কৃষক আন্দোলনের জয়ে শেষ ‘মোদী অরা’ : বললেন কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতা রাজিন্দর সিং


  • December 30, 2021
  • (0 Comments)
  • 1064 Views

ফেলে আসা বছরে দেশের গণআন্দোলনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং সদর্থক ঘটনা কৃষিআইন প্রত্যাহার করতে কেন্দ্রীয় সরকারকে বাধ্য করাপ্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং কৃষিআইন প্রত্যাহার করবেন এমনটা অতিবড় আশাবাদীও বোধহয় ভাবতে পারেনিএমনই এক সফল কৃষক আন্দোলনের পর কী ভাবছেন কৃষক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক, সংযুক্ত কৃষক মোর্চার অন্যতম সদস্য সংগঠন, পাঞ্জাবের কীর্তি কিসান ইউনিয়নের উপসভাপতি রাজিন্দর সিং দীপসিংওয়ালা? কৃষক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, আগামীতে এই আন্দোলন কীভাবে দেশের রাজনীতি, রাজনৈতিক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করবে সে বিষয়ে এবং আন্দোলনে মহিলাদের ভূমিকা নিয়ে কথা বললেন গ্রাউন্ডজিরো সঙ্গেরাজিন্দর সিংএর এই একান্ত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

 

প্র: দীর্ঘ এক বছর আন্দোলনের পর তিনটি কৃষি আইন কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যাহার করতে বাধ্য হল। আগামী দিনে দেশের গণআন্দোলনগুলিতে এই কৃষক আন্দোলনের কী প্রভাব পড়বে বলে আপনি মনে করছেন?

 

উঃ  দেশের ফ্যাসিস্ট শোষণকারীকে এই আন্দোলন একটা বড় ধরনের ধাক্কা দিতে পেরেছে। গত সাতবছরে যেন মনে হচ্ছিল এই সরকারের সামনে কোনও চ্যালেঞ্জ নেই। না তো কোনও বিরোধীদের থেকে, না-কোনও গণআন্দোলন থেকে। এই আন্দোলন, কৃষকদের প্রতিরোধের পর মানুষের মনে নতুন করে আশা জাগছে। কাশ্মীর থেকে বার্তা আসছে যে – কৃষক আন্দোলন থেকে শিখতে হবে। সিএএ আন্দোলনেরও কিছু মিটিং হচ্ছে, তারাও এর থেকে উৎসাহ পাচ্ছেন। একটা গণতান্ত্রিক পরিসরকে যেন পুনরুদ্ধার করেছে এই আন্দোলন। আর একটা ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পেছনে সরিয়ে দিয়েছে। তাই সারা দেশ জুড়ে এর একটা প্রভাব তো নিশ্চিতভাবেই পড়বে। এই কৃষক আন্দোলনের সময়ে পাঞ্জাব, হরিয়ানায় আরও বেশ কিছু মূলভিত্তিক বিষয় উঠে আসে, যেমন এসওয়াইএল-এর বিষয়টি, উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমভাগে যেমন দাঙ্গার মাধ্যমে সমাজে এক ধরনের বিভেদ তৈরি করা হয়েছিল – এই সবকিছুর প্রেক্ষাপটে যখন কৃষক আন্দোলন শুরু হল তখন পঞ্জাব-হরিয়ানায় সৌভ্রাতৃত্ব অনেক বেড়ে গেল, যাকে সম্ভবত কোনও শাসক দলই আগামী দিনে খুব তাড়াতাড়ি ভাঙতে পারবে না। সেভাবেই উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমভাগে এদের রাজনীতির চালকেও এই আন্দোলন পিছু হটতে বাধ্য করেছে। একটা এমন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে যে — ধর্ম আর জাতি ঘিরে এত বছর ধরে চলে আসা রাজনীতি তো থাকবে, কিন্তু তা যেমনভাবে সব কিছু সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করছিল, রাষ্ট্রের নামে মানুষের অধিকারের প্রশ্নগুলিকে চাপা দিয়ে দিচ্ছিল এবার তা কিছুটা হলেও কমতে শুরু করবে। ইস্যুভিত্তিক লড়াইগুলো, প্রশ্নগুলো ধীরে ধীরে সামনে আসবে। এই প্রভাবটা আমরা মোটামুটি যেন দেখতে পাচ্ছি।

