শিক্ষাঙ্গন বন্ধ রেখে অনলাইন শিক্ষার নামে দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের মুনাফা লোটার পথ করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার। চলতি শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে অ্যাপ ভিত্তিক শিক্ষার বন্দোবস্ত চালু করতে চায় তারা। ছাত্র-ঋণের নামেও ছাত্র-ছাত্রীদের সপরিবারে দেনার ফাঁদে ফেলার চেষ্টা চলছে। লিখছেন অজয় রায়।
বিক্ষোভ-আন্দোলনের মুখে পিছু হটে বাংলার তৃণমূল সরকার গত ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে স্কুলের অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন ফের চালু করতে বাধ্য হয়েছে। এখন প্রাথমিক স্তর থেকেও স্কুল খোলার জরুরি প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। যখন অনলাইন শিক্ষার সঙ্গেই আরও প্রকট হচ্ছে ডিজিটাল বিভাজন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত দুই বছরের অধিকাংশ সময়ই করোনা অতিমারির কারণ দেখিয়ে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছিল। গত ১৬ নভেম্বর নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির জন্য স্কুল খুললেও জানুয়ারির গোড়াতেই কোভিডের তৃতীয় ঢেউ এবং ওমিক্রণের আবহে আবার তা বন্ধ করা হয়। এদিকে অনলাইন শিক্ষার নিদান দিয়ে গেছে সরকার। আর সাধারণ পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীরা বেশিরভাগই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এর প্রতিবাদে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফলাইন পঠনপাঠন চালু করার দাবিতে সরব হন ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী এবং অভিভাবকদের বড় অংশ। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন-সহ বহু শিক্ষানুরাগী মানুষ পথে নামেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল — বাজার, রেস্তরাঁ, সিনেমা হল যখন খুলে দেওয়া হয়েছে, সরকারি উদ্যোগে মেলা, উৎসব আর রাজনৈতিক কর্মসূচি চলছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকেও অবিলম্বে খুলতে হবে। অফলাইনে সেকন্ডারি এবং হায়ার সেকন্ডারি পরীক্ষার বন্দোবস্ত করতে হবে। গণপরিবহন ব্যবস্থা পুরোপুরি স্বাভাবিক রাখার দাবিও ওঠে। স্বৈরাচারী রাজ্যসরকার অবশ্য আন্দোলনকারীদের উপর দমন-পীড়ন নামিয়ে আনে। তাঁদের গ্রেপ্তারও করা হয়। তবে শেষ অবধি চাপের মুখে তাঁদের দাবি আংশিকভাবে মানতেই হয়েছে। এখন ‘পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষালয়’ নয়, অবিলম্বে বিদ্যালয়েই প্রাক-প্রাথমিক থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পঠনপাঠন চালু করার দাবিতেও সরব হচ্ছে নানা মহল। রাজ্য সরকার অবশ্য ‘পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষালয়’ চালু করার কথাই বলছে। কিন্তু তার জন্য শৌচালয়, ছাউনি ও জল সরবরাহের মতো পরিকাঠামোর তেমন কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। স্পষ্টত এভাবে মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে শিক্ষাঙ্গন বন্ধ রাখা আর নিজেদের দায় এড়ানোই সরকারের লক্ষ্য।
এদিকে, অনলাইন শিক্ষার সঙ্গেই আরও বাড়ছে ডিজিটাল বৈষম্য। যা আর্থ-সামাজিক বৈষম্যেরই প্রতিফলন। সাধারণ পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীরা, বিশেষত প্রত্যন্ত গ্রামে ও শহরের বস্তি অঞ্চলে বাস করেন এমন পরিবারের সন্তানরা অধিকাংশই গত প্রায় দুই বছর যাবৎ শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। তাঁদের শিক্ষার বুনিয়াদটাই কার্যত ধ্বংস করার তৎপরতা চলেছে। আর বহু ছাত্র-ছাত্রী স্কুলছুট হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ। ডিজিটাল নীতির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আইসিআরআইইআর অ্যান্ড এলআইআরএনইএ এশিয়া’র এক নতুন জাতীয় নমুনা সমীক্ষা অনুসারে, ভারতে মাত্র ২০% স্কুলে যাবার বয়সের শিশু অতিমারির সময় দূরশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিল, যাদের মধ্যে কেবলমাত্র অর্ধেক লাইভ অনলাইন শিক্ষায় অংশগ্রহণ করে। বস্তুত, ৩৮% পরিবারই বলেছে যে অন্তত একটি শিশু কোভিড-১৯’র দরুন সম্পূর্ণ ভাবে স্কুলছুট হয়েছে।১
