চা শিল্পের সঙ্কট ও বাস্তবতা


  • March 30, 2022
  • (1 Comments)
  • 1410 Views

বাংলার চা শ্রমিকরা কি ন্যূনতম মজুরি আইনে মজুরি পেতে চলেছেন? শ্রমমন্ত্রী বেচারাম মান্নার আসন্ন সফর এবং সরকারি মহলে, মন্ত্রী-আমলাদের দপ্তরে মালিক পক্ষের সংগঠনের প্রতিনিধিদের ঘন ঘন যাতায়ত এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরের টানাপড়েনে তেমনই ইঙ্গিত মিলছে। বর্তমানে শ্রমিকরা ২০২ টাকা হাজিরা পান। তার বদলে নূন্যতম মজুরি আইনে মজুরির জন্য শ্রমিক সংগঠনগুলি দীর্ঘকাল লড়াই চালাচ্ছে। সন্দেহ নেই এর ফলে শুধু তিন লক্ষ শ্রমিক লাভবান হবেন তাই নয়, গোটা উত্তরবঙ্গের অর্থনীতি লাভবান হবে। তবে মাঠে নেমে পড়েছে মালিক সংগঠনগুলো। সংবাদমাধ্যমের দ্বারা বোঝানোর শেষ চেষ্টা চলছে নূন্যতম মুজুরি আইন লাগু হলে চা শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে। রপ্তানি কমে যাওয়া, চায়ের দাম না পাওয়া, ছোট বাগানের বাড়বাড়ন্ত ও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ধারাবাহিক প্রচারে আমাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে দাড়িয়েছে যে চা শিল্প সঙ্কটে। এতে প্রভাবিত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে চা শ্রমিকদের আন্দোলন। তাই অর্থনীতির সরল যুক্তিতে আজ বুঝে নেওয়া যাক মালিকদের এই দাবির কতটা যুক্তি আছে! লিখেছেন রুপম দেব।

 

মালবাজারে নূন্যতম মুজুরির দাবি নিয়ে গঠিত জয়েন্ট ফোরামের আলোচনা সভা।

 

চায়ের দাম না পাওয়ার গল্প

 

কারখানা থেকে চা উৎপাদন হওয়ার পর চা দু’ভাবে বিক্রি হয়। একটি অকশনে আরকটি খোলা বাজারে। অকশনের দাম জানা গেলেও খোলা বাজারে বিক্রির হিসেব জানা যায় না। বিভিন্ন মহলে অভিযোগ মালিকপক্ষ অকশনে খারাপ চা পাঠিয়ে থাকে আর খোলা বাজারে যায় ভালো চা।

 

বিষয়টি আরো ভালো করে বুঝে নেওয়া যাক। পুরো ভারতের আর্থিক বছর ২০১৮-১৯ চায়ের অকশনের দাম ধরলে দাঁড়ায় ১৪১ টাকা ৯৪ পয়সা আর ২০১৯-২০২০ অকশনের দাম দাঁড়ায় ১৩৯ টাকা ১৮ পয়সা। অর্থাৎ ৩ টাকার ওঠা নামা। এই তথ্য দেখিয়ে মালিক পক্ষ বোঝানোর চেষ্টা করবে চা শিল্প সঙ্কটে। এবার একটু গভীরে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করলে আমরা জানতে পারি ২০১৯-২০ দেশের চায়ের উৎপাদন ১৩৬০.৮১ মিলিয়ন কেজি। যার মধ্যে অকশনে গিয়েছে ৬০৩.৫৪ মিলিয়ন কেজি। আর রপ্তানি হয়েছে ২৪১.৩৪ মিলিয়ন কেজি। বাকি ৫১৫.৯৩ কেজি খোলা বাজারে বিক্রি হয়েছে যে দামের কোনও হিসেব আমরা পাই না (India data portal)। শ্রমিক আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য এবং সরকারের সাথে আলাপচারিতায় মালিকপক্ষ আপেক্ষিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারবে বলে আংশিক তথ্য বার বার প্রচার করা হয়। বলে রাখা ভালো এই সব ক্ষেত্রে টি বোর্ডের ভূমিকা ন্যক্কারজনক। কারণ চায়ের লাভ লোকসানের পুরো তথ্য সামনে আনার দ্বায়িত্ব টি বোর্ডের।

 

এও বলে রাখা দরকার অকশনের দামকে প্রভাবিত করার চেষ্টাও মালিকপক্ষ থেকে হয় এমন অভিযোগ বহু পুরনো। আইএলও রিপোর্টে প্রকাশ বড় বড় কোম্পানি কীভাবে নিলাম কেন্দ্রকে প্রভাবিত করে দাম কমিয়ে আর খুচরো বাজারে চায়ের দাম বাড়িয়ে মুনাফা কামিয়ে নেয়। এই একই তথ্য আমরা টি বোর্ডের  সমীক্ষাতেও পাই। ভারতের অর্ধেক চা উৎপাদন অকশনের মাধ্যমে বিক্রি হয়। যার সিংহভাগ বিক্রি হয় কতিপয় সংস্থার মাধ্যমে। ফলত অকশনে কৃত্রিম ভাবে দামের হ্রাস ঘটানো অসম্ভব নয়।

 

রপ্তানি ও চাহিদা যোগানের গল্প 

 