 

প্র: একবছরের আন্দোলনের শেষে তিনটি আইন প্রত্যাহার হয়েছে। কিন্তু প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের যে শোষণ তা তো এত সহজে কমার নয়। কৃষকদের স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদীভাবে লড়াই চালাতে এই আন্দোলনের, আপনারা যাঁরা নেতৃত্বে রয়েছেন তাঁদের কী পরিকল্পনা রয়েছে?

 

উঃ দেখুন, একটা কথা তো অবশ্যই সত্যি যে এই তিনটি আইন প্রত্যাহার হয়েছে মানে কৃষকদের সমস্ত সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে তা তো একেবারেই নয়। তাদের অবস্থা তো আগে যা ছিল এখনও তাই-ই থাকবে। কিন্তু এই আন্দোলন কৃষকদের একটি বিষয় বুঝতে সাহায্য করেছে যে যদি আমরা একজোট হয়ে কোনও আন্দোলন করি তাহলে কিছু অধিকার আদায় করতে পারব। সেইজন্য এমএসপি-র বিষয়টি নিয়ে দেশ জুড়ে আন্দোলন তৈরির প্রচেষ্টা আমাদের থাকবে। তাছাড়া পঞ্জাবের কৃষকদের উপরে এক লক্ষ কোটি টাকার যে ঋণ আছে, কয়েক বছর আগে তা মকুব করার দাবিতে পঞ্জাবের কৃষকদের জাটঠেবন্দিরা একটা আন্দোলন চালিয়েছিলেন। এই আন্দোলনের ফলেই পঞ্জাবের কংগ্রেস সরকার নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, এই ঋণ মকুব করা হবে। এখনও সেই ঋণ রয়েছে। তবে ঋণ মকুবের জন্য একটা বড় আন্দোলনের প্রেক্ষাপট পঞ্জাবে তৈরি হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে এই নিয়ে বড় আন্দোলন হবে এবং তা পঞ্জাবের কৃষকদের অনেকটাই নিশ্চিন্তি দেবে। যে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকেরা রয়েছেন, তাঁদের জন্যও আমাদের প্রোগ্রাম আছে। যেমন গ্রামে তাঁদের যে জমি থাকে সেগুলি নিঃশর্তভাবে তাঁদের দিয়ে দিতে হবে। তার সমস্ত বন্দোবস্ত সরকারকে করতে হবে, চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস তাঁরা যেন বিনামূল্যে পান তা দেখতে হবে, পাঁচ একর পর্যন্ত জমি যাদের আছে তাদের বিনাসুদের কৃষিঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে – এরকম কিছু বিষয় নিয়েই আমরা প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্য লড়ার পরিকল্পনা করেছি। আরও একটা বড় ইস্যু হল গ্রিন রেভলুশন বেল্ট-এ যে কৃষি সমস্যা রয়েছে। বোঝা প্রয়োজন গ্রিন রেভলুশনের যে মডেল তা প্রো-কর্পোরেট মডেল। এই মডেল কৃষি-বিরোধী ও প্রকৃতি-বিরোধী। কৃষক স্বার্থরক্ষাকারী এবং প্রকৃতির স্বার্থরক্ষাকারী একটি মডেল হোক, দীর্ঘমেয়াদী একটি কৃষি মডেল উঠে আসুক – এই বিষয়গুলি নিয়েও আমরা আলোচনা চালাচ্ছি ও ভবিষ্যতে এই বিষয়গুলি নিয়েও লড়াই চলতে পারে।

 

প্র: গত একবছর আপনারা এক জায়গায় থেকে একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করেই জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। সহমত তৈরি করা, কোনও ক্ষেত্রে মতবিভেদ তৈরি হলে তা মিটিয়ে নেওয়া আন্দোলনের স্বার্থে সহজ ছিল। কিন্তু এখন যখন আন্দোলনকারীরা এবং কৃষক নেতৃত্ব যে যাঁর নিজেদের জায়গায় ফিরে গেছেন, নিজেদের পরিসরে আন্দোলনকে হয়তো নিজেদের মতো করে দেখবেন, তখন ভবিষ্যতের আন্দোলনকেন্দ্রিক রূপরেখা একজোট হয়ে তৈরি করা কীভাবে সম্ভব হবে বলে দেখছেন?

