দেশ বলতে যা বুঝি


  • January 26, 2022
  • (0 Comments)
  • 712 Views

পাড়ায় পাড়ায় নিয়ম মেনে পতাকা উত্তোলন, দেশের ট্যাবলো বিতর্ক, বিশেষ দিনটির আগে দেশ জুড়ে ‘পদ্ম’ পুরষ্কার নিয়ে হৈ-চৈ, এখনও কোথাও কোথাও সকালে প্যারেড ইত্যাদি মিলিয়ে মিশিয়ে বেশ একটা জব্বর ছুটির দিন পাওয়া গেল। ব্যাস, শুধুই এটুকু? লিখলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

ছাব্বিশ জানুয়ারি, ভারতবর্ষের প্রজাতন্ত্র দিবস। ১৯৫০-এর এই তারিখে সংবিধান কার্যকরী হওয়ার দিন। সেই সংবিধান যা এই দেশকে সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। যে সংবিধান এই দেশের মানুষদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করেছে। যে সংবিধানকে আঁকড়ে ধরে ভারতবর্ষের নাগরিকেরা লড়তে পারেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। যে সংবিধান আমাদের বলতে শেখায়, “আমরা, ভারতবর্ষের মানুষেরা…”। এই ২০২২-এ দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া এক পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলিই বোধহয় একজোট হয়ে চেঁচিয়ে বলা কতটা জরুরি তা আজকের দিনটিতে বুঝতে পারার সময়।

 

না, প্রজাতন্ত্র দিবস মানে শুধুই সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ আর বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক ট্যাবলো প্রদর্শন নয়, নয় টেলি প্রম্পটার অভ্যস্ত কোনও রাষ্ট্রনায়কের সারবত্তাহীন ভাষণ। দেশের প্রতিটি রাজ্যের মানুষগুলির অধিকার কায়েম থাকছে কি না, তাদের নাগরিক স্বার্থ কতটা সুরক্ষিত, রাজ্যের ও দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজেদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কতটা তৎপর, আদৌ কাজের কাজ কিছু করছেন কি না সেই বিষয়গুলি নিয়ে যদি আলোচনা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এই দিনটি নিছক উদ্‌যাপনের জন্য রয়ে যায়। আর আজকের ভারবর্ষে মনে হয় না আমাদের সেই বিলাসিতার অবকাশ রয়েছে, যখন দেশের সরকার চালাচ্ছে এক ফ্যাসিস্ত দল আর বিভিন্ন রাজ্যের সরকার নিজেদের স্বার্থ গোছাতেই ব্যস্ত। এমতাবস্থায় প্রজাতন্ত্র দিবস স্রেফ একটি দিন নয়।

 

গত দু’বছর ধরে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বুঝতে পেরেছেন নাগরিক অধিকার রক্ষা করতে, বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু মেটাতে এক অভূতপূর্ব এবং বিপদকালীন পরিস্থিতিতেও এ দেশের সরকার ব্যর্থ। জীবন রক্ষা করার জন্য যেটুকু স্বাস্থ্য পরিকাঠামো প্রয়োজন ছিল ব্যর্থ সেই জায়গার প্রয়োজন মেটাতেও। এমন নয় যে কোভিড পরিস্থিতির মোকাবিলা পৃথিবীর সব দেশ একই রকমভাবে করতে পেরেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসাবে এমনিতেই ভারত পিছিয়ে। কিন্তু যেটুকু নাছোড় জেদ দরকার ছিল দেশের গ্রাম, শহর, শহরতলীর নিম্নবিত্ত, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে, তাদের প্রাণগুলো বাঁচানোর জন্য ন্যূনতম যে সাহায্যটুকু করা সরকারের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত তা পালনে সে শুধু ব্যর্থ নয়, অনিচ্ছুকও। সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার শব্দবন্ধ কেবলই বইয়ের পাতায় রয়ে গেছে। দেশের দিকে তাকালে মনে হয় আদৌ যে স্বাধীন ভারতের একটি সংবিধান রয়েছে যেখানে দেশের মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের কথা বলা রয়েছে, রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা, জীবনধারণ, নিজ নিজ ধর্ম পালন বা ধর্ম পালন না করার অধিকারের কথা, রয়েছে দেশের প্রতিটি নাগরিকের সমানাধিকারের কথা – তা সম্ভবত দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া রাজনৈতিক দল ও তার প্রতিনিধিরা সম্পূর্ণই ভুলতে বসেছে।

 

