দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে আর্ন্তজাতিক শ্রম দিবস উদযাপন। পাশাপাশি খুব শীঘ্রই দেশে চালু হতে চলেছে শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী চারটি শ্রমকোড। ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক সংগঠনগুলির বর্তমান চিত্র এ দেশে হতাশাজনক। দেশব্যাপী একটি সম্মিলিত জোরদার শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠল না গত তিন-চার বছরে শ্রমকোড পাশ ও জারি হওয়া আটকাতে। মে দিবস পালন কী তাহলে রয়ে গেল শুধু খাতায়-কলমেই? লিখলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
পয়লা মে – আর্ন্তজাতিক শ্রম দিবস। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন দেশ জুড়ে আজকের দিনটি উদযাপন করছেন। তাদের সামগ্রিক কার্যাবলির মধ্যে এই ঐতিহাসিক দিনটি পালন করাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকের অধিকার, শ্রমের যোগ্য পারিশ্রমিক, সামাজিক সুরক্ষা, কাজের সুস্থ পরিবেশ, সম কাজে সম বেতন দাবিতে এবং, মালিকপক্ষের শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের যে লড়াই চলে তা যেন কোনও পরিস্থিতি, কোনও রাষ্ট্র তথা সরকারের চাপের কাছেই নতিস্বীকার না করে, তা নিয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ারই দিন পয়লা মে – ‘মে দিবস’। অথচ যদি বাস্তবের দিকে তাকানো যায় তাহলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় দেখে যে, ভারতে গত কয়েক দশকে শ্রমিক আন্দোলন যেন তার গতিপথ থেকে দুর্ভাগ্যজনকভাবেই কিছুটা হলেও সরে এসেছে।
ট্রেড ইউনিয়ন-এর ভূমিকা ক্রমশই যেন শুধু খাতায়-কলমে রয়ে যাচ্ছে। বিবিধ পরিকল্পনা এবং নানা মতের ঐক্য-অনৈক্য সব মিলিয়ে শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্বের যে প্রকৃত ভূমিকা থাকার কথা – শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার জন্য – সেই বিষয়টিতেই তাঁরা পিছিয়ে পড়ছেন। আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে পয়লা মে-র শপথ গ্রহণ তাই নিছক উদযাপন হয়েই আটকে থাকছে। কী করেই বা ভুলে যাওয়া যায় দু’বছর আগে কোভিড-১৯ মহামারী যখন সারা বিশ্বের মতো এ দেশেও থাবা বসাল তখন সবচেয়ে বেশি দুরাবস্থায় পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষেরাই। মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন, পথে মরে গেছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা – যার কোনও তথ্য না কি দেশের সরকারের কাছে নেই-ই। এহেন অবস্থা তৈরির পরও কোনও জোরদার, শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন দানা বাঁধেনি। কোনও নেতৃত্বই তার দায়িত্ব নেননি।
অথচ মহামারী পূর্ববর্তী সময়ে যে ক্ষেত্রগুলিতে গত কয়েক বছরে শ্রমিকেরা বিভিন্ন শোষণ এবং মালিকপক্ষের শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী কাজের জন্য নিজেরা সংগঠিত হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন সেই ক্ষেত্রগুলিতে তারা কম-বেশি সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু তবু একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, বেসরকারিকরণ, শ্রমিক ছাঁটাই, চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের কোনওরকম সুযোগ-সুবিধা ছাড়া কর্মচ্যূত করা, অসংগঠিত শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকার চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতা, শ্রমজীবী নারীদের কাজের জায়গায় বৈষম্য, যৌন নিপীড়ন ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী অবিরাম আন্দোলনের চিত্র আর চোখে পড়ে না।
