রাজতন্ত্রে এমনই হয়। কখন যে ক্ষমতা আরও ক্ষমতার খিদের জ্বালায় দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে নিজেকেই খেতে শুরু করে তা টের পাওয়া যায় না। টিভি ফাটার শাক দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না মাছের গন্ধ। ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব দিয়ে আড়াল করা যাবে না দলীয় হানাহানির এই মূষলপর্বকে। লিখেছেন দেবাশিস আইচ।
আপাতত ষড়যন্ত্র তত্ত্বতেই স্থিত হয়েছে তাবড় তৃণমূলকুল। তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। রামপুরহাট ১ ব্লকের বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপপ্রধান ভাদু শেখকে বোমা মেরে খুন করা হল। আর সেই রাতেই বগটুই গ্রামে বাড়ি ঘিরে আগুনে পুড়িয়ে মারা হল অন্তত পক্ষে আট জনকে। যাঁরা সকলেই নারী কিংবা শিশু। এক বৃদ্ধাও আছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে বাড়ির পুরুষরা গা ঢাকা দিয়েছিলেন। উপপ্রধানের বাড়িটি একই গ্রামের পূর্ব পাড়ায়। আর মৃত আট জন ছিলেন পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা। অভিযোগ, ওই পরিবারের কোনও কোনও ব্যক্তি ভাদু শেখের খুনের জন্য দায়ী। গভীর ষড়যন্ত্র সন্দেহ নেই। তবে ‘রাজনৈতিক’ নয় থেকে ‘গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ তত্ত্বে পৌঁছতে বেশ কিছু সময় ব্যয় করে ফেলল তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব। বিধানসভায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ষড়যন্ত্র’ বিবৃতির পরই সব নেতাদের এক রা শোনা গেল। এমনকি রাজ্য পুলিশের ডিজি মালব্যও প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছিলেন এই ঘটনা ‘রাজনৈতিক নয়’। একই সঙ্গে তিনি জানান, ‘গভীর শত্রুতা’-র কারণে এই ঘটনা ঘটতে পারে। এবং উপপ্রধান খুনের সঙ্গে এই ঘটনার কোনও সম্পর্ক রয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ দুপুর সাড়ে বারোটায় টুইট করে বলেন, “রামপুরহাটের মৃত্যুর ঘটনায় রাজনীতি নেই।” তার তিন ঘণ্টার মধ্যে, তিনটে আঠাশ মিনিটে বয়ান বদলে কুণাল পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সুরেই লিখলেন, “বৃহত্তর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে তৃণমূল নেতাকে খুন করে তারপর এই আগুন লাগানো হয়েছে।” বীরভূমের বাদশা অনুব্রত মণ্ডল অবশ্য স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, টিভি ফেটে শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন লেগেছে। পরবর্তীতে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে টিভি ফেটে যদি আগুন লাগে তবে তার তদন্তে সিট কেন? কেনই-বা ‘ক্লোজ’ করা হল স্থানীয় থানার আইসি ও মহকুমার এসডিপিও-কে? কেনই-বা হেলিকপ্টারে উড়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন মন্ত্রী ও বীরভূম জেলার ভারপ্রাপ্ত তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিম। ফিরহাদ সেই গভীর ষড়যন্ত্রের তত্ত্বই আওড়ালেন। কেন ষড়যন্ত্র? তাঁর ব্যাখ্যা, তাঁর দলেরই নেতাকে খুন করা হয়েছে। আবার বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। এ সবই করা হয়েছে দলকে অপদস্থ করার জন্য। দু’দিন আগেই তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, খুনের ঘটনা না ঘটলে, দুষ্কৃতী না থাকলে পুলিশ, আদালত উঠে যেত। আনিশ খান থেকে একই দিনে সকাল-সন্ধেয় রাজ্যের দুই প্রান্তে দুই পুরপিতা খুন, খোদ কলকাতায় শ্যুট আউটের প্রেক্ষিতেই সাংবাদিকদের এই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ফিরহাদ হাকিম। রামপুরহাটে তিনি ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছেন।
