পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী ফল : অশনি সংকেত স্পষ্ট


  • March 29, 2022
  • (0 Comments)
  • 750 Views

নির্বাচনী পাটিগণিতের সমীকরণে নয়, সেই লড়াইটা হবে ময়দানে। ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিবাদী বিজ্ঞান চেতনায় সমন্বিতন্যায়বোধের জীবনাদর্শ ও আম আদমির কল্যাণের ভাবনা প্রসূত রাজনীতির অভ্যাস হিন্দুত্বের রাজনীতির প্রতিস্পর্ধা তৈরি করতে পারে। কিন্তু আজকের ভারতে সেই রাজনীতির অনুশীলনের সম্ভাবনা দূর অস্ত। লিখেছেন সুমন কল্যাণ মৌলিক

 

সদ্য সমাপ্ত উত্তর প্রদেশ বিধানসভা ফলাফল ঘোষণার পর সোসাল মিডিয়ার কল্যাণে একটি ভোটের অঙ্ক যথেষ্ট ভাইরাল হয়েছে। সেই গণিতে বলা হয়েছে উত্তরপ্রদেশে মোট ভোটারের সংখ্যা ১৫৩০ লক্ষ। ভোট দিয়েছেন ৯২৭ লক্ষ। বিজেপি ভোট পেয়েছে ৩৮০ লক্ষ। এই হিসাব অনুযায়ী মোট ভোটারের ২৫ শতাংশের সমর্থন পেয়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসীন অথচ মোট ভোটারের ৭৫ শতাংশ বিজেপির সমর্থক নয়। পোস্টের উদ্দেশ্য পরিষ্কার যে বিজেপির এই জয় আদৌ সংগত কি না! এই গণিতের যথার্থতা মেনে নিয়েই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র তার যাত্রা শুরুর সময় থেকে আজ পর্যন্ত এদেশে যত নির্বাচন হয়েছে তার প্রতিটাতেই তো কমবেশি এই পাটিগণিতেরই প্রতিফলন যার আনুষ্ঠানিক নাম ‘ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট’ সিস্টেম। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল এই নিয়ম মেনেই ভোট প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, তাহলে আজ হঠাৎ তাদের এই বোধোদয়ের কারণ? বরং এভাবেও তো ভাবা যেতে পারে যে প্রদত্ত ভোটের ৪১ শতাংশ পেয়ে বিজেপির যদি ক্ষমতাসীন না হওয়ার যোগ্যতা থাকে তবে ৩২.৮৫ শতাংশ ভোট পাওয়া সমাজবাদী পার্টি আার ১২.৮৮ শতাংশের বহুজন সমাজ পার্টি তো হিসাবেই আসে না।

 

আরেকটি প্রচলিত গণিত হল যদি বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগাভাগি না হত তাহলে বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত ছিল। কথাটা অঙ্কের বিচারে অন্তত মিথ্যা নয়। যেমন উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী, বহুজন সমাজ পার্টি ও কংগ্রেসের মিলিত ভোটের পরিমাণ বিজেপির থেকে অন্তত ৫ শতাংশ বেশি। গোয়াতে কংগ্রেস, আপ ও তৃণমূলের মোট ভোটের শতাংশের হার বিজেপির থেকে বেশি। সমস্যা হল বেশিরভাগ সময় বিজেপি বিরোধী ভোটের বিভাজন জনিত মায়াকান্না শোনা যায় ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর, ভোটের আগে চলে একলাই কেল্লা ফতে করার তর্জন-গর্জন। উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী, বহুজন ও কংগ্রেসের মধ্যে বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগাভাগি হলে তা যে নিশ্চিত ভাবে বিজেপির সুবিধা করে দেবে তা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্স পড়ার প্রয়োজন হয় না। একই কথা গোয়ার জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু বহু দলীয় গণতন্ত্রে যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি ও ভাবনা বিভিন্ন সেখানে কোন অভিন্ন কর্মসূচি ও লক্ষ্য ছাড়া শুধু বিজেপিকে আটকাতে জোট গঠন শুধু অনৈতিক নয়, বাস্তবত অসম্ভব। সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলির প্রাণভোমরা হল নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল তাই শুধু বিজেপিকে আটকাতে কোন দল ভোটে লড়বে না – এই বালখিল্য স্বপ্ন দেখার মানেই হয় না। মায়াবতী ও রাহুল গান্ধীর দল ভোটে না দাঁড়ালে অখিলেশ যাদব জিততেন বা তৃণমূল কংগ্রেস ও আপ না থাকলে গোয়া কংগ্রেসের হত – এই ভাবনার সূত্র ধরে কাল যদি কেউ দাবি করেন পশ্চিমবঙ্গে বাম ও কংগ্রেস যেহেতু আজ প্রান্তিক শক্তি তাই বিজেপি কে রুখতে তৃণমূলের সমর্থনে তাদের মাঠ ছেড়ে দেওয়া উচিত তাহলে সেটা কি মানা সম্ভব?

