একের পর এক বলপূর্বক নিখোঁজের ঘটনায় কাশ্মীরে আতঙ্কের পরিস্থিতি দিনে দিনে আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের মধ্যে তো একাধিকরকম মানসিক সমস্যা দেখা দেয়ই, পাশাপাশি সাধারণ মানুষজনের মধ্যেও এই আতঙ্কের ভিত আরও পোক্ত হতে থাকে। অর্ধ-বিধবা নারী এবং নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের সন্তানদের জন্য উপত্যকায় জীবন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। লিখছেন পীযুষ দত্ত।
দক্ষিণ কাশ্মীরের সোপিয়ান জেলার ডুমপুরা গ্রাম। মধ্যরাত্রে দরজা ধাক্কানোর শব্দ, অস্বাভাবিক না হলেও খানিক চিন্তার। বাইরে তখন হাড় কাঁপানো শুকনো হাওয়া। দরজা খোলার সাথে সাথেই মহম্মদ হোসেনের বাড়িতে জোর করে ঢুকে পড়ল একদল সেনা। ঘরের সমস্ত সদস্যদের একটি ঘরে বন্দি করে, তাদের ছেলে নাসিরকে সেই রাতেই সেনার গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গেল। সাথে নিয়ে গেল নাসিরের ফোন, জামাকাপড়-সহ বাকি সামগ্রী। ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে এবং এফ আই আর করতে, মহম্মদ হোসেন পরের দিন যখন থানায় গেলেন, তখন তাঁকে খোঁজ করতে বলা হল সেনাদের ক্যাম্পে। সেখানে আশ্বাস দেওয়া হল পরদিন অবশ্যই তাঁদের ছেলে নাসিরকে ছেড়ে দেওয়া হবে। পরে সেই রাত্রেই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মহম্মদ হোসেনের বাড়িতে এসে জানিয়ে যাওয়া হয় যে, তাঁরা নাসিরকে ছেড়ে দিয়েছে এবং সে কোনও এক অপরিচিতের বাইকে চড়ে বেরিয়ে গেছে। কে সেই বাইকচালক? কোথায় গেল নাসির? জানতে চাইলে উত্তর পায় না ঘরের লোক। তারপর থেকে আজ অবধি নাসিরের নাম নিখোঁজের খাতায়।
ঘটনাটি ২৯ নভেম্বর ২০১৯-এর। ২০২০-র জুন মাসে ঠিক একই রকম একটি ঘটনা ঘটে কাশ্মীরের গান্দেরবাল জেলার কাঙ্গান শহরে। ঘরের একমাত্র উপার্জনকারী নুর-উল-হাসানকে ঘরে ফেরার পথে সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায়। নুরের বাড়িতে ছিল তাঁর অসুস্থ বাবা, মা, স্ত্রী এবং আড়াই বছরের একটি মেয়ে। সেদিনের পর থেকে আজ অবধি নুরের পরিবারের কাছে কোন হদিস নেই নুর কোথায়।
কাশ্মীরের সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাঁটলে এমন হাজার খানেক নুর, নাসিরদের খবর পাব যাঁরা এ ভাবে নিখোঁজের শিকার। এখানে আমাদের আলোচনা দু’টি ঘটনা দিয়ে শুরু হলেও, জানিয়ে রাখা প্রয়োজন কাশ্মীরে এমন ঘটনা হাতে গোনা যাবে না। আলোচনা এগোলে তা আরও স্পষ্ট হবে।
এমন ভাবে ‘নিখোঁজ’ হওয়া বা ‘গুম’ করে দেওয়ার রীতি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন শাসকের দ্বারা ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। তাই এই ভাবে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের জন্য জাতিসংঘ একটি কমিটি গঠন করে, তার কনভেনশনে এই ‘বলপূর্বক নিখোঁজ’ অথবা ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘এনফোরসড ডিসাপিয়ারেন্স’ এর একটি সংজ্ঞা দেওয়া হয়, যার মূলভাব বাংলায় অনুবাদ করলে খানিকটা এমন দাঁড়ায় যে, বলপূর্বক নিখোঁজ বা গুম হল একপ্রকার গ্রেফতারি বা অপহরণ যা শাসক বা শাসক ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীরাই করে থাকে। এই রাস্তা থেকে অপহরণ বা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর সেই ব্যক্তি আদৌ জীবিত না মৃত তা জানা যায় না। তাঁদের