 

উঃ দেখুন যে জোটমঞ্চ তৈরি হয়েছিল তা তো আমরা অক্ষুণ্ণ রেখেইছি, শুরু থেকেই তাই আমাদের লক্ষ্য ছিল। তাছাড়া পঞ্জাবের যে সমস্ত কৃষক সংগঠন সেগুলিও এখনও জোটবদ্ধ রয়েছে। প্রথমে পঞ্জাবে আন্দোলন শুরু হয়, তারপর হরিয়ানায় তার প্রভাব পড়ে এবং হরিয়ানাতেও আন্দোলন শুরু হয়। এবার আমরা যদি পঞ্জাবে ঋণ মকুবের আন্দোলন শুরু করি, তাহলে তার প্রভাব তো নিশ্চয়ই অন্যত্রও পড়বে। সবাই সক্রিয়ভাবে যোগ দেবে। তবে দেখুন একটা সত্যি কথা হল হরিয়ানায় যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা খুবই দুর্বল ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা জোর ধাক্কা দিতে পেরেছিলেন। এই আন্দোলন থেকে তাঁরা অনেক কিছু শিখেছেন, কীভাবে লড়তে হবে শিখেছেন তাও। এমন কথাও সবাই বলছেন যে, পঞ্জাবের মানুষেরাই আমাদের লড়াই করা শেখালেন। কীভাবে একটা দীর্ঘ লড়াই লড়তে হয়, কীভাবে আন্দোলনকারীদের মোবিলাইজ করাতে হয় এই আন্দোলন তা শিখিয়েছে। তাই আগামী দিনে যখনই কোনও আন্দোলন হবে, তার উপরে এর প্রভাব তো পড়বেই। পঞ্জাবের কৃষক আন্দোলন তো যথেষ্ট পুরনো। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তা চলেছে। মুশকিল হল পঞ্জাব যেহেতু ছোট রাজ্য তাই দেশের অন্যদের, জাতীয় মিডিয়ার তার উপরে কখনও নজর পড়েনি। পঞ্জাবে ছাত্র আন্দোলনও খুবই জোরদার চলেছে। কিন্তু জাতীয় মিডিয়া দিল্লিতে জেএনইউ, ডিইউ-এর ছাত্র আন্দোলনকে কভার করলেও পঞ্জাবের ছাত্র আন্দোলনের কথা কখনও বলেনি। একই ঘটনা কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। কিন্তু এবার যখন পঞ্জাবের কৃষক আন্দোলনের অভিমুখ দিল্লির দিকে ঘুরে গেল তখন তো কভার করতে বাধ্য হলই। এখন সব মানুষের নজর ঘুরে গেছে। আর পঞ্জাবও ভবিষ্যতে এভাবেই অনুপ্রাণিত করতে থাকবে। আগামী দিনে বড় পরিসরেই কৃষকদের আন্দোলন চলবে আর ঋণ মকুবের জন্য আন্দোলন তো ইতিমধ্যেই আমাদের অ্যাজেন্ডায় রয়েছে।

 

প্র: নেতৃত্ব নয়, কিন্তু আন্দোলনকারীদের মধ্যে কি কৃষকদের আয়ের ভিত্তিতে কোনও ধরনের হায়ারার্কি ছিল? সিদ্ধান্ত নেওয়া বা সামনের সারিতে থাকার ক্ষেত্রে কি তা কোনওভাবে প্রভাব ফেলতো?

