নাটক: কেন পল্টু জোরে ছোটে?


  • May 6, 2022
  • (0 Comments)
  • 1230 Views

হাড়হাভাতে মানুষের জীবন-নামচা থেঁতলে যায় রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতির অদৃশ্য চাপে। কিন্তু থেমে যায় না। এ জীবন গাঁথা থাকে ইতিহাস ও রাজনীতির পালায়। এক চিলতে খুপরি ঘরের সীমানা, মহল্লার উঠোন, চাতাল ছুঁয়ে থাকে শৈশব, সর্ম্পক, মৃত্যু, ধর্ম, খিদে, রাগ, অভিমান, স্পর্দ্ধা, স্বপ্ন। জীবনই সেখানে পাঠশালা। সেই পাঠশালার নিত্যনতুন শিক্ষা গিলতে গিলতে কেন বাসচালক পল্টুর জোরে ছোটা? জবাব খুঁজতে বিদূষক নাট্যমণ্ডলীর পুরনো নাটক ‘কেন পল্টু জোরে ছোটে’-র কাছে ফিরে গেলেন কোয়েল সাহা।

 

রোজকার চলনবলন সবেতে ‘কেন’ এসে পিঁড়ি পেতে বসলে নতুন অনুসন্ধান শুরু হয়। কেন? – এই প্রশ্নের উত্তর যোগাতে চোখ-কান-নাক অর্থাৎ পঞ্চ ইন্দ্রিয় সহ মাথা নামক হেড অফিসের দরজা খুলে রাখতে হয়। তবে গিয়ে কেন-র উত্তর পরতে পরতে খোসা ছাড়ানোর মতো করে বেরিয়ে আসে। স্বাধীন ভারতে আছে কাঁটাতারের ক্ষত। তারই ভিতের উপর বিহারি দলিত মিল শ্রমিক লালটেন পাসোয়ানের সাথে ইমিগ্রেশন খাতায় নাম তোলা রিফিউজি বাঙাল সীতার প্রেম-দাম্পত্য জমে ওঠে মফস্বল বাংলার মিল মহল্লায়। চরিত্র-পাত্র-মিত্র নিয়ে এই দু’য়ের প্রেম-পিরীতি বিবাহের সফরনামা নিয়তিবাদের কপাল ফাটা লেবেল ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ে খোলা দুনিয়ায়।

 

নাটকে আছে হারমোনিয়াম-মেলোডিকা-ভায়োলিন তিন বাজনা আর গানের এফেক্ট। যে এফেক্ট আনন্দ-দুঃখ-যন্ত্রণা-যৌথতাকে টানটান করে টিউনে বেঁধে রাখে। লোকসঙ্গীতের গা বেয়ে ঘাম-রক্ত-শ্রমের সার টের পাওয়া যায়। ছাদ পেটানো থেকে ভারি মাল নামানো-ওঠানো – সুর-শব্দ-কথা হয়ে প্রকাশ পায়। মিল মহল্লায় ছিন্নমূল মানুষের জীবন গ্রাম-শহরের মাঝে লুম্পেন-অলুম্পেনের জাঁতায় পড়ে মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার আলোআঁধারি স্বপ্ন হয়ে আধভাঙা হিন্দি গানে ঢাকা পড়ে।

 

 

তিন বাজনার বাজনদার অঙ্কন ভট্টাচার্য, শুভ মাইতি ও জিৎ সেন নাট্যশাস্ত্রের নীতিরীতি মেনে, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো এক কোনে কেবল সুরঝঙ্কারের অধিপতি হয়ে থেকে গেলেন, তা কিন্তু নয়। বরং তাঁরা নাটকের ফ্লেক্সিবল চরিত্র হয়ে বহু মানুষের সংকেত হয়ে ওঠেন। বহুমাত্রিক জীবনসমাজের খাঁজে খাঁজে, বিচিত্র পরিসরে অন্ধকারের ধার ঘেঁষে থাকা পল্টুদের ছুটে চলা সময়ের দলিল এই নাটক।

 

আবার পল্টুর ছুটে চলা উজ্বল আলোর নীচে। এমন এক জীবনে, যেখানে আলোআঁধারির মারপ্যাঁচ নেই। যে জীবনে আড়াল চলে না। প্রেম, হিংসা, সন্তানের বেড়ে ওঠা, মৃত্যুভয়, বিচ্ছেদ, একের পর এক আসা-যাওয়া করে প্রাচীন অভ্যাসের মতো। একসময় আবার সেই রুটিনেও ধাক্কা লাগে। দলিত হিন্দুবাড়ির মেয়ের কাছে ধর্ম-যন্ত্রণার ধারণা স্পষ্ট হয়। সে প্রথা ভাঙে। স্বেচ্ছায় বিয়ে করে ভিনধর্মে। পল্টুর আপন সন্তান না হওয়ার দুঃখ ভুলে, টুম্পার অন্যপক্ষের কন্যাসন্তানকে ‘বেটা’ বলে হাঁকডাক কেবল সামাজিক স্বীকৃতি নয়, রক্তের সম্পর্কে উত্তরণের ইঙ্গিত। পল্টুর প্রথাগত শিক্ষা ছোটবয়সে থমকে গেলেও জীবন-পাঠশালার পাঠে তার কখনো ছেদ পড়েনি। জীবনসম্ভাবনার প্রতিটি ক্ষেত্রকে অদৃশ্য নানা হাতুড়ি-পেরেক ঘা মেরে মেরে কব্জা করার চেষ্টা জারি রাখলেও, চেতনাকে অত সহজে তারা বিকলাঙ্গ করতে পারে না।

