দেশের ব্যাঘ্র প্রকল্পের কর্তাব্যক্তিরা জানাচ্ছেন, ১৯৭২ সালে ব্যাঘ্র প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত, দেশের ৫০টি ব্যাঘ্রে প্রকল্প এলাকার ৭৫১টি বনগ্রামের ৫৬,২৪৭টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এবং তাদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত ১২,৩২৭টি পরিবারকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে বা স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এনটিসিএ কর্তাদের কাছে এ বড় ‘গর্বের সাফল্য’ সন্দেহ নেই। এবং এই উচ্ছেদের নীল নকশা তৈরিতে যাদের হাত আছে এবং যারা এই উচ্ছেদের পক্ষে, দেশের সেই নীতি নির্ধারক থেকে এক শ্রেণির বাগান-বিলাসী উন্নয়নকামী পরিবেশপ্রেমীদের অশিক্ষিত, অদীক্ষিত মনকে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত করে তুলতে পেরেছে, সেই ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড ফর ইন্ডিয়া (ডব্লিউডব্লিউএফ), কনজারভেশন ইন্টারন্যাশনাল, ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া, ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া, সাতপুরা ফাউন্ডেশন-এর মতো সংগঠনগুলি এই সাফল্যে যে খুশি সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে, যারপরনাই খুশি সে কথা বলা যাবে না। তারা তো চায়—যে কাজে তারা কোটি কোটি ইউরো, কোটি কোটি ডলার অক্লেশে বিতরণ করেছে, দেশের তথাকথিত এলিট ও অদীক্ষিতদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা ডোনেশন স্ংগ্রহ করেছে—প্রতিটি অরণ্যবাসী উচ্ছেদ হোক। এই ‘সংরক্ষণ মাফিয়া’ গোষ্ঠী তো অন্যতম যারা দেশের বনাঞ্চল থেকে ১১.৮ লক্ষ অরণ্যবাসী এবং অরণ্য-নির্ভর জাতি-জনজাতির মানুষের উচ্ছেদের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায় ‘কিনেছিল’। প্রকৃত অর্থে এই মামলা ছিল বনাধিকার আইন (২০১৬)-এর বিরুদ্ধে। এবং কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকারগুলি যার কোনও বিরোধিতা করেনি। উলটে এই ১১ লক্ষ ‘বেআইনি’ মানুষের জালি হিসেব পেশ করেছে। আমাদের রাজ্য সরকার বনাধিকার আইনের প্রকৃত প্রয়োগ না করেই ৮৬,১৪৬ হাজার জন ‘বেআইনি’ অরণ্যবাসীর হিসেব আদালতে পেশ করেছিল। কী কেন্দ্র, কী রাজ্য কারও সাহসে কুলোয়নি সেই রায় অক্ষরে অক্ষরে পালন করার। তা বলে মনে করার কোনও কারণ ঘটেনি যে, তারা ছলেবলেকৌশলে সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে না। যার অন্যতম বন (সংরক্ষণ) আইন (১৯৮০)-এর বিধির সংশোধনের জন্য বিল নিয়ে আসা। যা বনাধিকার আইন, ২০০৬-কে পঙ্গু করে দেবে।(১)
যে কথা বলছিলাম, বাঘবন থেকে উচ্ছেদের কথা, ১২,৩২৭ পরিবারকে পুনর্বাসনের কথা—তথ্যের খাতিরে যোগ করি যে, এর অর্থ ৪৪ হাজারেরও বেশি পরিবারের, মোটামুটি ২২০,০০০ মানুষ পুনর্বাসিত হননি। এই উচ্ছেদ ও পুনর্বাসনের তথ্য যথাযথ নয়, কেননা এ সরকারি তথ্য। যারা উচ্ছেদ করেছে তাদের তথ্য। আর যাঁদের উচ্ছেদ করা হয়েছে তাঁদের পুনর্বাসন/ স্থানান্তরের কাহিনি অতি করুণ।(২) আমরা আরও একবার দেখে নিই কীভাবে সরকার হাজার হাজার হেক্টর সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে কসাইখানায় পাঠিয়েছে। সংসদে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ঠিক কোথায় কোথায় ‘উন্নয়নের স্বার্থে’ এই বনাঞ্চলের চরিত্র বদল করা হয়েছে তার ভয়াবহ চিত্র চোখে পড়বে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংক্রান্ত নোডাল এজেন্সি ন্যাশনাল ওয়াইল্ড লাইফ বোর্ড-এর ৬৬তম মিটিং (২০২২)-এর কার্যবিবরণীতে চোখ বোলালেই।(৩)
