বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে তো বটেই তাছাড়াও যেকোনও রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কথা না বললেই সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকেরা সরকার ও প্রশাসনের রোষের মুখে পড়ে যাবেন এটাই এখন এ দেশে রীতি হয়ে উঠেছে। লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী।
মধ্যপ্রদেশের এক পুলিশ স্টেশনে সরকার-বিরোধী প্রতিবেদনের অভিযোগে একজন সাংবাদিক (ইউ টিউবার) ও এক থিয়েটার কর্মীসহ আটজনকে সম্প্রতি আটক করা হয়। বিষয়টি শুধু আটকেই থেমে থাকেনি, তাঁদের সম্পূর্ণ পোশাক খুলিয়ে নিয়ে শুধু অর্ন্তবাস পরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় ও সেই চরম অস্বস্তিজনক অবস্থায় পুলিশ হেফাজতে তাঁদের ছবি তুলে সেই ছবি মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াটস অ্যাপে ভাইরাল করে দেওয়া হয়। বার্তাটি খুব স্পষ্ট যদি সরকারের, রাষ্ট্রের কেনা সংবাদমাধ্যম না হয়, যদি সাংবাদিকতার নামে নিজের সাংবাদিক সত্ত্বাকে বিক্রি করে প্রাণের ভয়ে, কিছু বিলাস-ব্যসন, সুবিধাভোগের লোভে ক্ষমতাসীনের পদলেহন করতে না পারেন, তাহলে সাংবাদিকের পরিচয়টিকে এরকম চূড়ান্ত অপমান, হেনস্থা ও সামাজিক অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দেওয়া হবে। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে তো বটেই তাছাড়াও যেকোনও রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কথা না বললেই সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকেরা সরকার ও প্রশাসনের রোষের মুখে পড়ে যাবেন এটাই এখন এ দেশে রীতি হয়ে উঠেছে।
কয়েক দশক আগেও কোনও সরকারের দূর্নীতি বা সরকার ও অন্ধকার জগতের খবর করতে গিয়ে সাংবাদিকদের কয়েকটি অর্ন্তধান বা হত্যার ঘটনা আমাদের নাড়িয়ে দিত। শিউরে উঠে সকলেই ভাবত, ‘এসব তো সিনেমায় দেখা যায়!’ কিন্তু সিনেমা নয়, দু’দফায় দেশে সরকার গঠনের পর বিজেপি শাষিত কেন্দ্র সরকার সংবাদমাধ্যমকে বাস্তবিকই রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতিয়ারে পরিণত করেছেন, তাদের নির্দ্ধারিত নিয়ম মেনেই খবর করতে হবে, দেখানো যাবে না কোনও রকম দমন-পীড়ন, তারা যাদের শত্রু মনে করছে তাদের বিরুদ্ধে, সেইসব মানুষদের নিয়ে সঠিক তথ্যনির্ভর খবর করা সর্বতোভাবে বন্ধ। কেউ কোনওভাবে যদি এই স্রোতের বিপরীতে হাঁটার চেষ্টা করেন তাহলেই তাঁর হাল হবে মধ্যপ্রদেশের সাংবাদিকদের মতো। ভয়ের আবহাওয়া তৈরি করে রেখে সংবাদমাধ্যমের কন্ঠরোধ করে রাখা – এটাই এই সরকারের পরিকল্পিত পন্থা।
বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার অবস্থা কীরকম তা জানার জন্য একটি তথ্যই যথেষ্ঠ। ২০১৯ সালে প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স-এ সারা বিশ্বের দেশগুলির নিরিখে ভারত ছিল ১৪০তম স্থানে। ২০২০-’২১-এ আরও দু’ধাপ নেমে তা দাঁড়িয়েছে ১৪২। এই সংখ্যা থেকেই বোঝা যায় দেশের স্বাধীন সংবাদ পরিবেশনের মান কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দেশের সংবাদমাধ্যম জরুরি অবস্থা