কলকাতায় ডিজি এই ঘটনায় ১১ জনের গ্রেপ্তারের খবর শুনিয়েছেন। আর বগটুই গ্রামে নিহত নেতা ভাদু শেখের স্ত্রী তেবিলা বিবি ফিরহাদকে স্পষ্ট জানিয়েছেন, বিনা দোষে তাঁর পরিবারের ছেলেদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ওরা নির্দোষ। মিথ্যা কেসে ফাঁসানো হচ্ছে। তাদের ছাড়া না হলে স্বামীর কবরে মাটি দেবেন না। তেবিলার সব রাগ পুলিশের উপর। কারা খুন করেছে ভাদু শেখকে? এই প্রশ্নের উত্তরে তেবিলা বলেন, ওরা সব ছিল তাঁর স্বামীর ‘চামচে’। ডিজি কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, ভাদু শেখের মৃত্যুর পরই ওই গ্রামের সঞ্জু শেখের বাড়ি আক্রান্ত হয়। গায়ে গায়ে লেগে থাকা মোট আটটি বাড়ি আগুনে পুড়েছে। ওই রাতেই তিন জনকে উদ্ধার করে দমকল। তাঁদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। বাকি আর কেউ জতুগৃহে আটকে পড়েছে কি না তার খোঁজ নেয়নি পুলিশ কিংবা দমকল। ফের সকালে একটি বাড়ি থেকে সেই দমকলের কর্মীরাই পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া সাত জনের দেহ উদ্ধার করে। তাঁদের মধ্যে পাঁচ জন নারী ও দুটি শিশু আছে বলে জানা গিয়েছে। সারা রাত ধরে পুড়ে পুড়ে চরম বিকৃত হয়ে যাওয়া মৃতদেহগুলি শনাক্ত করাও আত্মীয়দের কাছে কঠিন ছিল। শিশু এক জন না দু’জন তা ঠাহর করতে পারেননি এক নিকট আত্মীয়। উদ্ধার হওয়া আহতদের মধ্যে এক জনের মৃত্যু হয়েছে।
রাজতন্ত্রে এমনই হয়। উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে ঘর পাহাড়ায় কেউ থাকে না। চড়াম চড়াম একদিন বুমেরাং হয়ে নেতাদের পিঠেও বাজতে পারে। মন্ত্রী, সান্ত্রী, পঞ্চায়েতি জায়গিরদার, সিভিক পেয়াদারা বুঝে গেছে বিরোধী বিহীন একনায়কতন্ত্র কায়েম হয়েছে, এবার যথাসম্ভব লুটের ফসল ঘরে তুলতে হবে। দীর্ঘ বাম শাসনে বাংলার গণতন্ত্রের ভিত নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। যেটুকু ছিল তারই জোরে ক্ষমতার বদল ঘটতে পেরেছিল। সিভিল সোসাইটি শুধু নয়, রাজনৈতিক সমাজের এক বড় অংশই চেয়েছিল ক্ষমতার বদল হোক। বিগত এগারো বছরে গণতন্ত্রের ভিটে মাটি চাটি করে ছেড়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। প্রবল সংখ্যাধিক্যের পরও, ‘শত্রুর শেষ রাখতে নেই’, এই প্রাচীন নীতি মান্য করে দখল করা হয়েছে একের পর এক বিরোধী শাসিত পুরসভা, পঞ্চায়েত। অভিযোগ, কখনও পুলিশ ও মামলার ভয় দেখিয়ে, কখনও নানা ছলচাতুরি ও প্রলোভন দেখিয়ে গণ-ঘোড়া কেনাবেচার এই রাজনীতির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মমতা-রাজতন্ত্র। গত এগারো বছরে স্থানীয় নির্বাচন নিছকই ছেলেখেলায় পরিণত। এবং সর্বত্রই এক অবাধ লুঠের রাজত্ব। শুধু পঞ্চায়েত নয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী নিয়োগ নিয়ে যে পরিমাণ দুর্নীতির খবর হাই কোর্টের মামলার সূত্রে বেরিয়ে পড়েছে তা সম্ভবত এ রাজ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান পোষিত দুর্নীতির এক সর্বকালীন রেকর্ড