 

উঃ দেখুন, নেতৃত্বে তো বিভিন্ন স্তরের কৃষকদের যে প্রতিনিধিরা তাঁরা ছিলেন। যদি খেয়াল করা হয়, তাহলে দেখা যাবে সারা দেশে ধনী কৃষকেরাই কৃষকদের পরিসরটিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এই আন্দোলনে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদেরও অংশগ্রহণ চোখে পড়ল। এটিই প্রথম কৃষক আন্দোলন যেখানে তাঁদের প্রতিনিধিরাও নেতৃত্বে ছিলেন। যেমন আমাদের সংগঠন কীর্তি কিসান ইউনিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সংগঠন। ধনী কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব আমরা করি না। তাছাড়া যে কৃষকেরা শহিদ হয়েছেন।  একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে তাঁদের মধ্যে ৯৫ শতাংশের পৌনে তিন বা তিন একর জমি আছে এমন কৃষক, অর্থাৎ শহিদদের মধ্যেও প্রায় পুরোটাই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক।

 

প্র: এই কৃষক আন্দোলনে পঞ্জাব পথ দেখিয়েছে। সঙ্গে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ ছিল সামনের সারিতে। সারা দেশের কৃষকেরাই তাদের সমর্থন জানিয়েছেন, পাশে থেকেছেন। দেশের মধ্যে মহারাষ্ট্রের কৃষকদের লড়াইয়ের কথাও আমরা জানি। কিন্তু কৃষিআইন বিরোধী আন্দোলনে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতের কৃষকদের সমর্থন, সংহতি থাকলেও তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ যেন কিছুটা হলেও কম ছিল। আপনি জানেন পশ্চিমবঙ্গে কৃষক আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তো এবারে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতের কৃষকদের এই অবস্থান বিষয়ে আপনি কী বলবেন? সেখানকার রাজ্যগুলির সরকারেরও কী কোনও ভূমিকা ছিল এর পেছনে?

 

