জাতীয় প্রতিবন্ধকতা খসড়া নীতি: সম্পূর্ণ বাদ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত নারীরা


  • July 16, 2022
  • (0 Comments)
  • 994 Views

সম্প্রতি ভারত সরকার জাতীয় প্রতিবন্ধকতা খসড়া নীতি নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। আশ্চর্যজনকভাবে এই খসড়া নীতি থেকে পুরোপুরি বাদ পড়েছে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত নারীদের বিষয়টি। অথচ ২০০৬ সালে দেশের প্রথম প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য আনা জাতীয় নীতিতে প্রতিবন্ধী মহিলাদের উপর একটি আলাদা অধ্যায় ছিল। ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইটস অফ দ্য ডিসএবেলড (এনপিআরডি)-এর যুগ্ম সম্পাদক শম্পা সেনগুপ্ত-র সঙ্গে কথাবার্তায় সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

সম্প্রতি ভারত সরকার জাতীয় প্রতিবন্ধকতা খসড়া নীতি নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। কেবলমাত্র ইংরাজিতে প্রকাশিত হওয়ায় এই খসড়া নীতি এ দেশের এক বড় সংখ্যক প্রতিবন্ধী মানুষদের কাছেও পৌঁছায়নি। ওয়েবনসাইট-এ আপলোড হওয়া নীতিটি সমস্ত ধরনের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য অ্যাকসেসিবল-ও নয়। মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও এ নিয়ে লেখা হয়নি একটি কথাও। অথচ দেশের নাগরিক হিসাবে নির্দিষ্ট প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার ও সমানাধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য জাতীয় নীতি প্রণয়ন জরুরি। কিন্তু দেশের বর্তমান সরকারের কাজের ধারা আনুযায়ী এই জাতীয় প্রতিবন্ধকতা খসড়া নীতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দিশাহীন, তা প্রণয়নের নির্দিষ্ট রূপরেখা নেই এবং দায়সারা হিসাবে করা।

 

দেশের প্রতিবন্ধী মানুষদের সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার ও সমান সুযোগ দেওয়ার জন্য এই জাতীয় নীতি থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অথচ এর দীর্ঘমেয়াদী ও সুদূরপ্রসারী ফলাফলের কথা চিন্তা না করে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকার আইন, ২০১৬ ও ইউনাইটেড ন্যাশনাল কনভেনশন অন দ্য রাইটস অফ পার্সনস উইথ ডিসএবিলিটিস থেকেই অধিকাংশ বিভাগে ধারাগুলি যুক্ত করা হয়েছে। ফলে কিছু ক্ষেত্রে সদর্থক উদ্দেশ্য দেখা গেলেও সেগুলি অসম্পূর্ণই রয়ে যাচ্ছে। প্রায় ১০০ পাতার কাছাকাছি বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করা প্রতিবন্ধকতা বিষয়ক এই খসড়া নীতি তাই এ দেশের প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য সামগ্রিকভাবে ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে না বলেই মনে করেছেন প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ আন্দোলনকর্মী, সংগঠন ও প্রতিবন্ধী মানুষেরা। দেশের প্রতিবন্ধী সংগঠনগুলি থেকে খুবই কম সময়ের ব্যবধানে এই নীতির সংশোধনের জন্য কোনও প্রস্তাব থাকলে তা জানানোর কথাও বলা হয়েছিল। পরবর্তীতে সংগঠনগুলির জোটবদ্ধ দাবীর কারণে তা বেড়ে ৩১ আগস্ট করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রতিবন্ধী সংগঠন ও মঞ্চগুলি তাদের প্রস্তাব পাঠাচ্ছে। গত এক মাস ধরে চলেছে আলোচনা, পরামর্শ ইত্যাদি। ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইটস অফ দ্য ডিসএবেলড এই জাতীয় খসড়া নীতি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চালিয়েছে এবং এক দীর্ঘ প্রস্তাবসূচী সরকারের কাছে পাঠিয়েছে।

 