সৃষ্টি করতে চলেছে। বিরুদ্ধতার স্বর শোনা গেলেই আনিস খান ঘটবে। ঘটবে মইদুল, সুদীপ্ত। এমনকি ছাড় পাবেন না দলেরই সমর্থক পরিবার। চরম লাঞ্চনা এবং শারীরিক আক্রমণের পর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবেন বর্ধমানের তুহিনা খাতুন। প্রধান অভিযুক্তকে খুঁজে পাবে না পুলিশ। প্রতিবাদে মিটিং-মিছিল করলে ছাত্র পিটিয়ে থানায় ভরা হবে। দেউচা-পাচামির পথে আক্রান্ত হবে নাগরিক মিছিল। নাটকের দলের সাজ-সরঞ্জাম ভেঙে, পিটিয়ে বার করে দেওয়া হবে লজ থেকে। গ্রেপ্তার করা হবে সামাজিক, রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীদের। মিথ্যা মামলায় জেলে পোরা হবে। নদী থেকে বালি-পাথর লুঠ করার খবর করলে সাংবাদিকের বাড়ি ঘিরে বাপবাপান্ত করবে লুঠেরারা। এমনকি আক্রান্ত হতে হবে প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের। ‘পজিটিভ’ খবর না হলে শুধুই দলীয় কর্মীদের হাতেই মার খাবেন না সাংবাদিকরা, ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হবে তাঁদের ক্যামেরা কিংবা মোবাইল—স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী উপদেশের ছলে সংবাদমাধ্যমকে প্রচ্ছন্ন হুমকির স্বরে বুঝিয়ে ছাড়বেন ‘পজিটিভ’ না হলে ‘সাপোর্ট’ মিলবে না। আর তার চারদিনের মাথায় ১০৮টি পুরসভা নির্বাচনের দিনে সাংবাদিকদের উপর তার ফলিত প্রয়োগ দেখাবে দলীয় বর্গিবাহিনী। বন্ধ করা হবে বিজ্ঞাপন। আদালতের নির্দেশের পরও মিলবে না বিজ্ঞাপন। সরকারি লাইব্রেরিতে হুকুম জারি করে বন্ধ করে দেওয়া হবে অপছন্দের খবররের কাগজের সাবস্ক্রিপশন। খবর মন্দ হলে বন্ধ হবে টিভির ডিসট্রিবিউশন। মাথা নত করলে তবেই ছাড় মিলবে।
রাজতন্ত্রে এমনই হয়। কখন যে ক্ষমতা আরও ক্ষমতার খিদের জ্বালায় দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে নিজেকেই খেতে শুরু করে তা টের পাওয়া যায় না। টিভি ফাটার শাক দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না মাছের গন্ধ। ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব দিয়ে আড়াল করা যাবে না দলীয় হানাহানির এই মূষলপর্বকে। ষড়যন্ত্র যদি কোথাও হয়ে থাকে তবে তা দলের অভ্যন্তরেই। নারী ও শিশুদের আগুনে পুড়িয়ে মারার মতো এমন নারকীয় ঘটনা ঘটতে পারে পুলিশ-প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে পারলেই। মুখ বাঁচাতে পুলিশ কর্তাদের ‘ক্লোজড’ করা যেতেই পারে। কিন্তু, ‘শর্ট সার্কিট’-এর টিকি ছোঁবে কে? এই ঘটনার পূর্ণ সুযোগ নিতে চাইবেই বিজেপি-র মতো বিরোধী দল। চালুনি যেমন সুচের ফুটো খুঁজে বেড়ায়। সে কাজে সর্বশক্তিতে নেমে পড়েছে তারা। কলকাতা হাই কোর্ট থেকে দিল্লির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দরবারে অতি দ্রুত পৌঁছে গিয়েছে। তোলা হয়ে গিয়েছে এনআইএ ও সিবিআই তদন্তের দাবিও। তাই বোধহয় ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ধুয়ো তুলে রক্ষণ সাজাতে চাইছে তৃণমূল। আট নারী-শিশুকে পুড়িয়ে মারার ঘটনাকে বিরোধীদের চক্রান্ত বলে চালাতে চাইছে। দুর্বল রণকৌশল।
রাজতন্ত্রে এমনই হয়। গণতন্ত্র থাকলে এতক্ষণে ‘রাজধর্ম’ পালনের অঙ্গীকার শোনা যেত। শাসক যখন সে অঙ্গীকার পালনে অক্ষম, তখন মাভৈ ডাকে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার শপথ নিতে হবে নাগরিক ও রাজনৈতিক সমাজকেই। আর কোনও পথ খোলা নেই।