দেশ, হ্যাঁ দেশই তো – যা শুধু কোনও কাল্পনিক পৌরানিক চরিত্রদের বাসস্থান নয়, যার প্রতিটি কোণায় আমাদের সহ নাগরিকেরা নিজেদের শ্রমের ঘাম ঝরিয়ে ফসল ফলান, কারখানা চালান, সচল রাখেন প্রতিদিনের জীবন। দেশ মানে যেমন মানচিত্রের সীমারেখা, তেমনি সেই সীমানা অতিক্রম করে একে অপরের প্রতিটি উৎসবে মেতে ওঠা, একে অন্যের অধিকারের জন্য যে কোনও প্রান্তে মিছিলে পা মেলানো। ভারতবর্ষের এই বহু সত্ত্বার জোটবদ্ধ ভাবনাকেই ভয় ফ্যাসিস্ত শক্তির। ভয় সেইসব দায়িত্বজ্ঞানহীন সরকারেরও যারা রাজ্য চালনা বলতে বোঝে শুধুই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি। সেইজন্যই এত ভাগ করে রাখার চেষ্টা – যাতে কাশ্মীরের সমস্যায় উত্তর-পূর্ব ভারত রেগে না ওঠে, যাতে উত্তরপ্রদেশে অপশাসনে কেরালায় আন্দোলন শুরু না হয়, যাতে পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়ায় মহারাষ্ট্র প্রশ্ন না তোলে। এই চুপ করিয়ে দিতে চাওয়ার রাজনীতিতে আমাদের অভ্যস্ত করে তুলতে চায় সরকার, রাষ্ট্র। দিনের পর দিন আমরাও কেমন তোতাপাখিতেই পরিণত হতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম।

 

কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে দুর্বলতম মানুষটিও প্রতিবাদ করে ওঠে। কোভিড মহামারির সময়ে ভারতবর্ষ রাষ্ট্রের, বিভিন্ন রাজ্য সরকারের যে ঘৃণ্য, বৈষম্যমূলক, অমানবিক চেহারা দেখেছে তারপরে অনেকটা, অনেকটাই তারা নতুন করে সোচ্চার হচ্ছে নিজেদের মৌলিক অধিকারগুলি নিয়ে। হয়তো এখনই আমাদের বোঝার সময় যে একা একা আমরা কেউই বাঁচতে পারব না, পারব না রাষ্ট্রের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। রেল লাইনে রুটি আর পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃতদেহের রক্ত একসঙ্গে পড়ে থাকা, মাইলের পর মাইল হাঁটতে থাকা শ্রমিকদের ভিড়, মৃত মায়ের উপর খেলতে থাকা শিশু, বাড়ি পৌঁছতে চাওয়া পথেই মৃত শিশুশ্রমিক – এরাই আমার দেশ।

 

আমার দেশ রাষ্ট্রের সমস্ত চোখ-রাঙানি আর কৌশলী ছক উল্টে দেওয়া অধিকার আদায় করা আন্দোলনকারী কৃষকেরা, পুঁজিপতি আর রাষ্ট্রের জল-জমি-জঙ্গল দখল করার বিরুদ্ধে মরণপণ লড়ে যাওয়া আদিবাসী, বনবাসীরা। আমার দেশ ফ্যাসিস্ত শক্তির কাছে মাথা নত না করা ফাদার স্ট্যান স্বামী, ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, জে এন সাইবাবা, গৌতম নওলাখা, গৌরি লঙ্কেশ। কর্পোরেটের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া সরকারের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন তোলা সেই মানুষেরা আমার দেশ যারা অবিরাম প্রশ্ন তুলে যায় রোহিত ভেমুলার মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? যারা ক্লান্ত হয় না জিজ্ঞেস করতে করতে নাজিব কোথায়? আমার দেশ শাহিনবাগের দাদি। আমার দেশ দিল্লির সংখ্যালঘুদের প্রতি সংঘটিত হিংসা ও গণহত্যায় যারা বুক দিয়ে আগলানোর চেষ্টা করে গেছেন যে বিপদাক্রান্ত মানুষগুলোকে। দেশ বলতে বুঝি সেইসমস্ত সাংবাদিক আর সংবাদ প্রতিষ্ঠানকে যারা শেখানো বুলি না আউড়ে, মিথ্যে খবর না করে দেশের বাস্তব ছবি তুলে ধরে গেছেন – কখনও চাকরি খুইয়ে কখনও বা জীবন। আমার দেশ দানিশ সিদ্দিকির দেশ।

 

ঘুমিয়ে পড়ার আগে সম্মিলিত পথ হাঁটা বাকি আমাদের অনেকখানি। যেন দেশ বলতে শুধু রাষ্ট্রশক্তি না বুঝি, বুঝি দেশের খেটে খাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে। যেন নিশ্চিত করতে পারি প্রতিটি লিঙ্গ ও যৌন পরিচিতির মানুষের সসম্মানে বেঁচে থাকাকে, প্রতিটি প্রতিবন্ধী মানুষের ব্যক্তিজীবন, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, স্বাস্থ্য পরিষেবা, সামাজিক ও রাজনৈতিক যাপনে আইনি অধিকার পাওয়াকে। সংবিধান আমাদের অধিকার দিয়েছে, দিয়েছে দেশ চালানোর প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষমতাও। মুষ্টিমেয় ধনী পুঁজিপতির খেলনা নয় অগনিত কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষ, শিক্ষক, শিল্পীদের পরিশ্রমে, মননে গড়ে তোলা এই দেশ। যেন এটুকু ভুলে না যাই।

 

ছবি : প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের কাশী বিশ্বনাথ করিডোর ট্যাবলো।

 

Share this
Leave a Comment