প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকার আইন,২০১৬ খাতায়-কলমে থাকলেও তা কার্যকর করার বিষয়ে প্রশাসনিক স্তরে ঔদাসীন্য ও অজ্ঞতা দুই’ই রয়েছে। নিজেদের অধিকার বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য সকল প্রতিবন্ধী মানুষদের কাছেও এখনও নেই। ফলে খসড়া জাতীয় প্রতিবন্ধকতা নীতিতে যে ফাঁকগুলি রয়ে যাচ্ছে সেগুলিকে দেখতে পাওয়া ও তা চিনিয়ে দেওয়া জরুরি, যাতে খসড়াটি সংশোধনের পর রূপায়িত হলে যতটা সম্ভব সদর্থক করে তোলা যায়। তারজন্য অবশ্যই সরকারের সদিচ্ছা থাকা প্রয়োজন। যা প্রতিবন্ধী মানুষদের ‘দিব্যাঙ্গ’ বলে আর জাতীয় বাজেটে তাদের জন্য বরাদ্দ লজ্জাজনকভাবে কমিয়ে দিয়ে দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে চাওয়া রাষ্ট্রর কতটা রয়েছে সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই রয়ে যায়।

 

এই জাতীয় প্রতিবন্ধকতা খসড়া নীতিতে যে বিষয়গুলির উপর আলোচনা করা হয়েছে সেগুলি হল – প্রতিরোধ-যত দ্রুত সম্ভব চিহ্নিতকরণ-হস্তক্ষেপ, প্রতিবন্ধকতার সার্টিফিকেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান, ক্রীড়া-সংস্কৃতি ও বিনোদন, সুগমতা (অ্যাক্সেসিবিলিটি), দুর্যোগ মোকাবিলা, সামাজিক সুরক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষিত করা। আশ্চর্যজনকভাবে এই খসড়া নীতি থেকে পুরোপুরি বাদ পড়েছে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত নারীদের বিষয়টি। এই বিষয়েই কথা বলেছিলাম, প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনে তিন দশকেরও বেশি যুক্ত থাকা, ন্যাশনাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইটস অফ দ্য ডিসএবেলড (এনপিআরডি)-এর যুগ্ম সম্পাদক শম্পা সেনগুপ্ত-র সঙ্গে।

 

প্র: সম্প্রতি ভারত সরকার জাতীয় প্রতিবন্ধকতা খসড়া নীতি নিয়ে এসেছে এবং সেখানে সম্পূর্ণই বাদ গেছে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের বিষয়টি। এই বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

 

শম্পা: আমার যেটা খুব সিগনিফিকেন্ট মনে হয় যে আমাদের তো আগে কোনও আইন ছিল না। ২০০৬-এর আগে আইন, পলিসিতে প্রতিবন্ধী মেয়েদের কথা ছিল না। ২০০৬-এ প্রথম প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য জাতীয় পলিসি এল এবং সেখানে প্রতিবন্ধী মহিলাদের জন্য আলাদা একটা চ্যাপ্টার যোগ হল। এবং সেটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি তো এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করছি, মূলধারার প্রতিবন্ধী আন্দোলনে কিন্তু বারবার করে এই কথাটা আসত যে কী দরকার? এমনিতেই এত সমস্যা, এত বেরিয়ার, আবার আলাদা করে মেয়েদের কথা বলার কী দরকার? আমি যেহেতু এগুলো শুনেছি, তাই এটা একটা পলিসিতে আসছে সেই ২০০৬ সালে আমার কাছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তখন ইউএনসিআরপিডি-র ড্রাফটিং চলছে। সেখানে জেনিভাতে প্রসেস চলছে। সেখানে মেয়েদের ইস্যুটা কীভাবে আসবে সেটা নিয়ে অনেক ডিবেটস হচ্ছে, সেখানেও কিন্তু কথা উঠেছিল যে রাখা হবে না। কারণ CEDAW তো আছে, মেয়েদের জন্য আলাদা কনভেনশন তো আছে। তার আগেই আমাদের কাছে ২০০৬-এর জাতীয় পলিসি ও তাতে আলাদা করে মেয়েদের চ্যাপ্টার বিষয়টি এসে গেল। এবার ইমপ্লিমেন্টেশন বা রূপায়ণের ব্যাপারটা আমি বলব খানিকটা আমাদের সেক্টরের মানুষেরও দোষ। আমরা বেশি আইনের পেছনে দৌড়েছি, পলিসিটার বিষয়ে ভাবিনি। ইমপ্লিমেন্টেশন একেবারে হয়নি তা তো নয়। রেলওয়েজ’এর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ইউনিয়ন ইমপ্লিমেন্টেশন-এর কাজটা করাতে পেরেছে। এই পলিসিতে বলা হয়েছিল প্রতিবন্ধী মেয়রা মা হলে যেহেতু সন্তানদের বড় করা একটু সমস্যাজনক, তাই তাদের অতিরিক্ত সাপোর্ট দরকার হতে পারে ও সেইজন্য তাদের নিয়োগকারীরা অতিরিক্ত টাকা দেবে যদি কোনও প্রতিবন্ধী মহিলা কর্মীর সন্তান হয়, এই মাতৃত্বকালীন ভাতা রেলওয়েজ-এ সেটা চালু করা গেছিল। যদি ধরে নেওয়াও হয় যে খুব কম সংখ্যক মেয়েই সেটি পেয়েছেন, সারা দেশের প্রতিবন্ধী মেয়েদের তুলনায় হয়তো নগন্য, পলিসি থাকার কারণে অধিকারটি রূপায়িত হয়েছিল এবং সেটি প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্যের অধিকারের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সংযুক্ত একটা জায়গা – এটা জরুরি। এবার ১৬ বছর পর যখন নতুন করে জাতীয় পলিসি আসছে তখন মহিলাদের চ্যাপ্টারটি এভাবে উড়িয়ে দেবে সেটা আমি ভাবতে পারিনি।