বাংলায় যখন ন্যূনতম মুজুরি আইন হওয়ার জোর চর্চা চলছে। ঠিক সেই সময় খবরে প্রকাশ ২০২১ দেশের চায়ের রপ্তানি কমে গিয়েছে। এবং সস্তা দাম হওয়ার দরুন কেনিয়া বাজার দখল করেছে। তবে পাঠকদের বলব টি বোর্ডের ওয়েবসাইটে গিয়ে কয়েকবছরের রপ্তানির হিসেব দেখলে বোঝা যাবে। ভারত থেকে কেনিয়ার চায়ের দাম যখন বেশি ছিল তখনও কেনিয়া বেশি রপ্তানি করেছে। ফলত কম দামের সাথে রপ্তানির কোনও সম্পর্ক নেই। আসলে কেনিয়া হল রপ্তানি নির্ভর দেশ। আমাদের দেশের চায়ের বাজার রপ্তানি নির্ভর নয়। দেশের অভ্যন্তরীণ চায়ের বাজার অনেক বড়। এই কথা বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ সোভিয়েত পতনের সাথে আমাদের দেশের ‘চায়ের মন্দা’ কে দেখানো হয়। টি বোর্ড অফ ইন্ডিয়া এবং ভারতের চা মালিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন মিলিতভাবে এক সমীক্ষা করে ২০০৬ সালের রিপোর্টে স্বীকার করে, দেশের আভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদার বৃদ্ধির জন্যই রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা ও রপ্তানির মধ্যেও কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে। এই কারণেই সরকার চায়ে রপ্তানি শুল্ক বাড়িয়ে দেয়। এবং ২০০-২১৫ মিলিয়ন কেজি বেশি চা রপ্তানি করা যাবে না বলে নির্দেশ জারি করে  (Tea Board, Tea Statistics, ১৯৭৭৭৮)। যে কোনও দেশে অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পুরণ না করে বা দ্রব্যমূল্য ঘটিয়ে বিদেশে দ্রব্য রাপ্তানি করা যায় না।

 

২০১৯-২০ সালে দেশে চায়ের আনুমানিক চাহিদা ধরা হয়েছিল ১১১৬ মিলিয়ন কেজি কিন্তু চাহিদা ছিল ১১৩৫.০১ মিলিয়ন কেজি। পরবর্তী বছর গুলোতেও একই চিত্র দেখা গিয়েছে। এমনকি লকডাউনের সময়েও চাহিদা যোগানের খুব একটা পার্থক্য ঘটেনি (টি বোর্ডের হিসেব)। ফলত মালিকের কথা অনুসারে চায়ে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ধরে নিলেও চা শিল্পে ক্ষতির সম্ভাবনা নেই কারণ বাজারে চায়ের চাহিদা যোগানের চেয়ে বেশি।

২৮-২৯ মার্চ দেশজুড়ে ধর্মঘটের পক্ষে বীরপাড়া অঞ্চলে CITU-র মিছিল। রয়েছেন, পরিচিত চা শ্রমিক নেতা জিয়াউল আলাম।

 

চট জলদি মুনাফা লুঠ করাই বাগান ধ্বংসের আসল কারণ 

 

বহু সময় বাগানের উৎপাদন বেশি না হওয়া বা গুণগত চা পাতা না থাকা কে চায়ের মন্দার প্রতিচ্ছবি বলা হয়। কিন্তু এর পেছনে দায়ী বেশি বয়সের গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ এবং নতুন চারা গাছ না লাগানো। সাধারণ ভাবে ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে চা গাছ বাণিজ্যিকভাবে অনুৎপাদক হয়ে যায়। আমাদের উত্তরবঙ্গের বহু চা বাগিচার গাছের বয়স পঞ্চাশের উপরে। এছাড়া আজও প্রায় ৬০ শতাংশ বাগান সেচের অধীনে আসেনি। বছরে অন্তত ২ শতাংশ রিপ্ল্যান্টেশন করার কথা। টি বোর্ড থেকেও রিপ্ল্যান্টেশন করার জন্য বাগানগুলি অনুদান পেয়ে আসছে। তবুও মালিকের শিল্প ভাবনার পরিবর্তে তাড়াতাড়ি টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা এবং চায়ের লাভের একটা অংশ যে পুনরায় বিনিয়োগ করার কথা সেটাও না হয়ে অন্য ব্যাবসায় বা ফাটকাবাজিতে লাগিয়ে রাখতে তৎপর। এমন বাগানগুলোই চা শিল্পে অসন্তোষের অন্যতম কারণ। এই কারনেই ডানকানসের বাগান গুলো বন্ধ হয়েছে। যা স্পষ্ট করেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা BIFR (Board for industrial and financial reconstruction)। BIFR তদন্তে জানা যায়, ডানকানস তার ক্ষতিতে চলা সার কারখানায় টাকা ঢেলেছে চা শিল্পের লাভ থেকে। সারের ব্যবসা লোকসানে পড়ায় চা শিল্পেও তার প্রভাব পড়ে। আর এটাই কম বেশি বাগানের প্রতিচ্ছবি। বাগানে লাভ থাকলেও শ্রমিকরা পিএফ, গ্র‍্যাচুয়টি ঠিক মতো পায় না। প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট মেনে চলার কথা আমরা ছেড়েই দিলাম।

 

শেষে বলতে হয় উত্তরবঙ্গের এই বৃহৎ শিল্প শুধু শ্রমিকদের মুজুরি কমিয়েই মুনাফা করে গিয়েছে তা নয়। পুরো উত্তরবঙ্গের উন্নয়নও ব্যাহত করেছে। এবার শুধু দেখা ন্যূনতম মজুরি আইনের নামে সামান্য টাকা বাড়িয়েই মুজুরি আইন লাগু করা হবে নাকি সাম্মানিক মজুরির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ঘটানো হবে? যদি তা হয় তাহলে এর প্রভাব কিন্তু বাংলা ছাড়িয়ে চা শিল্প নির্ভর আসাম ও ত্রিপুরাতেও পড়তে চলেছে।

 

Share this
Recent Comments
1
Leave a Comment