অস্তিত্বকেই একপ্রকার মুছে ফেলা হয়। গুম হয়ে যাওয়া ওই ব্যক্তি সমস্ত রকমের মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হন। কাশ্মীরে এই সমস্ত নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের লোকেরা এক হয়ে ১৯৯৪তে একটি সংগঠন গড়ে তোলে, যার নাম অ্যাসোসিয়েশন অব প্যারেন্টস অব ডিসাপিয়ারড পারসানস (এপিডিপি)। তাদের প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় ঠিক কেমন করে গোটা বিশ্বে এই ‘বলপূর্বক নিখোঁজ’ গণতান্ত্রিক কণ্ঠরোধ করতে শাসকের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
জানা যায়, এই জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করে দেওয়ার রীতির প্রথম দেখা মেলে নাৎসি শাসিত জার্মানিতে। সেখানে এই আক্রমণের শিকার হন ইহুদি এবং কমিউনিস্টরা। যা পরবর্তীকালে ছড়িয়ে পরে কম করে হলেও পৃথিবীর ৬৩টা দেশে। জানা যায় স্পেনে গৃহযুদ্ধের সময়ও এই দমনরীতি শাসকের হাতিয়ার ছিল। তবে আজও অবধি এই দমনরীতির দ্বারা সবথেকে বেশি আক্রান্ত এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি। জানা যায়, ফিলিপিন্সে রাষ্ট্রপতি কোরোসিওন, একুইনো এবং ফিদেল রামোসের আমলেই ১৬৪০টা বলপূর্বক নিখোঁজের ঘটনা ঘটে, যার আজ অবধি কোনও সমাধান হয়নি। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কায় কেবল ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে বলপূর্বক নিখোঁজের ঘটনা ঘটে ৬০,০০০টি। বাংলাদেশেও বিভিন্ন আমলে রাজনৈতিক বিরোধী, ব্যবসায়ী থেকে সন্দেহভাজন অভিযুক্তদের গুম করে দেওয়া এক প্রচলিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও ভারতে কাশ্মীর ছাড়াও উত্তরপূর্ব ভারতের মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর এবং আসামে এমন বলপূর্বক নিখোঁজের অজস্র ঘটনার কথা জানা যায়।
তবে এই বলপূর্বক নিখোঁজের সব থেকে ভয়াবহ শিকার যে কাশ্মীর, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। এপিডিপি-র দ্বারা প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, কেবল ১৯৮৯ থেকে ২০০৬ সাল অবধি, নিখোঁজ হয়েছেন ৮০০০ থেকে ১০,০০০ জন। এঁদের মধ্যে অধিকাংশই যুবক অথবা কিশোর। ২০১১ সালে, উত্তর কাশ্মীরের চারটি জেলায় ১১ জনের একটি দল তদন্ত করতে গিয়ে সেখান থেকে ২৭০০টি নামহীন কবর খুঁজে পায়। পুলিশের দাবি অনুযায়ী তা ‘জঙ্গি’দের লাশ হলেও, তার মধ্যে ৫৭৪টি লাশ নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বলে স্থানীয় বাসিন্দারা চিহ্নিত করেন। এটা কেবল উত্তর কাশ্মীরের চারটি জেলার ঘটনা। জম্মু-কাশ্মীর স্টেট হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে সমগ্র উপত্যকায় এমন ৭০০০টি নামহীন কবরের সন্ধান তাঁদের তদন্ত থেকে উঠে এসেছে। এসএইচআরসি-র এই রিপোর্টের উত্তরে সরকার ২০১২-র ১৩ অগস্ট একটি ‘অ্যাকশান টেকেন রিপোর্ট’ পেশ করে। যেখানে তারা এই নামহীন কবরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে এবং বলে ওগুলো বিদেশি এবং আঞ্চলিক জঙ্গিদের কবর। স্টেট হিউম্যান রাইটস কমিশনের দাবির উত্তরে সরকার জানায় তাঁদের কাছে এই তদন্ত চালানোর মতো পর্যাপ্ত সরঞ্জাম নেই।
