প্রতিবন্ধীদের যৌন হেনস্থায় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার নিয়োগ করা আবশ্যক 


  • February 6, 2022
  • (0 Comments)
  • 775 Views

২০১২ সালের পকসো (প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট) ও ২০১৩এর সিলএএ (ক্রিমিনাল লঅ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) অনুযায়ী প্রতিবন্ধকতাযুক্ত কোনও শিশু বা মহিলা যখন যৌন হেনস্থার অভিযোগ করছেন তখন রাজ্যর নির্দিষ্টভাবে তাতে হস্তক্ষেপ করা বাধ্যতামূলক। এই দুটি আইন অনুযায়ীই রাজ্য প্রশাসনকেই অভিযোগকারীর জন্য স্পেশাল এডুকেটর ও সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটারএর পরিষেবার ব্যবস্থা করতে হবে। সুদর্শনা চক্রবর্তীর প্রতিবেদন।

 

৩ ডিসেম্বর আর্ন্তজাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। সদ্য শেষ হওয়া ২০২১ সালের ৩ ডিসেম্বর এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ১০০ জন মানুষের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি যায়। যার মূলে ছিল তার কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া একটি জঘন্য অপরাধ এবং  তাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া একটি আইনি ও প্রশাসনিক দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা।

 

ঘটনাটি এই রকম – ২০২১-এর জুলাই মাসে মধ্য কলকাতার কলকাতার এন্টালি থানা এলাকায় একজন মূক ও বধির তরুণী তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে এই মর্মে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। এই নির্দিষ্ট থানার পুলিশ সেই তরুণীকে কোনও সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার (অনুবাদক)-এর পরিষেবা দিতে ব্যর্থ হন। যেহেতু তরুণীর বক্তব্য তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিক যথাযথভাবে বুঝে উঠতে পারেননি, তাই তাঁর ধর্ষণের অভিযোগও থানায় নথিভুক্ত হয়নি। ঘটনাটি হাইকোর্ট অবধি গড়ায়। হাইকোর্ট-এর হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত নভেম্বর ২০২১-এ এই তরুণীকে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার-এর পরিষেবা দেওয়া হয় এবং তিনি প্রথম অভিযোগ করার চার মাস পরে ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়। মুখ্যমন্ত্রীকে গত ৩ ডিসেম্বরে পাঠানো চিঠিতে স্পষ্ট করে জানানো হয় যে, ২০১২ সালের পকসো (প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট) ও ২০১৩-এর সিলএএ (ক্রিমিনাল ল’ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) অনুযায়ী প্রতিবন্ধকতাযুক্ত কোনও শিশু বা মহিলা যখন যৌন হেনস্থার অভিযোগ করছেন তখন রাজ্যর নির্দিষ্টভাবে তাতে হস্তক্ষেপ করা বাধ্যতামূলক। এই দু’টি আইন অনুযায়ীই রাজ্য প্রশাসনকেই অভিযোগকারীর জন্য স্পেশাল এডুকেটর ও সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার-এর পরিষেবার ব্যবস্থা করতে হবে। চিঠিতে জানানো হয় যে এন্টালি থানার নির্দিষ্ট ঘটনায় অত্যাচারিত তরুণীটিকে এই সহায়তা দিতে না পারা খুবই অবাক করার মতো।

 

মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হয় পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে রিহ্যাবিলেটশন কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (আরসিআই)-তে নথিভুক্ত আছেন এমন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ  ইন্টারপ্রেটার-এর সংখ্যা ৬২। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ চাইলেই আরসিআই-তে যোগাযোগ করে স্পেশাল এডুকেটর ও সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটারদের নামের তালিকা পেতে পারেন। পকসো-তে এও বলা আছে যে, প্রতিটি রাজ্যে এ রকম তালিকা জেলাভিত্তিক থাকতে হবে এবং তাদের পেশাগত পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে সাম্মানিক দেওয়ার কথা তার জন্য বাজেটও রাখতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠিতে অনুরোধ করা হয় যেন পকসো ও সিএলএএ-এ উল্লেখিত এই ধারাগুলি যাতে সঠিকভাবে প্রণয়ন করা হয় তা নিশ্চিত করতে যাতে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত শিশু ও মহিলারা ন্যায় পান।

 

এই ঘটনার এক মাসের মধ্যেই আবারও খাস কলকাতায় এক প্রতিবন্ধী মহিলাকে গাড়ির মধ্যে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এই নৃশংস ঘটনার পরেও অভিযোগকারী সেই মহিলাকে দু’টি থানা থেকে অভিযোগ না নিয়েই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ঘটনা যে থানা এলাকার সেখানে নথিভুক্ত করা হয় বলে অভিযোগ। উল্লেখযোগ্য হল সেই থানায় পুলিশ কর্মীদের উদ্যোগে প্রথম থেকেই আইন মেনে অভিযোগকারীর বক্তব্য সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার-এর মাধ্যমে নথিভুক্ত করা হতে থাকে। গাড়ি চিহ্নিত করা থেকে অভিযোগকারীর মেডিক্যাল পরীক্ষা প্রতিটি ধাপেই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার উপস্থিত ছিলেন। না, এই ঘটনা ব্যতিক্রম নয়, এটাই নিয়ম ও আইন মেনে হওয়ার কথা। অথচ যেহেতু প্রশাসনিক উদাসীনতায় এগুলি প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়, সেইজন্য এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তা খবর তৈরি হয়।