 

রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষের শক্তি ও দুর্বলতার সঠিক মূল্যায়ণ করা জরুরি যেমন জরুরি গ্রাউন্ডজিরো সম্পর্কে সঠিক বোঝাপড়া। এই গাণিতিক প্যাঁচ-পয়জারকে কিছুক্ষণের জন্য পাশে রেখে যদি পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনী ফলের দিকে তাকাই তবে আমাদের কাছে কিন্তু অশনিসংকেতটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই নির্বাচন আসলে উগ্র হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের জয়, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের স্বপ্ন প্রকল্প ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের’ প্রতি আরেক দফা আস্থার শিলমোহর। একথা অস্বীকার করার কোন কারণ নেই যে ভারতীয় রাজনীতির হৃৎপিণ্ড হিসাবে পরিচিত উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনের পূর্বে বিজেপির অবস্থা ছিল যথেষ্ট খারাপ। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের সাফল্য, জাঠ বলয়ে বিদ্রোহের আগুন, লখিমপুর-খেরিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ছেলের গাড়িতে কৃষক হত্যা, করোনা অতিমারীর সময়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় শয়ে-শয়ে লোকের মারা যাওয়া, গঙ্গায় ভেসে যাওয়া লাশের সারি ও প্রত্যেকদিন রাজ্যের কোথাও না কোথাও নারী নির্যাতনের ঘটনা ‘উত্তম প্রদেশ’ এর আসল ছবিটা স্পষ্ট করে দিয়েছিল। এতদসত্বেও যোগী আদিত্যনাথের এই মসৃণ জয় সম্ভব হয়েছে তীব্র মেরুকরণের কারণে। আদিত্যনাথ সরকারের অসাফল্যের আখ্যানকে চাপা দিতে আনা হয়েছে সোজাসুজি ৮০-২০ গল্প। যে গল্পে কুড়ি শতাংশ সংখ্যালঘুকে দুরমুশ করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সংখ্যাগুরু হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের চাবিকাঠি। দীর্ঘ নির্বাচন প্রক্রিয়া যত এগিয়েছে তত ঘৃণার রাজনীতির বিপণন বেড়েছে। আর সেই প্রচারের মোকাবিলা করতে গিয়ে সমবেত বিরোধী পক্ষ সম্প্রদায়গত পরিচিতি ও নরম হিন্দুত্বের এক মিশেল তৈরি করতে চেয়েছেন। বলা হয়েছে সংখ্যালঘু, যাদব ও জাঠের ত্রহ্যস্পর্শে বাজিমাত নিশ্চিত। তারাও যে কম হিন্দু নন তা বোঝাতে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মন্দির যাত্রা। এইভাবে বিজেপির পাতা ফাঁদে পা দিয়ে আসলে ধর্মের রাজনীতির ময়দানে আটকা পড়েছেন বিরোধীরা। ফলত কৃষক বিদ্রোহ, বেকারি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, নারী নির্যাতন, আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতির মত বিষয়গুলো পেছনের সারিতে চলে গেছে।

 

এই আগ্রাসী হিন্দুত্বের ন্যারেটিভটা শুধু গো-বলয়ে সীমাবদ্ধ থাকে নি। গোয়া ও মনিপুরের মত রাজ্য যেখানে যথাক্রমে ২৬ ও ৪২ শতাংশ ক্রীশ্চান মানুষের বাস সেখানেও হিন্দুত্ব রক্ষার গল্প মান্যতা পেয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা হল পাঞ্জাব যেখানে বিজেপি পরাজিত হয়েছে সেখানেও মোহন ভাগবতদের চিন্তার কোন কারণ ঘটে নি। ‘ইন্ডিয়া এগেনস্ট কোরাপশন’ এর সময় থেকে আপ প্রধান মতাদর্শগত ভাবে সংঘ ঘনিষ্ঠ। দিল্লি দাঙ্গার সময় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ভূমিকা, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের সমর্থন, বিনা পয়সায় দিল্লিবাসীর জন্য অযোধ্যায় রাম মন্দির দর্শনের প্রস্তাব, প্রকাশ্যে হনুমান চালিশা পাঠ আসলে সংখ্যাগরিষ্টের মতাদর্শের সঙ্গে থাকার বার্তা।

 

মুশকিল হল এদেশে যে সমস্ত রাজনৈতিক দল অন্তত কাগজে কলমে ফ্যাসিবাদ ও উগ্র হিন্দুত্বের মতাদর্শকে প্রতিহত করতে চান তারা বিজেপিকে আটকানোর উপায় মনে করেন নির্বাচন পূর্ব জোট তৈরি ও ক্ষমতা দখল। আর সরকারে আসীন হয়ে কম বেশি সংঘ পরিবারের ভাবনাকেই মান্যতা দেন। ছত্তিসগড়ের কংগ্রেস বা এরাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস তার আদর্শ উদাহরণ। কেউ বোঝেন না সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের বিকল্প রাজনীতি তৈরি করতে না পারলে বিজেপির অগ্রগমনকে আটকানো স্বপ্নই থেকে যাবে। নির্বাচনী পাটিগণিতের সমীকরণে নয়, সেই লড়াইটা হবে ময়দানে। ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিবাদী বিজ্ঞান চেতনায় সমন্বিত ন্যায়বোধের জীবনাদর্শ ও আম আদমির কল্যাণের ভাবনা প্রসূত রাজনীতির অভ্যাস হিন্দুত্বের রাজনীতির প্রতিস্পর্ধা তৈরি করতে পারে। কিন্তু আজকের ভারতে সেই রাজনীতির অনুশীলনের সম্ভাবনা দূর অস্ত।

 

লেখক স্কুল শিক্ষক ও অধিকার আন্দোলনের কর্মী।  যোগাযোগ ৯৫৬৪৬৮৩৮১৩

 

Share this
Leave a Comment