 

প্র: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আইন ২০১৬ (আরপিডব্লিউডি) তে মহিলাদের বিভিন্ন অধিকারের কথা উল্লেখ করে ধারা আছে। আগের জাতীয় পলিসিতে আলাদা অধ্যায় ছিল। সেখানে বর্তমান কেন্দ্র সরকার ঠিক কোন রাজনৈতিক জায়গা থেকে প্রতিবন্ধী মহিলাদের কোনওরকম উল্লেখ খসড়া নীতিতে রাখলেন না বলে আপনি মনে করছেন?

 

শম্পা: আরপিডব্লিউডি-তেও অনেক লড়াই করে মহিলাদের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছে। ইট ওয়াজ নট অ্যান ইজি প্রসেস। সিআরপিডি-র বেসিস-এ আইন চেঞ্জ হচ্ছে। প্রথম ড্রাফট’টা তো সরকার যে কমিটি তৈরি করে তারা তৈরি করেছিল, আমাদের ইনপুট ইত্যাদি সবই ছিল। প্রথমে দেখা গেল বড় একটা অংশ দেওয়া হল, দ্বিতীয়বারে দেখা গেল তার থেকে অনেকখানি বাদ দেওয়া হয়েছে, সরকার থেকে যে ড্রাফট’টা দিয়েছিল তাতে কিন্তু পুরো চ্যাপ্টারটা উড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে আরপিডব্লিউডি-তে অনেক লড়াই করে রাখতে হয়েছে। ২০১০-এ প্রথম কমিটি তৈরি হয়, ২০১১-এ প্রথম ড্রাফটা’টা আমরা দেখি, ২০১১ থেকে ২০১৬ – এর মধ্যে যতগুলো ড্রাফট হয়েছে মেয়েদের অংশটায় বহু কিছু বাদ দিতে দিতে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা জানি এই আইনটা রূপায়ন করতে গেলে রুলস লাগবে, সেন্ট্রাল রুলস-এ কিন্তু নেই প্রতিবন্ধী মেয়েদের কথা। ফলে ইমপ্লিমেন্ট করার কথা রাস্তা নেই। অ্যাকচুয়ালি তো হবে না ইমপ্লিমেন্ট। মানে কোর্ট কেস না করলে আমরা তো পাচ্ছি না কিছু। এখানে যেটা বলতে পারি, যেটা করেওছি, পশ্চিমবঙ্গে যে পরিবর্তনটা এনেছি, উচ্চ শিক্ষায় সংরক্ষণ ৩% ছিল, আমরা ৪% করতে পেরেছি। কিন্তু তাতে কি চট করে কন্যাশ্রীতে প্রতিবন্ধী মেয়েরা ২৫% বেশি পাবে? অথচ আরপিডব্লিউডি বলছে তো, যেকোনও কল্যাণমূলক প্রকল্পে প্রতিবন্ধী মেয়েরা বেশি পাবে। কন্যাশ্রীতে আমরা করাতে পারব না কি? রুলস-এ নেই তো। করা যায় যখন কোর্টে যাওয়া যায় এবং সে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া।

