ডলু চা-বাগান উপড়ে ফেলেছে বুলডোজার, তৈরি হচ্ছে গ্রীনফিল্ড এয়ারপোর্ট


  • May 15, 2022
  • (1 Comments)
  • 1441 Views

এয়ারপোর্ট বানাবার উদ্দেশ্যে দুশো বুলডোজার উপড়ে ফেলেছে শিলচরের ডলু চা-বাগান। এলাকার বিজেপি সাংসদ জানিয়েছেন, মুখ্য ট্রেড ইউনিয়নগুলি মৌ স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু প্রতিরোধ জারি রেখেছে অধিকাংশ চা-শ্রমিকদের দ্বারা সমর্থিত অসম মজুরী শ্রমিক ইউনিয়ন। ইতিমধ্যেই তাদের গায়ে লেগেছে মাওবাদী তকমা। লেখা ও ভিডিও – পার্থ প্রতিম মৈত্র

 

গ্রীনফিল্ড এয়ারপোর্ট। একটা আস্ত চা-বাগান ধ্বংস করে একটি এয়ারপোর্ট নির্মিত হবে। কোন সময়? যখন সারা ভারত জুড়ে ছ’খানা ব্যস্ত এয়ারপোর্ট তুলে দেওয়া হয়েছে আদানী গোষ্ঠির হাতে। পিপিপি মডেলের নামে। শিলচর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরত্বে কুম্ভীরগ্রামে একটি বিমানবন্দর রয়েছে। যদ্দূর জানি সেখান থেকে দিনে চারটি, বা বড়জোর পাঁচটি প্লেন ওঠা নামা করে। সপ্তাহে ৩২টি ফ্লাইট। এই মাত্র যেখানে প্রয়োজনীয়তা, সেখানে সামান্য ঘুরপথে, ২৬ কিলোমিটার দূরত্বে, ডলুর মতো একটি চালু চা-বাগান সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে, শ্রমিকদের ভবিষ্যতের তোয়াক্কা না করে হঠাৎ এই গ্রীনফিল্ড এয়ারপোর্ট তৈরীর জন্য উদ্বেল হয়ে ওঠার পিছনে রহস্যটা কি? ২০০০-এরও বেশী শ্রমিক ও তাদের পরিবার, ২৫০০ বিঘা চা জমি, আর ৩০ লক্ষ চা-গাছ ও ছায়াগাছ এক দিনে ধ্বংস করে দিয়ে কোন উন্নয়ন হল? কার জন্য নির্মিত হচ্ছে আরও একটা গ্রীনফিল্ড এয়ারপোর্ট? চা শ্রমিকদের জন্য?

 

চা-শ্রমিকরা কি এই চা-বাগান ধ্বংসের শর্তগুলি মেনে নিয়েছেন? না, মুখ্য ট্রেড ইউনিয়নগুলি, মানে, কংগ্রেসের আইএনটিইউসি, সিপিএমের সিআইটিইউ, আর বিজেপির বিএমএস এয়ারপোর্ট নির্মাণ মেনে নিয়ে মৌ স্বাক্ষর করেছে। এবং এই মহান উন্নয়নের কাজে সর্বতোভাবে সাহায্যের গ্রীন সিগন্যাল দিয়েছে। কিন্তু ডলু বাগানে এই মুহূর্তে এদের সমর্থন কতটুকু? শিলচরের বিজেপি সাংসদ রাজদীপ রায় সরাসরি বলেছেন, সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের ট্রেড ইউনিয়নগুলিই স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন এবং তাদের সঙ্গেই মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছে। অথচ অধিকাংশ শ্রমিকের সমর্থনপ্রাপ্ত অসম মজুরী শ্রমিক ইউনিয়ন, যারা সামান্য হলেও প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, তাদের আলোচনায় ডাকা হল না।  ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট ১৯২৬-কে নস্যাৎ করে দেওয়া হল। নিউ ট্রেড ইউনিয়নের অ্যাফিলিয়েশন প্রাপ্ত অসম মজুরী শ্রমিক ইউনিয়ন-এর কাছাড় জেলা কমিটির লেটারহেডে জ্বলজ্বল করছে ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন নম্বর ২২৮৭। এরা স্বীকৃত নয়? তবে এরা কারা?

