পুলিশ কমিশনের রিপোর্টই বলছে, পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত যখন উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিকরা করেন তখন অভিযোগ প্রমাণ হয় সবচেয়ে কম। ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তে তার বেশি। সবচেয়ে ভাল ফল পাওয়া যায় বিচারবিভাগীয় তদন্তে। মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশিত সিট তদন্ত তাঁর ঘোষণার ১০ ঘণ্টার মধ্যে শুরু হলেও তা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা না আঁচিয়ে বিশ্বাস করা মুশকিল। লিখেছেন দেবাশিস আইচ।
২৪ মে ২০২১, আনিস খান হাওড়া গ্রামীণ থানার পুলিশ সুপার সৌম্য রায় থেকে আমতা থানায় ওসি-র কাছে লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন তিনি ও তাঁর পরিবার বিপন্ন। জানিয়েছিলেন মৃত্যুর আশঙ্কার কথা। নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। নাম করে করে জানিয়েছিলেন স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব তাঁর ও তাঁদের পরিজনের উপর হামলা চালিয়েছে। নাম ধরে ধরে জানিয়েছিলেন কারা এই হামলার জন্য দায়ী। প্রায় ন’মাস কেটে গেলেও পুলিশের ঘুম ভাঙেনি। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, রাত একটা থেকে দেড়টার মধ্যে আনিস নৃশংস ভাবে খুন হন। পরিবারের অভিযোগ, ‘পুলিশ’ আমতা থানা থেকে আসচি বলে বন্দুক উঁচিয়ে বাড়িতে ঢোকে। এর পর আনিসের উপর অত্যাচার চালিয়ে তিন তলা থেকে ঠেলে ফেলে খুন করে। রাত তিনটেয় আমতা থানায় ফোন করার ছ’ঘন্টা পর পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। আর এই হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৬০ ঘণ্টা পর প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় পেলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছাত্রনেতা, সুপরিচিত সমাজকর্মী, গণআন্দোলনের সংগঠক মাত্র ২৭ বছরের এক যুবকের ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে—যে হত্যার অভি্যোগের তির পুলিশের দিকে, যে পুলিশ তাঁরই অধীন—স্রেফ ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়ে সিট গঠনের কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। ‘রাজধর্ম’ পালনে উজ্জ্বল নজির সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলেন তিনি।
নিরপেক্ষ তদন্তের আশ্বাসও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু, সিআইডি-সিট কিছুই যে চান না আনিসের পিতা সালেম খান এবং তাঁর পরিবার। চান না যে তার কারণ অনেক। পুলিশ যে আনিসের ২০২১ সালের অভিযোগের কোনও মূল্য দেয়নি তা শুধু নয়, তাঁর খুন হয়ে যাওয়ার খবর পাওয়ার পরও ছিল চরম ঔদাসীন্য ও নির্লিপ্ততাও দেখিয়েছে। অন্তত থানার ডিউটি অফিসার ও আনিসের পিতার প্রকাশ হয়ে যাওয়া ফোনে কথোপকথন থেকেই তা প্রমাণিত। প্রমাণিত আরও তথ্য এই যে, লাশ তুলে নিয়ে যাওয়ার পরও ঘটনাস্থলটি পরবর্তী ফরেনসিক তদন্তের জন্য ঘিরে রাখেনি পুলিশ। ময়নাতদন্তের সময় খবর দেওয়া হয়নি পরিবারের কাউকে। এমন ঘটনার ময়নাতদন্তের ভিডিও করে রাখাই দস্তুর। তাও করা হয়নি। এখান থেকেই প্রমাণিত হয় এই খুনের ঘটনাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিতে রাজি ছিল না আমতা থানা বা খুনের যাবতীয় প্রমাণ মুছে ফেলতেই সক্রিয় ছিল। এমন পুলিশ দপ্তর নয়, আনিসের পিতা চান তদন্ত করুক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই।
পুলিশ কমিশনের রিপোর্টই বলছে, পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত যখন উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিকরা করেন তখন অভিযোগ প্রমাণ হয় সবচেয়ে কম। ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তে তার বেশি। সবচেয়ে ভাল ফল পাওয়া যায় বিচারবিভাগীয় তদন্তে। মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশিত সিট তদন্ত তাঁর ঘোষণার ১০ ঘণ্টার মধ্যে শুরু হলেও তা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা না আঁচিয়ে বিশ্বাস করা মুশকিল। মুশকিল আরও এই কারণে যে, স্বয়ং এসপি সাংবাদিকদের বলেন, আনিসের বিরুদ্ধে বাগনান থানায় পসকো ধারায় মামলা রয়েছে। এবং আদালতের সমনও ছিল। অর্থাৎ, আনিস যে গর্হিত অপরাধে অভিযুক্ত সে দিকেই যেন আঙুল তুল্তে চাইলেন এসপি। কিন্তু এ কথা বলতে পারলেন না যে, তাঁর অধীনস্থ কোনও থানা থেকে কোনও পুলিশ কর্মী আনিসের বাড়িতে যায়নি।
অন্যদিকে, সোমবারই কলকাতা হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আনিস-মামলা গ্রহণ করে। হাই কোর্টের আইনজীবী কৌস্তভ বাগচী প্রধান বিচারপতি রাজশেখর সামান্থার আদালতে আনিস-কাণ্ডের কথা তুলে ধরেন। সব শোনার পর আদালত মামলা গ্রহণ করে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ঘোষণা করে। একই সঙ্গে বিচারপতি এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে রাজ্য সরকারকে বক্তব্য পেশ করার আদেশ দিয়েছেন। হাই কোর্টে মামলাই কি একই দিনে রাজ্য সরকারকে সিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করল? এমন প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠতে শুরু করেছে। নির্বাচন পরবর্তী হিংসা এবং শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের মামলাগুলিতে ইতিমধ্যেই সরকারের মুখ পুড়েছে। আনিস-কাণ্ডে সিট গঠন করে সরকার নিজের ‘ডিফেন্স’ সাজিয়ে রাখতে চাইছে বলেই অনেকের অভিমত।
আনিস হত্যাকাণ্ডে ছাত্র সমাজ অবশ্য চুপ নেই। প্রথম দিন থেকেই সমাজমাধ্যমে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল ছাত্রসমাজ। ১৯ ফেব্রুয়ারি আনিসের বিশ্ববিদ্যালয় আলিয়ার ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষোভ মিছিলে সামিল হন। মিছিলের ব্যানারে ছিল তাঁরই এক উক্তি— রবিবার এসএফআই, ডিওয়াইএফআই আমতা থানা ঘেরাও করে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সামিল হন। সোমবার কলকাতা শহর জুড়ে আলাদা আলাদা ভাবে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে সামিল হয় এসএফআই, ছাত্র পরিষদ, ডিএসও। এন্টালিতে ছাত্র পরিষদের মিছিল আটকে দিলে পুলিশের সঙ্গে রীতিমতো ধ্বস্তাধ্বস্তি বেঁধে যায় পুলিশের। বেশ কিছু ছাত্র পরিষদ কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বাম মনোভাবাপন্ন নাগরিক মিছিলও ছিল আনিস-রাঙা। প্রধান ব্যানারের ছিল রক্তলাঞ্ছিত আনিসের মুখের পাশে লেখা ছিল বাংলা ভাষা আন্দোলনের গানের কলি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’। রাজ্যের বিভিন্ন ক্যাম্পাসেও আনিস-হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীরা।
পড়ুন :
“উহার লালায় বিষ আছে।”
Heinous murder of Anish Khan – a student activist – reflects the grim state-of-affairs in West Bengal