 

দেখুন এই যে শেল্টারগুলির কথা বলা হয়েছে সেগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ – শর্ট স্টে হোম, ওয়ার্কিং উওমেন’স হস্টেল, এল্ডারলি হোম। শর্ট স্টে হোম তো প্রতিবন্ধী মেয়েদের উপর পারিবারিক হিংসা নিয়ে কাজ করার জন্য খুবই জরুরি। যেমন আমরা থাকার জায়গা দিতে পারি না। মানে এনজিও-রা হোম করলে হয়, সরকারের তো নেই কিছু। এই যে শেল্টারগুলো এগুলো আসলে প্রতিবন্ধী মহিলাদের জীবনযাত্রায় একটা বড় সাপোর্ট। একজন মহিলা যদি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হন, হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী হন – এমন কোনও চাকরি পান যাতে তাকে বাড়ির বাইরে অন্যত্র থাকতে হবে, তাদের জন্য যদি অ্যাকসেসিবল ওয়ার্কিং উইমেন’স হস্টেল না থাকে তাহলে তার অভিভাবক তো চাকরি করতে যেতে দিতেই চাইবেন না।

 

প্র: প্রতিবন্ধী আন্দোলনে সমাজের বৃহত্তর অংশের (নাগরিক সমাজ ও অন্যান্য আন্দোলনের অংশীদারেরা) সেভাবে অংশগ্রহণ এখনও চোখে পড়ে না। আপনি যেমন নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে প্রতিবন্ধী আন্দোলনে মহিলাদের অবস্থানকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন, সেই জায়গা থেকে এইভাবে পলিসি, আইন সবেতেই মেয়েদের অধিকারের জায়গাগুলি ছোট হয়ে যাওয়া, বাদ পড়ে যাওয়ার পর আপনি বা আপনারা তা নিয়ে কীভাবে কাজ করবেন ভাবছেন?

শম্পা: আমরা এখনও পুরোপুরি ভেবে ওঠার সময় পাইনি। প্রতিবন্ধী আন্দোলন আসলে অনেক বড় একটা আন্দোলন। সমস্যা হল নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টিকে দেখবে হয়তো সারা দেশে তিন, চারটে সংগঠন। সংগঠনের থেকে বরং কোনও কোনও ব্যক্তি আন্দোলনকর্মী এরকম ভাবে চিন্তাভাবনা করেন। কোথাও যেন আমরা আন্দোলনের ভেতরে বহিরাগতর মতো। বিভিন্ন বড় সংগঠনেও হয়তো তত্ত্বগতভাবে নারীবাদী চিন্তাভাবনা রয়েছে কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে বাস্তবে তা খুব একটা রূপায়িত হতে দেখা যাচ্ছে না, সেখানে ওটা কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে থাকছে।

 

প্র: এর একটা কারণ কি হতে পারে নারীবাদী আন্দোলনে প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়টি একেবারেই না আসা বা কম আসা?

শম্পা: ঠিক সেটা নয়। কারণ নারীবাদী আন্দোলনের দ্বারা প্রতিবন্ধী আন্দোলন একেবারেই প্রভাবিত নয়। আসল কারণ হল প্রতিবন্ধী মহিলাদের অদৃশ্যায়ণ, প্রতিবন্ধী আন্দোলনে তো বটেই, সমস্ত আন্দোলনের পরিসরেই। চোখে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না তাদের কোথাও, তাদের কথা শোনার লোক নেই। আমি অফিশিয়ালি একটি তথ্য দিতে পারি – এনপিআরডি-র শেষ অধিবেশনে সচেতনভাবে বলা হয়েছিল বিভিন্ন রাজ্য থেকে যত বেশি সংখ্যক মহিলা ডেলিগেট পাঠানো যায়। দেখা গেল নির্দিষ্ট পার্সেন্টেজ কোনও রাজ্যই পূরণ করতে পারেনি, মহিলা ডেলিগেটদের সংখ্যা তুলনায় কম ছিল। সচেতনভাবে চেষ্টা করেও তো আনা যাচ্ছে না। যদিও ইন্টারেস্টিংলি এসসি/এসটি সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল। আমরা কিন্তু সেটা বলিনি যে তাদের বেশি আনতে হবে, এটা আপনাআপনিই হয়েছিল। আসলে দারিদ্র্য আর প্রতিবন্ধকতা তো সংযুক্ত। এটা সেইটিই প্রমাণ করে।