দেখেছে, দেখেছে কীভাবে কোন্ খবর প্রকাশিত হবে আর কোন্ খবর লোকচক্ষুর আড়ালে থাকবে তা সম্পূর্ণভাবে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু সেই সময়েও সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, সম্পাদক, সাংবাদিকেরা নিজেদের মতো করে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু আজ যেন সবটাই বিক্রি হয়ে গেছে। সাংবাদিকতার জন্য যে ঋজু শিরদাঁড়াটি প্রয়োজন ভয়ে, লোভে তা ক্রমেই ঝুঁকে পড়ছে। সেই কারণেই মূলধারার সংবাদমাধ্যমের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তৈরি করে নিতে হচ্ছে বিকল্প সংবাদমাধ্যম। যেখানে ঝুঁকি বেশি, প্রয়োজন সাহস, সততা আর সাংবাদিক পরিচয়টির প্রতি প্রবল বিশ্বাস।
এ দেশে এখন পুঁজিপতিরা অধিকাংশ সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলির মালিক। সরকার আর এই পুঁজিপতিদের আঁতাত সম্পর্কেও সকলেই ওয়াকিবহাল। এই যে এক নতুন শব্দবন্ধ প্রচলন হয়েছে ‘গোদি মিডিয়া’ তা তো এই সম্পর্কেরই ফলশ্রুতি। সেই কারণেই এ দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, গণহত্যা থেকে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সবকিছুই বিরোধীদের ষড়যন্ত্র হয়ে যায় সংবাদমাধ্যমে, সেই কারণেই মানবাধিকার কর্মীদের জেলযাপন খবর হয় না, সেই কারণেই এমন সংবাদ পরিবেশিত হয় যাতে মনে হয় এক দুর্দান্ত ‘আচ্ছে দিন’-এর মধ্যেই দিন কাটাচ্ছি আমরা, সংবাদমাধ্যম থেকে শিল্প সবেতেই বাক স্বাধীনতা উপভোগ করছি। অথচ বাস্তব যেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সিনেমা, শিল্প সবেতেই জোর করে গিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশপ্রেম আর ধর্মের পাঁচন এবং সংবাদ মানেই শুধু গলা ফাটিয়ে জো-হুজুর বলে যাওয়া। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে মূলধারার সংবাদ মাধ্যম সব রকম খবর করবে, সরকারের মুখপত্র হয়ে উঠবে না সেটিই কাম্য, তবু্ রাজনীতির মারপ্যাঁচে সব দেশেই রাষ্ট্রের বা বলা ভালো সরকারের ধ্বজাধারী কিছু সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিক সব সময়েই থাকেন।
দুর্ভাগ্যবশত বর্তমান ভারতবর্ষে সেই সংখ্যাটাই প্রায় পুরোটা দখল করে রেখেছে। তাই গোদি মিডিয়া চলে রমরমিয়ে। কিছুটা সরকারবিরোধীতা করলেও সরকারী বিজ্ঞাপন নিতেই হয়। যে কারণে বিকল্প সংবাদমাধ্যম অপরিহার্য হয়ে উঠছে। সেইজন্যই সামাজিক মাধ্যম, ইউ টিউব ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মগুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই সরকারের নজরে পড়ে বেঘোরে মরে যাওয়া, অনির্দিষ্টকালের জন্য জেল হাজত, আটক থাকাকালীন সমস্তরকম সাংবিধানিক অধিকার ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত থাকা, সামাজিক হেনস্থা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা সব মেনে নিয়েও মূলধারার বাইরে বেরিয়ে সাংবাদিকতা করছেন কিছু মানুষ। সেই বিকল্প ধারাও কোথাও কোথাও ‘অ্যাপ্রোপ্রিয়েট’ বা নিজেদের মতো করে যথাযথ করে নেওয়ার প্রচেষ্টা চোখে পড়ে আজকাল। আসলে অই যে প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা করতে করতেই অনেক সময়ে প্রতিষ্ঠান হয়ে যায় অনেকে। এই মুহূর্তে সাংবাদিকতায় সেই আশঙ্কা রয়েছে তো বটেই।
