প্রাক-কথা
১ ফ্রেব্রুয়ারি সংসদে বাজেট পেশ করবেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। এমন এক সময় যখন খুচরো মূল্যবৃদ্ধি ২ থেকে ৬ শতাংশ যা নাগালের মধ্যে থাকলেও উর্ধ্বমুখী, কিন্তু পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার ১৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে যা বিশেষজ্ঞদের মতে মাথাব্যথার কারণ।
বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, কর্মসংকোচন, ছোট ও মাঝারি শিল্পে মন্দা, অসংগঠিত ও পরিযায়ী শ্রমিকদের শোচনীয় অবস্থা গৃহস্থদের তো বটেই, বেসরকারি ক্ষেত্রের কেনাকেটার পিছনে খরচ বাড়াচ্ছে না। আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে তৃতীয় ঢেউ। নতুন বছরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যা কিছুটা হলেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিমারি, লকডাউন, কেন্দ্রীয় নীতির ধাক্কায় বিগত অর্থবর্ষে ভারতের অর্থনীতি ৭.৩ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছিল। জিডিপি গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ১৩৫.১৩ লক্ষ কোটি টাকায়। ৭ জানুয়ারি ২০২২, পরিসংখান দফতর জানায়, এই সঙ্কুচিত জিডিপি-র ভিত্তিতে চলতি অর্থবর্ষে অর্থনীতির বাড়বে ৯.২ শতাংশ। অর্থমন্ত্রকের দাবি চলতি অর্থবর্ষে ভারতের অর্থনীতি ৯.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেই ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের জিডিপি অর্থাৎ, ১৪৫.৬৯ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে ১৪৭.৫৪ লক্ষ কোটি টাকায় দাঁড়াবে। একেই বলা হচ্ছে ‘ঘুরে দাঁড়ানো’। তার মানে হল, করোনাকালের পূর্বের অর্থনীতিতে ভারত পৌঁছে গিয়েছে। যা খুব কম দেশই পেরেছে। অর্থনীতিবিদ, বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে এই বৃদ্ধি ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের তুলনায় খুবই কম, মাত্র ১.৪ শতাংশ। বিপুল বৈষম্যের বোঝা মাথায় নিয়ে ভারত আদৌ কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারল তা নিয়ে ঘোরতর সংশয় রয়েছে।
আশঙ্কা ও মাথাব্যথা –১
পণ্য | পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার (%) | |
নভেম্বর | ডিসেম্বর | |
খাদ্য সূচক | ৪.৮৮ | ৯.৫৬ |
আনাজ | ৩.৯১ | ৩১.৫৬ |
তৈরি জিনিস | ১১.৯২ | ১০.৬২ |
জ্বালানি-বিদ্যুৎ | ৩৯.৮১ | ৩২.৩০ |
পণ্য | পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার (%) | |
নভেম্বর | ডিসেম্বর | |
তেল ও চর্বি | ২৯.৬ | ২৪.৩ |
চাল, গম | ১.৫১ | ২.৬২ |
মাছ-মাংস | ৫,৫৫ | ৪.৫৮ |
ডিম | –১.৩১ | ১.৪৮ |
দুধ | ৩.৩৭ | ৩.৭৬ |
খাদ্য সূচক | ১.৮৭ | ৪.০৫ |
খুচরো মূল্যবৃদ্ধি | ৪.৯১ | ৫.৫৯ |
- এই সারণি থেকে স্পষ্ট ২০২১ সালে নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়েছে। যা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নির্ধারিত মূল্যবৃদ্ধির সহনশীলতার কাছাকাছি। পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি নভেম্বরের ১৪.২৩ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়ে ১৩.৫৬ শতাংশ হয়েছে। যা গত দু’বছরে হওয়া সর্বোচ্চ (৯.৫৬%)।
সূত্র : অমিতাভ গুহ সরকার, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ জানুয়ারি ২০২২
আশঙ্কা ও মাথাব্যথা – ২
- জ্বালানি ও বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি নভেম্বরের ৩৯.৮১ শতাংশ থেকে ডিসেম্বরে ৩২.৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। বিগত দু’মাসের বেশি সময় ধরে ভারতে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম এক জায়গাতেও রয়েছে। এর পিছনে উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনকেই কারণ হিসাবে দেখছেন রাজনীতিক ও বাজার বিশেষজ্ঞরা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কর্নাটক, গুজরাত নির্বাচনের সময়ও তা স্থির ছিল। পশ্চিমবঙ্গ-সহ পাঁচ রাজ্যের ভোটের সময়ও তা বাড়েনি। ভোট শেষ হলেই ফের বাড়তে শুরু করে। এই নীতির পুনরাবৃত্তি হওয়ার ষোল আনা সম্ভাবনা রয়েছে।
- জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি রাষ্ট্রপুঞ্জ তেলের চড়া দাম এবং কয়লার ঘাটতি নিয়ে ভারতকে সতর্ক করে। রাষ্ট্রপুঞ্জের আশঙ্কা এর ফলে ভারতের আর্থিক কর্মকাণ্ড মার খাবে। এবং খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জেরে খাদ্য নিরাপত্তা ধাক্কা খাবে, প্রকৃত আয় কমবে, বাড়বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা।
- ১২ জানুয়ারি বাজারে অশোধিত তেল ব্রেন্ট ক্রডের দাম ৮৪ ডলার ছুঁয়েছে। পেট্রল-ডিজেলের চড়া দর মূল্যবৃদ্ধিতে ইন্ধন জোগায়। জে পি মরগানের বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, খুব তাড়াতাড়ি অশোধিত তেলের দাম ৩০ ডলার বাড়তে পারে। অন্যদিকে, মর্গান স্ট্যানলির মতে এ বছরের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে তা ৯০ ডলার ছাড়াতে পারে।
- অ্যাকুইট রেটিংস অ্যান্ড রিসার্চের প্রধান অ্যানালিটিক্যাল অফিসার সুমন চৌধুরীর দাবি করেছেন, জ্বালানি বা কারখানায় তৈরি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার কমায় যে হিসাব আপাতদৃষ্টিতে স্বস্তির মনে হচ্ছে, সেটাও সাময়িক। কারণ, বিশ্বের বাজারে অশোধিত তেলের দাম ফের বাড়ছে। সরবরাহ সমস্যা, কাঁচামালের ঘাটতি এবং চড়া পণ্যের দাম বহাল থাকার কারণে অদুর ভবিষ্যতে খাদ্য ও জ্বালনি বাদে বাকি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হারও উঁচু থাকবে।
*সূত্র : সংবাদ সংস্থা ও আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩, ১৪, ১৫ জানুয়ারি ২০২২।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
কেন্দ্রের প্রাক্তন মুখ্য উপদেষ্টা তথা অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু সম্প্রতি সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, সার্বিক ভাবে অর্থনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্মণ দেখা গেলেও, তার সুবিধা মূলত সমাজের উপরতলার মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে সতর্ক করেন। তাঁর মত, করোনার আগেই তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৩% ছুয়েছিল। আয় কমেছে শ্রমিক,কৃষক, ছোট শিল্পের। অথচ গত কয়েক বছর ধরে মূলত বড় শিল্পের দিকে তাকিয়েই সরকার বিভিন্ন নীতি নিয়েছে।
তাঁর মতে, “১৫ বছর আগেও মূল্যবৃদ্ধি ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। কিন্তু তার তুলনায় এখনকার পরিস্থিতি আলাদা। সে সময়ে দেশের প্রকৃত বৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশ। ফলে মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও গড়ে পরিবার পিছু আয় ৭% থেকে ৮% হারে বাড়ছিল।” তিনি ব্যাখ্যা করে জানান, গত দু’বছরে গড় মূল্যবৃদ্ধি ৫ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। অথচ প্রকৃত আয় কমে গিয়েছে। তার উপরে গত অর্থবর্ষের ৭.৩ শতাংশ জিডিপি সঙ্কোচন হয়েছে। এ বছর কেন্দ্রের পূর্বাভাস ৯.২ শতাংশ হারে বৃদ্ধির। কিন্তু এর ফলেও প্রকৃত অর্থে গত দু’বছরে গড় বৃদ্ধি দাঁড়াবে ০.৬%। যা অবস্থাকে আরও সঙ্কটজনক করে তুলেছে।
অধাপক বসুর কথায়, “এটা অর্থনীতিতে স্ট্যাগফ্লেশনের–যেখানে মূল্যবৃদ্ধি চড়া, বেকারত্ব বেশি এবং আর্থিক বৃদ্ধি ঝিমিয়ে–ছবিই তুলে ধরে। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কাজের সুযোগ তৈরি এবং ছোট শিল্পকে সাহায্য করা। একই সঙ্গে উৎপাদন বাড়ানো।”
তাঁর পরামর্শ : (১) গরিবদের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের একাংশের হাতেও সরাসরি নগদ ত্রাণ তুলে দেওয়া। (২) পরিকাঠামোয় জোর দেওয়া। (৩) সরবরাহ ব্যবস্থা সরল করা এবং (৪) ধারাবাহিক ভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করা। একই সঙ্গে তিনি সতর্ক করে বলেন, “বর্তমানে যেখানে অতিমারিতে অর্থনীতি ধাক্কা খাচ্ছে, সেখানে সেন্ট্রাল ভিস্তায় আনুমানিক ২০০ কোটি ডলার (প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকা) খরচ অস্বস্তিকর।” যা আদতে উৎপাদনশীলতা বাড়ায় না।