 

প্র: মানে শুধু পলিসি বা আইন রূপায়ন নয়, তৃণমূল স্তরে কাজ করার ক্ষেত্রেও ফাঁক থেকে যাচ্ছে…

শম্পা: কাজ নেই তো। আপনি দেখতে পান? ক’জনকে দেখতে পান?

 

প্র: পলিসি একবার রূপায়ন হয়ে গেলে, আর সমস্ত প্রস্তাবের পরেও যদি মহিলাদের বিষয়টি তাতে না আসে, তাহলে প্রতিবন্ধী মহিলাদের উপর সামগ্রিকভাবে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষেত্রে তা কি প্রভাব ফেলবে?

শম্পা: আমি তো ভীষণভাবে মনে করি মেয়েদের, নারীবাদী আন্দোলনকে পিছনে ঠেলে দেওয়ার একটা প্রক্রিয়া সারা পৃথিবী জুড়েই চলছে। আমেরিকার গর্ভপাত আইন তার একটি উদাহরণ। সারাক্ষণই সবাই যে খুব সচেতনভাবে করছে তা নয়, কিন্তু একেবারেই সচেতন নয় তাও তো নয়।

 

প্র: আন্দোলনের ভেতরে আন্দোলন যা আপনাদের সারাক্ষণই চালিয়ে যেতে হয় তা কি কোনও বাধার মুখোমুখি হবে?

শম্পা: এমনিতে পলিসি নিয়ে প্রতিবন্ধী গোষ্ঠীগুলি খুব বেশি মাথা ঘামাত না এতদিন। ২০০৬-এর পলিসি নিয়ে খুব একটা হৈ-চৈ হয়নি। আইন এসে গেছে, আইনকে রূপায়ন করতে হবে ইত্যাদি ছিল। এবারের পলিসি নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হচ্ছে। সরকারের ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়া একটা বড় কারণ। এটা ঘিরে একটা অ্যাক্টিভিজম হচ্ছে। কাজ না হলে তো আন্দোলনটা বোঝা যায় না। মিডিয়াতে অবশ্য কোনও আলোচনাই হচ্ছে না। আসলে প্রতিবন্ধকতা একটা অদৃশ্য বিষয়।

 

এই পলিসির প্রসেস চলছে অনেক দিন। ২০০৬-এ পলিসি অ্যাডপ্ট করেছে ভারত সরকার। ২০০৭-এ ইউএন সিআরপিডি অ্যাডপ্ট করল। ফলে তখনই তো চেঞ্জ হওয়ার কথা। কারণ প্রতিবন্ধকতার তো সংজ্ঞা পাল্টে যাচ্ছে। তাহলে তো পলিসি-ও তো অবস্যই বদলাতে হবে।

 

প্র: আপনারা বারবার আরও একটি বিষয় বলছেন যে বিভিন্ন আইন ও পলিসি থেকে স্রেফ কপি-পেস্ট করে দেওয়া হয়েছে। যেটিও বেশ অপমানজনক।

শম্পা: আরপিডব্লিউডি, ইউএনসিআরপিডি, এসডিজি সব জায়গা থেকে তাই করেছে। এভাবে কি কোনও পলিসি লেখা হয়? অমুক বিদেশী নীতিতে তাই বলেছে, তমুকে তাই আছে! কপি-পেস্ট করে পলিসি লেখা যায়? পানিশমেন্ট(শাস্তি)-এর পুরো ক্লজ’টা কপি করে রেখে দিয়েছো।

 

প্র: এই পলিসি-র উপর প্রস্তাব (রেকমেন্ডেশন) যা যাচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন থেকে সেখানে লিঙ্গ পরিচিতি বা নারীদের বিষয়টি নিয়ে সবাই কি লিখছেন? বা কত সংখ্যক লিখছেন?