এপিডিপি এবং জম্মু-কাশ্মীর কোয়ালিশন সিভিল সোসাইটি যখন তথ্যপ্রমাণ-সহ দেখাচ্ছে যে ১৯৮৯ থেকে ২০০৬ অবধি ৮০০০-১০০০০ লোক নিখোঁজ হয়েছে, তখন ২০১৭ সালে কাশ্মীরের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি বলছেন—কেবল ৪,০০৮ জন কাশ্মীর থেকে নিখোঁজ হয়েছে। এবং এই নিখোঁজ হওয়া যুবকদের অধিকাংশই পাকিস্তানে গেছে জঙ্গি সংগঠনে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে।
২০০৬ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ বলপূর্বক নিখোঁজ বিষয়ে একটি কনভেনশনের আয়োজন করে। ২০০৭ সালে ভারতও সেই কনভেনশনে অংশ নেয়। এবং ২০১৭ সালে ‘প্রিভেনশন অব এনফোরসড ডিসাপিয়ারেন্স’ শীর্ষক একটি বিল সংসদে উত্থাপিত হয়। ওই বিলটিতে বলা হয়, ‘বলপূর্বক নিখোঁজ’ একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। যে বা যারা এর সাথে যুক্ত থাকবে তাদের তিন থেকে দশ বছর অবধি জেল হতে পারে।
অন্যদিকে ‘বলপূর্বক নিখোঁজ’-কে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলেও চিহ্নিত করা হয় এই বিলে। সেখানে আরও বলা হয়, যদি কোনও আধিকারিক এমন বলপূর্বক নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে জেনে থাকে এবং তা নিয়ে তদন্তের দিকে না এগোয় তবে তাকেও এক থেকে দশ বছর অবধি জেল খাটতে হতে পারে। অর্থাৎ সাদা চোখে দেখলে বলপূর্বক নিখোঁজের বিরুদ্ধে জোর পদক্ষেপ বলেই মনে হবে। কিন্তু এই বিল শেষ পর্যন্ত আইনে পরিণত হয়নি। এমন একটি আইন যে অত্যন্ত জরুরি তা গুম হয়ে যাওয়া ৭০০০ নামহীন কবর, নাসির, নুর-উল-হাসানদের জীবন প্রমাণ করে।
এ বার আসা যাক এই বলপূর্বক নিখোঁজের সামাজিক প্রভাবের দিকটায়। কাশ্মীরি সমাজে এবং শেষ কয়েক বছরে কাশ্মীরের গণ্ডি ছাড়িয়ে ‘হাফ উইডো’ শব্দবন্ধটি আমাদের অনেকের কাছেই বেশ পরিচিত। বলপূর্বক ভাবে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের স্ত্রীদের মূলত এই ‘হাফ উইডো’ বা ‘অর্ধ-বিধবা’ বলা হয়ে থাকে। উপত্যকায় এমন অর্ধ-বিধবা নারীর সংখ্যা ঘোষিতভাবে ২০০০ থেকে ২৫০০। যেহেতু তাঁদের স্বামীরা জীবিত না মৃত এ বিষয়ে কোনও তথ্য প্রমাণ থাকে না, তাই তাঁদের ‘অর্ধ-বিধবা’ আখ্যা দেওয়া হয়। এর ফলে, বিধবা নারীদের জন্য যে যৎসামান্য সুযোগ সুবিধা সরকার দিয়ে থাকে, তার থেকেও এই নারীরা বরাবর বঞ্চিত হয়ে থাকেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিরা ঘরের একমাত্র উপার্জনকারী, ফলত তাঁরা নিখোঁজ হওয়ার পর গোটা পরিবারের বোঝা এসে পড়ে ঘরের নারীদের উপর। অন্যদিকে দেখা যায় এই সুযোগে অর্ধ-বিধবা নারীদের, স্বামীর সম্পত্তির উপর তাঁদের যে অধিকার তা থেকেও বঞ্চিত করা হয়। ইসলামি আইন অনুযায়ী, কাশ্মীরে এই অর্ধ-বিধবা নারীরা চার বছর অপেক্ষার পর চাইলে নতুন করে বিয়ে করতে পারেন এবং নিজের স্বামীর সম্পত্তির ভাগ পেতে পারেন, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় না। খাতায় কলমে এমন নিয়ম থাকলেও স্বামীর পরিবার তাঁদের বঞ্চিত করে। খুঁজলে, কাশ্মীরে এমন ঘটনার অভাব মিলবে না। আরেকদিকে সরকারকেও এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায় না, তার অন্যতম কারণ এই ‘অর্ধ-বিধবা’ বা ‘হাফ উইডো’ শব্দবন্ধটি কাশ্মীরি সমাজে স্বীকৃত হলেও আইনের খাতায় নয়। তাই যতদিন না এই ‘হাফ উইডো’ শব্দবন্ধটি আইনি মর্যাদা পাচ্ছে, ততদিন এই সম্পত্তির অধিকারে অর্ধ-বিধবা নারীদের অধিকার বিষয়ে সরকারের কথা শোনা কঠিন। এখানে আরেকটি বিষয় হল, এই অর্ধ-বিধবা নারীদের স্বীকৃতি দিলে, সরকারকে একভাবে বলপূর্বক নিখোঁজের অস্তিত্বকেও স্বীকার করতে হবে, তার দায় নিতে হবে।