উঃ না, সরকারের ভূমিকা এতে ছিল না। কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কৃষকদের অবস্থান কীরকম হবে তা নির্ণয় করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা কৃষক সংগঠনগুলিরই ছিল। পঞ্জাবে এই আন্দোলন দীর্ঘ সময় ধরে চলার কারণে একটা ধারাবাহিকতা ছিল। পশ্চিমবঙ্গে সংসদীয় বামদলের যে ভূমিকা এক্ষেত্রে ছিল তা নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনের পর কেমন যেন দুর্বল হয়ে গেল, মানুষের মনে এমন একটা ধারণা তৈরি হল যে এরা তো জমি কেড়ে নেওয়ার দল। তাছাড়া এমএসপি-র যে দাবি তা গ্রিন রেভলুশন বেল্টের কৃষকদের দাবি। অনেকেই বলছেন যে, এটা সারা ভারতের কৃষকদের দাবি। কিন্তু তা নয়, এটি সারপ্লাস প্রোডাকশন এরিয়ার দাবি। বোঝা দরকার যে প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘এবার ভালো বৃষ্টি হয়েছে, তাই ভালো ফসল ফলবে’, তার মানে আমদের দেশের কৃষি এখনও প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল, এখনও কৃষিতে, সেচে বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। এ দেশে এখনও একটা বড় অংশের কৃষক নিজেদের খাওয়ার জন্যই শস্য উৎপাদন করেন। কখনও কখনও তার চেয়েও কম ফসল উৎপন্ন হয়। তাদের দাবি এমএসপি নয়। এমএসপি সারপ্লাস প্রোডাকশন এরিয়া, বিশেষত গ্রিন রেভলুশন বেল্ট, যেখানকার কৃষকেরা মার্কেটের সঙ্গে যুক্ত, সেখানকার দাবি। অন্য অনেক জায়গায় ভূমিসংস্কার, কৃষিতে বিনিয়োগ (প্রাইভেট নয়, সরকারি বিনিয়োগ) ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কারণ সারা দেশে একটা অসম উন্নয়ন হয়েছে কৃষিক্ষেত্রে, তাই কোনও একটি ইস্যুতে সকলে জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন সম্ভব ছিল না। একটা বিষয় এর মধ্যে ছিল যেখানে হয়ত সবাই সহমত হতে পারতেন, তা হল চুক্তিচাষের বিষয়টি। সমস্যা হল এমএসপি নিয়ে বেশি কথা হল, চুক্তিচাষ নিয়ে কম কথা হল। যেখানে প্রাইভেট মান্ডি আছে, যেখানে এমএসপি পাওয়া যাচ্ছে না, এগুলি যেখানে কৃষকেরা নিজেদের খাওয়ার জন্য শস্য উৎপাদন করেন সেখানকার সমস্যা নয়, চুক্তিচাষ কিন্তু সেখানকারও ইস্যু – কর্পোরেট আমাদের জমি নিয়ে নিতে পারে। অথচ তা তেমনভাবে উঠে এল না। যাঁরা পিডিএস ব্যবস্থার আওতায়, তাঁদের জন্য কীভাবে এসেনশিয়াল কমোডিটি অ্যাক্ট দরকার, সে বিষয়টিও সামনের সারিতে আসেনি। যতটা হয়েছে তার নিরিখেই আন্দোলন হয়েছে। এর কারণ হল এগুলির জন্য অন্য রাজ্যগুলির স্থানীয় স্তরের কৃষক সংগঠনগুলি সক্রিয়ভাবে কাজ করেনি, যেভাবে পঞ্জাব, হরিয়ানাতে করেছে স্থানীয় স্তরের কৃষক সংগঠনগুলি। যখনই আমাদের অন্য রাজ্যের যেমন ধরুন দক্ষিণ ভারতের কোনও কৃষক সংগঠনের কারওর সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা সেরকম ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেননি। যেমন বলেছেন, ‘চুক্তিচাষ তো অনেকটাই ঐচ্ছিক – কৃষক চাইলে হবে না হলে নয়। এতে অসুবিধার কী আছে?’ পঞ্জাবের কৃষকেরা যেমন এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন – না, চুক্তিচাষ হওয়া মানে আমাদের জমি চলে যাওয়া। হরিয়ানাতেও তাই। কিন্তু অন্য রাজ্যে তা হতে দেখা যায়নি। এর পেছনে কারণ স্পষ্টতই রাজ্যগুলিতে স্থানীয় স্তরে কৃষক সংগঠনগুলির কাজ না করা।

 

আরেকটি বিষয় হল, সাত বছরে দেশের সরকার এরকম একটা ধারণা তৈরি করেছিল যে তাদের পেছনে হটানো যাবে না। এই আন্দোলনের জয়ের ফলে অন্তত ‘মোদী অরা’ শেষ হয়েছে। যেভাবে উনি পিছু হটেছেন, ক্ষমা চেয়েছেন… যদি ভবিষ্যতে সংযুক্ত কিসান মোর্চা অটুট থাকে, তাহলে দেশব্যাপী আরও অনেক বিষয় নিয়ে কৃষক আন্দোলন নতুন পথে এগোতে পারে।

 

প্র: একদম ঠিক বলেছেন যে কৃষক আন্দোলন ‘বিজেপি-আরএসএস’-এর বিরুদ্ধে দেশের বৃহত্তর লড়াইকে নতুন দিশা দেখিয়েছে। আপনারা বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগে গিয়ে বিজেপিকে ভোট না-দেওয়ার জন্য প্রচারও করেছেন। পশ্চিমবঙ্গেও এসেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে তেমন কোনও জোরদার বক্তব্য কখনওই দেননি। বিষয়টি কি আপনাদের নজরে এসেছিল? আসলে কী বলবেন?