যেমন, ২০২১ সালের ৭ অগস্ট তেলেঙ্গানায় একটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণের গাঘেঁষা ৩,৩০০ হেক্টর বনাঞ্চলে কয়লাখনির করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আইনত, এই অঞ্চল ‘ইকো-সেনসেটিভ’ বা পরিবেশ-সংবেদী অঞ্চল। অর্থাৎ, কয়লাখনি তো বটেই অন্যান্য ‘উন্নয়নমূলক’ প্রকল্পের জন্যও ‘নো গো জোন’। ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি মাসে একইভাবে উত্তরাখণ্ডের রাজাজি টাইগার রিজার্ভের ঠিক বাইরে পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলের উপর দিয়ে ফোর-লেন হাইওয়ে নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এখানে বন আধিকারিকরা এই অঞ্চলে বসবাসকারী আধা-যাযাবর শ্রেণির বন-গুজ্জর আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের উচ্ছেদ করার জন্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। বনাধিকার আইন মোতাবেক বন-গুজ্জররা তাঁদের যাবতীয় দাবিদাওয়া পেশ করার পরও অত্যাচার থামেনি। অরুণাচলের দিবাং অভয়ারণ্যের মধ্যে ৬০ হেক্টর বনভূমি রাস্তা তৈরির জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। অরুণাচলেরই নামধাপা টাইগার রিজার্ভের মধ্য দিয়ে ট্র্যান্সমিশন লাইন নির্মাণের জন্যও বন কাটার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। লাদাখে সড়ক নির্মাণের জন্য কোনও পরিবেশ আইনই মানা হবে না বলে সম্প্রতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সংবাদ স্ংস্থার এক রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দিয়েছে, “সীমান্ত রাজ্যগুলিতে প্রতিরক্ষায় কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কিত জাতীয় সড়ক প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে।” নির্দেশিকায় আরও বলা হয়েছে, চিন লাগোয়া প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) এবং জম্মু-কাশ্মীরে পাকিস্তানের সঙ্গে নির্ধারক নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি)-র ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ‘সামরিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা’গুলিতে পরিবেশবিধি না মেনেই জাতীয় সড়ক নির্মাণ করা যাবে।(৪) ইতিমধ্যেই ট্র্যান্স-হিমালয়ান চ্যাংথ্যাং অভয়ারণ্যের ১৮৮ হেক্টর জমিতে রাস্তা তৈরির জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এখানে অন্যান্য সঙ্কটাপন্ন প্রাণী-সহ অতি বিরল তুষার চিতা এবং কিয়াং (হিমালয়ের বুনো ঘোড়া)-এর সংরক্ষণের জন্যই এই অভয়ারণ্যের সৃষ্টি হয়েছিল। এ ছাড়াও রাজস্থানের মুকুন্দ্রা টাইগার রিজার্ভ এবং মহারাষ্ট্রের সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশনাল পার্ককে বিপন্ন করে যথাক্রমে, গ্রিনফিল্ড এইট-লেন হাইওয়ে ও মুম্বাই-আহমেদাবাদ রেল প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
