দু’বছরের মহামারী পরিস্থিতি চরম অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছিল গৃহশ্রমিকের পেশায় থাকা মহিলাদের। তাদের অধিকার আন্দোলনের মুখ্য দাবি – ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, ছুটি, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যহীন সম্মানের পরিবেশ। কোভিড পেরিয়ে এসে নতুন করে দানা বাঁধছে আন্দোলন। লিখলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
কোভিড মহামারির সময়ে যে পেশায় থাকা কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম হল গৃহশ্রমিকের পেশা। মূলত মহিলাদের অংশগ্রহণ বেশি এই পেশায় এবং আর্থসামাজিকভাবে স্বাবলম্বী থাকার ক্ষেত্রে এই পেশাটি বহুলাংশেই তাঁদের সাহায্য করে চলেছে বছরের পর বছর। কিন্তু ২০২০ সালে অতর্কিতে কোভিড ১৯ হানা দিয়ে গৃহশ্রমিক পেশাটিকে যারপরনাই বিপর্যস্ত করে দেয়। বিনা নোটিসে চাকরি চলে যাওয়া, অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে মাসের পর মাস কাজে যোগ দিতে না পারা, হঠাতই সম্পূর্ণ আয়শূন্য হয়ে পড়া, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, সব নিয়ে হাজার হাজার গৃহশ্রমিক মহিলা অথৈ জলে পড়েন। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে, কোভিড মহামারীর আতঙ্ক সঙ্গে নিয়েই জনজীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করে। তবে গৃহশ্রমিক মহিলাদের পেশার জায়গায় পরিস্থিতি এখনও আগের জায়গায় ফিরে যায়নি।
সংক্রামক কোভিড মহামারী তাঁদের সঙ্গে কাজের জায়গায় হতে থাকা বৈষম্যকে যেন কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। লকডাউন শিথিল হওয়ার পর যখন ট্রেন, বাস, অটোর মতো গণ-পরিবহনে করে তাঁরা যাতায়াত শুরু করেন, তখন অধিকাংশ কাজের বাড়িতে এমনটাই ব্যবহার করা হতে থাকে যে তাঁদের থেকেই কোভিড সংক্রমণ হতে পারে। তাঁদের স্যানিটাইজেশন-এর উপর অহেতুক নজরদারি বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ বাস্তবে তাঁরা নিজেরাই এ ব্যাপারে প্রথম থেকে যথেষ্ট সতর্ক থাকছিলেন। তবু আর্থসামাজিকভাবে তাঁদের অসচেতন প্রমাণ করার একটা চেষ্টা যেন দেখা গেছিল কিছু কিছু নিয়োগকারীর মানসিকতায়। আবার অন্যদিকে, মানবিকতার দিক থেকে বিচার করে ও কাজের অলিখিত নিয়ম মেনে গৃহশ্রমিক মহিলারা যখন মহামারীর জন্য কাজে আসতে পারছিলেন না, তখন এই নিয়োগকারীরাই তাঁদের বেতন বন্ধ রেখেছিলেন বেশ কয়েক মাস। এই অবস্থায় এই মহিলারা কতটা সমস্যায় পড়তে পারেন, সে কথা চিন্তা করেননি, অনেকে তো কাজ থেকে ছাড়িয়েও দিয়েছেন।