 

উঃ না, ঠিকই আছে। যেমন ভারত বন্‌ধের ডাক যখন দেওয়া হল, সব রাজ্য থেকে তো এক রকম সাড়া পাওয়া যায়নি। মমতা ব্যানার্জির দল তো শাসক দল। তাঁর জন্য তো বাংলা বন্‌ধ করা কোনও ইস্যুই ছিল না। উনি সমর্থন করেছিলেন কিন্তু সক্রিয়ভাবে কোনও কাজ করেননি। দেখুন, শাসক দলগুলির, তা যদি অ-বিজেপিও হয়, একটা সময়ের পর এই আন্দোলনকে তাদের ‘ড্রামা’/নাটক বলে মনে হচ্ছিল। যেমনভাবে এই আন্দোলন বাড়ছিল বিভিন্ন রাজ্যের শাসক দল অস্বস্তিতে পড়ছিলেন। যেমন পঞ্জাবে শাসক দল কংগ্রেস একটা সময়ে আন্দোলনকে হালকা ভাবে নিয়েছিল। কিন্তু একটা সময়ের পর তাদের একে ঝামেলা মনে হতে লাগল, অস্বস্তি বাড়ল। কারণ এই আন্দোলন কোনও একটি সরকারের বিরুদ্ধে ছিল না, এটি পুরো যে কর্পোরেট কাঠামো তাকে চ্যালেঞ্জ করছিল। আর আরেকটি বিষয় হল সব রাজনৈতিক দলই এক রকমের। সব দলই কর্পোরেটদের যে অর্থনৈতিক পলিসি তাকেই পছন্দ করে, তার পক্ষেই থাকে। তাই পঞ্জাব সরকারও এই আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা পর্যায়ে চেষ্টা করে, কিন্তু ততদিনে আন্দোলন অনেকটাই বেড়ে গেছে। এটাও শাসক দলগুলির একটা ভয়ের কারণ ছিল। বিজেপি-র বিরুদ্ধে যতটুকু করার তারা করেছেন, কিন্তু কৃষকদের পক্ষে কিছু করার হলে তারা করেননি।

 

প্র: বহু দিন পরে এ-দেশের বামদলগুলি নিজেদের মতানৈক্য দূরে রেখে এই একটি ইস্যুতে একজোট হয়ে লড়াই লড়েছিলেন আর তার ফলও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলন হোক বা সংসদীয় রাজনীতি বামেদের এই জোটবদ্ধ চেহারা দেখা যায় না। ফলত দেখা যায়, বিরোধী স্বর হিসাবে তারা তেমন শক্তিশালী হচ্ছে না, নির্বাচনের ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে তাদের উপস্থিতি ও গ্রহণযোগ্যতা কমছে। কৃষক আন্দোলনের জোটবদ্ধ হওয়া থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা কী ভবিষ্যতে পন্থা নির্ধারণ করবেন বলে মনে করছেন?

 

উঃ পঞ্জাবের যে বাম কৃষক সংগঠন তারা তো কাজ করছিলই। একথা ঠিক যে সবাই একজোট হয়েছিলেন। দেখার বিষয় হল এটি সরাসরি রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না, অর্থনৈতিক আন্দোলন ছিল, যার একটা রাজনৈতিক দিক নিশ্চয়ই ছিল। নিশ্চিতভাবেই লড়াই, জয় এগুলোর ফলে বামেদের বিষয়ে মানুষের কাছে একটা ইতিবাচক ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বৃহত্তর বাম আন্দোলন গড়ে উঠতে সময় লাগবে। তার জন্য বামেদের পরিশ্রমও করতে হবে। কিন্তু এই আন্দোলনের ফলে বামেদের জন্য নতুন করে পরিসর তৈরি হয়েছে এ কথা সত্যি।

 

প্র: আগামী দিনগুলিতে কী বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের স্বার্থে তারা নিজেদের নীতিগত মতানৈক্য দূরে রেখে লড়তে পারবেন?

 

উঃ না, এত তাড়াতাড়ি তো নয়। (হাসি)

 

প্র: লেবার কোড নিয়ে শ্রমিকদের ও শ্রমিক সংগঠনগুলির মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও এর বিরুদ্ধে তেমন জোরদার শ্রমিক আন্দোলন তৈরি হয়নি। আপনার কী মনে হয় কৃষক আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা লেবার কোড প্রত্যাহার করার মতো কিছু সম্ভব করতে পারবেন?