ঠিক এই শূণ্যস্থানটির সুযোগ নিয়েই দেশের বর্তমান সরকার সম্পূর্ণ শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী চারটি শ্রমকোড সংসদে পাশ করিয়ে নেয়। তিন, চারটি রাজ্য বাদে বাকি সব রাজ্যেই এই কোড অনুসরণ করে রুল-ও ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকার গত বছরেই এই নতুন শ্রমকোড-এর অধীন তার নিজস্ব রুল প্রস্তুত করে নিয়েছে। মাত্র চার দিন আগে, কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী ভূপেন্দর যাদব জানিয়েছেন শীঘ্রই সারা দেশ জুড়ে এই শ্রমকোড চালু করা হবে। ২০১৯-’২০ সালে এই নতুন চারটি কোড সংসদে পাশ হওয়ার আগে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন নিশ্চিতভাবেই অনেক আলোচনা চালিয়েছে, অসংগঠিত শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনও এই কোড চালু হলে শ্রমিকদের উপর শোষণ কী বিরাটভাবে বেড়ে যাবে তা নিয়ে অনেক সভা-কর্মশালা ইত্যাদি চালিয়েছে, কিন্তু কোনও পক্ষই বিভিন্ন সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিবিধ ধরনের বিপুল সংখ্যক শ্রমিকদের একত্রিত করে একটি মিলিত আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্বটি নেয়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। কার্যত বিনা প্রতিরোধে পাশ হয়েছে শ্রমিক-বিরোধী চারটি শ্রমকোড, যা হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যেই চালুও হয়ে যাবে।
এই মুহূর্তে প্রাচীনপন্থী ভাবনা ও কার্যপদ্ধতির উপর নির্ভর করে ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক সংগঠনগুলি যদি দাবি আদায় ও শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার পরিকল্পনা করে তাহলে তা এই কর্পোরেট-পোষ্য বর্তমান কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে যুঝে যাওয়ার জন্য আদপেই কার্যকরী হবে না। দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা, করোনা-আতঙ্ককে সঙ্গে নিয়েও নিজেদের দাবি থেকে পিছু না হঠা কৃষক আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে নিজেদের দাবি নিয়ে পথে নামলে সারা দেশ কাঁপিয়ে দেওয়া যায়, সমর্থন পাওয়া যায় সব মেহনতী মানুষদের থেকে এবং সবচেয়ে বড় কথা দেশের সরকারকে বাধ্য করা যায় কৃষক-স্বার্থ বিরোধী কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে। এখনও অনেক দাবি আদায় বাকি ও সেই লক্ষ্যে আন্দোলনের রূপরেখাও তৈরি করছেন কৃষক নেতৃত্ব। এই কৃষক আন্দোলনের হাত ধরেই স্লোগান তৈরি হয়েছে শ্রমিক মজদুর একতা জিন্দাবাদ। দিল্লির কৃষক আন্দোলন চলাকালীন যেমন শ্রমিক নেতৃত্ব সেখানে পৌঁছেছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন তেমনি কৃষক নেতৃত্বও বিভিন্ন সময়ে বারেবারেই বলেছেন শ্রমিকদের যদি কোনও বৃহত্তর আন্দোলন সংগঠিত হয় শ্রমকোড বাতিলের দাবিতে তাহলে তাঁরা সর্বতোভাবে পাশে থাকবেন, কিন্তু প্রাথমিকভাবে লড়াইটা শ্রমিকদের এবং তাদেরই ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করে আন্দোলনে নামতে হবে। এবং বাস্তব হল দেশের শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন এই জোটবদ্ধ আন্দোলন তৈরি করতে আপাতভাবে ব্যর্থই হয়েছে।