নিজেদের কাজ ধরে রাখার জন্য এমনও দেখা গেছে দক্ষিণ ২৪ পরগণার ক্যানিং, লক্ষ্মীকান্তপুর, ডায়মন্ড হারবার থেকে আসা গৃহশ্রমিক মহিলারা, যাঁরা ‘কাজের দিদি’ নামেই পরিচিত, কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় কয়েকজন একসঙ্গে মিলে ছোট্ট একটি ঘর ভাড়া করে থেকেছেন কয়েক মাস। এই ঘর ভাড়া তাঁদের বেতনের টাকা থেকেই দিতে হয়েছে, যা অবশ্যই ছিল অতিরিক্ত খরচ। মনে রাখা দরকার, এই মহিলাদের অধিকাংশের উপরেই সংসার চালানোর বড় দায়িত্ব থাকে। মহামারীর সময়ে তা আরও বেড়ে গিয়েছিল, কারণ পরিবারের রোজগেরে পুরুষ সদস্যদের বেশিরভাগেরই রোজগার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই মহিলাদের উপরেই ছিল সংসারের দৈনন্দিন খরচ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, খাবারের ব্যবস্থা, অসুখ-বিসুখের খরচ ইত্যাদি চালানোর ভার। ফলে কাজ চালিয়ে যাওয়ার দাঁতে দাঁত চাপা লড়াইটা তাঁদের চালিয়ে যেতে হয়েছিল।
বেশিরভাগ কাজের বাড়িতেই চা, জল, খাবার খাওয়ার বাসন ব্যবহারের ক্ষেত্রে গৃহশ্রমিক মহিলাদের সঙ্গে অত্যন্ত বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় এখনও। মাটিতে বসতে দেওয়া, ভাঙা বা ফাটা কাপে চা দেওয়া, আলাদা থালায় খাবার দেওয়া – এগুলি বছরের পর বছর ধরে হয়ে আসছে। কোভিডের পর থেকে সংক্রমণের অজুহাতে এই বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে – এমন অসংখ্য উদাহরণ আশেপাশে দেখা যাচ্ছে। শান্তি মন্ডল গৃহশ্রমিকের পেশায় রয়েছেন ত্রিশ বছরেরও বেশি। বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলছিলেন যে, একটি বা দু’টি বাড়িই এমন পাওয়া যায়, যেখানে কোনও ভেদাভেদ করা হয় না। শান্তি বলছিলেন, “এখন যে বাড়িগুলোতে কাজ করি, সেগুলোর মধ্যে এক বাড়ির দাদা সোফায় না বসে মাটিতে বসলেই আমাকে বলেন সোফাটা রয়েছে কী করতে। চা, খাবার কোনও কিছুতে কোনও ছোঁয়াছুঁয়ি করে না ওই বাড়িতে। আরেক বাড়িতে আমরা যারা কাজ করি তাদের জলের বোতলটা পর্যন্ত ধরতে দেয় না। ফাটা গ্লাসে জল দেয়। ডিপ ফ্রিজে রেখে দেওয়া তিন, চার দিনের বাসি তরকারি বের করে খেতে দেয়। ওখানে রোজ পাখির জন্য তিনটে রুটি বানাই আমি, তার থেকে না দিয়ে আমাকে বাইরে রেখে দেওয়া ভেপসে ওঠা বাসি রুটি খেতে দিতে চেয়েছে, এমনও হয়েছে। আমি ওই বাড়িতে কিচ্ছু খাই না। মাসিমা বয়স্ক মানুষ। উনি এমন করেন, কী বলব? খুব খারাপ লাগে।”
আরেক জন গৃহশ্রমিক সুপর্ণার কথায় উঠে এল গৃহশ্রমিকদের দীর্ঘ দিনের আন্দোলনের প্রাথমিক দাবিগুলো, আর বোঝা গেল ঠিক কোন্ জায়গা থেকে সমস্যার সূত্রপাত হয়। তিনি বলছিলেন, “আমাদের যে মাসে কয়েক’টা ছুটি লাগে, সেটা কিছুতেই কাজের বাড়িতে বুঝতে চায় না। মাসে চারটে ছুটি আমাদের দিতে হবে। বাড়িতেও তো কত সময়ে দরকার পড়ে, তাও ছুটি দেয় না। বলবে, একটু কাজ সেরে দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যেও। পুজোর ঠিক আগে আগে কাজ ছাড়িয়ে দেয় কোনও না কোনও অজুহাতে। যাতে পুজোর বোনাস না দিতে হয়। এক বছর বা তার বেশি হয়ে গেলে তো এক মাসের মাইনে বোনাস দেওয়ার কথা, আর কয়েক মাস কাজ হলে অন্তত অর্ধেক বোনাস তো দেবে। তাও দিতে চায় না কত বাড়িতে। আর সবচেয়ে অসুবিধা হল কিছুতেই বাথরুম ব্যবহার করতে দেয় না। বড় বিল্ডিংগুলোতে বলে, নীচে যে আলাদা বাথরুম সেখানে যেতে। হাতের কাজ সারতে সারতে কি যাওয়া যায়? খুব কষ্ট হয়। ছুটি, বোনাস, বাথরুম ব্যবহার করতে দেওয়া এগুলো আমাদের দাবি।”