মধ্যপ্রদেশের ঘটনাটি ভাইরাল হওয়ার পর প্রশাসনিক স্তরে কিছু লোক দেখানো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সর্বস্তরের সংবাদ মাধ্যম, শিল্পী মহল, থিয়েটার গোষ্ঠীর মানুষদের থেকে জোরালো প্রতিবাদ উঠে আসেনি। প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়া আর ইন্ডিয়ান উওমেন প্রেস কর্প (আইডব্লিউপিসি) এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছে ঘটনার এক দিন পরে। সেখানে কেবলই ধিক্কার জানানোর কিছু শুকনো বুলি। এক পাতার একটি চিঠিতে একটি নির্দিষ্ট ছকে প্রতিবাদ জানিয়ে আসলে যে কাজের কাজ কিছুই হয় না তা আমরা সকলেই জানি। একজন ইউ টিউবার, যিনি স্বাধীন সাংবাদিক, একজন থিয়েটার শিল্পী ও আরও মানুষেরা যাঁরা সেদিন পুলিশি হেফাজতে নগ্ন হতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা নামীদামী সংবাদমাধ্যমের পরিচিত প্রাইম টাইম-এর মুখ নন, বিকল্প সংবাদমাধ্যমের তথাকথিত অপ্রাতিষ্ঠানিক তারকাও নন, নেহাতই এক অখ্যাত স্থানের কিছু স্বাধীন পেশাদার মানুষ। তাঁদের জন্য যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা ছিল আমাদের, যেভাবে রাস্তায় নামার ছিল, যেভাবে তদন্তমূলক প্রতিবেদন করার ছিল – তা করা হল কোথায়? কেবলই সাংবাদমাধ্যমের হোতারা চিঠি দিয়ে দায় মেটালেন। সে চিঠি কার বিরুদ্ধে, কী পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারের এধরনের প্রতিশোধমূলক চূড়ান্ত অবমাননাকর আচরণ রুখতে সে বিষয়ে কোনও স্পষ্ট বক্তব্য নেই।
একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী যে কোনও সরকারই সংবাদমাধ্যমকে নিজের তাঁবে রাখতে চায়। তাই এ রাজ্যেও দেখি সাংবাদিকদের উপর নেমে আসে নৃশংস আক্রমণ। প্রচন্ড মারধোর, খবর করার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ভেঙে দেওয়া, ভয় দেখানো কোনও কিছুই বাদ থাকে না। তার প্রতিবাদে এক দিনের মোমবাতি মিছিল বা প্রেস ক্লাবের সামনে ছোট্ট প্রতিবাদ – ব্যস এটুকুতেই শেষ হয় সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। মানছি চাকরি অপরিহার্য। কিন্তু কিছু পেশা মতাদর্শের উর্দ্ধে উঠে টিঁকিয়ে রাখা যায় না। সৎ সাংবাদিকতা, সঠিক খবর করাটা তাই সাংবাদিকের চাকরি বাঁচিয়ে রাখার প্রথম ও একমাত্র শর্ত। স্বাধীন সাবাদিক মানে তাই শুধুমাত্র ‘ফ্রিল্যান্সার’ নয়, স্বাধীন সাংবাদিক মানে রাষ্ট্র, সরকার, পুঁজিবাদ সব, সব কিছুর বিপরীতে দাঁড়ানো, সংবাদের প্রয়োজনে।
মধ্যপ্রদেশের ইউ টিউবার সাংবাদিক না কি সাংবাদিক নন, সে তর্ক এখন গুরুত্বপূর্ণ নয়। সময়ের প্রেক্ষিতে সাংবাদিকতা নতুন ভাষা, নতুন মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছে, তৈরি করছে। তা যদি সাংবাদিকতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়, নীষ্ঠ থাকে তাহলে তার পাশে দাঁড়ানোটাই সময়ের দাবি। কারণ সংবাদমাধ্যমের প্রকৃত তথ্যই প্রতিরোধের ভাষা।