 

এরা তারা, যাদের বিজেপি বলছে ‘বহিরাগত’। এরা তারা, যাদের কিছুদিন আগেও বলা হয়েছে মাওবাদী। এখন জেলার পুলিশ সুপার রমণদীপ কাউর যখন বলছেন যে, আমরা এদের সঙ্গে মাওবাদী যোগাযোগের কোনও প্রমাণ পাইনি, তখন চাপে পড়ে বলা হচ্ছে, এদের সঙ্গে আলট্রা লেফ্টদের যোগাযোগ থাকলেও থাকতে পারে। বিজেপি বলছে ডলুতে উচ্ছেদ নয়, জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। তাহলে জেলা উপায়ুক্তের নোটিশে এভিকশান শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে কেন? আজ বলা হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়নগুলির সঙ্গে স্বাক্ষরিত মৌ প্রকাশ্য করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু গোপনীয়তার শর্তটি রাখা হয়েছিল কেন?

 

 

এই তথাকথিত উন্নয়নবিরোধীর তকমা যাদের গায়ে সেঁটে দেবার চেষ্টা হয়েছিল, তাদেরই কয়েকজন অরূপ বৈশ্য, বিশ্বজিৎ দাস, মৃণালকান্তি সোম-রা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে –

 

১. কেন ডলু? কেন পাশের বিশাল খালি জমি খরিল নয়? কী রহস্য যার জন্য বলির পাঁঠা বানানো হল ডলুর শ্রমিকদের?

২. পিএফ-এর অর্থ জমা দেওয়ার সাথে চুক্তির কী সম্পর্ক? এটা কোম্পানীর আইনি বাধ্যবাধকতা। অথচ পিএফ জমা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিকে তার বদান্যতা ও চুক্তির প্রতিশ্রুতি মানার আন্তরিকতা হিসাবে তুলে ধরেছেন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তাঁর চিঠিতে। কেন?

৩. এই অবৈধ ও শ্রমিকবিরোধী চুক্তির আগেও বাগান চলছিল ও লাভজনকভাবে চলছিল। তাহলে সরকার কোম্পানীর কাছে জমি চেয়েছে বলেই সেটা দিয়ে দেওয়ার জন্য প্রশাসনের চেয়েও বাগান মালিক ও কতিপয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতা কেন বেশি উদগ্রীব?

৪. শ্রমিকরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দৈনন্দিন কাজ করছিল  তখন ডলু চাবাগানের ডিজিএম হঠাৎ আইনশৃংখলার অবনতির ধুয়ো তুলে বাগান ছেড়ে পালালেন কেন?

৫. প্রথমে একজন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা শ্রমিকদের হুমকি দিলেন চুক্তি না মানলে চা বাগান লকআউট করে দেওয়া হবে। পরবর্তীতে ডিজিএম আইনশৃংখলা অবনতির কারণে চা বাগান লকআউট করার হুমকি দিলেন, যখন শ্রমিকেরা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়েই তাঁদের অসম্মতি জ্ঞাপন করছিলেন। কেন?

 

মনে রাখতে হবে বিজেপি সাংসদও বকেয়া পাওনা মিটিয়ে দেবার ঢালাও প্রতিশ্রতি দিয়েছেন। একজন শ্রমিকেরও চাকরী যাবেনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু পাশেই রয়েছে প্রতিশ্রুতি সত্বেও চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া পাঁচগ্রাম পেপার মিল এবং জাগীরোড পেপার মিল। শোনা যাচ্ছে জলের দরে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে মিল দুটো। কিন্তু শুনানীর পর শুনানী চলছে বকেয়া টাকাও শ্রমিকেরা পান নি।

 

বলা হচ্ছে কুম্ভীরগ্রাম বিমানবন্দরে আর প্রসারণের সুযোগ নেই। অথচ চাহিদা বাড়ছে। তাই ডলু বাগানে ২৫০০ বিঘা জমি দিয়ে শুরু হচ্ছে। একই সঙ্গে বলা হচ্ছে শ্রমিকদের জীবিকায় হাত পড়বে না, কেননা পার্শ্ববর্তী জমিতে নতুন করে চা গাছ লাগানো হবে। প্রথমত, যতদিন না সে চারাগাছ বড় হয়ে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তোলার অবস্থায় পৌঁছাচ্ছে ততদিন শ্রমিকদের জীবিকা নির্বাহের দায়িত্ব কে বা কারা নেবে? দ্বিতীয়ত, তখন এয়ারপোর্ট প্রসারণের দাবী উঠলে সেই তো আবার উচ্ছেদের প্রশ্ন উঠবে। নভেম্বর-ডিসেম্বর এ ডলু বাগানে চা-পাতা তোলা বন্ধ করা হয়েছিল কি আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য?