সূত্র : সংবাদ সংস্থা ও আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ জানুয়ারি ২০২২
সাংবাদিক এবং অর্থনীতির ভাষ্যকার অমিতাভ গুপ্ত-র মতে, “পরিসংখ্যান বলছে যে, এই অর্থবর্ষে অনেক কিছু বাড়ছে বটে, কিন্তু খুঁড়িয়ে চলছে মানুষের ভোগব্যয়। জিডিপি হিসাব করা হয় তিনটি উপাদানের ভিত্তিতে–মানুষের ব্যক্তিগত ভোগব্যয়, সরকারের ভোগব্যয় এবং স্থায়ী মূলধন নির্মাণ, অর্থাৎ বিনিয়োগ। দেখা যাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় এই অর্থবর্ষে জিডিপি-তে সরকারি ভোগব্যয়ের অনুপাতও বেড়েছে, স্থায়ী মূলধনের অনুপাতও বেড়েছে। কমে গিয়েছে, ব্যক্তিগত ভোগব্যয়ের অনুপাত। মানুষের খরচের মাত্রা এখন কোভিড-পূর্বস্তরে পৌছয়নি।”
অমিতাভ বাবুর প্রশ্ন, “জিডিপি বাড়ছে, অথচ মানুষের ভোগব্যয় বাড়ছে না–কেন?” উত্তরে তিনি জানাচ্ছেন, “দেশের প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন একটা কথা বলেছেন – যাঁরা বেশি খরচ করেন, তাঁদের বদলে রোজগার গিয়েছে যাঁরা বেশি সঞ্চয় করেন, তাঁদের হাতে। …প্রণব সেন যে কথাটা বলেছেন তা হল, অর্থব্যবস্থা যদি বা ঘুরে দাঁড়ায় তার সুফল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের বদলে পৌঁছচ্ছে মুষ্টিমেয় ধনীর হাতে।”
ক্রমবর্ধমান বেকারিত্ব বিষয়ে তাঁর মত, “দেশের মোট উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ছে, কিন্তু লোকের বেকারত্ব বাড়ছে, এমন পরিস্থিতি তৈরি হল কী করে? প্রাথমিক আগাম হিসাবের অঙ্কে এই প্রশ্নেরও উত্তর রয়েছে। উৎপাদন বেড়েছে মূলত পুঁজিনির্ভর ক্ষেত্রে, যেখানে নতুন শ্রমিক নিয়োগের সম্ভাবনা কম। শ্রমনিবিড় পরিষেবা ক্ষেত্র এখনও ধুঁকছে। বাজারে শ্রমের চাহিদা কম, ফলে নতুন কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে না। যাঁরা চাকরি করছেন, তাঁদের মধ্যেও অনেকেই আগের চেয়ে কম মাইনেতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।”
একই সঙ্গে তিনি এই সময় পালটে যাওয়া চাকরির চরিত্র নিয়ে সিএমআইই-র কর্ণধার মহেশ ব্যাস-এর এক সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ তুলে লিখছেন, সংগঠিত খুচরো ব্যবসা থেকে হরেক পরিষেবা ক্ষেত্র, সর্বত্রই এখন নিয়োগ করা হচ্ছে ‘গিগ’ কর্মী। অর্থাৎ, সংগঠিত ক্ষেত্রের মধ্যে গড়ে উঠছে এক আশ্চর্য কাজের বাজার, যেখানে কর্মীদের ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও নেই। এর পর তিনি তাঁর নিবন্ধ শেষ করছেন এই প্রশ্ন তুলে যে, “তার পরেও দিল্লির শাসকরা দাবি করবেন যে, অর্থব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বড় অর্থনীতিরগুলির মধ্যে ভারতই সবচেয়ে দ্রুত সামলে নিয়েছে কোভিড-এর ধাক্কা। শীর্ষে থাকা এক শতাংশ, এমনকি ১০ শতাংশ মানুষের কাছেও কথাগুলো সত্যি, বাস্তব। কিন্তু, তার বাইরে যে আশি শতাংশের ভারত, সেখানে দাঁড়িয়ে শাসকদের এই কথায় বিশ্বাস করব কি না, এই বিবেচনা একান্তই আমাদের।”
সূত্র : ক’জন ঘুরে দাড়ালেন? অমিতাভ গুপ্ত, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ জানুয়ারি ২০২২
কেন্দ্রীয় নীতিই যে ভারতের এই অর্থনৈতিক দূরবস্থার জন্য দায়ী তা স্পষ্ট। অক্সফ্যাম তার রিপোর্টে পরিষ্কার করে জানিয়েছে, বিগত চার বছর ধরে পরোক্ষ করের পরিমাণ বাড়ছে, কর্পোরেট করের অংশ কমছে। প্রাক-কোভিড পর্ব থেকে জ্বালানির উপর কর বেড়েছে ৭৯ শতাংশ। অথচ ২০১৬ সাল থেকেই অতি-ধনীদের জন্য সম্পদ কর তুলেই দেওয়া হয়েছে। কর্পোরেট কর ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে আনা হয়েছে ২২ শতাংশে। মহামারির সময়েও রিলিফ প্যাকেজ করা হয়েছে ধনকুবের এবং কর্পোরেটের মুখের দিকে তাকিয়ে। অক্সফ্যামের বিশ্লেষকরা বলছেন, ধনীতম ৯৮টি পরিবারের উপরে বাড়তি ১% সম্পদ কর বসালে উঠে আসবে সাত বছরের আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের বরাদ্দ। স্যাঙ্গাৎ ধনতন্ত্রের মদতদাতা নরেন্দ্র মোদী সরকার কি এ পথে হাঁটবে? এমন কোনও লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না।
পড়ুন : অসাম্যের শিখর ছুঁয়েছে ভারত