 

কথা বলছিলাম প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত দীর্ঘদিনের সংগঠন শ্রুতি ডিসএবিলিটি রাইটস সেন্টার-এর পক্ষ থেকে শম্পা সেনগুপ্তর সঙ্গে। শ্রুতি-ই ৩ ডিসেম্বর মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিটি পাঠিয়েছিল। শম্পা বললেন, “এটা তো আইনেই রয়েছে। তবে ইন্টারপ্রেটার সঠিকভাবে কাজ করতে পারছেন কি না, তার উপর কতটা চাপ পড়ছে, তার পারিশ্রমিক কীভাবে দেওয়া হচ্ছে সেগুলোও যেন গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। এই ঘটনায় যিনি ইন্টারপ্রেটার তিনিই এর আগে প্রচুর ধর্ষণের ঘটনায় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার হিসাবে কাজ করেছেন। এবারে অবশ্যই মিডিয়ায় প্রচার পেয়েছে বেশি এবং এটাও সত্যি যে তাঁকে প্রথম থেকেই নিয়োগ করা হয়েছে। তবে এই প্রক্রিয়া যেন নিয়মিত হতে থাকে। যেন থেমে না যায়। আমি এমন ঘটনার কথা বলতে পারি যেখানে আজ থেকে ২২ বছর আগে এই ঘটনার যিনি ইন্টারপ্রেটার তাঁর বাবাও  ইন্টারপ্রেটার হিসাবে কাজ করেছেন। তবে এই যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার-এর সাহায্য নেওয়া এটা এই ঘটনায় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। আর একটি বিষয় হল যে, আমাদের পাঠানো চিঠিটিতে ১০০ জন স্বাক্ষরকারী ছিলেন। নিশ্চয়ই এই পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে চিঠিটির কোথাও একটা প্রভাব আছেই।”

 

এই ঘটনায় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার হিসাবে কাজ করেছেন রজনী বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর এই ধরনের কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি পুলিশের দায়িত্ব পালন ও উদ্যোগে যথেষ্ঠ খুশি। তাঁর নিয়োগ ও অভিযোগকারী মহিলার সঙ্গে ব্যবহারে, তদন্তের প্রতিটি পদক্ষেপে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার-এর সাহায্য নেওয়া, মানবিক ব্যবহারে রজনী আশ্বস্ত হয়েছেন। তিনি জানালেন, “গাড়ি চিহ্নিত করা, মেডিক্যাল, ফরেনসিক সব স্টেপগুলি যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে। মেডিক্যাল-এ কিছু সমস্যা হয়েছিল, ডাক্তারের সঙ্গে সময় নিয়ে অসুবিধা হওয়ায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারও সমাধান হয়। মেয়েটির মা হাসপাতালে আছেন, পুলিশ তার সঙ্গে দেখাও করিয়ে এনেছে। মেয়েটির জামাকাপড় উদ্ধার, তাঁকে সরকারি রক্ষণাবেক্ষণে হোমে রাখা পুরোটাই হচ্ছে। পুলিশ ও মেয়েটির বাড়ির লোকেরা আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছেন। এমনকি পুলিশ দু’জন ইন্টারপ্রেটার নিয়োগ করেছে, যাতে সমস্যা না হয়। ইন্টারপ্রেটার আসার আগে পর্যন্ত তাঁরা নিজেরা চেষ্টা করে অভিযোগকারীর সঙ্গে লিখে, তার সাইন বুঝে ঘটনাটি যতটা সম্ভব বোঝার চেষ্টা করেছেন। আর ইন্টারপ্রেটার যাওয়ার পর মেয়েটি তো অবশ্যই নিশ্চিন্ত হয়েছেন যে তার কথা বোঝার মতো কেউ এসেছেন, ট্রমা থেকে বেরোতে, লজ্জা বা অস্বস্তি থেকে বেরোতে তা অনেকটাই সাহায্য করেছে। আমি আশা করব, পুলিশ, প্রশাসন আরও বেশি সচেতন হবে ও ইন্টারপ্রেটার নিয়োগ কীভাবে বিভিন্ন থানার মধ্যে যোগাযোগ রেখে পাওয়া সম্ভব তাতে নজর দেবে।”

 

এই প্রক্রিয়াটি এমন নয় যে প্রথম বার হল, কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার-এর নিযুক্তি অবশ্যই ইতিবাচক পদক্ষেপ। আইন অনুযায়ী প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার পাওয়ার জন্য আন্দোলন অবিরাম চালিয়ে গেলে যে তার প্রভাব পড়ে এই ঘটনা তার প্রমাণ। তবে মনে রাখা দরকার প্রতিবন্ধী মহিলাদের উপর যৌন হেনস্থার ঘটনা কমছে না। শহরে এরকম ঘটনা ঘটলে তাও তা মিডিয়া ও আলোচনার কেন্দ্রে আসছে, কিন্তু শহরতলী বা গ্রামে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে যেন তাও সামনে আসে। সরকার ও প্রশাসন যেন ঘটনা বন্ধ করা ও ঘটলে তাতে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় হবে।

 

 

Share this
Leave a Comment