দশ বারো বছর ধরে কাজ করছেন মুনমুন। যে বিষয়টির কথা তিনি বললেন তা বোধহয় গৃহশ্রমিকদের অধিকারের অন্যতম প্রধান। সম্মান, কাজের মূল্য। মুনমুন বলছিলেন “আমরা তো সব বাড়িতেই সেই বাড়ির মতো মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু অনেক বাড়িতেই নানাভাবে আমাদের জন্য অসুবিধা তৈরি করে। অবশ্যই সবাই নয়। অনেক বাড়ি বেশ ভালও হয়। তবে অনেক সময়েই আমাদের একটা মাইনেতে যে কয়েকটা কাজের কথা বলে, তার থেকে অনেক বেশি কাজ করিয়ে নেয়। আমরা ওই মাইনেতে রাজি হয়ে যাই বলে আর কিছু বলতে পারি না। আমরা চাই, এই যে আমরা এত পরিশ্রম করি, তার সম্মানটা যেন পাই। কাজের পরিচয়টা পাই। এমনভাবে দেখা হয়, যেন আমাদের কাজের কোনও মূল্যই নেই।”
গত বেশ কয়েক বছর ধরেই সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও গৃহশ্রমিকদের কাজের অধিকার ও নানা দাবিদাওয়া নিয়ে চলছে জোটবদ্ধ আন্দোলন। তাদের নিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে নেতৃত্বে। গড়ে উঠেছিল পশ্চিমবঙ্গ গৃহশ্রমিক অধিকার অভিযান মঞ্চ। গৃহশ্রমিকদের একটি সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন-এর রেজিস্ট্রেশনও পায়। তারপর অবশ্য আর কোনও আবেদনকারী গৃহশ্রমিক সংগঠনকে এই রেজিস্ট্রেশন সরকারিভাবে দেওয়া হয়নি। সেই প্রক্রিয়াটিই বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে গত দু’বছরে কোভিড পরিস্থিতিতে এই আন্দোলনে কিছুটা ভাঁটা পড়ে। এই বছর ১৬ জুন আর্ন্তজাতিক গৃহশ্রমিক দিবস উপলক্ষ্যে আরও একবার আন্দোলনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হল। গৃহশ্রমিকদের অধিকারের দাবি নিয়ে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে পরিচিত সংগঠনের উদ্যোগে গৃহশ্রমিক, নিয়োগকারী, সরকারী আধিকারিকদের সঙ্গে এক আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত সোনারপুর ব্লক-এর শ্রম আধিকারিক তন্ময় চ্যাটার্জি যেমন বললেন, “২০১১ সালে আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থার কনভেনশনে গৃহশ্রমকে শ্রমের অধিকার দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও ভারতে এখনও এ নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট আইন নেই। সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন, উত্তরণ প্রয়োজন আগে। আন্দোলনের নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে এ দেশে যে ৬২টি শিডিউলড জীবিকা রয়েছে, যেগুলি ন্যূনতম মজুরির আওতায় পড়ে, তার মধ্যে গৃহশ্রম নেই। যাতে সেই তালিকার অর্ন্তভুক্ত হতে পারে, তার জন্য আন্দোলন করতে হবে, প্রেশার গ্রুপ হিসাবে কাজ করতে হবে।”