 

উঃ দেখুন, কৃষক আন্দোলন প্রমাণ করে দিয়েছে যে সবই সম্ভব। ওরা বলত, ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়!’ আমরা বলেছি, ‘ইউনিটি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়!’  এখন এটা তো স্পষ্ট যে মোদীজি চাইলে সব আইন প্রত্যাহার করতে পারেন। কিন্তু তার জন্য ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে কাজ করতে হবে। লেবার কোড নিয়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলি কিছুই করতে পারছে না। শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে একটা বিরাট বড় অংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকেরা। অসংগঠিত ক্ষেত্রে ইউনিয়ন তৈরি করা একটা বড় সমস্যার বিষয়। কম অংশই সংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত। আরেকটা কারণ হল ট্রেড ইউনিয়নগুলি, তা তারা যদি বাম দলেরও হয়, বিগত কয়েক বছরে তাদের তেমন সক্রিয় ভূমিকা, লড়াই নজরে পড়েনি। কিন্তু তারা চাইলে কাজ করতে পারেন। একবার এমন কথাও উঠেছিল যে ট্রেড ইউনিয়নগুলি আর কৃষক সংগঠনগুলি একজোট হয়ে যাক আর লেবার কোড প্রত্যাহারের কথাও আন্দোলনে উঠুক। কিন্তু তখন সবাই বলেন যে, কৃষকেরা একটা আন্দোলন দাঁড় করিয়েছেন, ট্রেড ইউনিয়নগুলি একটা আন্দোলন দাঁড় করালে তবেই একজোট হওয়ার কথা উঠতে পারে। নাহলে তো ব্যাপারটা এমন দাঁড়াবে যে লেবার কোডও কৃষক আন্দোলন প্রত্যাহার করালো। সেটা ঠিক হবে না। দাবি তো যোগ করাই যায়, কিন্তু আন্দোলনও তো কিছু থাকতে হবে। যৌথ আন্দোলনে সমস্যা তো কিছু ছিল না।

 

প্র: কৃষক আন্দোলনে মহিলাদের ভূমিকা অতুলনীয় ছিল। আমরা বারবারই বলি পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশে চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে মহিলাদের এমন বিরাটভাবে আন্দোলনে যোগদান এক অন্য উদাহরণ তৈরি করল। ভবিষ্যতে মহিলাদের আন্দোলনে এই যোগদান কী নতুন দিশা দেখাবে?

 

উঃ পিতৃতন্ত্রের শিকড় আমাদের সমাজে অনেক গভীরে ছড়ানো। কিন্তু এই আন্দোলনের হাত ধরে হরিয়ানার মহিলারা প্রথম বার বাড়ির বাইরে এলেন। এত বিশাল সংখ্যায় এলেন। পাঞ্জাবের মহিলারা এলেন। এক পা হলেও তারা এগিয়েছেন। নিশ্চিতভাবেই এর প্রভাব তো পড়বে। সমাজে বড় প্রভাব পড়বে। আগে যেমন ছিল যে রাজনৈতিক দলগুলিকে কোনও প্রশ্ন করতে হলে তা পুরুষেরা করতেন। কিন্তু গত কয়েক দিনে এমন হয়েছে যে রাজনৈতিক দলের নেতারা গ্রামে গেলে মহিলারা তাদের ঘিরে ধরে প্রশ্ন করেছেন। এক বছর দিল্লিতে থাকার ফলে পুরুষেরা বাড়ির কাজ আর মহিলারা খেতের কাজ শিখেছেন। এরকমই হয়তো ছোট ছোট বদল এসেছে যা ইতিবাচক বদল। এখন যেমন তারা সংগঠনে এসেছেন, আন্দোলনে এসেছেন, ধীরে ধীরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা তৈরি হবে। এবং এর ফলে সমাজে সদর্থক প্রভাব পড়বে।

 

Share this
Leave a Comment