 

 

হাড়হাভাতে মানুষের জীবন-নামচা থেঁতলে যায় রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতির অদৃশ্য চাপে। কিন্তু থেমে যায় না। এ জীবন গাঁথা থাকে ইতিহাস ও রাজনীতির পালায়। এক চিলতে খুপরি ঘরের সীমানা, মহল্লার উঠোন, চাতাল ছুঁয়ে থাকে শৈশব, সর্ম্পক, মৃত্যু, ধর্ম, খিদে, রাগ, অভিমান, স্পর্দ্ধা, স্বপ্ন। জীবনই সেখানে পাঠশালা। পাশাপাশি বসত করে হিন্দু-মুসলমান। মাঝে উসকে দেওয়া ক্ষমতাবাজদের দাঙ্গা অভিসন্ধি। স্বাধীন দেশে অদৃশ্য হয় আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। ভোট রাজনীতির ছিনিমিনি খেলার ফাঁদে পড়ে মিল মজুর উৎপাদন সম্পর্কের বাইরে সরে যেতে থাকে। মিলে তালা ঝোলে। সত্তর দশক মুক্তির দশক হয়ে মিল মহল্লার দরজাতে কড়া নাড়ে। স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করে জোরদার হয় আইনের শাসন।

 

এমনই এক শর্তসাপেক্ষ অঙ্গীকারে দর্শক-অভিনেতা মুখোমুখি উত্তরের খোঁজ শুরু করেন। ভারত সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতিতে গল্পের প্রভাব ভীষণ রকম। ‘পাণ্ডবানী’ থেকে ‘মহালয়া’, সবই গল্পের নিগড়ে বাঁধা। আমরা গল্প শুনতে পছন্দ করি। তবে এই নাটকের গল্প আমাদের ভুলোয় না। গল্প-কথা-গান-বাদ্য-ঝনঝনানি শরীরি ভাষা স্নায়ুযন্ত্রকে টানটান করে রাখে। মন মজানো নয়। বরং আমাদের ভাবনাচিন্তা নানা পরিসরে চলাচল করার রাস্তা খুঁজে পায়। গল্পের কথক ঝাঁকুনি দিয়ে নানা প্রসঙ্গের সূত্র ধরিয়ে দিতে থাকেন। প্রসঙ্গ টেনে বলা যেতে পারে, এ হল ভারতের প্রাচীন এপিক ধারা – বিদুর যেভাবে রাজতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্রের নিগড়ে গড়ে ওঠা কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধকে বর্ণনা করেছেন, যাকে তামাম দুনিয়া দার্শনিক অভিপ্রায় বলে মান্যতা দিয়ে থাকেন।

 

 

নাটকের কাঠামো ঘিরে গল্পটি ভূত-বর্তমানের সাথে পাঞ্জা কাষাকষি করে। শতাংশের হিসাবে ৯৯.৯৯ বোকা বনে যাওয়া মানুষের প্রতিনিধি এই পল্টু। আপনার-আমার জীবনের প্রতিনিধি এই পল্টু – বাসের স্টিয়ারিং ধরে ডান-বাঁ-সাইড কাটাতে কাটাতে তুলনায় সে জড়িয়ে পড়ে ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬৫) চলচ্চিত্রের অভিরাম চরিত্রটির সাথে। শাসক বাস-কর্তৃপক্ষের সচেতন অবহেলা কারচুপির দায় এড়াতে না পেরে অভিরামের মতো চরিত্রদের ব্রেক ফেল করে।  সমাজ-জীবন শোষণের যেসব ছোটবড় দ্বন্দ্বকে চাপা দিয়ে রাখতে চেষ্টা করে, তা এক লহমায় বেআব্রু হয়ে বেরিয়ে পড়ে রাজপথে। কেন পল্টু জোরে ছোটে? উত্তরের খোঁজ এখান থেকে শুরু হলেও পল্টুদের জোরে ছোটা তার বহু আগে থেকে জারি আছে।

 

আয়নায় আপনার-আমার প্রতিবিম্ব হয়ে কলুর ঘানি টেনে ছুটে চলেছে পল্টু। কোন সুর্বণক্ষণে পল্টু আট ঘন্টা কাজের বিরতি টেনে চেতনার স্নায়ুযন্ত্রকে ধারালো করতে পারবে? ঘাড়ে চেপে বসা বদ অভিসন্ধির সাঙাৎকে নস্যাৎ করতে পারবে? এই প্রশ্নগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করাটা দর্শক হিসাবে আমাদের হোমওয়র্ক। বিদূষক দলের হয়ে প্রয়াত রাজা বিশ্বাস, বর্তমান নির্দেশক অমিত সাহা ও প্রত্যেক অভিনেতা ১ ঘন্টা ৩০ মিনিটের পরিসরে আমাদের হয়ে এই প্রশ্নগুলি নিয়েই নাড়াচাড়া করেছেন।

 

 

লেখক গবেষক বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।

Share this
Leave a Comment