 

প্রশ্নগুলি অমীমাংসিতই থেকে গেল। একটি গ্রীনফিল্ড এয়ারপোর্ট তৈরীর জন্য সবাই এত মরিয়া কেন? উত্তর সম্ভবত লুকানো আছে গ্রীনফিল্ড এয়ারপোর্ট তৈরীর পিছনে যে বিপুল অর্থ প্রয়োজন, সেই হিসেবের অঙ্কে। গ্রীনফিল্ড এয়ারপোর্ট তৈরীর খরচ কমপক্ষে ৬৫০ থেকে ৭৫০ কোটি টাকার মত। এই বিপুল অর্থ জোগাবে কে? পিপিপি মডেলে হলে অর্থ জোগানের জন্য জনগণের ট্যাক্স তো আছেই। আর লাভের গুড় খাবার জন্য আদানীরাও প্রস্তুত। হিস্যার ভাগ কি অন্যেরা পাবে না? সর্বদলীয় সভায়, এআইইউডিএফ, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস সহ সব দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিল। সবাই ছিল। বিজেপির দাবী উন্নয়নের প্রশ্নে সবাই একমত ছিল। ছিটেফোঁটা, এঁটেকাঁটা পেলেও তো সাত পুরুষ বসে খাবে। মাত্র কয়েক বছর আগে ঢাকঢোল বাজিয়ে নমামি বরাক, নমামি ব্রহ্মপুত্র হয়ে গেল। শোনা গেল নদীর জলের মত টাকা আসবে, উন্নয়নে ফেটে যাবে বরাকভ্যালি। তারপর হঠাৎ হিরন্ময় নীরবতা। এই স্তব্ধতার অর্থ কী? অর্থ আসেনি? নাকি এসেও হিস্যা বাঁটতে ফুরিয়ে গেছে? এখন পরের কিস্তির অপেক্ষা?

 

মোদি-শাহ-যোগী রা আমাদের পোড়া দেশে এক নতুন ধারার রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। পুরুষকারের রাজনীতি। ক্ষমতার দর্প, স্বেচ্ছাচারিত্বের স্বাধীনতা। কোনও বিরোধিতাকে পাত্তা দিও না। দুদিন বাদে সব আন্দোলন থিতিয়ে যাবে। বিবেকদংশনমুক্ত আন্দোলন সমর্থক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী বড়ই উদ্বায়ী। তারাই যে কোনও বিরোধিতা, যে কোনও আন্দোলনের প্রান্তিক সুবিধাভোগী। প্রত্যন্ত বরাকে আরও একটি বিমানবন্দর তাদের জন্য মন্দ নয়। যে কোনও রাজনীতিকে বুলডোজার গুঁড়ো করে দাও। যেটা ঠিক করেছ, সেটাই করে যাও। ভোটের অঙ্ক বিগড়ে যাবার কথা ভেবো না, যেটা কংগ্রেস ভাবত। আত্মপ্রত্যয়ী হও। নির্বাচনের আগে ঠিক অন্য ইস্যু বেরিয়ে যাবে। জেতাও যাবে। সারা ভারতের পরিবেশবিদরা এই সবুজ ধ্বংসের বিরুদ্ধে গলা তুলছে না। অর্থনীতিবিদেরা চা-শিল্পের মৃত্যুঘন্টা বাজানোর বিরুদ্ধে সোচ্চার নয়। রাজনৈতিক দলগুলি উন্নয়নের হিস্যা খাবার লোভে বিজেপিকে অবাধ স্বাধীনতা দিতে রাজি। সব শেয়ালের এক রা। এটা প্রতীকী যে, ডলু চাবাগানে দুশোর কাছাকাছি বুলডোজার ব্যবহৃত হয়েছে চা আর ছায়াগাছগুলিকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে।

 

লেখক প্রাবন্ধিক ও কবি।

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: Sushanta on May 17, 2022

    সুন্দর লিখেছেন। অনেক ধন্যবাদ

Leave a Comment