বলপূর্বক নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য সরকার কিছু টাকা বরাদ্দ করে, এবং সেই পরিবারের কোনও একজন সদস্যকে চাকরি দেওয়া হবে এমন প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে এসবই শর্তসাপেক্ষ। এখানে উল্লেখ্য এই ‘টাকা’ ঠিক কতটা তা জানা যায় না। শর্তে বলা হয়, যদি সেই নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের লোকজন এ কথা প্রমাণ করতে পারে যে, সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তি কোনওরকম জঙ্গি সংগঠনের কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত ছিল না এবং সেই ব্যক্তি মৃত, কেবল তখনই তাঁরা এই সাহায্য পেতে পারে। শর্তে আরও বলা হয়, যদি সরকারের থেকে টাকা পাওয়ার পর সেই ব্যক্তি ফিরে আসে, তবে সেই পরিবারকে সাহায্যের গোটা টাকাটা ফেরত দিয়ে দিতে হবে।
২০২১-র ৯ জুলাই দ্য কুইন্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কাশ্মীরে বাসির বলে এক নিখোঁজ যুবকের পরিবার ১৯৯৯ সালে সরকারের থেকে এক লক্ষ টাকা পায় এবং সাথে সাথে তাঁদের পরিবারের এক সদস্যকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তবে সে চাকরি তাঁরা আজ অবধি পায়নি। উপরন্তু তাঁদের হাতে চাকরির বদলে ২০১৯ সালে আরও চার লক্ষ টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এখানে জেনে রাখা প্রয়োজন, এই সামান্য সরকারি সাহায্যটুকুও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেওয়া হয় না কারণ ধরেই নেওয়া হয় যে নিখোঁজ ব্যক্তিরা প্রত্যেকেই জঙ্গি কার্যকলাপের সাথে জড়িত ছিল।
একের পর এক বলপূর্বক নিখোঁজের ঘটনায় কাশ্মীরে আতঙ্কের পরিস্থিতি দিনে দিনে আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের মধ্যে তো একাধিকরকম মানসিক সমস্যা দেখা দেয়ই, পাশাপাশি সাধারণ মানুষজনের মধ্যেও এই আতঙ্কের ভিত আরও পোক্ত হতে থাকে। অর্ধ-বিধবা নারী এবং নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের সন্তানদের জন্য উপত্যকায় জীবন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। যেহেতু তাঁদের পরিবারের লোক নিখোঁজ তাই একথা ধরেই নেওয়া হয় যে তাঁদের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠনের কোনও না কোনও যোগাযোগ রয়েছে। এবং সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করা শুরু হয়। সমাজ থেকে লাগাতার বিচ্ছিন্ন হতে হতে স্বভাবতই তাঁরা মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেন। এর ফলে ক্রনিক ডিপ্রেশন, পিটিএসডি-র মতো মানসিক রোগ দেখা দেয়। এনসিবিআই-এর প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, কাশ্মীরে ৫৫ শতাংশ লোক ক্রনিক ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। ২৬ থেকে ৩৫ বছরের বয়সসীমার মধ্যে ডিপ্রেশনের প্রভাব ৬৬ শতাংশ। ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে ৬৫ শতাংশ। এবং দেখা যাচ্ছে নারীদের মধ্যে ডিপ্রেশন পুরুষদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ, ৯৩ শতাংশ।