শম্পা: নারীদের বিষয় নিয়ে হয়তো তিন, চারটে যাবে আলাদা করে। কিন্তু বাকি সবাই দেবে কি না সেটা নিয়েও আমার সন্দেহ আছে। ইউএনসিআরপিডি-র পর অনেকেই প্রতিবন্ধী আন্দোলনে মহিলাদের বিষয়টিকে টোকেনিজম হিসাবে দেখেন।

 

প্র: খসড়া নীতিতে এইভাবে প্রতিবন্ধী মহিলাদের বাদ পড়ে যাওয়াটা প্রতিবন্ধী আন্দোলনের ভেতরে প্রতিবন্ধী মহিলাদের কি নতুন কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবাবে?

শম্পা: একটা যেটা হচ্ছে আরও কিছু মহিলার কাছে পৌঁছতে পারছি – দেখো আমাদের কথা বলেনি। তারাও আসছে। এর বাইরে খুব কিছু হওয়া মুশকিল।

 

এনপিআরডি থেকে জাতীয় প্রতিবন্ধকতা খসড়া নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে তাতে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের বিষয়টি যেভাবে রয়েছে

 

২১. এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি যা প্রতিবন্ধী গোষ্ঠীর অতিকারগুলিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিশ্রুতিকে দৃঢ় করবে এমনটাই ভাবা হচ্ছে সেখানে লিঙ্গ পরিচিতিভিত্তিক অধিকারের বিষয়টি, বিশেষত প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের বিষয়টিকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে, যেখানে ২০০৬-এর নীতিতে এর উপরে একটি আললাদা অধ্যায় ছিল।

২২. এই স্পষ্ট অনুপস্থিতিটি আরও বেশি দুশ্চিন্তার কারণ পরিচ্ছেদ ২.২-এর ৭ নম্বর বুলেট পয়েন্ট-এ বলা হয়েছে, “প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলা ও মেয়েরা অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন এবং হিংসা, নির্যাতন ও শোষন তাদের উপরেই বেশি হয়।”

২৩. আমরা প্রস্তাব দিচ্ছি যে জাতীয় প্রতিবন্ধকতা নীতি, ভারত সরকারের কাছে সিআরপিডি কমিটি-র যে প্রস্তাব রয়েছে তা গ্রহণ করে ও প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের উপরে অধ্যায়ে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত করে:

(ক) প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলা ও মেয়েদের বিরুদ্ধে  যে বহু রকমের ও বহুভাবে সংযুক্ত বৈষম্য ঘটে তা বন্ধ করার প্রক্রিয়া দৃঢ় করতে হবে

(খ) জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলা ও মেয়েদের অন্তর্ভুক্তির জন্য  জাতীয় ও রাজ্য স্তরে পরিকল্পনা নিতে হবে, সুনিশ্চিত করতে হবে যে মহিলাদের জন্য জাতীয় নীতি প্রতিবন্ধকতাকে মূলধারায় নিয়ে আসে, সুনিশ্চিত করতে হবে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন সচেতনতা বাড়াতে এবং ছুঁৎমার্গ ও লিঙ্গ পরিচিতি ও প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে স্টিরিওটাইপ কমাতে কার্যকরী ভূমিকা নিচ্ছে, কমিটির সাধারণ মন্তব্য নম্বর ৭ (২০১৮) অনুযায়ী প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের তাদের নির্দিষ্ট সংগঠনগুলির মাধ্যমে সচেতনা বাড়ানোর প্রোগ্রামগুলিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে

(গ) সমস্ত প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলা ও মেয়েদের অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য প্রতিবন্ধকতা, গ্রাম ও শহরের অবস্থান, জাতিগত পরিচয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ব্যতিরেকে জাতীয় ও রাজ্য স্তরে লিঙ্গ পরিচিতি বিষয়ে সংবেদনশীল নীতি আনতে হবে ও বাজেট বরাদ্দ করতে হবে; লিঙ্গ পরিচিতি, বয়স, জাতিগত, ভাষাগত বা ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে তাদের উপর তথ্য সংগ্রহ করতে হবে যাতে তথ্যসম্মৃদ্ধ নীতি আনা যায় ও পরিষেবা দেওয়া যায়