গৃহশ্রমিকদের জন্য ইতিমধ্যেই দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যে ন্যূনতম মজুরি চালু করেছে সেখানকার রাজ্য সরকার। এ রাজ্যের সরকার সেরকম কোনও উদ্যোগই এখনও পর্যন্ত নেয়নি। মাঝেমধ্যে কিছু কথাবার্তা শোনা গেলেও বাস্তবায়িত হয়নি কিছুই। এ রাজ্যে অবশ্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য রয়েছে বিনামূল্যে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ করার ক্ষমতা কমে আসলে বা অবসর নিতে চাইলে এই প্রকল্পে জমানো টাকা সুদসহ পেলে শ্রমিকেরা লাভবান হন। তাই এই প্রকল্পে গৃহশ্রমিকেরা কিছুটা সুবিধা পাবেন। অধিকার আন্দোলনের নেতৃত্বের দাবির মধ্যে প্রাধান্য পাচ্ছে সরকারি নীতি নির্ধারণ করা ও সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বোর্ড তৈরি করা।
কাজের সম্মান পাওয়া এক্ষেত্রে অন্যতম দাবি। এমন অনেকসময়ই দেখা যায় যে, কোনও কাজের বাড়িতে টাকাপয়সা বা জিনিসপত্র হারালে প্রথমেই গৃহশ্রমিককে অভিযুক্ত করা হয় ও পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গিয়ে অপমানজনক ব্যবহার, দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখা ইত্যাদি করা হয়। এধরনের হেনস্থা অবিলম্বে বন্ধ করাও দাবির তালিকায় রয়েছে। নিয়োগকারীদের মানসিকতায় শ্রেণীভেদ ও সামাজিক বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি আসলে রয়েই যাচ্ছে। বাড়ির বাথরুম ব্যবহার করতে দিলে গৃহশ্রমিকদের যে আলাদা করে পরিষ্কার রাখার প্রশিক্ষণ দিতে হবে না, তাঁরা নিজেরাই যে স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে সচেতন, একদিন সঙ্গে বেড়াতে নিয়ে যাওয়াটা যে উদাহরণ তৈরি বা ব্যতিক্রম নয় – এগুলো না বুঝলে এই সমাজের দু’জন মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কের আদানপ্রদানের ভিতরকার বৈষম্য দূর হবে না। আসলে বিষয়টি পরিষেবা দেওয়ার ও পরিষেবা নেওয়ার। সুতরাং পেশাদারী পরিবেশ তৈরির ও ‘কাজের বাড়ি’কে কর্মক্ষেত্র ভাবার দায়টি কেবল গৃহশ্রমিকের নয়, নিয়োগকারীরও।
গৃহশ্রমিকদের অধিকার আন্দোলনের প্রধান দাবিগুলির মধ্যে রইল – ন্যূনতম মজুরি, নির্দিষ্ট সংখ্যক ও নির্দিষ্ট সময়ের কাজের জন্য নির্দিষ্ট মজুরি, গৃহশ্রমিক ও নিয়োগকারী উভয়েরই পরিচয়পত্র থাকা, শ্রমের স্বীকৃতির মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। শান্তি মন্ডল স্পষ্টভাবে বললেন, “সরকার এই দাবিগুলো মানলে তা যেন এদিক-ওদিক ছড়িয়ে না থাকে, সরকার যেন নোটিস দিয়ে জানায়, তাহলে আমাদের মতো অশিক্ষিতরাও জানতে পারব, আর কোনও সমস্যা হলে কাজের জায়গায় দেখাতেও পারব।”
শরীর না পারলেও একটু বেশি রোজগারের জন্য দিনের আলো ফোটার আগে থেকে বিকেল বা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন গৃহশ্রমিকেরা। নিজেদের বাড়ির কাজও তো থাকে। মহিলা, শ্রমিক – এই দুই পরিচয়ের মাঝে হারিয়ে যায় নিজের যত্ন, বিনোদন, বিশ্রামের কথাগুলো। মুনমুন বলছিলেন, “অন্তত চারটে ছুটি দরকার। একটু ঘুরতে-বেড়াতে যেতে পারব, বাড়ির কাজ করতে পারব। আর একটু ঘুমোতে পারব,” – বলতে বলতে হেসে ফেললেন তিনি। আসলে ঘুম, বিশ্রাম যে শ্রমিকের অধিকার, তা যেন ক্রমশ মানবিকতা হারাতে থাকা সমাজে হারিয়ে না যায়, আন্দোলনের গতিমুখ সে দিকেও থাকুক।