একদিকে যে কোনও প্রতর্কে ‘কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ বলে গলা ফাটানো, আবার আরেকদিকে কাশ্মীরের মানুষের উপর এই লাগাতার হামলা। বিগত তিন দশক জুড়ে এমন হাজার ক্ষত বহন করে চলেছে কাশ্মীর। বলপূর্বক নিখোঁজ সেই হাজারটা ক্ষতর একটা। সম্প্রতি এপিডিপি-র চেয়ারপারসন পারভিনা আহাঙ্গারের বাড়িতে এনআইএ-র আক্রমণ, খুররম পারভেজের মতো মানবাধিকার কর্মীর গ্রেফতার আমাদের বুঝিয়ে দেয় কাশ্মীরে মানবাধিকারের দুর্দশা। পারভিনা আহাঙ্গার নিজে একজন নিখোঁজ ব্যক্তির মা, এ ছাড়াও বলপূর্বক নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের পাশে থেকে তিনি লাগাতার আন্দোলন করে গেছেন। বলপূর্বক নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির ঘরের লোকেদের অন্যতম ভরসার জায়গা হিসাবে থেকেছেন পারভিনা, আজ তাঁর উপর এনআইএ-র এই আক্রমণ বা সম্প্রতি কাশ্মীরওয়ালা পত্রিকার সম্পাদক ফাহাদ শাহ-এর গ্রেফতারি আমাদের সামনে উপত্যকার সঙ্কুচিত গণতান্ত্রিক চেহারাটি স্পষ্ট করে দেয়।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে, শাসকগোষ্ঠীর সুরে সুর মিলিয়েই ভারত রাষ্ট্র বলপূর্বক নিখোঁজকে তার দমনরীতি হিসাবে বেছে নিয়েছে। খেয়াল করলে দেখব, তাদের এই দমনরীতি বেছে নেওয়ার পিছনে কাজ করছে কাশ্মীরের জনতাকে বিধ্বস্ত করে তোলবার তাগিদ। সবরকম প্রক্রিয়ায় তারা কাশ্মীরের লড়াইকে দমন করতে চায়। যে কোনও মানুষের আশ্রয়, ভরসার জায়গা তাঁর পরিবার, তাই সেইখানেও কামড় বসাতে বাদ রাখেনি তারা। সমাজে একপ্রকার ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করে প্রতিটি প্রজন্মকে তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠার থেকে আটকাতে চায়। বলপূর্বক নিখোঁজ সেই ভীতি গড়ে তোলবারই অস্ত্র। আফস্পার মতো নির্দয় আইন পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনী এবং সামরিক বাহিনীকে তার যাবতীয় অত্যাচার, হত্যা, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ভুয়ো সংঘর্ষএবং হেফাজতে মৃত্যুর মতো অপরাধকে আইনের হাত থেকে সহজেই আড়াল করে রাখে। অর্থাৎ, রক্ষাকবচের কাজ করে।
তথ্যসূত্র:
১) https://m.thewire.in/article/rights/kashmir-army-enforced-disappearances
২) https://www.ohchr.org/en/hrbodies/ced/pages/conventionced.aspx
৩) Enforced Disappearance in Kashmir, by APDP.
৪) https://www.videovolunteers.org/enforced-disappearances-in-kashmir-a-states-denial-and-a-communitys-agony/
৫) THE PREVENTION OF ENFORCED DISAPPEARANCE BILL, 2017.
৬) https://www.theguardian.com/global-development/2010/oct/11/1
৭) https://www.aljazeera.com/news/2013/10/12/the-dilemma-of-kashmirs-half-widows
৮) https://www.thequint.com/news/law/enforced-disappearances-in-kashmir-no-law-no-relief-for-families
৯) https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3068807/
১০) https://theintercept.com/2021/07/26/india-kashmir-human-rights-nia/
১১)https://www.thequint.com/news/law/enforced-disappearances-in-kashmir-no-law-no-relief-for-families
১২)https://apdpkashmir.com/
১৩)https://standwithkashmir.org/enforced-disappearances-in-kashmir/ https://www.videovolunteers.org/enforced-disappearances-in-kashmir-a-states-denial-and-a-communitys-agony/
১৪)https://jkccs.net/international-week-of-the-disappeared-those-disappeared-in-kashmir-may-have-been-tortured/
লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।