রাজস্থানের সারিস্কা টাইগার রিজার্ভ থেকে ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল থেকে একটি আস্ত গ্রাম স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছে এনটিসিএ। আরও ছ’টি সম্প্রদায় এবং তাদের গ্রামকেও এই ২০২২ সালের মধ্যেই উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা রয়েছে। অথচ, এই টাইগার রিজার্ভ ঘিরেই বহু বহু আইনি ও বেআইনি খনি চালাচ্ছে অত্যন্ত প্রভাবশালী মাফিয়ারা। প্রসঙ্গত ২০০৪ সাল থেকেই এই ব্যাঘ্র প্রকল্পে কোনও বাঘ ছিল না। এবং তা নজরে আসার পর সম্প্রতি ফের বাঘ ছাড়া হয়। এবার বাঘ সংরক্ষণের জন্য আদিবাসী গ্রাম উচ্ছেদ করা হচ্ছে কিন্তু খনি মাফিয়ারা বহাল তবিয়তেই তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল, টাইগার রিজার্ভ, অভয়ারণ্য, জাতীয় উদ্যানের জমি দখল করে বন ও বন্যপ্রাণী, অরণ্যবাসীদের বিপন্ন করে তোলার এই ‘উন্নয়নী’ প্রকল্প বিষয়ে একটি বাক্য খরচ করেনি ‘ফরট্রেস কনজারভেশন’-বাদী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলি। এখানেই শেষ নয়, এনটিসিএ-র ১৮তম মিটিং-এর (২০২০) তথ্য অনুযায়ী টাইগার রিজার্ভগুলিতে ৪৬ হাজার পরিবার রয়েছে। তাদের স্থানান্তরিত করতে অর্থাৎ জল-জঙ্গল-জমি-পাহাড় থেকে উচ্ছেদ করার জন্য আনুমানিক ৬০ বিলিয়ন কোটি টাকা প্রয়োজন।(৫)
স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়নের তাড়নায় ঠিক কত মানুষ উচ্ছেদ হয়েছেন এবং বিভিন্ন প্রকল্পে কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তার খোঁজ করার চেষ্টা করেছিল অধ্যাপক ভার্জিনিয়াস খাখা-র নেতৃত্বাধীন নেতৃত্ব ‘হাই লেভেল কমিটি অন সোশ্যাল-ইকনমিক, হেলথ অ্যান্ড এডুকেশনাল স্টেটাস অব ট্রাইবাল কমিউনিটিজ অফ ইন্ডিয়া (২০১৪)। কমিটির প্রতিবেদন বলছে, কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রদায়গত ভাবে ঠিক কত মানুষ স্থানচ্যুত/ খতিগ্রস্ত হয়েছেন সে বিষয়ে জেলা বা রাজ্যওয়ারি কোনও তথ্যের উল্লেখ করেনি। এমনকি পুনর্বাসন/ স্থানান্তর সংক্রান্ত তথ্যও দেয়নি। কমিটির মন্তব্য, এই আচরণ “বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উপর স্থানচ্যুতির ক্ষতিকর প্রভাবের প্রতি রাষ্ট্রের অবজ্ঞার পরিচয়।” শেষ পর্যন্ত উচ্ছেদ/ স্থানচ্যুতি বিষয়ে এফ ফার্নান্ডেজ, ভি পরাঞ্জপে, ওয়াল্টার ফার্নান্ডেজ প্রমুখের গবেষণা ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে হাই লেভেল কমিটিকে। রিপোর্ট জানাচ্ছে, “ফার্নান্ডেজ ও পরাঞ্জপের হিসেব মতো স্বাধীনতার পর চার দশকে বাঁধ, খনি, অভয়ারণ্য, শিল্পের কারণে ২১ মিলিয়ন মানুষ উচ্ছেদ হয়েছেন। এবং সরকারি সূত্র মতে তার ৭৫% পুনর্বাসিত হননি। মহাপাত্র সংখ্যাটি ২৫ মিলিয়ন বলে হিসেব কষেছেন। ওয়াল্টার ফার্নান্ডেজ আরও তথ্য সংযোজন, এবং রাজ্যগুলিতে বিভিন্ন গবেষণা, ক্ষেত্র সমীক্ষার ভিত্তিতে হিসেব কষে দেখিয়েছেন, স্বাধীনতার পর থেকে ২০০০ সাল অবধি উচ্ছেদ/ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৬০ মিলিয়ন। এ হিসেবও কষা হয়েছে যে, এঁদের মধ্যে ২০% দলিত, আরও ২০% মৎস্যজীবী, খাদান শ্রমিকের মতো গরিব গ্রামীণ সম্প্রদায়। গবেষকদের মতে, ভারতে আদিবাসীদের ২৫% জীবনে অন্তত একবার স্থানচ্যুত হয়েছেন। কারণ, তাঁদের বাসস্থান যে অঞ্চলে সেগুলি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। সরকারি তথ্যের অভাবে প্ল্যানিং কমিশনের রিপোর্টে গবেষকদের এই ৬০ মিলিয়ন স্থানচ্যুতির কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত ‘দ্য এক্সপার্ট গ্রুপ অব প্রিভেনশন অফ এলিয়েনেশন অফ ট্রাইবাল ল্যান্ড অ্যান্ড ইটস রেস্টোরেশন’-এর হিসেব মতো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য উচ্ছেদ হওয়া জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশই আদিবাসী।”(৫) মনে রাখতে হবে, ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতে আদিবাসীদের সংখ্যা ১০ কোটি ৪২ লক্ষ ৮১ হাজার ৩৪ জন। যা ভারতের মোট জনসংখ্যার ৮.৬ শতাংশ।