দেশের ৪৪টি শ্রম আইনকে এই চারটি শ্রম কোড-এর মধ্যে নিয়ে আসা হল। এ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে এই শ্রমকোডগুলি তৈরি হল সম্পূর্ণভাবে বেসরকারিকরণের পথকে মসৃণ করার জন্য, কর্পোরেট পুঁজির বিনিয়োগের পথে যাতে কোনওরকম বাধা না থাকে তা সুনিশ্চিত করার জন্য। প্রযুক্তির প্রয়োগে শ্রমিকদের পরিশ্রম কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানো নয় বরং শ্রমিকদের ছাঁটাই করে বা তাঁদের অতিরিক্ত শ্রমের বিনিময়ে ন্যূনতম সুবিধাটুকুও না দিয়ে কীভাবে নিজেদের সম্পত্তি বাড়ানো যায় দেশের সরকারের সহায়তায় তা এই কর্পোরেট ধনকুবেরদের কাছে আরও সহজ হয়ে উঠবে। ভাবনার বিষয় হল যেহেতু শ্রমিক আন্দোলনের পরিসরে শ্রমকোড বাতিলের দাবিতে কোনও শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে ওঠেনি, ফলে সমাজের অন্যত্রও এ নিয়ে আলোচনা, আন্দোলন দানা বাঁধেনি।
এই শ্রমকোডগুলি হল মজুরি সংক্রান্ত শ্রমকোড, সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত শ্রমকোড, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত শ্রমকোড, শিল্প-সম্পর্ক সংক্রান্ত শ্রমকোড। এই চারটি শ্রমকোড চালু হলে শ্রমিকদের যাবতীয় অধিকার খর্ব হয়ে যাবে, যা ইতিমত্যেই মজুরি কোড আইন হওয়ায় দেখাই যাচ্ছে। শ্রমিক ইউনিয়নের দীর্ঘদিনের দাবি মতো শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক মজুরি ২১ হাজার টাকা নয়, তা হয়ে গেছে ৪৬২৮ টানা। আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে এই মজুরিতে একটি শ্রমিক পরিবারের জীবন নির্বাহ কীভাবে হবে তা নিয়ে সরকারের কোনও বক্তব্য নেই। এই মজুরি হলে শ্রমিকেরা প্রাথমিকভাবে একটি সুস্থ জীবনযাপন থেকে বহু দূরে চলে যাবেন সেই রাস্তাই তৈরি করে দিচ্ছে সরকার। এর ফলে দরিদ্ররা আরও দরিদ্র ও ধনীরা আরও ধনী হয়ে উঠবেন স্বাভাবিক নিয়মেই।
এই শ্রমকোড অনুযায়ী চাকরিতে কাজের মেয়াদ আট ঘণ্টা থেকে বেড়ে ১২ ঘণ্টা হয়ে যাবে। কাজের ক্ষেত্রে স্থায়িত্ব বলে কিছুই থাকবে না। সব চাকরির ক্ষেত্রেই ছ’মাসের চুক্তি করা হবে। শ্রমিকদের দাবি আদায়ের জন্য যে দর কষাকষি (নেগোশিয়েশন) তার কোনও উপায় রাখছে না এই কোড, এই অধিকার বাতিল করা হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা ক্ষেত্রটিও বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেই আশঙ্কা শ্রমিক মহলের।
সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে দু’টি বিষয়। এই কোড অনুযায়ী শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে ইউনিয়নের শীর্ষ নেতা বেছে দেবে মালিকপক্ষ। দ্বিতীয়ত, কোনও কাজের জায়গায় যদি ৩০০ জনের বেশি কর্মী থাকে তাহলে কর্মী ছাঁটাইতে প্রশাসনিক অনুমতি লাগবে আর ৩০০-র কম হলে শ্রমিক ছাঁটাইতে কোনও অনুমতি লাগবে না। মনে রাখা দরকার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিল্পক্ষেত্রেই শ্রমিক সংখ্যা ৩০০-র কম, ফলে অধিকাংশ শ্রমিকই ছাঁটাইয়ের ভয় ও দুশ্চিন্তা সঙ্গে করে প্রতিদিন কাজে যাবেন। প্রতি পদেই আর্ন্তজাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) নির্দেশ লঙ্ঘন করা হয়েছে এই শ্রমকোডগুলিতে।
আরও একটি মে দিবস চলে যাবে, আর্ন্তজাতিক শ্রম দিবস উদযাপিত হবে। অথচ কোনও সরকার, প্রশাসন, রাষ্ট্রর বুকে কাঁপন ধরানো, শ্রমিক-বিরোধী শ্রমকোড প্রত্যাহারে বাধ্য করা শ্রমিক আন্দোলন শুরু হবে না এ দেশে।
গ্রাফিক্স : অলিভিয়া