এদেশে বেশিরভাগ পরিবারেরই কম্পিউটার বা ল্যাপটপ নেই। স্মার্ট ফোনও পান না অনেকেই। যেসব বাড়িতে স্মার্ট ফোন আছে সেখানেও বহুক্ষেত্রেই একাধিক ছাত্র-ছাত্রীর জন্য তেমন মোবাইল সেট কেবল একটি। তাছাড়া ইন্টারনেট পরিষেবা নেবার খরচ বহন করা বহু পরিবারের পক্ষেই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন অঞ্চলে ইন্টারনেটের সংযোগ দুর্বল ও অস্থিতিশীল। শুধু ছাত্র-ছাত্রীরাই নন, বহু শিক্ষক-শিক্ষিকাও এই সব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারছেন না। আর অনলাইন ক্লাস যারা করছে, সেই সব পড়ুয়াদের সঙ্গেও সরাসরি সংযোগের অভাবে শিক্ষার গভীরতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদদের একাংশ। অনেক শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে মনোযোগী থাকছে না। তাছাড়া অনলাইনে বিশেষত ব্যবহারিক বিভাগের বিষয়গুলিতে শিক্ষাদান আর ছোট শিশুদের লেখাপড়া শেখানো দুরূহ। আরও যেটা লক্ষ্য করার তা হল, ছাত্র-ছাত্রীদের মোবাইলের প্রতি আসক্তি বাড়ছে। তারা স্কুলের শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিবেশ পাচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশও ব্যাহত হচ্ছে।
অনলাইন শিক্ষার নামে কার্যত সর্বজনীন শিক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করা হচ্ছে। শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রান্তিক পরিবারের সন্তানরা। বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বিশেষত ছাত্রীরা; আর সেই সঙ্গে তফসিলি জাতি ও জনজাতির শিক্ষার্থীরা। এদিকে মোদী সরকার জনবিরোধী নয়া-উদারবাদী নীতি অনুসরণ করে চলেছে। শিক্ষাকেও বেসরকারিকরণ করছে। তাদের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’র লক্ষ্যই এটি। যখন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে বর্ধিত বেতন ও অন্যান্য ফি আদায় করে চলেছে। আর শিক্ষাঙ্গন বন্ধ রেখে অনলাইন শিক্ষার নামে দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের মুনাফা লোটার পথ করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার। চলতি শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে অ্যাপ ভিত্তিক শিক্ষার বন্দোবস্ত চালু করতে চায় তারা। ছাত্র-ঋণের নামেও ছাত্র-ছাত্রীদের সপরিবারে দেনার ফাঁদে ফেলার চেষ্টা চলছে।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, বর্তমান সঙ্কট মোকাবিলায় শিক্ষাক্ষেত্রেও সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। কিন্তু মোদী সরকার ডিজিটাল শিক্ষা নিয়ে মাতামাতি করলেও প্রকৃতপক্ষে জনসাধারণের জন্য শিক্ষায় বরাদ্দ কমিয়ে চলেছে। এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ বাতিল করার দাবি উঠছে নানা মহল থেকে। স্পষ্টতই, সরকারি উদ্যোগে এখন শিক্ষার পরিকাঠামোর উন্নয়ন দরকার। যাতে কোনও ছাত্র-ছাত্রী যাতে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়; এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে পঠনপাঠন চালানো যায়। স্কুল পড়ুয়াদের টিকাকরণও গুরুত্বপূর্ণ। আর মিড-ডে মিল চালু করা এবং সেই সঙ্গে স্কুলছুটদের স্কুলে ফেরানো আশু কর্তব্য।
তথ্যসূত্র
[১] ‘‘Remote education was inaccessible to most children, says survey’’, November 12, 2021, The Hindu
https://www.thehindu.com/news/national/remote-education-was-inaccessible-to-most-children-says-survey/article37461115.ece