গোড়ায় যে কথা হচ্ছিল, আধিপত্যবাদী সরকারের হাতে আদিবাসী জীবন তো বটেই প্রকৃতি-পরিবেশ চরম বিপন্ন। এ কথার সূত্র ধরেই বলা যায়—এই খনিজ সমৃদ্ধ পাহাড়-জঙ্গল যে দু’হাত ভরে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া হবে তার আগাম আন্দাজ আমাদের কাছে না থাকলেও বহুজাতিক কর্পোরেশনের কাছে ছিল। তাই ডোঙ্গারিয়া কন্ধদের মরিয়া লড়াই এবং বনাধিকার আইনের বলে নিয়মগিরি হাতছাড়া হয়ে গেলেও এতটুকু বিচলিত হননি বেদান্তের আধিকারিকরা। সেই ২০১৩ সালেই এক আধিকারিক ডাউন টু আর্থ-কে বলেছিলেন, “নরেন্দ্র মোদী অ্যাজ দ্য নেক্সট প্রাইম মিনিস্টার উইল ইজ আস আউট।”(৬) বনাধিকার আইনে বনভূমির চরিত্র বদলে গ্রামসভার অনুমতির ধারাকে নসাৎ করতেই যে বন (সংরক্ষণ) আইনের বিধি বদলের জন্য মোদী সরকার বিল আনল সে বিষয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই। সংসদে তা গৃহীত হলে আদিবাসী সমাজের অস্তিত্বই চরম বিপদের মুখে পড়বে। হাই লেভেল কমিটির রিপোর্টের ভাষায়, এই জমি-জঙ্গল-পাহাড় তাদের আদিবাসী জীবনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় পরিচিতির দ্যোতক, তাঁদের জীবন-জীবিকা এবং অস্তিত্বের ভিত্তি। খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ, পশুখাদ্য, জীবিকার জন্য তাঁদের জীবন অরণ্যের সঙ্গে নিবিঢ় ভাবে সম্পৃক্ত। পাহাড় ও অরণ্য আদিবাসী সমাজ পরিচয়ের প্রধান উৎস। বনের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে এবং জমি থেকে উৎখাত হতে হলে তাঁদের জীবনে যে বিপর্যয় নেমে আসে তাকে এই প্রেক্ষিতেই দেখতে হবে। এই অধিকারচ্যুতি ঘটে দু’ভাবে, প্রত্যক্ষ ভাবে আদিবাসী সমাজকে তার জমি, বাসস্থান, জীবিকা, রাজনৈতিক শাসনতন্ত্র, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও পরিচয়সত্তা এবং পরোক্ষে ভাবে উন্নয়নের সুফল ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।
কমিটি এ কথাও মনে করে, ভারতের উন্নয়ন মডেল ইংরেজদের মতোই প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদের শোষণের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। তফাত এটাই যে, ইংরেজরা শোষণ করত তাঁদের দেশের শ্রীবৃদ্ধি এবং শিল্পবিপ্লবকে মদত দিতে। স্বাধীন ভারতে তা করা হচ্ছে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী স্ংস্থা এবং ক্রমে প্রাইভেট সেক্টরের সমৃদ্ধির জন্য।
তথ্যসূত্র :
১। নয়া অরণ্য সংরক্ষণ বিধি : আদিবাসীদের অধিকার হরণই মূল লক্ষ্য, দেবাশিস আইচ, গ্রাউন্ডজিরো, ১৮ জুলাই ২০২২।
২। ফরট্রেস কনজারভেশন : আদিবাসী উচ্ছেদের নীল নকশা, দেবাশিস আইচ, গ্রাউন্ডজিরো, ২৬ মে ২০২২।
৩। India : Whither Fortress Conservation, Soumitra Ghosh, WRM Bulletin, 2022.
৪। পরিবেশ বাঁচানোর দায়বদ্ধতা না মেনেই জাতীয় সড়ক হবে সীমান্তে, সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের, আনন্দবাজার অনলাইন, ১৯ জুলাই ২০২২।
৫। সৌমিত্র ঘোষ, প্রাগুক্ত।
৬। Niyamgiri Answers, People veto bauxite Mining, but Vedanta is unlikely to let go of the bounty, Sayantan Bera, Down To Earth, 31 August 2013.
আপনাদের পত্রিকায় প্রকাশিত দেবাশিস আইচের ‘উচ্ছেদ ও ধ্বংসের আদিবাসী ইতিবৃত্ত’ আমাদের ছোট কাগজের বিশেষ সংখ্যায় ( স্বাধীনতার ৭৫এ বাংলা ) প্রকাশ করতে চাই । অনুমতি দিয়ে বাধিত করবেন ।