(ঘ) সমস্ত স্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও নীতি নির্দ্ধারনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের সম্পূর্ণ ও প্রভাব ফেলে এমন অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে হবে, এর মধ্যে থাকবে মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের নীতি নির্দ্ধারণও, জাতীয় ও রাজ্য স্তরের মহিলা কমিশন

 

২৪) এই নীতিতে ফৌজদারী সংশোধনী আইন, ২০১৩ ও পকসো আইন, ২০১২-তে প্রতিবন্ধকতা-নির্দিষ্ট যে ধারাগুলি রয়েছে সেগুলি মান্য করে ধারা রাখতে হবে এবং সুনিশ্চিত করতে হবে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলা ও মেয়েরা কোনও রকম বাধা ছাড়া ন্যায় পান, যদি তাদের যৌনতার উপর স্বনিয়ন্ত্রণ কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়

২৫) সিআরপিডি কমিটিতে যেমন উল্লেখ আছে সেই অনুযায়ী এই নীতিতেও লিঙ্গ ও যৌন পরিচিতিতে প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদেরও এই নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত

২৬) জাস্টিস ভর্মা কমিটিতে যেমন বলা আছে সেই অনুযায়ী এই নীতিতে সুনিশ্চিত করতে হবে যাতে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত শিশুরা সামগ্রিকভাবে যৌনতার শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পায়

আরপিডব্লিউডি ২০১৬-তে মহিলাদের জন্য যে অধিকারগুলি রয়েছে

 

শাস্তি সংক্রান্ত:-

ক) যদি কেউ তার পদের জোরে কোনও প্রতিবন্ধী শিশু বা মহিলার ইচ্ছেকে দমন করে ও সেই পদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তার উপর যৌন নির্যাতন চালায়

খ) কেউ যদি প্রতিবন্ধকতাযুক্ত কোনও মহিলার উপর এমন কোনও চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগ করে বা করতে নির্দেশ দেয় যাতে সেই মহিলার সম্মতি ছাড়া গর্ভপাত হতে পারে, এমন ব্যতিক্রম ছাড়া যেখানে একজন নথিভুক্ত চিকিৎসকের মতামত ও সেই প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলার অভিভাবকের সম্মতিতে গুরুতর প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে গর্ভপাত করা হচ্ছে

তাহলে তার ন্যূনতম ছ’মাস থেকে পাঁচ বছরের থেকেও বেশি কারাবাস ও জরিমানা হতে পারে।

 

সংরক্ষণ সংক্রান্ত:- (প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য)

 

ক) সরকার সমস্ত উন্নয়ন প্রকল্পে কৃষিজমি বিতরণ ও আবাস যোজনায় ৫% সংরক্ষণ রাখবে, যাতে বেঞ্চমার্ক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের সঠিক অগ্রাধিকার দেওয়া হবে

খ) সরকার দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ৫% সংরক্ষণ, যাতে যাতে বেঞ্চমার্ক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের সঠিক অগ্রাধিকার দেওয়া হবে

 

লিঙ্গ পরিচিতির উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট ধারা

 

৪. (১) সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন এমন পদক্ষেপ নেবে যাতে সুনিশ্চিত হয় যে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলা ও শিশুরা অন্যান্য সকলের সঙ্গে সমানভাবে নিজেদের অধিকারগুলি উপভোগ করেন

১০. (১) সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন এমন পদক্ষেপ নেবে যাতে সুনিশ্চিত হয় যে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিরা প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সঠিক তথ্য পান

(২) প্রতিবন্ধকতাযুক্ত কোনও ব্যক্তিকে তার সম্মতি ছাড়া এমন কোনও চিকিৎসা প্রক্রিয়ার আওতায় আনা যাবে না যাতে তার বন্ধ্যাত্ব আসতে পারে

 

Share this
Leave a Comment